![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আখতারের স্ত্রী দুই সন্তানের জননী মাহমুদা আখতার মিতু সন্তানকে স্কুল বাসে তুলে দিতে এসে রাস্তায় অপেক্ষমাণ অবস্থায় প্রকাশ্য জঙ্গি হামলার নির্মম শিকার হয়ে নিহত হন। দেশের মানুষ শোকে মুহ্যমান হয়েও জঙ্গিবাদের নিন্দায় ফুঁসে উঠেছে। এই প্রথম কথিত জিহাদিরা হামলা করলো একজন পুলিশ কর্মকর্তার পত্নীর উপর। মাহমুদা খানম মিতুর হত্যাকাণ্ডটি জঙ্গি হামলায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। পুলিশ সুপার বাবুল আখতার চট্টগ্রামে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অনেক সাহসী ও ঝুঁকিপূর্ণ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়ে জঙ্গি আস্তানা ভেঙেছেন ও অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার করেছেন। জঙ্গি নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোয় তার উপর আক্রোশ তুঙ্গে ছিল। বাবুল আখতারকে হামলা করার অভিপ্রায় সার্থক না হওয়াই প্রতিহিংসার লক্ষ্যবস্তু করেছে তার স্ত্রীকে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পরিবারের ওপর হামলার মধ্যদিয়ে জঙ্গিরা নজিরবিহীন ঔদ্ধত্য ও ধৃষ্টতা দেখালো। রাষ্ট্রের প্রতি অবজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ ঘটাল। এই পাশবিক ও নৃশংস হামলার মধ্য দিয়ে জঙ্গিরা নিজেদের অস্তিত্ব ও শক্তি উভয়ই প্রদর্শন করল।
মাহমুদা আখতার হত্যা দেশে ও বিদেশের গণমাধ্যমের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে বাংলাদেশের জননিরাপত্তা নিয়ে ভাবিয়ে তুলেছে বিশ্ববাসীকে। জঙ্গিদের টার্গেট কিলিং বন্ধ করতে না পারার কারণে ভিন্ন ভিন্ন ব্যখ্যার উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। সুযোগ তৈরি হচ্ছে বিদেশীদের বাংলাদেশ নিয়ে ভাবনা তৈরিতে। বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত স্টিফেনস মার্শা ব্লুম বার্নিকাট বলেছেন, বাংলাদেশে যে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাগুলো ঘটছে, তা বিশ্বজুড়ে চলতে থাকা সন্ত্রাসী হামলা থেকে আলাদা কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্রগুলো মিলে এই হামলা মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করতে চায়। তিনি বলেন, আমাদের কাছে থাকা প্রতিবেদন বলছে, এখানকার সন্ত্রাসী হামলা বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদেরই অংশ, এর বাইরে কিছু নয়। গত ১৫ মাসে বাংলাদেশে ৪০টির বেশি সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সবাইকে নিয়ে কাজ করতে বদ্ধপরিকর।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকা শহরে ইতালীয় নাগরিক তাবেলা সিজার হত্যার পর থেকে দেশে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) আছে কি নেই এ নিয়ে এক ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের জঙ্গিদের সঙ্গে আইএসের সম্পৃক্ততা আছে এমন ধারণা পাকাপোক্ত করতেই জঙ্গিরা গুপ্তহত্যার পরিধি বাড়াচ্ছে। একই সঙ্গে এ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের জঙ্গিরা নিজেদের অবস্থানের দৃঢ়তা প্রমাণ করতে চাইছে। অপর দিকে স্থাপন করতে চাইছে গণতন্ত্রের অভাব ও সরকার বিরোধীদের রাজনৈতিক সংকোচন থেকে জঙ্গিবাদের বৃদ্ধি ঘটার সনাতনী ধারণাকে। যদিও উন্নত বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোও জঙ্গিবাদের আক্রমণ থেকে মুক্ত নয়। পুলিশের হিসেব মতে বিগতকালে ঘটে যাওয়া ৩৪টি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ১৫টির দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট ও ৮ টির দায়ভার নিয়েছে আল কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট। যদিও সরকার এটাকে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেখছে এবং জঙ্গিদেরকে দেশজ আখ্যা দিয়ে আসছে। ইসলামিক স্টেটের অন লাইন মাগ্যাজিন “দাবিক” গত নভেম্বরে “দি রিভাইভাল অব জিহাদ ইন বেঙ্গল” শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনকে বিদেশিরা ভিত্তি হিসেবে গণনা করছে সাথে ব্যবহার করছে সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টকে। আল কায়েদার দেওয়া ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশ ঘিরে জিহাদের আহবান ছিল এবং উভয়ের দৃষ্টিতেই সরকারের যুদ্ধাপরাধের বিচার ও জঙ্গি বিরোধী অভিযান ইসলাম বিরোধী আখ্যায়িত করে উত্খাতের ডাক দেওয়া হয়েছে।
ইসরাইলের ক্ষমতাসীন দলের নেতা মেন্দি এন সাফাদি জঙ্গি হামলার শিকার সংখ্যালঘুদের বিষয়কে প্রণিধানযোগ্য করে সরকারকে মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে তুলনা করে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছে। বাংলাদেশের বিএনপি রাজনীতিক আসলাম চৌধুরীর সাথে সরকার উত্খাতে ক্রিয়াশীল হয়েছে।
শঙ্কার বিষয় হলো গুপ্তহত্যার লক্ষ্যবস্তুর পরিধি ও ব্যাপ্তি ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। সর্বশেষ মাহমুদা আখতার হত্যা এই নতুন ধারণা পোক্ত করলো। জঙ্গিরা পছন্দমত লক্ষ্যবস্তু বেছে নিচ্ছে তাদের ইচ্ছামত সময় ও স্থানে হত্যা করছে। তারা হত্যার স্বাধীনতা ভোগ করছে চরমভাবে। ফলে জনমনে ভীতি ও শঙ্কার শিহরণ ছড়িয়ে পড়েছে। পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু কেউ না জানলে অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ বহনকারী সবাই ভুগছে নিরাপত্তাহীনতায়। এ অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না বলে জনমত ঘনীভূত হচ্ছে। জঙ্গি বিরোধী অভিযানের ঘোলাটে কৌশল ও দৃশ্যমান ব্যবস্থা কোনো ফল দিচ্ছে না। অনুসৃত কৌশল অকার্যকর হয়ে পড়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পূর্ণ সুরক্ষা নিচ্ছে জঙ্গিগুলো। সাথে পাচ্ছে গণতন্ত্র চর্চাকারী দলগুলোর রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া। দেশি ও বিদেশি মদদ ও পৃষ্ঠপোষকতা পুষ্টি যোগাচ্ছে। জামায়াত-বিএনপির সরকার উত্খাতের উদ্দেশ্য পূরণে জঙ্গিদলের হামলা পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে বিধায় মৃত্যুর হোলিখেলায় জামায়াত-বিএনপির নির্লিপ্ততার চেয়ে সম্পৃক্ততার ধারণা দিন দিন স্বচ্ছতা পাচ্ছে।
সংখ্যার দিক থেকে জঙ্গি হামলার মাত্রা তুলনামূলক ভাবে কম হলেও প্রবৃদ্ধির হার বেশি। চলতি বছরে উল্লেখ করার মত জঙ্গি হামলা ১৫ ছাড়িয়েছে। ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত বা বিবর্জিত নৈতিকতার অপরাধে নিরীহ মানুষ হত্যার যৌক্তিকতা ছড়ানো হয়েছিল সুকৌশলে। জঙ্গি চরিত্র, উদ্দেশ্য ও অপকৌশলের গতিধারা গণনায় না নিয়ে সহিংসতা এড়াতে সরকারও বিশ্বাস করেছিল ধর্মের বিরুদ্ধে লেখা বন্ধ হলে গুপ্তহত্যা বন্ধ হবে। গুপ্তহত্যার কুশীলবদের পাকড়াও করার চেয়ে হত্যার শিকারকে শাসন করার প্রবণতা বেশি দেখা গেছে। যা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রচারণা পেয়েছে যদিও তার পেছনে অপশক্তি সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করছে। অসাম্প্রদায়িক শাসক দলের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা মৌলবাদীরা ধর্মকে নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া না করার ধুয়া তুলে মৌলবাদী চক্রের সাথে কুটুম্বিতার কৌশলকে বেশি সাশ্রয়ী ও কার্যকর বলে বোঝাবার চেষ্টা করেছে। হেফাজত ই ইসলামের আস্ফাালনকে দমিয়ে ওলামা লীগের আস্ফাালনে পরিণত করাকে সফলতা ভাবছেন। জঙ্গি বিরোধী অভিযানের নমনীয়তার সুযোগ কাজে লাগিয়ে জেএমবি’ দখল করে নিয়েছে ইসলামি ছাত্রশিবির। সেই সুবাদে জামায়াত ই ইসলামের হাতে চলে গেছে জঙ্গিত্বের চাবিকাঠি। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচারে শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি হলেও অন্যদেরকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টার কসরত এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে বহুমুখি ও যুগপত্ আক্রমণ।
নরম ও শক্ত ব্যবস্থার সংমিশ্রিত বহুমুখি জঙ্গি বিরোধী কৌশল রচনার কোনো বিকল্প নাই। সশস্ত্র জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠিন ও শক্ত অবস্থান না নিলে তারা গোপন আস্তানায় বসে শান্ত মাথায় টার্গেট কিলিং চালিয়ে যাবে। দেশি-বিদেশি চাপের মুখে নমনীয়তা প্রকান্তরে দুর্বলতায় পরিণত হয়ে যাবে। হত্যার ধারাবাহিকতা বন্ধ হবে না। অপশক্তি গণতন্ত্রের সুরক্ষা বঞ্চিত হলেও নিরীহ মানুষের বাঁচার অধিকারকে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা দিতে হবে। আদর্শিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মদদ দাতাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রাখলে জঙ্গিদের পুষ্টি বঞ্চিত করে নির্জীব করা সহজ হবে।
জেএমবির মতো ভয়ঙ্কর জঙ্গিগোষ্ঠীকে র্যাব যুগপত্ আক্রমণের মধ্য দিয়ে ভেঙে দিয়েছিল। কিন্তু এখন জঙ্গি নির্মূলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের ‘হচ্ছে’ বা ‘হবে’ নীতি অনুসরণ করলে জঙ্গিরা আবার পুনর্গঠিত হবে। জঙ্গিদের কার্যক্রম রুখতে তাদের দৌড়ের ওপর রাখতে হবে। কিন্তু এমনটি করা যাচ্ছে না বলেই তারা প্রায়ই সংগঠিত হয়ে আক্রমণ চালাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে ভেঙে পড়া জেএমবির টুকরো অংশগুলোকে জড়ো করে ইসলামী ছাত্র শিবির নেতৃত্ব ও সরবরাহ দিয়ে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলামসহ আরও অনেক জঙ্গি দল গঠন করছে। টার্গেট কিলিংয়ের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করছে এবং সাহস ও ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে। জঙ্গিরা মাহমুদা আখতার মিতুকে হত্যা করে পুলিশ বাহিনীর মধ্যে পরিবার নিরাপত্তার ভীতি ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছে এবং নিজেদেরকে অপ্রতিরোধ্য বানাতে চেয়েছে। তাদের এই দুঃসাহস ভেঙে দিতে না পারলে ফলাফল সুদূর প্রসারী হবে।
আমরা লক্ষ্য করছি, ভিন্ন ধর্মাবলম্ব্বীদের সঙ্গে শিয়া, আহমেদিয়া ও ইসলামী সুফিবাদে বিশ্বাসীদেরও হত্যা করা হচ্ছে। ধারণা করছি, আইএস যেভাবে টার্গেট কিলিং করে, বাংলাদেশের জঙ্গিরাও নিজেদের অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটাতে আইএসের মতো করে সহজেই হত্যা করা যায় এমন মানুষদের হত্যা করছে। বাংলাদেশেও আইএস আছে এই বার্তা বিশ্বকে জানানোর জন্যই তারা এমন করছেন।
দেশে সম্প্রতি জঙ্গি হামলায় অপরাধীদের গ্রেফতারে সামান্য অগ্রগতি হয়েছে। চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে অভিজিত্ ও জুলহাস মান্নান হত্যাকাণ্ডসহ অনেক হত্যা মামলায় পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী রহস্য উদ্ঘাটন ও অপরাধীদের গ্রেফতার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। এই কথাও সত্য যে, এই আলোচিত হত্যাকাণ্ডগুলোর ক্ষেত্রে অপরাধী শনাক্ত করার ধীরগতি থেকে স্বজনদের মনে হতাশা জন্ম নিয়েছে। তদন্তের অগ্রগতি যাই হোক না কেন অনেক হত্যাকারী ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়েছে আবার অনেকেই অচিহ্নিত রয়ে গেছে। এর ফলে জনমনে এক ধরনের শঙ্কা কাজ করছে। জঙ্গিদের পরবর্তী টার্গেট কে হবেন তা নিয়ে সাধারণের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে এবং অস্বস্তিতে ভুগছেন।
ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের পুলিশি নিরাপত্তার প্রতিরোধমূলক কৌশল সাময়িকভাবে কার্যকরী হলেও জঙ্গি হামলা বন্ধে খুব একটা অবদান রাখবে বলে মনে হয় না। আক্রমণাত্মক কৌশল দিয়ে প্রতিরক্ষার ব্যূহ গড়তে হবে। জঙ্গিদলের কিলার সেলগুলোর ভেতরে ঢুকে তা উচ্ছেদ করতে হবে। চিরুনি অভিযানের মাধ্যমে দ্রুত হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা দরকার। প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় জঙ্গিদের শাস্তি প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এজন্য দ্রুত বিচার ব্যবস্থার আওতায় এনে জঙ্গিদের গ্রেফতার ও শাস্তি দেওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। জঙ্গিবিরোধী আইনের আওতায় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল চালু করে জঙ্গিদের দ্রুতবিচার নিশ্চিত করতে হবে। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কোনোভাবেই নমনীয় হওয়ার সুযোগ নেই। বরং এদের বিরুদ্ধে শিগগিরই শক্ত অভিযান শুরু করতে হবে। জঙ্গিদের মদদদাতাদের চিহ্নিত করে জঙ্গি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। জঙ্গিদের ব্যাপারে আর একমুখি কৌশলে থাকা যাবে না। এজন্য সংশ্লিষ্টদের বহুমুখি নতুন কৌশলে যেতে হবে।
©somewhere in net ltd.