![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লক্ষ করা যাচ্ছে বাংলাদেশে একের পর এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে। ঘটনাগুলো অরাজনৈতিক এবং সামাজিক। গত ২০ মার্চ সোহাগী জাহান তনু হত্যার রেশ উত্তপ্ত থাকা অবস্থাতেই ফের ব্লুগার হত্যা করা হয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএলএম ক্লাসের ছাত্র ও ব্লুগার নাজিমুদ্দিন সামাদকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যার ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠেছে পুরান ঢাকা। এ ঘটনার প্রতিবাদে গত বৃহস্পতিবার (৭/৪/১৬) সকাল থেকে সড়ক আবরোধ ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে সড়ক অবরোধ করে। এতে পুরান ঢাকা মূলত অচল হয়ে পড়ে। এদিকে ব্লুগার নাজিম হত্যার রহস্য উন্মোচনে থানা পুলিশের পাশাপাশি ডিবি ও র্যাদব মাঠে নেমেছে। পুলিশ বলছে, খুনিরা প্রশিক্ষিত ও পেশাদার। নাজিম হত্যার নিন্দা জানিয়েছে ইইউ ও জাতিসংঘ।
গত বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের একরামপুর মোড়ে সুবর্ণা টেইলার্সের সামনে নাজিমুদ্দিনকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। জবি শিক্ষার্থীরা বলেন, সকালে জবির বিভিন্ন বিভাগের পাঁচ শতাধিক বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী শহীদ মিনারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করেন। পরে শাঁখারীবাজার মোড়ে, লক্ষীবাজার, বাহাদুর শাহ পার্ক হয়ে ক্যাম্পাসের মূল ফটকের সামনে অবস্থান করে সড়ক অবরোধ করে।
জবির সান্ধ্যকালীন এলএলএম কোর্সের ৬ষ্ঠ কোর্সের ব্যাচের বি সেকশনের ছাত্র ছিলেন নামিজ। তার গ্রামের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার থানার টোকাভরাইট গ্রামে। তিনি গেণ্ডারিয়া এলাকার রজনী চৌধুরী রোডের ২৯/ঘ নম্বর বাড়ির ৭ম তলায় থাকতেন। জানা গেছে, নাজিম অন লাইন অ্যাক্টিভিস্ট ছিলেন। তিনি ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অন লাইনে লেখালেখি করতেন। ফেসবুক পাতায় নিজেকে সিলেট জেলা বঙ্গবন্ধু জাতীয় যুব পরিষদের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে উল্লেখ করেন। আওয়ামী লীগ সমর্থক হলেও লেখার মাধ্যমে বিভিন্ন সময় তিনি দলের সমালোচনা করতে ছাড়েননি। তিনি সিলেট গণজাগরণ আন্দোলনের সংগঠক হিসেবেও কাজ করেছিলেন।
নাজিম হত্যার দু’দিনের মাথায় তথাকথিত আল্লাম শফি, যিনি তেঁতুল হুজুর খেতাবপ্রাপ্ত, তিনি বয়ান দিয়েছেন, ইসলাম নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। গত শুক্রবার বিকেলে ফেনীর মিজান ময়দানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের উদ্যোগে আয়োজিত শানে রেসালত সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ বয়ান দেন। তিনি বলেন, আপনারা রাজনীতি করেন আমরা বাধা দেব না। কিন্তু ইসলাম নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। বাংলার মাটিতে হেফাজতে ইসলামের একজন কর্মী বেঁচে থাকতেও ইসলাম নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্র সহ্য করা হবে না। হেফাজতের নেতাকর্মীদের তৈরি থাকার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, নাস্তিকদের বিরুদ্ধে যখনই ডাক দেয়া হবে, তোমাদের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। ‘(আমার সংবাদ-৯/৪/১৬)’।
তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি আল্লাম শফি হুজুররা নাজিমুদ্দিনদের হত্যার উসকানি দিয়েছেন। হুজুরা ব্লুগে যারা লেখালেখি করেন তাদেরই নাস্তিক মনে করেন। মূলত নাস্তিক নয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, ১৯৭২ সালের সংবিধানের বিশ্বাসী, মানবতন্ত্রের বিশ্বাসীদের এভাবে চরম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে হত্যার প্ররোচনা দিয়ে যাচ্ছে মাওলানা শফিরা, যারা মা-বোনকে তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করছে। একজন সাধারণ নাগরিক আমাকে বললেন, যারা অমুসলমান তারাই নাস্তিক এক অর্থে, আবার সুন্নিদের চোখে শিয়ারা নাস্তিক, শিয়াদের চোখে সুন্নিরা নাস্তিক। সুন্নিদের মধ্যে মওদুদীবাদীরা অন্য তরিকার মুসলমানদের নাস্তিক মনে করে থাকে। বিশেষ করে মাওলানা জিয়াউল আহসানদের আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত ওহাবী, মওদুদীবাদীদের নাস্তিকের চেয়েও খারাপ দৃষ্টিতে দেখে থাকে। এক সময় ইঠকারী বাম-শ্রেণি তাত্তি¡করা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী আরেফ আহমেদকে তথাকথিত বাম-সর্বহারারা হত্যা করেছে। মাওবাদের নাম শুনলে মানুষ ভয়ে আতঙ্কিত হয়। সেই কাজটি এখন ইসলামের নামধারী খুনিরা করে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে লক্ষাধিক বুদ্ধিজীবী হত্যা করেছে এই সব ইসলাম দরদিরা।
ব্লুগার হত্যাকারীরাই ইসলামের মূল নীতিমালা লঙ্ঘন করছে। যুদ্ধের মাঠ ছাড়া কাউকে হত্যা করা যায় না। আধুনিক আইনের দৃষ্টিতেও বিনা বিচারে কাউকে হত্যা করা যায় না, আইন হাতে তুলে নেয়া যায় না। ইসলামের নিয়ম-কানুনের মধ্যে যে ভালো দিকগুলো আছে, তার প্রতি বহু প্রাচীনকাল থেকে অমুসলমান পণ্ডিতরাও মুগ্ধ। কিন্তু ব্লুগার হত্যাকরীদের জিঘাংসাবৃত্তি, হত্যার পিপাসা সারা বিশ্বে ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করছে। এই খুনিদের কারণে বিশ্বের নিরীহ মুসলমানরা অমুসলমানদের কোপানলে পড়ছে। সারা বিশ্বে ইসলামের নাম নিয়ে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ছড়ানো হচ্ছে। অন্য ধর্মের নাম নিয়ে এতটা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ছড়ানো হচ্ছে না। বাংলাদেশের কথা যদি বলি তাহলে সোজাসাপ্টা বলতে হবে যে, ক্রমাগত বর্তমান সরকারকে বেকায়দায় ফেলার এবং বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করার লক্ষ্যে বিভিন্ন হত্যা ও নাশকতার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। প্রতিটি হত্যা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। বিচারের জন্য সরকারকে আল্টিমেটাম দেয়া হচ্ছে। সরকারকে অস্থির ও বিব্রত, অকার্যকর করার নানা পদক্ষেপ চলছে দেশে। তনু হত্যার ঘটনাটি সরকারকে যথেষ্ট বেকায়দায় ফেলেছে। এর আগে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে সন্ত গৌড়ীর মঠের অধ্যক্ষ যগেশ্বর রায়কে নৃশংসভাবে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। এ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে দেশে। এতে সঙ্গত কারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিরাপত্তা হারিয়ে ফেলছে। তার দায় সরকারের ওপর পড়ছে। সুস্থ পরিবেশে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
১২/০৩/১৬ তারিখের পত্রিকায় পেয়েছি, যশোরে শিবির অফিসের নির্মাণাধীন ভবনের মাটির নিচে গোপন আস্তানা নির্মাণকালে ১০টি বোমা ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হয়েছে।
যশোর কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি ইলিয়াস হোসেন জানান, বসুন্দিয়ার ভৈরব নদের পাড়ে জামায়াত-শিবির বড় ধরনের নাশকতা পরিকল্পনার উদ্দেশ্যে ভবনের নিচে গোপন ঘর তৈরি করেছিল। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এ খবর পেয়ে ওই আস্তানায় অভিযান শুরু করে পুলিশ। ১১ জনকে আটক করে পুলিশ। সেখান থেকে ১১টি বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করে পুলিশ। নিঃসন্দেহে এই পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। এটা সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা। বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের ষড়যন্ত্র।
ঐতিহাসিক স্বাধীনতার মাস মার্চে, কুড়িগ্রামে প্রকাশ্য দিবালোকে এক ধর্মান্তরিত মুক্তিযোদ্ধাকে জবাই করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। সকাল ৭টার দিকে বাড়ির সামনের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতে যান পৌরসভার গাড়িয়াল পাড়া এলাকার বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলী (৬৮)। সেখানে তিন মোটরসাইকেল আরোহী তাকে জবাই করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। জবাইকারীরা আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়েছিল। মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়ার সময় বোমা বিস্ফোরণও ঘটিয়েছিল।
এমন জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘটানো হলো আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে। এই হত্যা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার লক্ষণ। এ বিষয়ে আল্লাম শফিরা একটু বয়ান দিলে আমরা বুঝতাম, এই কাপুরুষোচিত হত্যা ইসলামের সঙ্গে কতটুকু সামঞ্জস্য আছে? ইসলাম কি শতকরা ৯২ ভাগের বড়াই দেখার জন্য? ইসলামের দৃষ্টিতে কোন কোন কারণে মানুষ হয়ে মানুষকে জবাই করা জায়েজ, তা সাধারণ মানুষকে জানানো দরকার। দেশে একটি সংঘাতপূর্ণ, অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির জন্য এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে। যেকোনো হত্যার দায় সরকারের ওপর এসে পড়ে। তা নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়, স্থিতিশীল পরিবেশ অস্থির হয়। মুহূর্তের মধ্যে নাজিম হত্যার খবর জাতিসংঘে পৌঁছে গেছে। এটা অবশ্যই সরকারের জন্য বাড়তি চাপ।
শিবগঞ্জে শিবিরের ক্যাডাররা একটি বাসায় গত রোববার বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণে তাদের কয়েকজনের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। বাসা ভাড়া নিয়ে বোমা তৈরি করা হচ্ছিল। উদ্দেশ্য নাশকতা। দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করা। সরকারের সুনাম নষ্ট করা। সরকারকে দৃঢ়তার সঙ্গে এসব ধারালো ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে হবে।
মাহমুদুল বাসার : কলাম লেখক।
©somewhere in net ltd.