নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মন্ত্রক

আমি আমার দেশের জন্যে

মন্ত্রক › বিস্তারিত পোস্টঃ

মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা

১৩ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ১১:৪০

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সরকার ও সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে প্রথমবার যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তা কোন অধিকার বলে দেয়া হয়েছিল? এ প্রশ্ন আজ সমগ্র জাতির। অবশ্য জিয়া নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে তার জীবদ্দশায় কোনো সময় দাবি করেননি। বরং সাপ্তাহিক বিচিত্রায় একটা লিখিত প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু করেছিলেন বলে বর্ণনা দিয়েছেন। স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে পরে তার অনুসারীরা তাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন। অবশ্য তারা জিয়ার প্রথমবারের ঘোষণার কথা বলেন। কিন্তু তিনি সংশোধন করে দ্বিতীয়বার যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, যাতে মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল, তার অনুসারীরা সে ঘোষণাকে ইতিহাসবহির্ভূত মনে করেন। প্রথমবারের ঘোষণা সঠিক ছিল না বলেই তো তিনি তার সংশোধিত বক্তব্য পেশ করেন। সেই সংশোধিত বক্তব্যের ব্যাপারে নীরব থেকে, প্রথমবারের ঘোষণা প্রচার একেবারেই উদ্দেশ্যমূলক। তার অনুসারীরা হয়তো ভেবেছিলেন বঙ্গবন্ধুর স্থলে যদি জিয়াকে স্বাধীতার ঘোষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায় তাহলে তাদের রাজনীতি (বিএনপির রাজনীতি) দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে এবং মরহুমের স্ত্রী বেগম জিয়াকে নিয়ে সুদীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকতে সক্ষম হবেন। তা না হলে তাদের মতে যিনি স্বাধীনতার ঘোষক, সেই জিয়াউর রহমান তার জীবদ্দশায় নিজেকে ঘোষক হিসেবে দাবি করেননি কেন?
আসলে মহান মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতারা বিশেষ ভুল করেছিলেন বলেই মনে হয়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পর এমনকি ৭ মার্চের ঐতিহাসিক বক্তব্যের পর, আর কারো মুখ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার কোনো প্রয়োজন ছিল কি? চট্টগ্রামের নেতাদের মধ্যে যারা সেদিন মনে করেছিলেন একজন মেজরকে দিয়ে ওই ঘোষণা দেয়াতে পারলে মুক্তিযুদ্ধে আরো গতি আসবে, তারা বোধ হয় সেদিন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক ধারণা ছিল না বলেই তারা ওইরূপ সিদ্ধান্ত নেন, যার খেসারত জাতিকে এখনো দিতে হচ্ছে। সেদিন মুজিবনগর সরকারের কর্তব্য ছিল যখনই জিয়া বিপ্লবী সরকারের কাছে রিপোর্ট করেন, তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা_ কোন অধিকার বলে তিনি প্রথমবারের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সঠিক জবাব না পেলে তৎক্ষণাৎ তার কোর্ট মার্শাল করা উচিত ছিল।
অবশ্য সুদীর্ঘ তিন দশক ধরে চেষ্টা করেও একমাত্র বিএনপির কিছু সমর্থক ছাড়া আর কাউকে দেশের অভ্যন্তরে হোক আর বিদেশে হোক জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়নি। বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসের বাস্তবতা বলে দিয়েছে কে স্বাধীতার প্রকৃত ঘোষক? যা সাংবিধানিকভাবে আজো স্বীকৃত আছে এবং চিরদিন থাকবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে নিজেকে সেনাবাহিনী ও সরকারপ্রধান হিসেবে ঘোষণা দিলেন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জিয়ার কোনো সঠিক ধারণা ছিল না। তার সংশ্লিষ্টতা ছিল একেবারেই শূন্যের কোঠায়। ২৭ মার্চ হঠাৎ করে তিনি মুক্তিযোদ্ধা বনে যান। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন যা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পেঁৗছে গেল এবং বাংলাদেশের জনগণ প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করল তখন চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে কে স্বাধীনতার ঘোষণা দিল বা না দিল তার কি কোনো গুরুত্ব থাকতে পারে? তা ছাড়াও ২৬ মার্চ পর্যন্ত জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কেউ ছিলেন না। আর ছিলেন না বলেই হানাদার বাহিনীর পক্ষে সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে উদ্যত হয়েছিলেন। তখন তার সহযোগীরা তাকে ওই কাজ থেকে বিরত করতে না পারলে অবধারিত মৃত্যুই ছিল জিয়ার পরিণতি। তাই ২৬ মার্চ পর্যন্ত যিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষাবলম্বন করেননি তার পক্ষে ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া সম্ভব ছিল কি? পরবর্তী পর্যায়ে হত্যাকা- সংঘটিত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নেয়ার পর তার ভেতর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধের অনুপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়েছে এবং যেভাবে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন তা কি যথেষ্ট নয়, সশস্ত্র স্বাধীনতাযুদ্ধ ও তার কিছুটা সংশ্লিষ্ট থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে তার কাছে কিছু ছিল না। এ চেতনার অনুপস্থিতি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের সঠিক মূল্যায়ন করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এ আলোকে বিচার করতে হবে। জিয়ার মতো একজন পাকিস্তানের অনুগত সৈনিক হঠাৎ করে কখনো মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠতে পারেন না। আসলে জিয়া চেয়েছিলেন জাতীয় জীবনের ক্রান্তিলগ্নে অকস্মাৎ একটা সুযোগ গ্রহণের। তিনি ভেবেছিলেন ২৫ মার্চে ক্র্যাকডাউনের পর নিরস্ত্র বাঙালি কখনো তাদের মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে না। তার ধারণা ছিল নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যরা যারা দেশত্যাগ করে ভারতে গিয়েছিলেন তারা আর কখনো দেশে ফিরতে পারবেন না। তিনি হয়তো এ ধারণা করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে অবশ্যই ততক্ষণে পাকিস্তানিরা মেরে ফেলেছে। তাই নেতৃত্বের ওই শূন্যতার ভেতর যদি তার নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন তাহলে তিনি হয়তো মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবেন। অথবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কোনো শক্তি ওই অবস্থা থেকে তাকে স্বাধীনতা ঘোষণা করার পরামর্শ দিয়েছিল। তারা ভেবেছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিহীন পাকিস্তানের অনুগত একজন সৈনিক। তাই তিনি যদি তাদের পক্ষের হয়ে নেতৃত্ব দিতে পারেন, তাহলে একটা পর্যায়ে আপস-মীমাংসা করে পাকিস্তান রক্ষা করা সম্ভব হবে।
অনেকে হয়তো বলবেন আমার এ ধারণা একেবারেই অমূলক। কিন্তু মুজিবনগর সরকারের ভেতর যারা মুক্তিযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে আপস করতে চেয়েছিলেন সেই মোশতাক, মাহবুবুল আলম চাষী গংদের সঙ্গেই পরবর্তী পর্যায়ে জিয়াকে সংশ্লিষ্ট হতে দেখা যায়। তার আরো অকাট্য প্রমাণ হচ্ছে মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে জাতির জনক নিহত হন এবং স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হয়। এর নেতৃত্বেও ছিলেন জিয়া। আরো প্রমাণ হচ্ছে জিয়া ক্ষমতাসীন হয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মূল্যবোধ, অর্জিত সংবিধান সবকিছুই ধ্বংসের চেষ্টা চালান।
জিয়া যদি স্বাধীনতার ঘোষকই হবেন, তাহলে তার ভারতে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বলা উচিত ছিল 'আমি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছি আপনারা আমাকে সমর্থন জানান'। তা না করে তিনি কেন আওয়ামী লীগ কর্তৃক গঠিত মুজিবনগর সরকারের কাছে একটা চাকরির জন্য ধরনা দিলেন? কেননা তিনি ভালো করেই জানতেন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত নেতৃত্বে কারা আছেন। তাদের অগ্রাহ্য করে অকস্মাৎ কোনো কারণে কী বলেছিলেন তার ধারাবাহিকতা রাখা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর একজন অনুগত অফিসার হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছু দায়িত্ব অবশ্যই পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে তিনি জাতির জনকের কাছ থেকে বিশেষ সুযোগও নিয়েছেন। আবার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সমন্বিত হয়ে আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ব্যাপারে তিনি সবচেয়ে বৃহৎ ভূমিকা পালন করেছিলেন। আসলে অনেকেরই ধারণা বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত খুনি জিয়া আর মোশতাক হচ্ছেন তার অ্যাবেটার।
স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে ২৩ বছর নিরবচ্ছিন্ন প্রতিরোধ সংগ্রাম পরিচালিত করতে হয়েছিল। আগরতলা মামলার এক নাম্বার আসামি না হলে এবং '৬৬-তে ছয় দফা ঘোষণা না করলে '৬৯-এ গণঅভ্যুত্থান ও '৭০-এ নির্বাচন সম্ভব হতো না। '৭০-এর নির্বাচনে একচ্ছত্র বিজয়ী হয়ে তিনি বাংলাদেশের একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাই '৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর পাকিস্তান সরকার জাতীয় অধিবেশন ডেকেও তা বাতিল করে এবং ২৫ মার্চের কালরাতে বাঙালির বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে। তখন স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার একমাত্র অধিকার ছিল বঙ্গবন্ধুর। আর কোনো লোকের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া সম্ভব ছিল না। বাংলাদেশের ২৩ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে জিয়ার কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। এমনকি বাঙালির সামরিক বাহিনীর নামে যে আগরতলা মামলা করা হয়েছিল তার সঙ্গেও জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা ছিল না। তাকে একজন আগন্তুক হিসেবে দেখা যায়নি। বরং পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগের অনুগত একজন সৈনিক হিসেবে তাকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। সেই অনুগত অফিসারই যাকে চট্টগ্রামের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলতে গেলে ধরে নিয়ে উপস্থিত করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘোষণাটি বেতার মারফত প্রচার করতে বলেন। তখন তিনি অযাচিত অসৌজন্যমূলক অসংযতভাবে ওই ঘোষণা দিয়েছিলেন। আসলে ইতিহাস কি কেউ কোনো দিন মনে না রেখে ওইভাবে নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই যে যাই বলুক না কেন যেভাবেই ঘটনাপ্রবাহের অপব্যাখ্যা দেয়া হোক না কেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি তার অবস্থানে রয়েছেন ও থাকবেন। আর জিয়া চিহ্নিত হয়ে থাকবেন খুনি, ক্ষমতালোভী, ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে।
'৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে '৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত পূর্ব বাংলার বাঙালিরা স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম পরিচালনা করেছিল তার একচ্ছত্র নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সর্ববৃহৎ দল ছিল আওয়ামী লীগ। যার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল আর তার সঙ্গে ছিল স্বাধীনতার পক্ষের বাম গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তি। এর কোথাও জিয়া নামে কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিএনপি নামের কোনো দলের তো প্রশ্নই ওঠে না।
তাই স্বাধীতার ঘোষণা দেয়ার চেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, কে সেই অধিকার অর্জন করেছিলেন। যার নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে কোথাও সংশ্লিষ্ট ছিল না, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি যে দল অস্বীকার করত তারা কী বলছে, তা নিয়ে বাঙালি জাতি কখনো বিব্রতবোধ করেনি। আগামীতেও করবে না। যারা মুক্তিযুদ্ধের সস্নোগান জয় বাংলা, জাতির জনক, জাতীয় সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ নিয়ে এখনো বিতর্ক তোলেন তারাই তো বর্তমান গোলযোগ সৃষ্টিকারী। স্বাধীতনার শত্রুদের সহযোগিতা ছাড়া যাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয় তারাই তো তাদের সঙ্গে নিয়ে বর্তমান বাংলাদেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। কোনো জাতি তার জনক, স্বাধীনতার ঘোষণা, মহান মুক্তিযুদ্ধের সস্নোগান নিয়ে এভাবে অযৌক্তিক, অবাঞ্ছিত, হাস্যকর মন্তব্য করে না। এটা বাংলাদেশের জন্য দুর্ভাগ্য।

ডা. এসএ মালেক: রাজনীতিক ও কলাম লেখক

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই মার্চ, ২০১৬ দুপুর ১২:৫২

মোহাম্মদ মজিবর রহমান বলেছেন: অসীম সাহসিকতা ও জীবনের ঝুঁকি নিয়েই জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্বে তিনি ছিলেন নির্ভীক। যখন রাজনৈতিক নেতারা সিদ্ধান্তহীনতায় ছিলেন, তখন সেনাবাহিনীর একজন মেজর এসে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন; জীবনবাজি রেখে সশস্ত্র যুদ্ধ করেন। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন; বীর উত্তম খেতাব পান। স্বাধীনতার পর তিনি ফের সৈনিক জীবনে ফিরে যান। সেনাবাহিনীতে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।
আবার পঁচাত্তরের এক কালো সময়ে জিয়াউর রহমান সামনে চলে আসেন। সময় তাকে জাতীয় ভূমিকায় টেনে আনে। সেটাও ছিল এক অন্ধাকারাচ্ছন্ন সময়। সশস্ত্র বাহিনীর একটি অংশের বিদ্রোহে এবং আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় তত্কালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। জাতি এক চরম সঙ্কটের মুখোমুখি হয়। এমন এক দিকনির্দেশনাহীন সময়ে সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান জাতীয় ভূমিকায় আবির্ভূত হন। সেখানেও তিনি নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়েছেন। কিন্তু দূরদর্শিতা, দেশপ্রেম ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞা তাকে সফলতার শীর্ষে নিয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দুর্বল-শক্তিশালী সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। ভারত, চীন, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ সবার সঙ্গে পারস্পরিক সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক স্থাপন করতে যথেষ্ট সফলতা দেখিয়েছেন। দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি বৈদেশিক নীতি নির্দিষ্ট ও বাস্তবায়ন করেন। জোটনিরপেক্ষ এবং ইসলামী দেশগুলো ও বিভিন্ন উন্নয়নকামী দেশের সম্মেলনে তার ব্যক্তিগত এবং সক্রিয় অংশগ্রহণে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে বিশেষ গতি সঞ্চারিত হয়। ব্যক্তিগত কূটনীতি দ্বারা তিনি বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতা কাটিয়ে তুলতে সক্ষম হন।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বৈদেশিক নীতির দীর্ঘমেয়াদি ফলাফলকে তিন ভাগে আলোচনা করা যায়। প্রথমত, তিনি জাতিসংঘকে কেন্দ্র করে একটি বিশ্বব্যাপী শান্তির আবহ তৈরি করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের কর্মকাণ্ড পরিচালিত করেন। জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির উন্নয়ন ঘটান। এর ফলেই বাংলাদেশ ১৯৮০ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়। তিনি উপমহাদেশের জন্য একটি স্থানীয় শান্তিকাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো নিয়ে আসিয়ানের মতো সংস্থা গড়ার উদ্যোগ নেন, যা পরবর্তীকালে সার্ক নামে প্রতিষ্ঠা পায়।
রাষ্ট্রপতি জিয়ার পররাষ্ট্র নীতির আরেকটা লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যকে বহুমুখীকরণ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ ও সাহায্যকে উত্সাহিত করা। তার শাসনকালে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার নিরলস প্রচেষ্টার প্রশংসা করে বিশ্বের বিভিন্ন পত্রিকা। ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনালের সুজান গ্রিন ঢাকা থেকে পাঠানো এক ডেসপাচে লিখেছিলেন, ‘সাম্যের প্রতীক ও সত্ লোকরূপে ব্যাপকভাবে গণ্য জিয়াউর রহমান স্ব্বনির্ভর সংস্কার কর্মসূচি শুরু করে বাংলাদেশের ভিক্ষার ঝুড়ি ভাঙার প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন।’ মালয়েশিয় দৈনিক ‘বিজনেস টাইমস’-এ প্রকাশিত ওই ডেসপাচে বলা হয়, ‘অতীতে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে পরিচিত করেছিল যে মহাপ্লাবী সমস্যাগুলো, প্রেসিডেন্ট জিয়া কার্যত সেগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ নভেম্বর ১৯৭৯)
ওই সময় নিউইয়র্ক টাইমসের এক সংখ্যায় বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষা, স্বনির্ভরতা অর্জন এবং উত্পাদন দ্বিগুণ করার ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অক্লান্ত প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করা হয়। কাজের জন্য জনগণকে সংগঠিত ও অনুপ্রাণিত করতে প্রেসিডেন্ট জিয়া প্রায়ই গ্রামে-গঞ্জে সফর করেন। ‘জনগণের সঙ্গে সংযোগ রক্ষায় বাংলাদেশী নেতা’ শিরোনামে মাইকেল টি ক্যাফম্যানের এ রিপোর্টে গ্রামাঞ্চলে সপ্তাহে তিন-চারবার সফরের সময় জিয়াউর রহমানের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিবরণ দেয়া হয়।
এ সময় বাংলাদেশের নিরাপত্তা কৌশল নিয়েও বিশ্ববাসী উচ্চ ধারণা পোষণ করে। বাংলাদেশের নেতৃত্বের প্রতি বহির্বিশ্বের আস্থা সৃষ্টি হয়। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শহীদ জিয়ার আরেকটা অবদান হলো নাগরিক বাহিনী গঠনের চিন্তা বাস্তবায়ন করা। তিনি এক কোটি নারী ও পুরুষকে সাধারণ সামরিক প্রশিক্ষণ দানের লক্ষ্যে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) গঠনের মাধ্যমে দেশগঠন ও নিরাপত্তায় ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দেন।
জিয়াউর রহমানের গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী করার পদক্ষেপ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। কৃষকদের স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়ন প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বিশেষ প্রচার পেয়েছিল। জিয়াউর রহমান আমলানির্ভর প্রকল্প না করে স্থানীয় নেতাদের দ্বারা কৃষককে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এতে কৃষকের মধ্যেও ব্যাপক উত্সাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন করেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক প্লাটফর্মে থেকে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তিনি এদেশের মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগানোর প্রয়াস চালান। অনেকটা সফলও হন তিনি। এ জাতীয়তাবাদী দর্শনই একটি জাতি ও দেশের রক্ষাকবচ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.