![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দণ্ডপ্রাপ্তরা বিভিন্ন সময়ে ছিলেন সরকারের মন্ত্রী ও এমপি। ক্ষমতার সুযোগে তারা গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসার মালিকানা নিয়ে হাজার-কোটি টাকার সম্পদ আছে মাত্র আট যুদ্ধাপরাধীরই। এই আটজনের মধ্যে অন্যতম মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী ধনকুবের হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের অন্য ‘গান গেয়ে’।
১৯৭০ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে মীর কাসেম আলী জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। মাত্র এক বছরের মধ্যে চট্টগ্রাম শহর ছাত্রসংঘের সভাপতি হয়ে তিনি হয়ে ওঠেন চট্টগ্রামের ত্রাস, গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর অন্যতম প্রধান সংগঠক। এসব এখন প্রমাণিত সত্য, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের অংশ।
একাত্তরে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার মহামায়া ডালিম হোটেলে মীর কাসেম গড়ে তোলেন আলবদর ক্যাম্প ও নির্যাতনকেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধকামী বাঙালিদের ধরে নিয়ে সেখানে নির্মম নির্যাতনের পর প্রাণে মারা হতো। ভয়ে স্থানীয় লোকজন তার নাম দেন ‘বাঙালি খান’। ট্রাইব্যুনাল এই ডালিম হোটেলকে বলেছেন ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’। বাঙালি হত্যার পুরস্কার দ্রুতই পেলেন মীর কাসেম, একাত্তরের ৭ নভেম্বর দলে পদোন্নতি পেয়ে হয়ে গেলেন পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক।
দেশ স্বাধীনের পর স্থায়ীভাবে ঢাকায় আসেন মীর কাসেম। এরপর ভয়ে পালিয়ে চলে যান লন্ডনে। সেখান থেকে সৌদি আরবে গিয়ে রাজাকারদের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য বিপুল অর্থ সহায়তা জোগাড় করেন তিনি। পরে ওই অর্থ নিজেই ভোগ করতে থাকেন পুরোটা, গড়ে তোলেন এনজিও। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর দেশে ফিরে আসা মীর কাসেম মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনৈতিক সাহায্যপুষ্ট রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামী নামের এনজিওর কান্ট্রি ডিরেক্টর হন। সেই এনজিওর অর্থে তিনি একের পর এক গড়ে তোলেন ব্যবসায়িক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। সেই থেকে জামায়াতের সাংগঠনিক ব্যয় নির্বাহে সবচেয়ে বেশি অর্থের জোগানদাতা মীর কাসেম। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিস্ট নিয়োগ ও আর্থিক লেনদেনের নেতৃত্বেও ছিলেন হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক মীর কাসেম আলী।
বেশকিছু আর্থিক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক মীর কাসেমের সম্পদ হাজার কোটি টাকার বেশি। কিন্তু সে তুলনায় তার ব্যক্তি নামে সম্পদ কম দেখানো হয়েছে। তার তত্ত্বাবধানের বেশির ভাগ সম্পদই বিভিন্ন কোম্পানি, ট্রাস্ট ও বেসরকারি সংস্থার নামে রয়েছে। ঢাকা কর অঞ্চল-৫-এর সার্কেল ৫০-এর করদাতা মীর কাসেম আলীর কর শনাক্তকরণ নম্বর বা ই-টিআইএন নম্বর হলো ০৭৬-১০৩-৯৬৬৩। তিনি ঢাকার মিরপুরের দক্ষিণ মনিপুরে ২৮৭ নম্বর প্লটের বহুতল ভবন পেয়েছেন পৈতৃকসূত্রে। এ ছাড়া তার ব্যক্তি নামে ঢাকার মোহাম্মদপুরে একতা সোসাইটির ৫ কাঠা জমি ও মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের চালায় সাড়ে ১২ শতক জমি রয়েছে। তিনি ধানমন্ডির বহুতল ভবন কেয়ারী প্লাজার অবিক্রীত ১৭৮.৬৯ বর্গমিটারের মালিক। বাকি অংশ ইতোমধ্যেই বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মোট ২৭ হাজার ২৭৭টি শেয়ার রয়েছে তার নিজ নামে। স্ত্রীর নামে রয়েছে ১০০টি এবং দুই ছেলে-তিন মেয়ের নামে রয়েছে ৫০০টি। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের ২ হাজার ১১৩টি শেয়ার, কেয়ারী লিমিটেডের ১৪ হাজার শেয়ার, কেয়ারী টেলিকমের ১০ হাজার, কেয়ারী ট্যুরস এন্ড সার্ভিসেসের ১ হাজার শেয়ার, কেয়ারী ঝর্না লিমিটেডের ২০টি, কেয়ারী তাজ লিমিটেডের ৫টি, কেয়ারী সান লিমিটেডের ৫টি, কেয়ারী স্প্রিং লিমিটেডের ২০টি, সেভেল স্কাই লিমিটেডের ১০০, মীর আলী লিমিটেডের ২৫টি এবং দিগন্ত মাল্টিমিডিয়া লিমিটেডের ১০০টি শেয়ার রয়েছে মীর কাসেম আলীর নামে। তিনি কেয়ারী লিমিটেডের চেয়ারম্যান, ইবনে সিনা ট্রাস্টের সদস্য (প্রশাসন), ইবনে সিনা হাসপাতালের পরিচালক, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের পরিচালক, এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাস্টের সদস্য ও ফুয়াদ আল খতিব চ্যারিটি ফাউন্ডেশনের সদস্য। তিনি ইসলামী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন, রাবেতা আল আলম আল ইসলামী, ইবনে সিনা ট্রাস্ট, এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাস্ট, ফুয়াদ আল খতিব চ্যারিটি ফাউন্ডেশন এবং অ্যাসোসিয়েশন অব মাল্টিপারপাস ওয়েলফেয়ার এজেন্সিসের বিভিন্ন বোর্ড মিটিংয়ে উপস্থিতির জন্য নিয়মিত ভাতা পেতেন। এ ছাড়া পরিচালনা পর্ষদে আছেন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট এন্ড বিজনেসম্যান চ্যারিটি ফাউন্ডেশন, আল্লামা ইকবাল সংসদ, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি চট্টগ্রাম, দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি, সেন্টার ফর স্ট্রাটেজি এন্ড পিস, বায়তুশ শরফ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ ইসলামিক ট্রাস্ট ও ইসলামিক ইকোনমিক্স রিসার্চ সেন্টারের।
মীর কাসেম আলীর ২০১০ সালের আয়কর রিটার্নে ব্যক্তিগত ঘোষিত মোট পরিসম্পদ ৩ কোটি ৩৩ লাখ ৯৯ হাজার ৩২৪ টাকা। এর মধ্যে তার নামে থাকা শেয়ারগুলোর মূল্য ১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। ঢাকার বাড়ি ও জমির দাম মাত্র কয়েক লাখ টাকা করে উল্লেখ করা হয়েছে রিটার্নে। সে সময় তার বার্ষিক আয় ছিল ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৫২৯ এবং ব্যাংকে ছিল ১৮ লাখ ৪৫ হাজার ৭০১ টাকা। তবে মীর কাসেম আলী-সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের অঙ্কগুলোও বড় এবং এর কোনোটিই খেলাপি নয়। কেয়ারী লিমিটেডের নামে ঋণ ৬০ কোটি ৯৩ লাখ, ইবনে সিনা ট্রাস্টের নামে ৫০ কোটি, ইবনে সিনা হাসপাতালের ৬ কোটি ৩৪ লাখ, ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালসের ২০ কোটি, দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের নামে ৪১ কোটি ৩৫ লাখ, এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়ালের ২৩ কোটি ৭৫ লাখ এবং ফুয়াদ আল খতিবের নামে ২ কোটি ৯৬ লাখ টাকার ঋণ রয়েছে।
২০১২ সালের ১৭ জুন গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে তার নাম বাতিল করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেবল জামায়াত নেতাদের মধ্যেই নয়, গত তিন দশকে দেশের অন্যতম বড় ব্যবসায়ীতে পরিণত হন মীর কাসেম আলী। ব্যাংক, হাসপাতাল, কৃষি ব্যবসা, গণমাধ্যম, বিশ্ববিদ্যালয়, ওষুধশিল্পসহ বিভিন্ন খাতে বিস্তার করেন তার ব্যবসা। এসব ব্যবসা থেকে বিপুল আয়ের বড় একটি অংশ তিনি ব্যয় করতেন জামায়াতের রাজনীতির পেছনে, বিভিন্ন নামে গড়া ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে।
©somewhere in net ltd.