![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১৫ আগস্ট। বাঙালি জাতির শোকের দিন। ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এর চেয়ে বেদনাদায়ক দিন আর নেই। ওই দিন ভোরে ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে কিছু বিপথগামী সেনা সদস্য। তাঁর মতো বিশাল হৃদয়ের মানুষকে বাঙালি হত্যা করতে পারে তা তিনি কখনো বিশ্বাসই করতেন না। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংখ্যা ‘র’ আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিল।
গোয়েন্দাদের সতর্কবার্তার জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাঙালি আমাকে মারবে না। মারতে পারে না।’ তিনি আসলে বাঙালিকে অসম্ভব ভালোবাসতেন, বিশ্বাস করতেন। সে কারণেই তিনি তাঁর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি ছেড়ে যাননি। বঙ্গভবনে গেলে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারেন সে আশঙ্কায় তিনি নিজের বাড়িতেই থাকতেন। তিনি যদি নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবতেন তাহলে বঙ্গভবনে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতরেই থাকতেন।
আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের দিকে তাকাই তাহলে কী দেখতে পাই! ‘লরকে-লেঙ্গে পাকিস্তান’ আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তিনি অগ্রভাগে ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁর রাজনৈতিক গুরু। সোহরাওয়ার্দী যেমন নীতির প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন, বঙ্গবন্ধুও কখনো আপসের রাজনীতি করেননি। সে কারণেই তাঁকে বারবার জেল-জুলুম, অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রাক্কালে সর্বপ্রথম শামসুল হক এবং শেখ মুজিব কারাবরণ করেন। তারপর থেকে কোনো আন্দোলনের আভাস পেলেই পাকিস্তানি শাসকরা তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে প্রায় ২৩ বছর জেলেই কাটাতে হয়।
বঙ্গবন্ধু যে অত্যন্ত দূরদর্শী নেতা ছিলেন তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর ছয় দফা দাবির মধ্য দিয়ে। বাঙালিকে দাবিয়ে রাখার যে অপকৌশল নিয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী, তা তিনি উপলব্ধি করেন। তাই তিনি বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ছয় দফা দাবি পেশ করেন। সেই ছয় দফাই হয়ে ওঠে বাঙালি জাতির মুক্তিসনদ।
সত্তরের নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পরও আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা দেওয়া হলো না। ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে প্রহসন করা হয়। বঙ্গবন্ধু তখন স্বাধীনতার ডাক দিলেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে উদাত্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ৭ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত মূলত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই দেশ পরিচালিত হয়। তারপর শুরু হয় সশস্ত্র সংগ্রাম। ৯ মাসের যুদ্ধে বিজয়ী হয় বাঙালি জাতি।
বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিত করিয়েছেন। বাঙালিকে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখণ্ড দিয়েছেন। গণতান্ত্রিক সংবিধান দিয়েছেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন। উন্নত জাতি গঠনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই মহান নেতার ওপর মীরজাফরের বংশধররা চরম আঘাত হানল। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও সেই রাতে তাঁর স্ত্রী ফজিলাতুননেসা মুজিব, তাঁর তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশুপুত্র রাসেল, তাঁর দুই পুত্রবধূসহ নিকটজনদের নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান।
স্বাধীনতার সময় জিয়াউর রহমান ছিলেন মেজর। পরে বঙ্গবন্ধুই তাঁকে কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার এবং মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান করেন। তা ছাড়া স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু খালেদা জিয়া ও জিয়াউর রহমানকে বাসায় ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘খালেদা আমার মেয়ের মতো।’
সেই জিয়াউর রহমান যখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনার কথা জানতে পারলেন তখন তিনি কেন নীরব ভূমিকা পালন করেছিলেন? কর্নেল ফারুক নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাঁদের পরিকল্পনার কথা জিয়াউর রহমান জানতেন। তাঁর সঙ্গে তাঁদের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনাও করেছিলেন। কিন্তু তিনি হ্যাঁ-না কিছুই বলেননি। তিনি তো বিষয়টি নিয়ে সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর সঙ্গেও কথা বলতে পারতেন! অথবা তিনি নিজেও সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে ভূমিকা নিতে পারতেন! তাঁর সেই সময়ের রহস্যজনক ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধই থাকল।
পঁচাত্তরের পরের ইতিহাস আমাদের সবার জানা। আমরা দেখেছি, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে এ দেশে একসময় বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়াও নিষিদ্ধ ছিল। ইতিহাসের চাকা উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করল। পাকিস্তানিদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীকে এ দেশে পুনর্বাসন করা হলো। জামায়াতকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেওয়া হলো। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরিতে অবাধ সুযোগ দেওয়া হলো।
বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের যাতে বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াতে না হয় সে জন্য জিয়াউর রহমানই ইনডেমনিটি আইন জারি করলেন। খুনিদের বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হলো। সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের বেছে বেছে হত্যা করা হলো। অনেক অফিসারকে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হলো। পাকিস্তানি ভাবধারার প্রশাসনযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হলো।
একটা বিপরীত স্রোতের দিকে দেশ যখন ধাবিত হচ্ছিল; সেই কঠিন সময়ে ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। এটাই বুঝি ছিল তাঁর অপরাধ! সেই থেকে তিনি অনেক নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হন। তাঁর ওপর ছোট-বড় ১৪টি হামলা হয়েছে। তাঁকে টার্গেট করে এই হামলাগুলো চালানো হয়। এরশাদের আমলে কোটালীপাড়ায় সরাসরি শেখ হাসিনার ওপর হামলা চালানো হয়। সেই হামলায় অলৌকিকভাবে শেখ হাসিনা বেঁচে যান।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামী লীগের সমাবেশ চলাকালে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা হয়েছে। হামলায় ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে এবং অনেকে আহত হন। গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের ক্ষত তাঁরা আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন।
ষড়যন্ত্রকারীদের টার্গেট শুধু শেখ হাসিনাই ছিলেন না, তারা আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর চেতনা কি বাঙালির হৃদয় থেকে মুছে ফেলা যাবে? তাঁর চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়েছে। এই ভূখণ্ড যত দিন থাকবে, বাংলা ভাষা যত দিন থাকবে, বাঙালি জাতি যত দিন থাকবে তত দিন শেখ মুজিবের চেতনা থাকবে।
আমার মনে হয়, অপরাজনীতি করে বিএনপি নিজেদেরই ক্ষতি করছে। খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করে কুরুচির পরিচয় দিয়েছেন। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর চেতনায় বিশ্বাসীদের আঘাত করছেন। যদিও তাঁর আসল জন্মদিন ১৫ আগস্ট নয়। খালেদা জিয়ার এসএসসির মার্কশিট অনুযায়ী জন্মতারিখ হচ্ছে ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৬। বিয়ের সময় তাঁর জন্মতারিখ লেখা হয় ৪ আগস্ট, ১৯৪৪। জিয়াউর রহমান যখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন তখন তাঁর ফার্স্টলেডি হিসেবে লাল পাসপোর্ট ছিল। তাতে তাঁর জন্মতারিখ ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৬। আর ১৯৯১ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পত্রিকায় যে জীবনী ছাপা হয় তাতে জন্মতারিখ লেখা হয় ১৯ আগস্ট, ১৯৪৫।
খালেদা জিয়া নিজেই ভালো জানেন, তাঁর জন্মদিন আসলে কবে?
আসলে পাকিস্তানপন্থী একটি গ্রুপ খালেদা জিয়াকে ভুল বুঝিয়ে ১৯৯৩ সাল থেকে ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন শুরু করে। এর উদ্দেশ্যই হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর চেতনায় বিশ্বাসীদের আঘাত করা। তাতে কুচক্রী মহল হয়তো সফল হয়েছে। তবে খালেদা জিয়া কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের ভালোবাসা হারাচ্ছেন। কেউই শোকের দিনে তাঁর জন্মদিন পালন ভালো চোখে দেখছে না।
এবার ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়া আনুষ্ঠানিকতা বাদ দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু বিএনপির উদ্যোগে দলীয় কার্যালয়ে মিলাদ মাহফিল করা হয়েছে। তাতে ব্যাপারটা স্পষ্ট যে তিনি জন্মদিন পালন বাতিল করেননি। ওই দিন যদি তাঁর জন্মদিন হয়েও থাকে, তার পরও বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে জন্মদিন পালন করা থেকে বিরত থাকা উচিত। এই ইস্যুতে কোনো ধরনের রাজনীতি করা উচিত নয়। পাকিস্তানি ভাবধারার রাজনীতি বড্ড সেকেলে হয়ে গেছে। এই রাজনীতি দিয়ে দেশের মানুষকে আর কাছে টানা যাবে না।
এ ছাড়া এই মুহূর্তে সবাই মনে করছে, বিএনপির উচিত জামায়াতকে তাদের জোট থেকে বাদ দেওয়া। সেটা যত তাড়াতাড়ি বিএনপি করতে পারে ততই তাদের জন্য মঙ্গল। কিন্তু বিএনপির ভাব দেখে মনে হচ্ছে, যেকোনোভাবেই হোক, জামায়াতকে তারা ধরে রাখতে চায়। সম্প্রতি বিএনপির যে কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে সেখানে সাকা চৌধুরী ও আবদুল আলীমের ছেলেকে রাখা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে বিএনপির সখ্য সম্পর্কের কারণ কী? সাধারণ মানুষের মনে এ প্রশ্ন আছে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে থাকতে হলে উপরোল্লিখিত দুটি বিষয়ে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান যদি হয় ধরি মাছ না ছুঁই পানি, তাহলে তাদের টিকে থাকা কঠিন হবে। ইতিমধ্যে বিএনপি কিন্তু রাজনীতির মূলধারা থেকে কিছুটা বাইরে চলে গেছে। তবে সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। বিষয়টি নিয়ে বিএনপি নেতৃত্বকে এখনই ভাবতে হবে। পরিশেষে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, হাতে কিন্তু সময় বেশি নেই।
©somewhere in net ltd.