নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মন্ত্রক

আমি আমার দেশের জন্যে

মন্ত্রক › বিস্তারিত পোস্টঃ

জঙ্গিদমনে সামাজিক প্রতিরোধ

২৪ শে আগস্ট, ২০১৬ সকাল ১০:৫৮

পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশে আগস্ট শোকের মাস হিসেবে একটি দ্যোতনা পেয়েছে। বাঙালির কান্নার মাস। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে যিনি বিশ্বের দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, স্বাধীন বাংলাদেশের সেই মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রায় সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে এই আগস্ট মাসে। তবে প্রতিবাদহীন বোবা কান্নায় জীবন কাটিয়ে দেয়ার জাতি বাঙালি নয়। শোকাবহতার কান্না ভুলে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা আমাদের আছে। জাতীয় কবির কাব্যকণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে 'ত্যাগ চাই মার্সিয়া ক্রন্দন, চাহি না'। বিপ্লবী কবি সুকান্তও উদ্বেগ ছেড়ে প্রতিরোধের কথা বলেছেন, 'বন্ধু তোমার ছাড় উদ্বেগ সুতীক্ষ্ন করো চিত্ত। বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত'।
বাংলাদেশের মাটি যে প্রতিক্রিয়াশীল, ধর্মান্ধ জঙ্গি জিহাদিদের জন্য সুবিধাজনক জায়গা নয়_ তা আশা করি ইতোমধ্যেই কিছুটা করা গেছে। শোকাবহ আগস্টের পুঞ্জীভূত শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে আগস্টের ডে ওয়ানেই সমগ্র জাতি হাতে হাত মিলিয়ে জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যে ঘণ্টাব্যাপী ইতিহাসের বৃহত্তর র্যাালি অনুষ্ঠিত করেছে_ তা গিনেস বুকে স্থান পাওয়ার দাবি রাখছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যানারে অনুষ্ঠিত হলেও তাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যানার ফেস্টুন হাতে অংশগ্রহণ করে লাখ লাখ শিক্ষার্থী। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দলে দলে যোগ দিয়েছে এই জঙ্গিবাদবিরোধী মানববন্ধনে। এই প্রতিবাদ র্যা লির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো_ এর অসাম্প্রদায়িক অবয়ব। হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ, নারী-পুরুষসহ আবালবৃদ্ধবনিতার সমাগমে মুখরিত হয়ে ওঠে। সবার চোখে জঙ্গিবাদীদের প্রতি তীব্র ঘৃণা আর তাদের মোকাবেলার জন্য দৃঢ় প্রত্যয় মিশ্রিত অগি্নঝিলিক।
এর চেয়ে বড় সামাজিক প্রতিরোধ আর কী হতে পারে? জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছে আগস্ট মাসের এক একটি র্যা লির ভেতর দিয়ে। এর পেছনে কোনো রাজনীতি কাজ করেনি, কারো ঐক্য আহ্বান কাজ করেনি। কাজ করেছে দেশ ও মাতৃকার বিপর্যয় মোকাবেলায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করার মানসিকতা, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অসাম্প্রদায়িক চরিত্র মৌলবাদ-জঙ্গিবাদসহ সব প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তির করাল গ্রাস থেকে অক্ষুণ্ন রাখা। আনুষ্ঠানিকভাবে রচিত এ দ্রোহী চেতনা সাম্প্রতিক জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী সামাজিক প্রতিরোধ হিসেবে নিরন্তর প্রেরণা জোগাবে।
চলমান জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানে বাংলাদেশ সরকারিভাবে এবং সামাজিকভাবে এগিয়ে চলেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা ঘোষণা করেছেন। তার ঘোষণার প্রভাব রাষ্ট্রযন্ত্রের সব স্তরে কার্যকরভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাট জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অদম্য অঙ্গীকার এবং আন্তরিকতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা জঙ্গিদমন অভিযানে দৃশ্যমান সাফল্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গুলশান ক্যাফে হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেককে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শোলাকিয়া ঈদগাহ হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গিদ্বয় দমিত হয়েছে। ১ জুলাইয়ের অপারেশন থান্ডারবোল্ট, ২৬ জুলাইয়ের স্টর্ম-২৬সহ অন্যান্য যৌথ এলিট ফোর্স অপারেশনের সাফল্য তাৎক্ষণিকভাবে জঙ্গিবাদের প্রকোপ কমিয়ে ফেলেছে। কিন্তু কেবল সামরিক অভিযানের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের মূল উৎপাটন করা যাবে না। সমাজ এবং রাষ্ট্র থেকে জঙ্গিবাদের জীবাণু ধ্বংস করতে হলে সক্রিয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। বিপথগামী তারুণ্যের জঙ্গি হয়ে ওঠার রাস্তা বন্ধ করা দরকার।
এর জন্য দরকার জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রবল সামাজিক ঘৃণার সৃষ্টি করা। অবশ্য বাংলাদেশে তা হয়েছেও। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মধ্যে জঙ্গিদের প্রতি তীব্র ঘৃণা সঞ্চারিত হয়েছে। মৃত জঙ্গিদের লাশ গ্রহণেও আপত্তি জানাচ্ছে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো। অনেক পরিবার আবার জঙ্গি পথে যাওয়া নিরুদ্দিষ্ট সন্তানদের খবর পুলিশের কাছে দিচ্ছে। নিশ্চয়ই এ এক অসাধারণ জাগৃতি। হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক-বাহক এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনাপুষ্ট বাঙালি জাতি উগ্রবাদী ধর্মান্ধ জঙ্গি-জিহাদিদের যে প্রশ্রয় দেবে না_ তা খুবই স্বাভাবিক। তা ছাড়া হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিতা-বের যে পৈশাচিক দৃশ্য শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে তাতে কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে কোনো বিবেচনাতেই জঙ্গি জিহাদিদের পৈশাচিক কর্মকা-ের পক্ষে পরোক্ষতম সমর্থনদানও সম্ভব নয়।
তাহলে কারা এসব করছে? দেশের বড় বড় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বিলাসবহুল জীবন-অভ্যস্ত উচ্চবিত্ত তরুণদেরও যখন জঙ্গিবাদী জীবনাচরণ বেছে নিতে দেখা যাচ্ছে_ তখন সত্যিই হিসাব মেলানো ভার। কোন কুহেলিকা তাদের এই মরণ পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে? মহামতি ভলতেয়ার তার এক অমর বাণীতে বলেছিলেন কাউকে দিয়ে সন্ত্রাসী কাজ করিয়ে নিতে হলে তাকে প্রথমে অলৌকিকত্বে বিশ্বাস করাতে হয়। জঙ্গিবাদ সৃষ্টির পেছনের সবচেয়ে বড় ফর্মুলা মনে হয় এটিই।
শর্টকাট স্বর্গারোহণের চাবি জঙ্গিবাদী আত্মত্যাগেই মিলবে বলে অবিকশিত মন ও মগজের এই বিভ্রান্ত তরুণদের বোঝানো হয়। তাই স্বাভাবিক ধর্মানুশীলদের প্রলম্বিত পথে না গিয়ে রাতারাতি কিস্তিমাতের স্বপ্ন (নাকি দিবাস্বপ্ন) তারা দেখছে। আর এই দিবাস্বপ্ন দেখাতে মোক্ষম ভূমিকা পালন করে মেধাবী জঙ্গিগুরুদের বয়ান আর ধর্মের অপব্যাখ্যা। ধর্মশাস্ত্রের সামগ্রিক মূল্যায়ন না করে নিজ সুবিধা মতো আংশিক বা খ-িত ব্যাখ্যা করে মগজ ধোলাই করা হয় এবং কল্পিত শত্রু নিধনের মন্ত্র পড়িয়ে মাঠে ছেড়ে দেয়া হয়। এভাবে দেশ-বিদেশের সব জঙ্গিকে ট্রিগার হ্যাপি বানানোর পেছনে কাজ করে অলৌকিকত্বে বিশ্বাস স্থাপনের মনস্তাত্তি্বক কৌশল।
জঙ্গিবাদ সৃষ্টির পেছনের কারণগুলো নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ ভাবছেন মানুষের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, বঞ্চনা প্রভৃতি ম্যানিপুলেট করে স্বার্থান্বেষী মহল মানুষকে আত্মঘাতী জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দেয়। অনেকে আবার লোকবিশেষের অস্বাভাবিক মনস্তাত্তি্বক প্রবণতাকে দায়ী করতে চান। অনেকে আবার আর্থ-সামাজিক ও ধর্ম-সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোকে দায়ী করতে চান। তবে যে কারণেই একজন মানুষ জঙ্গি হয়ে উঠুক না কেন, এই প্রবণতা তরুণ সমাজের মধ্যে বেশি লক্ষ্য করা যায়। সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে উঠে আসা বিভ্রান্ত তরুণ এরা। তাই জঙ্গিবাদ মোকাবেলার জন্য সর্বাগ্রে নজর দিতে হবে তরুণ সমাজের দিকে। এই তরুণ সমাজকে সুস্থ-সুন্দর স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত/আবদ্ধ রাখার প্রাথমিক দায়িত্ব পরিবারের ওপরই বর্তায়।
ফ্যামিলিটাই দৃঢ় না হলে এর তরুণ সদস্যদের কক্ষচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। করপোরেট পুঁজি-শাসিত তীব্র প্রতিযোগিতামুখর সমাজে কথিত সাফল্যের পেছনে ইঁদুর-দৌড় দৌড়াতে গিয়ে মানুষ ক্রমাগত পরস্পর থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়েছে। তারা এই বিছিন্নতার ঋণাত্মক অভিঘাত সবচেয়ে বেশি পড়ছে তরুণ সমাজের ওপর। তাই জঙ্গিবাদ রোধে বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ''ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে' তুলতে হবে। সুষ্ঠু সাংস্কৃতিকচর্চার অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে সমাজে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। অসাম্প্রদায়িক চৈতন্য এবং আন্তঃব্যক্তিক (রহঃবৎঢ়বৎংড়হধষ) গুণাবলির বিকাশ ঘটাতে হবে। পরমত, পর ধর্ম, এবং পরসংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রক্ষার মানসিকতার বিকাশ ঘটাতে হবে। জঙ্গিবাদ সমাজে যে দুষ্টুক্ষত সৃষ্টি করেছে, তার আশু সমাধানের জন্য যেমন সাময়িক অভিযান প্রয়োজন, সমূলে বিনাশের জন্য তেমনি সামাজিক প্রতিরোধ প্রয়োজন।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.