![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ধ র্মান্ধ উগ্রবাদি জঙ্গিদের সশস্ত্র তত্পরতা বাংলাদেশের জননিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য এখন সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি জঙ্গিদের গুলশান আক্রমণ ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের সর্ববৃহত্ ঈদের জামায়াতের ওপর আক্রমণের চেষ্টা আমাদেরকে আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিল সশস্ত্র জঙ্গি তত্পরতা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য কত বড় হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করে এবং এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই আমাদেরকে আগামী দিনের পথ চলতে হবে। পথ চলার সাহস অর্জন করতে হবে। এটাই বাস্তবতা। জঙ্গিবাদের শেকড় নিহিত আছে বাংলাদেশের রাজনীতির ভেতরে। এটা নির্মূল ও শেকড় উত্পাটন করতে হলে রাজনৈতিক পন্থায়ই করতে হবে, এর অন্য কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির চরম ও কঠিন বাস্তবতায় অদূর ভবিষ্যতে এর রাজনৈতিক সমাধান হবে তা ভাববার মতো কোনো যৌক্তিক কারণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। এই বাস্তবতাকে স্বীকার করেই এর বিরুদ্ধে আমাদেরকে সংগ্রামের পথ ও পন্থা নির্ণয় করতে হবে। সমূলে নির্মূল করতে না পারলেও এদেরকে যে দমন ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব তা ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ২০০৯ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রমাণ করে আসছে। তা না হলে আমাদের এই রাষ্ট্রটি এতদিনে আরেকটি আফগানিস্তান ও পাকিস্তান হতো। গুলশানের ঘটনাটি একেবারে ব্যতিক্রম, জঙ্গিদের নতুন কৌশলের সফলতা। এটা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। আজকের লেখায় সার্বিক জঙ্গিবাদ নিয়ে আলোচনা করব। যে সব গুপ্ত হত্যা ও টার্গেট কিলিং হয়েছে তাও আরো নিম্ন পর্যায়ে রাখা যেত, যদি এর জন্য পূর্ব প্রস্তুতি থাকত এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আরো আগে বিষয়টি আঁচ করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিত। জননিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয়টি দিনে এনে দিনে খাই, এ রকম দর্শনের বিষয় নয়। সুদূরপ্রসারি ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হালনাগাদ পরিস্থিতির মূল্যায়ন ব্যতিরেকে কার্যকরি প্রতিরোধ ব্যবস্থা সময় মতো স্থাপন করা যায় না, এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এতগুলো তরুণ সন্দেহজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে গেল, তা কি গোয়েন্দা পরিস্থিতির মূল্যায়নে সময় মতো ধরা পড়েছে? চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে, এমন দূরদৃষ্টি দিয়ে জঙ্গি দমন ও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। তারা নিত্যনতুন ফ্রন্ট খুলছে, নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। এসব আগাম বুঝতে না পারলে গুলশানের মতো আক্রমণ ঠেকানো যাবে না। এই জায়গায় গোয়েন্দা তত্পরতার কার্যকারিতা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চেইন অব কমান্ডের জবাবদিহিতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। পুলিশের টপ পর্যায়ে কমিটমেন্টের ঘাটতি না থাকলেও, যেখানে প্রকৃত কাজ, অর্থাত্ পুলিশের তৃণমূল পর্যায়ে কমিটমেন্টের প্রচণ্ড ঘাটতি দেখা যায়। জঙ্গি দমন ও নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আরো বড় আকারের হুমকির মধ্যে পড়বে। সুতরাং এটা নিয়ে আর হেলাখেলা করার সময় নেই। জঙ্গি দমন ও নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে জঙ্গি কারা, এদের উত্পত্তি স্থল বা শেকড় কোথায় তা সর্বাগ্রে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। কি কৌশলে জঙ্গিরা সশস্ত্র তত্পরতা চালাচ্ছে তার নির্মোহ বিশ্লেষণ দরকার। টার্গেট নির্দিষ্ট না করে, তাদের কৌশল সম্পর্কে অবহিত না হয়ে ফাঁকা আওয়াজ দিলে বা শূন্যে গদা ঘুরালে কোনো কাজ হবে না। সামরিক পরিভাষায় ইংরেজিতে একটা কথা প্রচলিত আছে। তাহলো— Before you fire you must aim and before you aim you must fix the target. ১৯৯৯ সালে ৬ মার্চ যশোরে অনুষ্ঠিত উদীচীর সম্মেলনের ওপর আক্রমণের মাধ্যমে বাংলাদেশি জঙ্গিরা তাদের সশস্ত্র তত্পরতা শুরু করে। তারপর বিগত ১৬-১৭ বছর ধরে বিভিন্ন পরিচিতির মানুষ ও স্থাপনার ওপর বিভিন্ন কৌশলে তারা অনবরত আক্রমণ চালিয়েছে, এখনো চালাচ্ছে। জঙ্গিদের এই সব আক্রমণের শিকার কারা হয়েছেন, কোন সব অনুষ্ঠান ও কর্মকাণ্ডের ওপর তারা আক্রমণ চালিয়েছে, ধৃত জঙ্গিদের ব্যাকগ্রাউন্ড ও পরিচয় এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিচারিক আদালতে এ সম্পর্কিত দু’য়েকটি মামলার নিষ্পত্তি হওয়ায় আদালতের রায় ও পর্যবেক্ষণ পর্যালোচনা করলে জঙ্গিদের উত্পত্তি স্থল ও সঠিক পরিচয় সম্পর্কে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। প্রথমত ও প্রধানত জঙ্গিদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক দর্শনে বিশ্বাসী রাজনীতিক ও সমাজকর্মী, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, অসাম্প্রদায়িক ও ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থার চিন্তক ও বুদ্ধিজীবিগণ। ২০০৪-২০০৫ সালে এসে জঙ্গিরা তাদের সশস্ত্র তত্পরতার ক্ষেত্রের বিস্তৃতি ঘটায় এবং ভয়ানক বেপরোয়া হয়ে ওঠে। উপরে বর্ণিত টার্গেটের ওপর তো আক্রমণ অব্যাহত রেখেছেই, উপরন্তু এসময়ে তারা রাষ্ট্রের আইন-আদালত ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর আক্রমণ চালায়। তারা স্লোগান দেয় তাগুতি আইন অর্থাত্ মানব সৃষ্ট আইন দ্বারা রাষ্ট্র চালানো যাবে না, তাদের মতানুসারে আল্লাহ্র আইনে দেশ চালাতে হবে। এ সময়ে তারা পুলিশের উপস্থিতিতে একের পর এক আদালত প্রাঙ্গণ ও বিচারকদের ওপর আক্রমণ চালায়। কিন্তু ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় এসে জঙ্গি দমনে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। অনেক চেষ্টা ও প্রস্তুতি চালালেও গুলশান ঘটনার আগ পর্যন্ত, বিগত ছয়-সাত বছরে, জঙ্গিরা পূর্বের মতো বড় কোনো আক্রমণ চালাতে পারে না, যার কথা লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছি। সুতরাং তারা বেছে নেয় গুপ্ত হত্যা ও টার্গেট কিলিংয়ের পথ। এটি কেন প্রতিহত করা গেল না সে কথাও লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছি। এই গুপ্ত হত্যা ও টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছেন কট্টর ওয়াহাবিতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণকারি উদার, সহিষ্ণু ও শান্তিপ্রিয় ইসলামিক আলেম ও পীর ফকিরগণ। দ্বিতীয়ত টার্গেট হয়েছেন হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মের সাধারণ মানুষ ও ধর্ম গুরুগণ। তৃতীয়ত অসাম্প্রদায়িক ও বাঙালি চেতনায় বিশ্বাসী বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকগণ, এই শ্রেণির অনেকে এখনো হুমকির মুখে আছেন। চতুর্থত, কিছু ব্লগার যাদের বিরুদ্ধে জঙ্গি পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় এরা নাকি ধর্মের অবমাননা করেছেন। এর বাইরে দুইজন বিদেশি সিজার তাভেলা ও হোসিও কোনি গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছেন। উপরে বার্ণিত জঙ্গিদের আক্রমণের শিকার যারা হয়েছেন, তাদের পরিচিতি এবং অন্যান্য টার্গেটের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টও বোঝা যায় এসব আক্রমণ করেছেন তারাই, যারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক দর্শনের বিরুদ্ধে, যারা তাদের রাজনৈতিক মতানুসারে বাংলাদেশকে শরিয়া আইনের ওয়াহাবিপন্থি রাষ্ট্র বানাতে চান, যারা চরম সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করেন এবং বাংলাদেশকে একটা মনোলিথিক রাষ্ট্র বানানোর জন্য হিন্দু শূন্য ও সংখ্যালঘু বিহীন করতে চান। নির্মোহ তথ্য- উপাত্ত এবং মিডিয়ার প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যের পর্যালোচনা করলে জঙ্গিদের শেকড়ের পরিচয় আরো স্পষ্ট হয়। ২০০৬ সালে পহেলা ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. এস.এ তাহের হত্যাকাণ্ডের ওপর হাইকোর্টের রায়ে যাদের মৃত্যুদণ্ডসহ অন্যান্য শাস্তি হয়েছে তারা সবাই জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী। আফগান জঙ্গি নেতাদের সঙ্গেও জামায়াত নেতাদের কানেকশনের অনেক সচিত্র খবর পত্রিকায় বিভিন্ন সময় এসেছে। বিগত ৪৫ বছরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে এবং যত জঙ্গি আক্রমণ হয়েছে তার পর্যালোচনা করলে এটা নিশ্চিতভাবে স্পষ্ট হবে যে, বাংলাদেশের জঙ্গি তত্পরতার মূলে বা শেকড়ে রয়েছে জামায়াত শিবির ও ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি। জঙ্গিদের দমন, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল করতে চাইলে তাদের উত্পত্তি, বিস্তার, সক্ষমতা ও তত্পরতার কৌশল সম্পর্কে পূর্ণ উপলব্ধি থাকা প্রয়োজন। জঙ্গিবাদ কাজ করে দু’টি স্তরে। প্রথম স্তর বা ম্যাক্রো লেভেলে ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে তারা কথিত জেহাদে উদ্বুদ্ধকরণ, প্রশিক্ষণ ও অর্থায়নের ব্যবস্থা করে। জঙ্গিদের শেকড় এখানে প্রোথিত। এই স্তরে জঙ্গিদের সহায়ক ফ্যাক্টর বা উপাদান হিসেবে কাজ করছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চরম বিভাজন পরিস্থিতি, বৈশ্বিক জঙ্গি পরিস্থিতির প্রভাব এবং বাংলাদেশের ভেতরে জঙ্গি তত্পরতায় পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সরাসরি অংশ গ্রহণ। ম্যাক্রো স্তরে জঙ্গি বিস্তারে আরো সহায়ক ভূমিকা রাখছে দুর্নীতি, সুশাসনের অভাব, শিক্ষা ব্যবস্থার অসারতা, মাদ্রাসা শিক্ষার পশ্চাত্পদতা ও অন্ধত্ব, দারিদ্র্যতা, বেকার সমস্যা ইত্যাদি।
প্রথম স্তর থেকে উদ্বুদ্ধ ও প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রথমস্তরের পরিকল্পনা ও নির্দেশনা অনুযায়ী জঙ্গিরা দ্বিতীয় স্তর অর্থাত্ মাঠে নেমে গুপ্ত হত্যাসহ সব ধরনের জঙ্গি তত্পরতা চালায়। প্রথম স্তর অর্থাত্ জঙ্গিদের শেকড় উত্পাটন করতে হলে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাউন্টার ব্যবস্থা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গ্রহণ, রপ্ত ও বাস্তবায়ন করতে হবে। তার সঙ্গে বৃহত্তর জনগণকে সম্পৃক্ত করা একান্ত প্রয়োজন। দ্বিতীয় স্তর অর্থাত্ মাঠ পর্যায়ে সশস্ত্র জঙ্গিদের গুপ্তহত্যাসহ সব তত্পরতা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সার্বিকভাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত ও গোয়েন্দা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। উল্লিখিত সক্ষমতা বৃদ্ধির সবকিছুর সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি জনআস্থা বৃদ্ধি না পেলে আকাঙ্ক্ষিত ফল কখনো পাওয়া যাবে না। এখানে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। জঙ্গিবাদ ও সশস্ত্র জঙ্গি তত্পরতা এখন একটা বৈশ্বিক সমস্যা, যা থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। তাই আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক একটা সমন্বিত প্রচেষ্টা অবশ্যই বাংলাদেশের জঙ্গি দমনে ভূমিকা রাখতে পারে। ভারতের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়সহ একটা কার্যকর যোগাযোগ ও সমন্বয় বাংলাদেশের রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে চায়। কিন্তু তাদের সহযোগিতার কাঠামো, বৈশিষ্ট্য ও স্বরূপ সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ বুঝে উঠতে পারছে না। লন্ডন, নিউইয়র্ক, সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যেসব জঙ্গি পরিকল্পনা হচ্ছে সে সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সঠিক গোয়েন্দা তথ্য প্রদান করে সহায়তা করলে সেটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জঙ্গি দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এটা এখন নিশ্চিত যে অনেক জঙ্গি তত্পরতার পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ হচ্ছে দেশের বাইরে। লেখাটি শেষ করতে চাই এই বলে যে, রাষ্ট্রীয় শক্তি ও জনগণের শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালে জঙ্গিরা অবশ্যই দমন ও নিয়ন্ত্রণে থাকতে বাধ্য হবে।
©somewhere in net ltd.