![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলাদেশের সমাজের অভ্যন্তরে জঙ্গিবাদ যে গভীর শিকড় গ্রোথিত করেছে, তা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। গত দুই দশক ধরে আমরা জঙ্গিবাদের বিস্তৃতি ও এর ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কর্মক্ষমতা দেখে এসেছি। মাঝখানে বছর দুই-তিনেক সুপ্ত থাকার পর গত দুই-তিন বছর ধরে জঙ্গিবাদের যে বিস্তার আমরা প্রত্যক্ষ করছি, তাতে সমাজের প্রতিটি নাগরিক শঙ্কিত না হয়ে পারে না। গত বছর তথাকথিত ব্লগার বা মুক্তচিন্তার চর্চাকারীদের হত্যার মাধ্যমে যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল, তা পরবর্তীকালে সংখ্যালঘু ধর্মীয় উপাসনালয়, ধর্মযাজক, পুরোহিত ও সাধারণ বিদেশি নাগরিকদের ওপর হামলায় বিস্তৃত হতে দেখা গেছে। এসব ঘটনার যে একটি অভিন্ন যোগসূত্র রয়েছে, তা সাধারণ নাগরিকসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। কিন্তু সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বেশি কিছু দায়িত্বশীল কর্মকর্তা তখন এগুলোকে 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা' আখ্যা দিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। অতঃপর গত ১ জুলাই যখন গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় বাংলাদেশের ইতিহাসে নৃশংসতম জঙ্গি হামলা হলো, তখন আর জঙ্গিবাদের নবোত্থানকে অস্বীকার করার উপায় থাকল না।
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ মোকাবেলার ক্ষেত্রে হলি আর্টিসান হামলা একটি মোড় ঘোরানো ঘটনা বলে আমি মনে করি। এ ঘটনার মাধ্যমে আমরা দেখতে পেলাম যে, জঙ্গিবাদের বিস্তৃতি কেবল দরিদ্র পরিবারের অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত মাদ্রাসা-পড়ূয়াদের বেলায় প্রযোজ্য নয়। এই ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে সমাজের অত্যন্ত উঁচু মহলে, উচ্চবিত্ত পরিবারের ইংরেজি শিক্ষিত ছাত্র ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাত্রীদের মাঝেও। তাদের মধ্যে জঙ্গিবাদের ইন্ধনদাতা হিসেবে বেশকিছু শিক্ষক, ব্যবসায়ী এমনকি সামরিক বাহিনীর প্রাক্তন কর্মকর্তাদের ভূমিকার কথাও আমরা জানতে পেরেছি। জঙ্গিবাদের এ ধরনের বিস্তার স্বাভাবিকভাবেই সবাইকে ভাবিয়ে তুলবে যে, আমাদের আশু করণীয় কী? সরকার ও জনসাধারণের মিলিত প্রচেষ্টায় অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশেও আমাদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় যে উন্নতি ঘটে আসছে, যা কি-না সমগ্র বিশ্বের কাছে একটি নজির হিসেবে উপস্থাপিত হয়ে আসছে, জঙ্গিবাদের বিস্তারে তা কি চরম সংকটেই নিপতিত হবে? হলি আর্টিসান হামলার পর তার কিছু কিছু নমুনা আমরা দেখতেও পাচ্ছিলাম। বাংলাদেশে কর্মরত বিপুলসংখ্যক বিদেশি নাগরিক বা তাদের পরিবারের সদস্যদের এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে দেখেছি। ব্যবসা-বাণিজ্যেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে এমন আঘাত যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে, বলাই বাহুল্য।
আগে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা লক্ষ্য করলেও জুলাইয়ে হলি আর্টিসান হামলার পরবর্তী দিনগুলোতে আমরা জঙ্গিবাদবিরোধী তৎপরতায় সরকারকে দ্রুত, বলিষ্ঠ ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখেছি। সরকার প্রথমেই জঙ্গিবাদবিরোধী জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। ফলে গ্রামগঞ্জে, স্কুল-কলেজে-মাদ্রাসায়, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে_ বলা চলে সমাজের সর্বক্ষেত্রে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণা তৈরি হয়েছে। তারা জঙ্গিবাদকে নির্দি্বধায় প্রত্যাখ্যান করেছে। আমরা দেখেছি, ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে জঙ্গিবাদ ছড়ানোর বিরুদ্ধে আলেম সমাজও এগিয়ে এসেছে। জঙ্গিবাদ যে ইসলামবিরোধী সে সম্পর্কে একটি ফতোয়াও জারি করেন দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমরা। গোটা দেশের আলেম সমাজ তাতে স্বাক্ষর করেছে।
নাগরিকদের সঙ্গে যৌথভাবে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি সরকার জঙ্গিবাদ দমনে একটি বিশেষ বাহিনীও গঠন করেছে। তারা ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে অনেক জঙ্গিকে আটক করতে সক্ষম হয়েছে অথবা তাদের অভিযানের সময় বন্দুকযুদ্ধে জঙ্গিরা নিহত হচ্ছে। এর সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ শনিবার (৮ অক্টোবর) গাজীপুর ও টাঙ্গাইলের তিনটি স্থানে পৃথক অভিযানে ১২ জন জঙ্গি নিহত হওয়ার ঘটনা। বস্তুত জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অনেকটা 'প্রি-এম্পটিভ' অভিযান শুরু হয়েছিল গত ২৬ জুলাই কল্যাণপুরে অভিযানের মধ্য দিয়ে। সেখানে একসঙ্গে ৯ জঙ্গি নিহত ও একজন আহত অবস্থায় আটক হয়েছিল। তার পরের মাসে আগস্টের ২৭ তারিখ নারায়ণগঞ্জে অভিযান পরিচালিত হয়। কয়েকদিন পরে, সেপ্টেম্বরের শুরুতে মিরপুরের রূপনগরে এবং তার পরের সপ্তাহে আজিমপুরে অভিযানে কয়েকজন জঙ্গি নিহত ও কয়েকজন আটক হয়। হলি আর্টিসানে হামলার পর থেকে এখন পর্যন্ত সাতটি অভিযানে ২৫ জন জঙ্গি নিহত হয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে, এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জে নিহত হয়েছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক তামিম চৌধুরী। সে নব্য জেএমবির নেতা ছিল বলে জানা গেছে। আজিমপুরে নিহত হয়েছে সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর ও পরবর্তীকালে জঙ্গি দলে যোগ দেওয়া নব্য জেএমবির প্রশিক্ষক জাহিদুল ইসলাম ওরফে 'মেজর মুরাদ'। গাজীপুরে অভিযানে নিহত হয়েছে এই জঙ্গিগোষ্ঠীর ঢাকা অঞ্চলের সামরিক কমান্ডার 'আকাশ'। একই দিনে আশুলিয়ায় অভিযানের সময় পাঁচতলা থেকে লাফ দিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে মারা গেল নব্য জেএমবির অর্থ সমন্বয়ক আবদুর রহমান।
তামিম চৌধুরী নিহত হওয়ার পর জঙ্গিগোষ্ঠী নব্য জেএমবির নেতৃত্বে কে যাচ্ছে, এ নিয়ে নানা গুঞ্জন শুনেছি আমরা। গত তিন মাসের অভিযানে নেতৃস্থানীয় সবাই প্রায় নিহত হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, নব্য জঙ্গিবাদের আরেক মাস্টারমাইন্ড সেনাবাহিনী থেকে পলাতক মেজর জিয়া আইন-শৃৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারির মধ্যে রয়েছে। যে কোনো সময় তাকে আটক করা হতে পারে।
জঙ্গিবিরোধী অভিযানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাফল্যকে আমি সাধুবাদ জানাতে চাই। কিন্তু কথা হচ্ছে, আমরা যদি তরুণদের জঙ্গিবাদে ঝুঁকে পড়া ঠেকাতে না পারি, তাহলে শুধু অভিযান চালিয়ে দীর্ঘমেয়াদে সাফল্য আসবে না। এ ক্ষেত্রে অভিযান ও প্রচারণার পাশাপাশি জঙ্গিবাদবিরোধী কাউন্টার ন্যারেটিভস বা পাল্টা ভাষ্যও তৈরি করতে হবে। এ ভাষ্যের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে যে, তথাকথিত খেলাফত রাষ্ট্র এবং তা প্রতিষ্ঠার নামে যে তৎপরতা চালানো হচ্ছে, তা আদৌ ইসলাম স্বীকৃত পথ নয়। উপস্থাপন করতে হবে যে বহু মত, পথ ও ধর্মের সমন্বয়ে গঠিত আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে শান্তি ও প্রগতি প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
এর পাশাপাশি যেসব মাধ্যমে উগ্র ধর্মীয় মতবাদ ছড়ানো হচ্ছে, সেগুলোকে বন্ধ করে দিতে হবে। সরকার ইতিমধ্যে পিসটিভি নামক উগ্রবাদ ছড়ানো একটি বিদেশি টিভি চ্যানেল বাংলাদেশে প্রদর্শন বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের দেশের অভ্যন্তরেও রাজনীতি অথবা ধর্ম প্রচারের নামে যারা উগ্রবাদ ছড়ায়, সেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষাঙ্গনগুলোতে ধর্মীয় উগ্রবাদবিরোধী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর কথাও আমরা অনেকদিন ধরে বলে আসছি।
আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জানা মতে, দেশের বিভিন্ন কারাগারে কয়েক হাজার জঙ্গি বা জঙ্গি কার্যক্রমের সমর্থক বন্দি রয়েছে। এদের অবিলম্বে এক বা একাধিক বিশেষ কারাগারে স্থানান্তর করা প্রয়োজন। কারণ কারা অভ্যন্তরে এসব জঙ্গি তাদের মতাদর্শ প্রচারের বিরাট সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। এমনকি কারাগারে থেকেও তারা বিভিন্ন পর্যায়ে পয়সা ও প্রভাব খাটিয়ে বাইরে যোগাযোগ করছে_ এমন খবরও সংবাদমাধ্যমে এসেছে। সুতরাং সাধারণ কয়েদিদের কাছ থেকে তাদের আলাদা করার ব্যবস্থা করতেই হবে। দীর্ঘমেয়াদে জঙ্গিবাদবিরোধী লড়াইয়ে সাফল্য পেতে হলে এর বিকল্প নেই।
একই সঙ্গে আত্মঘাতী ও সমাজঘাতী উগ্রপন্থা থেকে জঙ্গিদের আদর্শিকভাবে সরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কারাবাসের পর তারা যাতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে এবং সুনাগরিক হিসেবে বাকি জীবন অতিবাহিত করতে পারে। অন্যথায় ফের জঙ্গিবাদে ঝুঁকে পড়ার ঝুঁকি থেকেই যাবে। জঙ্গিদের প্রায়োগিক দক্ষতা তৈরিতেও কর্তৃপক্ষ প্রশিক্ষণ এমনকি প্রাথমিক পুঁজিও দিতে পারে। যাতে করে তারা স্বাভাবিক জীবনে এসে সহজ জীবিকা নির্বাহ করতে সক্ষম হয়। কারাগারে থাকা অবস্থাতেই অভিভাবক, আত্মীয়, পরিবার-পরিজন, এমনকি প্রয়োজনে মনস্তত্ত্ববিদের সহায়তায় তাদের বোঝানো যেতে পারে; যাতে করে তাদের মানসিকতায় পরিবর্তন আসে। তারা বুঝতে সক্ষম হয় যে, মানুষ হত্যা করে কখনও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। ধর্মেও এ ব্যাপারে কড়া নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বস্তুত ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় এ ধরনের কর্মসূচি নিয়ে সাফল্য পাওয়া গেছে।
ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় আরেকটি কর্মসূচির সুদূরপ্রসারী সুফল পাওয়া গেছে। তা হচ্ছে, জঙ্গিবাদী বা জঙ্গিবাদ প্রচারকারী ব্যক্তিদের কারাগারের মধ্যেই ভ্রান্ত মতবাদ থেকে ফিরিয়ে এনে জঙ্গিবাদবিরোধী আদর্শে দীক্ষিত করা। এই কাজে আলেম সমাজ বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তাতে করে ওই জঙ্গিরা যদি কারাগারের বাইরে এসে জঙ্গিবাদবিরোধী বক্তব্য দেয়, তাহলে অন্যরা আর জঙ্গিবাদে ঝুঁকবে না। তাদের আগের বক্তব্যও আর অন্যদের প্রভাবিত করতে পারবে না।
আমরা জানি, জঙ্গিবাদ বাংলাদেশকে এখন এক ক্রান্তিলগ্নে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গিবাদ দমনে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়ে চলছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও তৈরি হয়েছে জঙ্গিবাদবিরোধী মানসিকতা। এমনকি নিহত জঙ্গিদের পিতামাতাও তাদের লাশ গ্রহণে আগ্রহী হচ্ছেন না। কবর হচ্ছে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে। এখন সময় এসেছে দীর্ঘমেয়াদে জঙ্গিবাদ নির্মূলে উদ্যোগী হওয়া এবং আরও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সুদৃঢ় মনোবল ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নিয়ে আমরা যদি জঙ্গিবাদ মোকাবেলা করতে পারি, তাহলে শান্তি ও প্রগতির পথে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে।
©somewhere in net ltd.