![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কাশিমপুর কারাগারে গতকাল শনিবার রাত সাড়ে ১০টায় যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
তানভীর আহমেদ, আজিজুর রহমান, ইমরান রহমান ও এম নজরুল ইসলাম কাশিমপুর কারাগার থেকে : রচিত হলো দায়মুক্তির আরেকটি অধ্যায়। তৈরি হলো জাতির স্বস্তি ও উল্লাসের আরেকটি উপলক্ষ। ফাঁসির রজ্জুতে ঝোলানো হলো আরেক কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীকে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ‘ডালিম হোটেলের জল্লাদ’ মীর কাসেম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দণ্ড কার্যকর করা হয় গতকাল শনিবার। রাত সাড়ে ১০টার দিকে জামায়াতে ইসলামির এই নেতাকে সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করা হয় বলে জানান কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) বিগ্রেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন আহমেদ। গত শুক্রবার দুপুরের পর মীর কাসেম আলী প্রাণভিক্ষা চাইবেন না বলে কারা প্রশাসনকে জানিয়ে দিলে আপিল বিভাগের দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকরের ক্ষণ গণনা শুরু হয়। পরে কাশিমপুর কারা কর্তৃপক্ষ সরকারি নির্দেশনা পেয়ে গতকাল ফাঁসি কার্যকর করেন। মীর কাসেম আলীর মৃতুদণ্ড কার্যকরের মধ্যদিয়ে এই প্রথম কাশিমপুর কারাগারে কোনো যুদ্ধাপরাধীর সাজা কার্যকর করা হলো। আর কাসেমের দণ্ড কার্যকরের খবরে স্বস্তি ও উল্লাস প্রকাশ করে গোটা জাতি।
মীর কাসেমের ফাঁসি কার্যকরের পদক্ষেপ হিসেবে কারা বিধি অনুযায়ী স্থানীয় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও সিভিল সার্জন এবং কারা মহাপরিদর্শকের কাছে অবহিতকরণ চিঠি পাঠায় কারা কর্তৃপক্ষ। একই চিঠি পাঠানো হয় মীর কাসেমের গ্রামের বাড়িতেও। লাল খামে ভরে গতকাল সকাল ১১টায় বিশেষ কারা বার্তা বাহকের মাধ্যমে চিঠিগুলো পাঠানো হয়। ৩ আগস্ট শুক্রবার দুপুরের পর মীর কাসেম আলী প্রাণভিক্ষা চাইবেন না বলে কারা প্রশাসনকে জানিয়ে দিলে জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকরের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন কারা কর্তৃপক্ষ। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এর জেলার নাশির আহমেদ জানান, শনিবার দুপুরের পর সরকারের আদেশ আমাদের কাছে পৌঁছে। পরে গতকাল রাত সাড়ে ৯টার দিকে কারাগারে প্রবেশ করেন গাজীপুর জেলা প্রশাসক এসএম আলম, জেলা পুলিশ সুপার হারুন-অর-রশিদ, জেলা সিভিল সার্জন আলী হায়দার, জেলা অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট রাহেনুল ইসলাম ও ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান। এর আগে সন্ধ্যা ৭টার পর মীর কাসেম আলীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে গোসল করানো হয়। পরে তাকে হালকা খাবার দেয়া হয়।
পরে মীর কাসেম আলীকে তওবা পড়ান কাশিমপুর কারাগার মসজিদের ইমাম হেলাল উদ্দীন। রাত সাড়ে ১০টার দিকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় তাকে। দড়িতে ২০ মিনিট ঝুলিয়ে রেখে লাশ নামানোর পর দুই পায়ের রগ কেটে দেয়া হয়। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর সেখানে তার লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া প্রহরায় রাত সাড়ে ১১টার দিকে তার লাশবাহী এম্বুলেন্স মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের চালা গ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়। সেখানে পৌঁছানোর পর জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হয় পারিবারিক কবরস্থানে। এর আগে কাশিমপুর কারাগারের জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক কারাফটকে সাংবাদিকদের বলেন, ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে তৈয়ব আলীর ছেলে মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে।
কারা সূত্র জানায়, মীর কাসেম আলীর ফাঁসির প্রধান জল্লাদের দায়িত্ব পালন করেন জল্লাদ শাজাহানের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি দল। শনিবার কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের দক্ষিণ পূর্ব কোণে ফাঁসির মঞ্চটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে মোম মাখানো দড়িতে আনুমানিক ওজনের বালির বস্তা বেঁধে প্রাথমিক মহরাও দেয়া হয়। ওইদিনই মীর কাসেম আলীর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেষ বারের মতো সাক্ষাতের জন্য তার পরিবারের সদস্যদের ডাকে কারা কর্তৃপক্ষ। পরে বিকেল ৩টা ৩৬ মিনিটে মীর কাসেম আলীর পরিবারের সদস্যসহ ৪৫ জন আত্মীয় ৬টি মাইক্রোবাসযোগে কাশিমপুর কারাগারে পৌঁছেন। তাদের মধ্যে ৩৮ জনকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয় বলে জানান জেলার নাসির আহমেদ। মীর কাসেমের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজনরা বিকেল ৪টা ১৫ মিনিট থেকে পৌনে ৬টা পর্যন্ত মীর কাসেম আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরে তার পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা সন্ধ্যা ৬টা ৩৭ মিনিটে কারাগার থেকে বের হন।
কারাগারের মূল ফটকের বাইরে মীর কাসেম আলীর স্ত্রী খন্দকার আয়েশা খাতুন সাংবাদিকদের জানান, মীর কাসেম আলী মৃত্যুকে ভয় পান না। শেষ মুহ‚র্তে তিনি তার ছেলেকে না পেয়ে আক্ষেপ করেছেন। ফাঁসি কার্যকরের পর সোয়া ১১টার দিকে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ফাঁসির রায় কার্যকরে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। রাত সাড়ে ১০টার দিকে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। সে সময় ২০ মিনিট ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল তাকে।
কড়া নিরাপত্তার চাদরে কাশিমপুর কারাগার এলাকা : এদিকে রায় কার্যকর করাকে কেন্দ্র করে গাজীপুরে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকাকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। গতকাল সন্ধ্যায় কারাগারের আশপাশে ও জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানান বাহিনীটির জনসংযোগ কর্মকর্তা মহসিন রেজা।
শনিবার সকাল থেকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ, ডিবি ও র্যাব সদস্যরা কাশিমপুর কারাগারের সড়কে এবং আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেয়। র্যাব ও পুলিশের সঙ্গে ছিল বিপুলসংখ্যক কমিউনিটি পুলিশ। বিকেল ৪টায় কারাগারের ভেতরে প্রবেশ করে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ি। পুলিশের জলকামান আগের রাতেই কারাগারের ভেতরে নিয়ে রাখা হয়েছিল। কারাগারের আরপি চেকপোস্ট সংলগ্ন দোকানপাট দুপুরেই বন্ধ করে দেয় পুলিশ।
গতকাল শনিবার গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ জানান, শুধু কাশিমপুর এলাকা নয়, পুরো গাজীপুর জেলা জুড়েই নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। এ জন্য টঙ্গী, স্টেশন রোড, বোর্ডবাজার, ভোগড়া বাইপাস মোড়, চান্দনা-চৌরাস্তা, গাজীপুর শহর, রাজেন্দ্রপুর, কোনাবাড়ি, চন্দ্রা এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এসব এলাকায় সর্বাত্মক সতর্কতা বজায় রাখার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়। রায়কে কেন্দ্র করে পুরো এলাকায় নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। কাশিমপুর কারাগারের সামনে মূল কারা ফটকে বাড়ানো হয় অতিরিক্ত কারারক্ষীর সংখ্যা। কারাগারে প্রবেশের প্রধান সড়কের সামনে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি ছিল। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক থেকে কারাগারের প্রধান ফটক পর্যন্ত সড়কের ৫টি স্থানে নিরাপত্তা চৌকি বসানো হয়। পুলিশের পাশাপাশি র্যাব সদস্যরা অবস্থান নেয় সেখানে।
৩১ আগস্ট বুধবার সকালে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় মীর কাসেম আলীকে পড়ে শোনান কারা কর্তৃপক্ষ। পূর্ণাঙ্গ রায় পরে শোনানোর পর মীর কাসেম আলী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইবেন কিনা কারা কর্তৃপক্ষ তা জানতে চান। পরে ১ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার আবারো প্রাণভিক্ষার বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষ জানতে চাইলে মীর কাসেম আলী সময় চান। এদিকে ৩১ আগস্ট বুধবার মীর কাসেম আলীর স্ত্রী খন্দকার আয়েশা খাতুন মীর কাসেম আলীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, মীর কাসেম আলীর দাবি, ২২দিন আগে সাদা পোশাকধারী লোকজন তাদের ছেলে ব্যারিস্টার আহম্মেদ বিন কাসেমকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গেছে। মার্সি পিটিশনের সিদ্ধান্তের আগে সরকারের কাছে তাদের নিখোঁজ ছেলেকে ফেরত চেয়েছেন মীর কাসেম আলী।
উল্লেখ্য, মীর কাসেম আলী হলেন জামায়াতের পঞ্চম শীর্ষ নেতা, চার দশক আগের অপরাধের কারণে যাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো। একাত্তরে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর ফাঁসিতে ঝোলানো হয় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লাকে। আর ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্র্যকর করেন কারা কর্তৃপক্ষ। তাদের দুজনের রিভিউ আবেদন একদিনের মধ্যে শুনানি শেষে খারিজ হয়ে গিয়েছিল। তারা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাননি বলে সরকারের পক্ষ থেকে সে সময় জানানো হয়, পরে তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। এর পর জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় একই দিনে গতবছর ২১ নভেম্বর। তারা প্রাণভিক্ষার আবেদন করলেও রাষ্ট্রপতি তা নাকচ করে দেন বলে সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়। মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে গত ১১ মে জামায়াত ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে মামলার শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ তাকে আখ্যায়িত করেছে পাকিস্তানের খান সেনাদের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হওয়া ‘বাঙালি খান’ হিসেবে।
©somewhere in net ltd.