নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মন্ত্রক

আমি আমার দেশের জন্যে

মন্ত্রক › বিস্তারিত পোস্টঃ

পাকিস্তান নাখোশ কেন?

১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১০:৪৭

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তাদের দন্ড কার্যকর করায় পাকিস্তান মহা নাখোশ। পাকিস্তান সরকার এবং সেখানকার পার্লামেন্টের মৌলবাদ সমর্থক সদস্যদের এ নিয়ে মাঝে মধ্যেই তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়তে দেখা যায়। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ কার্যক্রম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানের বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইয়ে দেয়া হয়েছিল। ১৯৭১ এ বাংলাদেশের মাটিতে যে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছিল তাতে হানাদার-পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামীর নেতাকর্মী ও চেলা-চামুন্ডাদের প্রত্যক্ষ এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। অর্থাৎ ঐ যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল উপরে উলি্লখিত সংস্থা ও দলসমূহের পূর্ণ সহযোগিতায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে ইসলামী 'তাহজিব-তমুদ্দুন পুনঃপ্রতিষ্ঠা' এবং তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানকে 'ভারতের প্রভাব' থেকে মুক্ত করে সেটিকে 'সাচ্চা মুসলমানদের' আবাসভূমি বানানোর এক 'মহান ও ঐশ্বরিক' দায়িত্ব পালনের নামে লাখ লাখ সাধারণ মানুষ হত্যা, নারী ধর্ষণ ও সম্পদ-সম্পত্তি ধ্বংস করতে মেতে ওঠে।

পাকিস্তানি শাসকরা বাংলাদেশের মানুষের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতির চর্চা একেবারেই সহ্য করতে পারত না। এর কারণ তাদের নিকট বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি আদতে হিন্দুয়ানী সভ্যতা-সংস্কৃতির অন্তর্গত বিষয় ছিল। তাদের বিবেচনায় পূর্ব-পাকিস্তানের মুসলমানরা পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানদের মতো সাচ্চা মুসলমান ছিল না। আর তাই এদেরকে খাঁটি মুসলমান বানাতে হলে প্রথমেই এদের মন-মানসিকতা থেকে 'হিন্দুয়ানী ভাবধারা' দূর করতে হবে। এবং সেটি করতে হলে বাংলা ভাষার হরফ, ব্যাকরণ, শব্দ-ভান্ডার ইত্যাদিও বদলে ফেলতে হবে। পাশাপাশি বাংলা ভাষায় 'মুসলমানী শব্দাবলী' ও প্রকাশভঙ্গি আরোপ করে এবং 'হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির' সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পালা-পার্বণ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও পরিহার করতে এ অঞ্চলের মানুষদের উদ্যোগী করে এক কিম্ভূতকিমাকার পাকিস্তানি তমদ্দুন চাপিয়ে দেয়ার নীতি গ্রহণ করে তারা।

পাকিস্তান যেহেতু দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছিল এবং বাংলার মুসলমানরাও পাকিস্তানের জন্য প্রাণপাত সংগ্রাম করেছিল সেজন্য বাংলার মুসলমানদেরকে ওরা খাঁটি মুসলমান মনে না করলেও ঐ রাষ্ট্রে তাদের ঠাঁই না দিয়ে তাদের উপায়ও ছিল না। কেননা, পাকিস্তান হবে কি হবে না সে বিষয়ে ১৯৪৬ সালে যখন উপমহাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোতে লাহোর প্রস্তাব বিষয়ে ভোটগ্রহণ করা হয় তখন একমাত্র বাংলা ছাড়া অন্য কোন মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল এর সমর্থনে রায় দেয়নি। বাংলার মুসলমানদের শতকরা ৯৭ জনই সে নির্বাচনে লাহোর প্রস্তাবের পক্ষে তাদের রায় দেয়ার কারণেই উপমহাদেশে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার দাবি ও স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার পথ তৈরি হয়। উল্লেখ্য, বাংলার শেরে বাংলা ফজলুল হক উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবে উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক আবাসভূমি সৃষ্টির কথা বলা হয়নি। কথাটি ছিল ভারত-ভূমির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোর সমন্বয়ে পৃথক পৃথক মুসলিম আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার। আর সেই মোতাবেক উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাংলা নামক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলটি একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদায় আত্মপ্রকাশ করবে। কিন্তু লাহোর প্রস্তাবকে ঈমানের অঙ্গ হিসেবে মেনে নিয়ে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ ১৯৪৬ সালে যে নির্বাচনে অংশ নিলেন এবং বাংলা ছাড়া আর কোথাও মুসলমানদের মন গলাতে পারলেন না সেই নেতৃবৃন্দই পরে স্ব স্ব শ্রেণী ও গোষ্ঠী স্বার্থে ও মতলবি রাজনীতি চরিতার্থ করতে পৃথক পৃথক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের সে দাবি থেকে সরে এসে একটিমাত্র স্বতন্ত্র মুসলিম আবাসভূমি প্রতিষ্ঠাকে মেনে নিলেন। আর সে ক্ষেত্রে হিন্দু মহাসভা, কংগ্রেস হাইকমান্ড ও বঙ্গীয় মুসলিম লীগের এক শ্রেণীর মতলববাজ রাজনীতিকের অপতৎপরতায় বাংলাকে তথাকথিত হিন্দু বাংলা ও মুসলমান বাংলায় বিভক্ত করা হলো। অথচ, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানরা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে নানান জনপদ সমন্বয়ে সৃষ্ট বঙ্গ বা বাংলা নামক অঞ্চলে আবহমানকাল ধরে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের সঙ্গে বসবাস করে এসেছে। শুধু তাই নয়, বুদ্ধিভিত্তিক দিক দিয়ে বাংলা কি ব্রিটিশ যুগে কি প্রাক ব্রিটিশ যুগে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছে। চিন্তার অগ্রনায়ক হিসেবে বাংলার সুখ্যাতি বারবার ঘোষিত হয়েছে। মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, ময়নামতিসহ বাংলার বিভিন্ন এলাকায় যেসব বৌদ্ধ বিহারের নিদর্শন পাওয়া যায় তা প্রাক্তন বাংলার বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চতা এবং শিল্প-সংস্কৃতি-সভ্যতার ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের অসামান্য উৎকর্ষেরই পরিচয় বহন করে।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় আমরা পাল, সেন ও নবাবী আমলগুলিতেও সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর মাঝে মানবতাবাদের চর্চা ও অনুশীলন লক্ষ্য করি। এর প্রধানতম কারণ বাংলার জলবায়ু ও প্রকৃতি। এই প্রকৃতি কোমলে-কঠোরে এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। বাংলার মানুষকে রুদ্র কঠিন প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয় বলে সাগরে ছোট্ট ডিঙি নিয়ে ভেসে বেড়ায় এরা ঝড়-ঝঞ্জার কোন প্রকার তোয়াক্কা না করে। গ্রীষ্মের খরতাপ, বর্ষার অবিরাম বারিধারা আর প্রচন্ড শীতের প্রকোপ উপেক্ষা করে খেতে-খামারে ফসল ফলাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলে এদেশের কৃষক। ঝড়-বৃষ্টি, গ্রীষ্ম-শৈত্য কোন কিছুই বাংলার মানুষের সংগ্রামী চেতনাকে এতটুকুও দমাতে পারে না। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান পাশাপাশি বাস করেছে, পাড়া-প্রতিবেশী হিসেবে একে-অপরের সুখ-দুঃখের ভাগিদার হয়েছে মানবতার রসে সিঞ্চিত মন নিয়ে। গৌতম বুদ্ধের অহিংস নীতি ও সকল মোহ ত্যাগের কঠোর তপস্যা, শ্রী চৈতন্যের ভক্তিরসধারায় জীবাত্মা ও পরমাত্মার অপূর্ব সম্মিলন সাধনা আর সুফিবাদী দর্শনতত্ত্বের প্লাবনে মানবতার জয়গান মুখরিত প্রেমের ঐশী বাণী_ এই তিন মানবতাবাদী ও অহিংস-নীতিধর্মী দর্শনের চর্চার মধ্য দিয়ে বাঙালির মানস কাঠামোটি গঠিত হয়েছে। ফলে হিংসা-হানাহানি কিংবা ধর্মীয় উন্মাদনা বা জাতি-বিদ্বেষ সৃষ্টির জন্য মতলববাজরা এখানে অনেক সময়ই অনেক রকম চেষ্টা-চরিত্র করা সত্ত্বেও তা কখনোই প্রকট আকার ধারণ করতে পারেনি। পাল বা সেনদের আমলে হিন্দু ও বৌদ্ধদের পরস্পরবিরোধী সাম্প্রদায়িকতার কিছু নিদর্শন পাওয়া যায় বটে তবে মনে রাখতে হবে যে, সেগুলো শাসকবর্গ ও তাদের তাঁবেদাররা নিছক গোষ্ঠী ও মতলবি স্বার্থে এই সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করেছে। সমাজ-মানসে এর তীব্র বিদ্বেষীরূপ ফুটিয়ে তুলে এক কর্তৃক অপরকে বিতাড়ন বা নির্মূলের উন্মাদনা সৃষ্টিই ছিল ওইসব কুমতলবি শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশ্য। এই হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার মধ্য দিয়ে প্রতিপক্ষীয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত লোকদের নারী সম্পত্তি ইত্যাদি ভোগ বা জবরদখল করা হতো। এ হচ্ছে নিছক স্থূল ও দুনিয়াবি মতলব হাসিলের বিষয়।
তবে যেহেতু মানবতাবাদী রসধারায় ঐ সকল ধর্মীয়দর্শন সিক্ত ছিল সেহেতু সমাজের উদার ও উন্নত চেতনার মানুষদের নিরবচ্ছিন্ন চর্চার কল্যাণে সমাজের অভ্যন্তরে অনির্বাণ দীপশিখার মতোই মানবতার চেতনাটি সদা জাগরুক থাকত বৈকি! ধর্মের দর্শনগত ও মর্মগত বাণীকে পুরোহিত ও অন্যান্য ধর্মব্যবসায়ীরা নিজেদের ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ আদায়ে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে যাচ্ছেতাইভাবে অপব্যাখ্যা করে ফিরত। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে কুসংস্কারের বাতাবরণে আবদ্ধ রেখে ঐ ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মকে শোষণ-বঞ্চনার হাতিয়ার বানায়। দুনিয়াবি যাবতীয় আরাম-আয়েশ ভোগ করতে থাকে ধর্মের নামে মানুষকে ঠকিয়ে। অথচ দেখা যাবে সব ধর্মেই আচার-অনুষ্ঠানের বেশিরভাগ বিষয়গুলো ঐ ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা সৃষ্টি। ধর্ম মূলত মানুষের আত্মিক ও ইহজাগতিক মানসিক উন্নতির লক্ষ্যে সৃষ্ট আর মানবতার পরিচর্যার প্রয়োজনও এই ধর্ম থেকে উৎসারিত। এক্ষেত্রে মানুষই প্রধান উপজীব্য। সে মানুষ কোন ধর্ম বা গোত্রাবলম্বী সেটি প্রণিধানযোগ্য নয় বা বিবেচ্য বিষয় নয়। কোন মানুষ বিপন্ন-বিপথগ্রস্ত হলে তাকে সহায়তা করাই সকল ধর্মের মানুষের জন্য অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। কিন্তু ধর্মগুলোর মূল সুর বা মর্মবাণীকে গোষ্ঠীস্বার্থে নিজেদের ব্যাখ্যা দিয়ে অসৎ-অসাধু ধর্মব্যবসায়ীরা সমাজে কর্তৃত্ব ফলায়। ইউরোপের মধ্যযুগ তো ধর্মের নামে অধর্মের চরমতম বিকাশের এবং মানবাত্মার যাচ্ছেতাই লাঞ্ছনা ও অবমাননার কাহিনীতে ঠাঁসা।
যাই হোক, আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্মকে রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরে রাখার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছ সকল নাগরিকের সকল প্রকার অধিকারকে নিশ্চিত করার প্রয়োজনে। তাই এসব রাষ্ট্রে 'ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার' এটিই হচ্ছে রাষ্ট্রীয় দর্শন। যে ধর্ম মানে রাষ্ট্র যেমন তার, তেমনি যে ধর্ম মানে না রাষ্ট্র তারও। সকলের ধর্ম পালনের অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য বটে, কিন্তু ধর্মকে হিংসা-বিদ্বেষের হাতিয়াররূপে ব্যবহার বা কোন একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের মতলবি চেষ্টাকে দমন করে রাখাও রাষ্ট্রের শান্তি ও শৃঙ্খলার স্বার্থে একান্তই প্রয়োজন।
পাকিস্তান রাষ্ট্রটির মূল দ্রষ্টারা একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নই দেখেছিলেন কিন্তু সেখানে শুরু থেকে একটি অসাধু ও ধর্মব্যবসায়ী মহল ক্ষমতা দখলে সক্ষম হওয়ায় সকল-প্রকার অগণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা ও বঞ্চনা বৈষম্য জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়। আর সেক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু বাঙালিদেরকে ক্ষমতার বাইরে রাখা এবং তাদেরকে নতুন করে মুসলমান বানানোর অপচেষ্টায় রবীন্দ্রনাথকে বর্জন ও বাঙলা ভাষা-সংস্কৃতির ওপর আঘাতের পর আঘাত হানতে থাকে। এর বিরুদ্ধে তেইশ বছরব্যাপী সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম করতে হয়েছে আমাদেরকে আর তারই শেষপর্বে করতে হয়েছে সশস্ত্র যুদ্ধ। সে যুদ্ধে আমরা আমাদের শৌর্য-বীর্য-পরাক্রমের পরিচয় দিয়ে বিশ্বসভায় নিজেদের অবস্থান করে নিতে সক্ষম হই। আর সে পরিচয় আমাদের বাঙালি জাতিসত্ত্বা, বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি ও স্বাতন্ত্র্যের ভিত্তিতে রচিত। কোন ধর্মীয় পরিচয়ে নয় জাতিসত্ত্বার পরিচয়েই আমরা বিশ্বে সমাদৃত ও পরিচিত।
ইতিহাসের এই স্বাভাবিক গতিধারার বিপরীতে একটি কৃত্রিম প্রতিক্রিয়াশীল ধারা তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার সচেতন ও উদ্দেশ্য-প্রণোদিত প্রয়াস চলে গোটা পাকিস্তান আমলটিতে। বিএনপি-জামায়াত স্বাধীন বাংলাদেশে এ পরিতাজ্য ও কৃত্রিম ধারাটির পুনঃপ্রবর্তনের রাজনীতিতেই আকণ্ঠ নিমজ্জিত।

একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের বিচার ও দ-দানকে ঘিরে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া ঐ বস্তাপচা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ারই ধারাবাহিকতা মাত্র। পাকিস্তানি চর সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করায় গত ২২ নভেম্বর পাকিস্তানি সংসদে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে তার মধ্য দিয়েই ঐ যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে পাকিস্তানিদের গভীর সম্পর্ক আরও স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। এরপর থেকেই বাংলাদেশ সরকার ও যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিষয়ে তাদের বিষোদগার ও বাংলাদেশবিরোধী চক্রান্ত প্রকট থেকে প্রকটতর হতে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানি দূতাবাসের কর্মকর্তারাও এখানে জঙ্গিদের নানান মদত দিচ্ছে এমন অভিযোগ নতুন নয়। এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে এক পাকিস্তানি কূটনীতিককে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে স্বদেশে ফেরত নিতে বাধ্য করা হয়। এর প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তান কোন অভিযোগ ছাড়াই সেখানকার এক বাংলাদেশি কূটনীতিককে বহিষ্কার করে। এই অভব্য ও অশিষ্ট ব্যবহার পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বর্বর মানসিকাটিই প্রকট করে মেলে ধরে মাত্র। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ_ বিশেষত বেলুচিস্তান, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মানুষ দারিদ্র্যক্লিষ্ট, অসহায় ও নানানভাবে শোষিত-বঞ্চিত। অন্যদিকে সামন্তবাদী ব্যবস্থা বহাল থাকায় একটি শ্রেণী বিত্ত-বৈভবে আর প্রভাব-প্রতিপতি্বতে অভাবনীয় দাপটের অধিকারী হয়ে বসে আছে। আর সেনা-শাসনের যুপকাষ্ঠে সেই শুরুতেই দেশটিকে বলি চড়ানোর ফলে দেশের অর্থনীতির বা সম্পদ-সম্পত্তির সত্তর-পঁচাত্তর ভাগের মালিক-মোকতার হচ্ছে সেনাবাহিনী। ফলে সেনা-কায়েমী স্বার্থের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত সেখানকার জনগণ। সন্ত্রাস ও মৌলবাদী জঙ্গিদের বাড়বাড়ন্ত সেখানে ঐ কায়েমী স্বার্থের প্রয়োজনেই চলছে দেদার। একটি অত্যন্ত আধুনিক মনস্ক এলিট শ্রেণীও পাকিস্তানে আছে। অর্থে-বিত্তে, শিক্ষা-দীক্ষায় এদের অবস্থান খুবই উচ্চে। কিন্তু এদের শ্রেণী চরিত্র সর্বদাই সাধারণ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতধর্মী। ফলে এদের কাছ থেকে জনকল্যাণ আশা করা যায় না। এসব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সেখানে প্রগতিবাদী ও গণমানুষের কল্যাণধর্মী বুদ্ধিজীবী ও মানুষ রয়েছে বটে কিন্তু তাদের কণ্ঠ উচ্চকিত নয় নানান হুমকি-ধমকি, ভয়-ভীতি ও প্রতিকূল পরিবেশের কারণে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াসহ সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের ওপর চাপ রয়েছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব সার্ক, ওআইসি, কমনওয়েলথ প্রভৃতি সংস্থায় উভয় দেশের অবস্থানের গুরুত্বের কথা তুলে ধরে এই সম্পর্ক ছিন্ন না করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছে বলে পত্রিকার খবরে প্রকাশ।

এমতাবস্থায়, একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালে যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন-কিসিঞ্জারের বাংলাদেশবিরোধী ন্যক্কারজনক ভূমিকার বিষয়টি খুব মনে পড়ছে। অন্যদিকে গোলাম আযমের 'পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার' কর্মসূচি আর একাত্তরের পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর জামায়াতী নেতাদের প্রতি সকল প্রকার সহযোগিতা দিয়ে সৌদি আরব সেদিন বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে যে জঘন্য ভূমিকা পালন করে তা আমরা এতো সহজে ভুলি কেমনে? স্মর্তব্য যে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, এর আগে নয়! অর্থাৎ, বঙ্গবন্ধুর সরকারকে তারা হিন্দু তথা ভারতীয়দের তাঁবেদার সরকার মনে করত। আজ যখন কিসিঞ্জার বর্ণিত 'বটমলেস বাস্কেট'টি বিশ্বের সবচেয়ে আশার আলো জাগানিয়া দেশ হিসেবে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও প্রতিভাত হচ্ছে তখন আমরা খানিক পুলকিত বোধ করছি বৈকি! আবার যে সৌদি আরব সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশকে সেদিন জামায়াতী কুলাঙ্গারদের প্ররোচনায় হিন্দু রাষ্ট্র বলেই মনে করত (সেখানে কিনা মুসলমানরা যারপরনাই নির্যাতিত হচ্ছে!) সেই সৌদি আরব এখন ইসলামী সম্মেলন সংস্থায় ও তার নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী জোটের অন্যতম সদস্য বলে বিবেচিত করছে। একেই বলে-'Man proposes God dispose' অর্থাৎ, মানুষ ভাবে এক হয় আর! তাই যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব আজ তাদের কাছে সেদিনের নিন্দিত বাংলাদেশকে আজ প্রশংসা না করে পারছে না।

যাহোক, বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে কি করবে না তা একান্তই আমাদের নিজস্ব ব্যাপার ও অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এতে তাদের এই নাকগলানো অনুচিত ও অশোভন। আমরা আজও ভুলে যাইনি যে, একাত্তরে পাকিস্তানিদের জঘন্য পৈশাচিকতা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সেদিন কোন উদ্যোগ তো ছিলই না বরং একে জায়েজ বলে মনে করেছে তারা এবং এই গণহত্যাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে জাহির করেছে সেদিন। তবে আজ কেন তাদের এই পরিবর্তন? বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে সকলকে।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১০:৫২

বিজন রয় বলেছেন: পাকিস্তানই তো নাখো্শ হবে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.