![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জু লাই মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় সমাপ্ত হয়েছে ২০১৬ সালের জেলা প্রশাসকদের সম্মেলন। চারদিনব্যাপী এই সম্মেলনে আলোচনার জন্যে গৃহীত হয়েছে ২৮৮টি প্রস্তাব, যদিও ৩৩৬টি প্রস্তাব জেলা প্রশাসকরা উপস্থাপনের উদ্যোগ নেয়। প্রস্তাবসমূহের মধ্যে এলাকার নানবিধ উন্নয়ন, শূন্যপদসমূহ পূরণ, এলাকার আইন-শৃঙ্খলা সংরক্ষণে অধিকতর ক্ষমতায়ন, এসব প্রাধান্য পেয়েছিলো সর্বাধিক। মোট ৩৯টি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত বিষয়াবলি নিয়ে ১৮টি অধিবেশনে প্রচুর খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। উপস্থিত ছিলেন ৬৪ জন জেলা প্রশাসকের মধ্যে ৫ জন মহিলা জেলা প্রশাসক। বাংলাদেশের প্রশাসনে মহিলা জেলা প্রশাসকদের এমন আধিক্য এই প্রথম। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসকের স্বামী হচ্ছেন নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক।
সম্মেলন শেষে যখন সিদ্ধান্ত হয়েছে তখন দেখা গেল জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে জেলা প্রশাসকদের ভূমিকা এবং গণসচেতনতা বৃদ্ধি করে জঙ্গিবাদকে নির্মূল করার দায়িত্বই প্রাধান্য পেয়েছে অনেক বেশি। এই প্রথমবারের মতো এমন গুরুদায়িত্ব জেলা প্রশাসকদের উপর অর্পিত হয়েছে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে। এজাতীয় দায়িত্ব পালনে জেলা প্রশাসকরা কতটা প্রস্তুত বা ক্ষমতাবান, এটাই হচ্ছে প্রশ্ন। তবে একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে এলাকার আইন-শৃঙ্খলা এবং জনজীবনে শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করা হচ্ছে মুখ্য দায়িত্ব— এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
গুলশান এবং শোলাকিয়ার ঘটনাবলি জাতীয় জীবনে নতুন ভাবনার সূচনা করেছে এবং জনপ্রশাসনের নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম হয়ে উঠেছে বিরাট এক ভাবনার বিষয় এবং কর্মকাণ্ডের বড় ক্ষেত্র। তথ্যমন্ত্রী সন্মেলনে বলেছেন- প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মচারীকে সাংবিধানিক দায়িত্ব মনে করে সন্ত্রাসকে দমন করে সূশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তিনি আরো বলেছেন- দেশ এখন তিনটি যুদ্ধের মধ্যদিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে: সন্ত্রাসকে দমন করা, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা এবং সকল ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। এই যুদ্ধে নির্লিপ্ততার কোনো সুযোগ নেই। জেলা প্রশাসকদের দায়িত্ব পালন করতে হবে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এবং তিনটি ক্ষেত্রেই অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে।
মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে জেলা প্রশাসকরা সাক্ষাত্ করতে গেলে তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে জঙ্গিবাদকে নিমূল করার পরামর্শ দেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মহোদয়ও বলেন সকল সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাদেরকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে এবং জেলা, থানা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে গঠিত সন্ত্রাসবিরোধী কমিটিসমূহের কর্মকাণ্ডকে মনিটর করতে হবে সঠিকভাবে। সকল বিষয়ের মধ্যে সার্বিকভাবে সকলের ভাবনায় জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ এবং এর সপক্ষে জনমত সৃষ্টিই প্রধান হয়ে প্রতিভাত হয়েছে্।
এমন নির্দেশনা এসেছে মূলত ১ জুলাই গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারি রেস্টুরেন্টে বিদেশি হত্যা এবং কিশোরগঞ্জে ৭ জুলাই শোলাকিয়ায় দেশের বৃহত্তম ঈদের জামাতের পাশে জঙ্গি আক্রমণের ফলশ্রুতি হিসাবে।
ওয়ান ইলেভেনে যখন টুইনটাওয়ার ধ্বংস হয়, তখন বাংলাদেশের লোকেরা অনেকেই বুঝতে পারিনি এর প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে। বাংলাদেশের মতো দেশে নিরাপত্তার বলয় অতটা ছিলো না যা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ অবাধে বিচরণ করেছে যত্রতত্র দ্বিধাহীনচিত্তে। এবার কিন্তু বাংলাদেশে নিরাপত্তার বিষয়টি অনেক বড় হয়ে দেখা দিতে শুরু করেছে। তাই জেলা প্রশাসনের উপর গণসচেতনতা বৃদ্ধির ব্যাপারে কাজ করার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে নতুন করে। জনগণও এখন অনেকটা সতর্ক হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, জেলা প্রশাসকরা সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে কতটা সক্ষম ? তারা হয়ত জেলায় নিরাপত্তা এবং আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিতদের সমন্বয় বিধান করে নেতৃত্ব দিতে পারেন। এজন্যে জেলা প্রশাসককে সহযোগিতা করতে হবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহকে। জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিরক্ষণ বা তদারকির কাজ বৃদ্ধি করার সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু জঙ্গিবাদের মতো একটি জটিল বিষয়কে নিরীক্ষণ করা সহজ বিষয় নয়, যদি না স্থানীয় লোকজনের এবং অভিভাবকদের সহযোগিতা না পাওয়া যায়।
জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে আরো আলোচনায় আসে মহাসড়কে তিন চাকাবিশিষ্ট যানবাহনের চলাচল নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত বিষয়াবলি, সীমান্তে চোরাচালান প্রতিরোধ এবং সড়কের দু’পাশে দোকানপাট নির্মাণ এবং সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়সমূহ। তবে একটি বিষয় জেলা প্রশাসকরা জোর দিয়ে বলেন, তা হচ্ছে—মোবাইল কোর্টে আইন ২০০৯’র সংশোধন। তারা দাবি করেন কোনো অপরাধী যদি তার অপরাধ স্বীকার নাও করে তাহলেও তাকে শাস্তি দেওয়ার বিধান সংযোজন করতে হবে। এছাড়া এই আইনে অপরাধ স্বীকার করলে মাত্র দুই বছর শাস্তি দানের বিধান আছে এবং তাকে চার বছর বৃদ্ধি করার সুপারিশ করেন। মোবাইল কোর্টের আওতায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদেরকে অপরাধ আমলে নিয়ে শাস্তিদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সাধারণ নিয়মে তাদের বিচার করার ক্ষমতা এখন নেই। এমন একটি পরিস্থিতির প্রচলন হয়েছে নভেম্বর ১, ২০০৭ সাল থেকে যখন বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের পৃথকীকরণ প্রক্রিয়া বলবত্ করা হয়। মাজদার হোসেন মামলা এবং অপরাপর ৪৪১ জনের রীট মামলার প্রেক্ষিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদেরকে কোনো মামলা ট্রায়াল করার ক্ষমতা রহিত করা হয়। যদিও মোবাইল কোর্ট আইনে কিছুটা ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কিন্তু মহাসড়ক আইন ১৯২৫, মোটর ভেহিক্যাল অধ্যাদেশ ১৯৮৩, এসিড নিক্ষেপ আইন ২০০২ এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০’র আওতায় মামলা আদালতে বিচারাধীন করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা বিরাজ করছে।
একথা সত্যি যে দেশের প্রায় শহর এবং গ্রামে চুরি-ডাকাতি, খুন-খারাবি এবং মহিলাদের প্রতি নির্যাতন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া টেলিফোনে হুমকি, বিভিন্নস্থানে পুরোহিত হত্যা, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার এবং শিল্প-কারখানায় শিশুশ্রম বৃদ্ধিসহ অনেক ক্ষেত্রে অসন্তোষ বৃদ্ধি পেয়েছে। জনগণ বিরাজমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে সন্তুষ্ট নয়, তারা এর উন্নতি প্রত্যাশা করে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে হয় যে, প্রত্যেক জেলায় জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি আইন-শৃঙ্খলা কমিটি আছে। এই সভায় পুলিশ সুপার কালেভদ্রে উপস্থিত থাকেন। ফলে আইন-শৃঙ্খলার বাস্তব পরিস্থিতি নিয়ে অর্থবহ আলোচনা হয় না। তাছাড়া চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সকল প্রকার সিভিল এবং ক্রিমিনাল মামলা পরিচালনা করেন । কিন্তু তিনি জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সদস্য নন। ফলে স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ মামলা সম্পর্কে জেলা প্রশাসকরা ভালোভাবে অবহিত হতে পারেন না। এমন একটি পরিস্থিতিতে কিভাবে জেলা প্রশাসকরা জেলার সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদ নিবারণে প্রধান ভূমিকা পালন করবেন? এই প্রেক্ষাপটে কয়েকটি ব্যবস্থা নিতে হবে, যেমন:পুলিশ সুপারকে জেলার আইন-শৃঙ্খলা কমিটিতে নিয়মিত উপস্থিত থাকতে হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর আইন-শৃঙ্খলাজনিত ঘটনা সম্পর্কে জেলা প্রশাসককে অবহিত রাখতে হবে এবং তার পরামর্শ নিতে হবে। দ্বিতীয়ত. চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সন্ত্রাসবাদজনিত মামলা এবং ঘটনা সম্পর্কে জেলা প্রশাসককে অবহিত করতে হবে এবং তার প্রতিনিধি জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় উপস্থিত থেকে বৃহত্তর স্বার্থে সভাকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহযোগিতা করতে পারেন। তৃতীয়ত. জনগণের সমন্বয়ে বিভিন্ন স্তরে কমিটি গঠন করা যেতে পারে, যারা প্রশাসনকে তথ্য সরবরাহসহ নিয়মিত সহযোগিতা করবেন। এছাড়াও, সরকারের যে সকল সিক্রেট সার্ভিসেস্ এজেন্সি আছে সে সকল ক্ষেত্রে তাদের তত্পরতা অধিকতর বৃদ্ধি করতে হবে এবং যারা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে কেন্দ্রকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করবেন।
জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাস নিবারণ একটি সহজ প্রক্রিয়া নয়। এজন্যে কোনো একক প্রতিষ্ঠান বা দপ্তরের উপর নির্ভরশীল হওয়ার সুযোগ নেই। সরকারের সকল স্তরের আইন-শৃঙ্খলায় নিয়োজিতদের মধ্যে নিবিড় সহযোগিতার প্রয়োজন আছে। কেন্দ্র এবং মাঠপর্যায়ের মধ্যে তথ্য বিনিময়ের ক্ষেত্রে যেমন সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে তেমনিভাবে খেয়াল রাখতে হবে বেড়ায় যেন ক্ষেত না খায়্। প্রত্যেককে খেয়াল রাখতে হবে দেশের ভাবমূর্তি এই দুটি ঘটনায় অনেক বিনষ্ট হয়েছে কিন্তু আর নয়। থামতে হবে এবং থামাতে হবে, যে কোনো মূল্যে।
©somewhere in net ltd.