![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বিশেষ সাক্ষাৎকার
বরোনহিলডে ফুকস ও এরনসট গ্রাফট
বরোনহিলডে ফুকস ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত অস্ট্রিয়া ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্য ছিলেন। ফেডারেল পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষেরও সদস্য ছিলেন তিনি। জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৭ মার্চ, ভিয়েনায়। লেখাপড়া শেষ করে ১৯৬৩ সালে অস্ট্রিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির যুব ও ক্রীড়া বিভাগে যোগ দেন। এরপর অস্ট্রিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি অস্ট্রিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির একজন শীর্ষ নেতা। এরনসট গ্রাফট গত ৫০ বছর অস্ট্রিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। জন্ম ১৯৪৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, ভিয়েনায়। ভিয়েনা চেম্বার অব কমার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। ভিয়েনিজ কমার্স পার্লামেন্টের সদস্য এরনসট গ্রাফট অস্ট্রিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির অর্থনৈতিক বিভাগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন অস্ট্রিয়ার এই দুই রাজনৈতিক নেতা। ঢাকা থেকে ভিয়েনায় ফিরে তাঁরা বলেছেন তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা। উভয়েই জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে যে ধারণা নিয়ে তাঁরা গিয়েছিলেন, অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ অচিরেই বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে,
বাংলাদেশ সফরের পর তাঁদের এ ধারণা এখন বদ্ধমূল। কালের কণ্ঠ’র পক্ষে ভিয়েনায় বরোনহিলডে ফুকস ও এরনসট গ্রাফটের সাক্ষাত্কার নিয়েছেন তাঁদের সফরসঙ্গী অস্ট্রিয়াপ্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক এম নজরুল ইসলাম
কালের কণ্ঠ : আপনারা দুজনই এই প্রথম বাংলাদেশ সফর করলেন। বাংলাদেশে পা রাখার অনুভূতি কী আপনাদের?
বরোনহিলডে ফুকস : আমি বিশ্বের বহু দেশে গেছি। বাংলাদেশের পাশের দেশ চীন ও ভারতের অবস্থাও নিজের চোখে দেখেছি। ভারতে ঘরবাড়ি, কাপড়, খাবার নেই এমন অসংখ্য মানুষ দেখেছি। অনেক মানুষ রাস্তায় ঘুমায়। বাংলাদেশের ব্যাপারে আমার দীর্ঘদিনের আগ্রহ ছিল। ১৯৭১ সালে দেশটি যখন স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে তখন অস্ট্রিয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করেছে। আমাদের তৎকালীন চ্যান্সেলর ব্রুনো ক্রিয়েস্কি এ জন্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। যুদ্ধ করে নিজের দেশ স্বাধীন করেছে যে দেশটি, সেই দেশ দেখার ও দেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ ছিল আমার। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সে সুযোগটি করে দিয়েছে তাদের জাতীয় সম্মেলনে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমি চার দিন সেখানে ছিলাম। দিনগুলো ভালো কেটেছে। জাতীয় সম্মেলনস্থলে গেছি। মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। আমার অভিজ্ঞতা ভালো। আর আতিথেয়তা? কী বলব! আজীবন মনে থাকবে বাংলাদেশের আতিথেয়তা। আমার মনে হচ্ছে, এরনসট গ্রাফট কিছু বলতে চান। তাঁকে একটু সুযোগ দেওয়া যাক।
এরনসট গ্রাফট : আমিও আগ্রহী ছিলাম বাংলাদেশ সম্পর্কে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধই আমাকে বাংলাদেশ সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলে। বিশেষ করে আমাদের তৎকালীন চ্যান্সেলর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করেছিলেন। আমি এ দেশের মানুষ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিলাম। আপনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ পেয়ে আমিও ভীষণ উত্তেজিত ছিলাম। বিমানে আমাদের দীর্ঘ যাত্রায় আলোচনার বিষয় ছিল বাংলাদেশ। আমরা কল্পনা করতে চেষ্টা করেছি বাংলাদেশ কেমন দেশ। কেমন সে দেশের মানুষ। আরো অনেক বিষয় নিয়ে আমরা বিমানে কথা বলেছি। আমাদের আগ্রহ ছিল আওয়ামী লীগ নিয়েও। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দলটি নেতৃত্ব দিয়েছে, শুনেছি। সেই দলের জাতীয় সম্মেলনে আমন্ত্রণ পাওয়া তো সৌভাগ্যের বিষয়। আমি এই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হতে চাইনি। আতিথেয়তার কথা তো না বললেই নয়। এক কথায় অসাধারণ। মনে রাখার মতো।
কালের কণ্ঠ : প্রথম দর্শনে কেমন লাগল বাংলাদেশ?
বরোনহিলডে ফুকস : বাংলাদেশের উদ্দেশে ভিয়েনা থেকে আমরা যাত্রা করি ২০ অক্টোবর সকালে। সত্যিকথা বলতে কি, বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা নিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু হয়। অন্তত আমার। আমাদের দুজনেরই ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আছে। বিমানে আসন গ্রহণ করে আমি এরনসট গ্রাফটকে বলেছি বাংলাদেশে ভারতের চেয়ে গরিব মানুষ অনেক বেশি দেখতে হবে। কে জানে, হয়তো এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার পথে ভিখিরিরা হাত পাতবে। আমার ধারণা ছিল বাংলাদেশে এসে দেখব, ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি, এবড়োখেবড়ো রাস্তাঘাট। কিন্তু এয়ারপোর্টে নামার পর আমার ধারণা পাল্টে গেল। যে ধারণা নিয়ে রওনা হয়েছিলাম, তা একেবারেই ভুল প্রমাণিত হলো। বলতে গেলে প্রথম দর্শনেই আমি মুগ্ধ। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে যাওয়ার পথে তেমন কোনো দৃশ্য দেখিনি, যা আমাকে বিব্রত করে। রাস্তায় যানজট আছে। এতে তো প্রমাণিত হয়, মানুষের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য আছে। মানুষ বের হচ্ছে। কাজ করছে। অবকাঠামো ভালো লেগেছে। মানুষের ভিড় আমার খারাপ লাগে না। কিন্তু বাংলাদেশে গিয়ে ঘরবাড়ি, কাপড়, খাবার নেই এমন মানুষ চোখে পড়েনি।
কালের কণ্ঠ : এরনসট গ্রাফট, এবার আপনার অভিজ্ঞতার কথা শুনি।
এরনসট গ্রাফট : আমার অভিজ্ঞতাও ঠিক একই। আমিও তো নেতিবাচক ধারণা নিয়েই বিমানে উঠেছিলাম। প্রথম দর্শনেই ধারণা পাল্টে যেতে পারে, এ ছিল আমার কাছে অবাক করার মতো ঘটনা। আমি সত্যি অভিভূত। আমি আরো যা কিছু বলতে পারতাম তা বরোনহিলডে ফুকস বলে দিয়েছেন। নতুন করে কিছু যোগ করার নেই। বাংলাদেশে না এলে এ দেশ সম্পর্কে আমার ভুল ধারণা থেকে যেত। আমার ভুল ভেঙেছে। এখন বাংলাদেশ সম্পর্কে কেউ নেতিবাচক কথা বললে আমি তার প্রতিবাদ করতে পারব। বাংলাদেশে যেতে পেরে আমি সত্যি খুব আনন্দিত। আমার এখানকার বন্ধুদের কাছে আমি বাংলাদেশ সফরের গল্প বলেছি। বাংলাদেশের কথা শুনে তারাও রোমাঞ্চিত। বাংলাদেশে না এলে অনেক কিছুই আমার অজানা থেকে যেত।
কালের কণ্ঠ : আপনারা ঢাকায় গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সম্মেলনে যোগ দিতে। সম্মেলন সম্পর্কে আপনাদের অভিজ্ঞতা নিশ্চয় আমরা শেয়ার করতে পারি?
বরোনহিলডে ফুকস : অবশ্যই। এ এক অন্য অভিজ্ঞতা। সত্যি বলতে কি, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সম্পর্কেও আমার খুব বেশি কিছু ধারণা ছিল না। দলটি পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী। স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে জানি। দলটি ক্ষমতায় আছে। কাজেই দলটির নেতাকর্মী-সমর্থক অনেক বেশি থাকবে, তা স্বাভাবিক। কিন্তু এ সম্মেলন ঘিরে তাদের যে আবেগ আমি দেখেছি, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এমন অভিজ্ঞতা আমার নেই। এত বড় একটি জায়গায় একটি দলের জাতীয় সম্মেলন হচ্ছে, সেখানে তৃণমূল পর্যায় থেকে নেতাকর্মী-সমর্থকরা আসবেন। কারা ডেলিগেট হবেন, কারা কাউন্সিলর হবেন, এটা তো আগে থেকেই নির্ধারণ করা ছিল। কিন্তু বাইরেও উত্সুক অনেক মুখ আমি দেখেছি। অনেকের সঙ্গে আমার কথাও হয়েছে। আমি তাদের আবেগ বুঝতে চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয়েছে, নেতাকর্মী-সমর্থকদের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দলটি।
কালের কণ্ঠ : আওয়ামী লীগের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পর আপনার অনুভূতি কী, এরনসট গ্রাফট?
এরনসট গ্রাফট : আমারও তেমনই মনে হয়েছে। যে দল মানুষের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে যায়, সেই দলের পক্ষেই মানুষের জন্য কিছু করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। আমিও অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। সম্মেলনস্থলের বাইরে অনেক মানুষ ছিল। ভেতরে কী হচ্ছে, তা জানার আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল তারা। আর সম্মেলনের কথা কী বলব, লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে এমন সুশৃঙ্খল একটি সম্মেলন যে করা যায়, তা-ও দুই দিন ধরে, আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে উপস্থিত না থাকলে তা আমি উপলব্ধি করতে পারতাম না। এটা আমার ধারণার অতীত। আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমি তো মনে করি, আমাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : আপনারা ক্ষমতাসীন দলের আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন। অনেক কিছুই হয়তো আপনাদের চোখ এড়িয়ে গেছে। এমন তো হতেই পারে?
বরোনহিলডে ফুকস : স্বাভাবিক। খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরাও তো রাজনীতি করি। একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দীর্ঘদিন সংশ্লিষ্ট আমরা। আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে নির্দিষ্ট ঘেরাটোপের মধ্যে আমাদের থাকার কথা। কিন্তু জানার চেষ্টা করলে জানা যাবে না, তা নয়। কিছু বিষয় উল্লেখ করি। বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদীরা প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, বুদ্ধিজীবীদের ওপর আক্রমণ করেছে, অনেককে হত্যাও করেছে। ধর্মান্ধদের এই যে হিংস্রতা, সত্যি খুব দুঃখজনক। এসব খবর যে আমাদের অজানা, তা নয়। সরকার এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ নিয়েছে বা নিচ্ছে, তা খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি আমি। যত দূর জেনেছি, আমার কাছে মনে হয়েছে, সরকার জঙ্গি-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিহত করতে যথাযথ পদক্ষেপই নিয়েছে। প্রশ্ন করা যেতে পারে, মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশকে আজ কারা এমন অসহিষ্ণু করে তুলছে? প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে গেছি আমি। থেকেছি অল্প দিন। তার পরও আমার মনে হয়েছে, সেখানে প্রতিক্রিয়াশীল একটি গোষ্ঠী আছে। উদারনৈতিক বাংলাদেশ তারা চায় না। বিরুদ্ধবাদীরা সুযোগটি নিচ্ছে কি না, তা আমি বলতে পারব না। নিলেও তো নিতে পারে।
কালের কণ্ঠ : বরোনহিলডে ফুকসের এই বক্তব্য আপনি কিভাবে দেখছেন?
এরনসট গ্রাফট : এ বক্তব্যের সঙ্গে আমিও একমত। স্বাধীনতার পর থেকেই তো বিরুদ্ধবাদীরা তত্পর। ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশের মহান স্থপতিকে হত্যা করা হয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। একটি পক্ষের স্বার্থে তো আঘাত লেগেছে। তারা অস্থিরতা সৃষ্টি করবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তৃতীয় বিশ্বের দেশে এটাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কী করছে? সরকার কি যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পেরেছে? সরকার কি ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করতে পারছে? সরকারের পদক্ষেপ কি সাহসী? এসব প্রশ্নের উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে বলতে হবে আশান্বিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। সরকার যদি জনগণের আবেগ বুঝতে পারে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারে, তাহলে যেকোনো দেশের অগ্রগতি হবে। কোনো অপশক্তিই তা বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। আমি তো মনে করি, সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশ সরকার যে ব্যবস্থা নিয়েছে তা যথাযথ।
কালের কণ্ঠ : ইতিবাচক আর কোন দিক আপনাদের চোখে পড়েছে?
বরোনহিলডে ফুকস : আমার কাছে মনে হয়েছে দারিদ্র্য দূরীকরণে এ সরকারের ভূমিকা প্রশংসনীয়। বিশ্বমন্দার সময়ও বাংলাদেশের সমৃদ্ধি থেমে ছিল না। দারিদ্র্য দূর করতে নিজেদের মতো করে ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ। উন্নয়নের মডেল হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় বলে আমি মনে করি। একটি দেশে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা, জাতীয় সংসদের স্পিকার, মন্ত্রিসভার অনেক সদস্য, জাতীয় সংসদ সদস্য, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রাজনৈতিক দলের নেতা, সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার উচ্চপদে নারীর অবস্থান—বিশ্বে এটা বড় উদাহরণ বলে আমার ধারণা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে শুধু সক্রিয় রাজনীতিতে নন, নানা পেশায় নারীদের যুক্ত করার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। এ জন্য তিনি নিজেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছেন।
কালের কণ্ঠ : এরনসট গ্রাফট কি কিছু যোগ করতে চান?
এরনসট গ্রাফট : আমার কাছে মনে হয়েছে, তথ্য-প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। আমি মানুষের হাতে হাতে মোবাইল ফোন দেখেছি। মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিংবা পথ চলতে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। বাংলাদেশে না এলে আমি তো এ দৃশ্য দেখতে পেতাম না। এ দেশ সম্পর্কে অনেক কিছুই আমার অজানা থেকে যেত।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশ আগামী দিনে আরো এগিয়ে যাবে। আপনারা দুজনই উন্নত দেশের রাজনৈতিক নেতা। সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন। দীর্ঘ মেয়াদে উন্নয়ন করতে আমাদের আর কী করা উচিত?
বরোনহিলডে ফুকস : আমি আমার ধারণার কথা বলি। এরনসট গ্রাফট নিশ্চয় তাঁর মূল্যায়ন করবেন। আমি মনে করি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে এ দেশের আরো অনেক কিছু করার আছে। আমার দেশ অস্ট্রিয়ার কথা যদি ধরি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অস্ট্রিয়া আজ যে অবস্থানে আছে, সে অবস্থানে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়েও কাজ করা যেতে পারে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য হচ্ছে যেকোনো জাতির বুনিয়াদ। এই ভিত্তি শক্ত করতে না পারলে সব উন্নয়ন ব্যর্থ হয়ে যাবে। ধরে রাখা যাবে না। সরকারের উচিত হবে, এই দুই সেবা খাতে আরো বেশি করে দৃষ্টি দেওয়া।
এরনসট গ্রাফট : অর্থনীতি ও বাণিজ্যের মানুষ হিসেবে আমি এদিকে দৃষ্টি দিতে পারি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে দলনেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশের সমপর্যায়ে পৌঁছবে। আমি উন্নয়নের যে গতি দেখলাম, তাতে আমার মনে হয়েছে, ২০৪১ সাল নয়, অনেক আগেই উন্নত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ স্থান করে নিতে পারবে। শর্ত হচ্ছে এই গতি আরো ত্বরান্বিত করতে হবে, বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। তার সঙ্গে শিক্ষার বিষয়টি তো থাকছেই। তবে খেয়াল রাখতে হবে, সামাজিক গঠন যেন ভেঙে না যায়। সমাজ ভেঙে গেলে অনেক বড় উন্নয়নও মুখ থুবড়ে পড়ে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে। এ ধারা ধরে রাখতে হলে নিজস্ব সম্পদের বেশি বেশি ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও তো দেখা হয়েছে আপনাদের। কথাও হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে কি কিছু বলতে চান?
বরোনহিলডে ফুকস : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ প্রগতিশীল নেতৃত্বের কথা আগে শুনেছি। ঢাকায় যাওয়ার আগে আপনিও তাঁর সম্পর্কে বলেছেন। এবার ঢাকায় গিয়ে সামনাসামনি তাঁকে দেখেছি। তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে আমার। দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে আগামী দিনে তাঁর সরকার কী করবে সেসব পরিকল্পনা তিনি আমাদের জানিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা অগাধ। দেশের মানুষকে তিনি সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে থাকেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে গর্ব করেন।
কালের কণ্ঠ : এরনসট গ্রাফট, আপনার কী মনে হয়?
এরনসট গ্রাফট : আমি তো মনে করি, শেখ হাসিনার মতো বিজ্ঞ, দৃঢ়চেতা, দূরদর্শী নেতা পেয়ে বাংলাদেশের মানুষের গর্বিত হওয়া উচিত। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ সমৃদ্ধির লক্ষ্যে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে। এখন দেশকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশের মানুষের।
কালের কণ্ঠ : আপনারা দুজনই ব্যস্ত মানুষ। এর পরও আমাদের সময় দিয়েছেন। এ জন্য আপনাদের ধন্যবাদ।
বরোনহিলডে ফুকস : আপনি আমাদের বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতার কথা জানতে চেয়েছেন। এ জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আবারও বলি, বাংলাদেশের আতিথেয়তার কথা আমাদের অনেক দিন মনে থাকবে।
এরনসট গ্রাফট : চমৎকার কয়েকটি দিন কেটেছে আমাদের। এই সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পেরে ভালো লাগছে।
বরোনহিলডে ফুকস ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত অস্ট্রিয়া ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্য ছিলেন। ফেডারেল পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষেরও সদস্য ছিলেন তিনি। জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৭ মার্চ, ভিয়েনায়। লেখাপড়া শেষ করে ১৯৬৩ সালে অস্ট্রিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির যুব ও ক্রীড়া বিভাগে যোগ দেন। এরপর অস্ট্রিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি অস্ট্রিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির একজন শীর্ষ নেতা। এরনসট গ্রাফট গত ৫০ বছর অস্ট্রিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। জন্ম ১৯৪৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, ভিয়েনায়। ভিয়েনা চেম্বার অব কমার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। ভিয়েনিজ কমার্স পার্লামেন্টের সদস্য এরনসট গ্রাফট অস্ট্রিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির অর্থনৈতিক বিভাগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন অস্ট্রিয়ার এই দুই রাজনৈতিক নেতা। ঢাকা থেকে ভিয়েনায় ফিরে তাঁরা বলেছেন তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা। উভয়েই জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে যে ধারণা নিয়ে তাঁরা গিয়েছিলেন, অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ অচিরেই বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে,
বাংলাদেশ সফরের পর তাঁদের এ ধারণা এখন বদ্ধমূল। কালের কণ্ঠ’র পক্ষে ভিয়েনায় বরোনহিলডে ফুকস ও এরনসট গ্রাফটের সাক্ষাত্কার নিয়েছেন তাঁদের সফরসঙ্গী অস্ট্রিয়াপ্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক এম নজরুল ইসলাম
কালের কণ্ঠ : আপনারা দুজনই এই প্রথম বাংলাদেশ সফর করলেন। বাংলাদেশে পা রাখার অনুভূতি কী আপনাদের?
বরোনহিলডে ফুকস : আমি বিশ্বের বহু দেশে গেছি। বাংলাদেশের পাশের দেশ চীন ও ভারতের অবস্থাও নিজের চোখে দেখেছি। ভারতে ঘরবাড়ি, কাপড়, খাবার নেই এমন অসংখ্য মানুষ দেখেছি। অনেক মানুষ রাস্তায় ঘুমায়। বাংলাদেশের ব্যাপারে আমার দীর্ঘদিনের আগ্রহ ছিল। ১৯৭১ সালে দেশটি যখন স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে তখন অস্ট্রিয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করেছে। আমাদের তৎকালীন চ্যান্সেলর ব্রুনো ক্রিয়েস্কি এ জন্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। যুদ্ধ করে নিজের দেশ স্বাধীন করেছে যে দেশটি, সেই দেশ দেখার ও দেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ ছিল আমার। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সে সুযোগটি করে দিয়েছে তাদের জাতীয় সম্মেলনে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমি চার দিন সেখানে ছিলাম। দিনগুলো ভালো কেটেছে। জাতীয় সম্মেলনস্থলে গেছি। মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। আমার অভিজ্ঞতা ভালো। আর আতিথেয়তা? কী বলব! আজীবন মনে থাকবে বাংলাদেশের আতিথেয়তা। আমার মনে হচ্ছে, এরনসট গ্রাফট কিছু বলতে চান। তাঁকে একটু সুযোগ দেওয়া যাক।
এরনসট গ্রাফট : আমিও আগ্রহী ছিলাম বাংলাদেশ সম্পর্কে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধই আমাকে বাংলাদেশ সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলে। বিশেষ করে আমাদের তৎকালীন চ্যান্সেলর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করেছিলেন। আমি এ দেশের মানুষ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিলাম। আপনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ পেয়ে আমিও ভীষণ উত্তেজিত ছিলাম। বিমানে আমাদের দীর্ঘ যাত্রায় আলোচনার বিষয় ছিল বাংলাদেশ। আমরা কল্পনা করতে চেষ্টা করেছি বাংলাদেশ কেমন দেশ। কেমন সে দেশের মানুষ। আরো অনেক বিষয় নিয়ে আমরা বিমানে কথা বলেছি। আমাদের আগ্রহ ছিল আওয়ামী লীগ নিয়েও। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দলটি নেতৃত্ব দিয়েছে, শুনেছি। সেই দলের জাতীয় সম্মেলনে আমন্ত্রণ পাওয়া তো সৌভাগ্যের বিষয়। আমি এই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হতে চাইনি। আতিথেয়তার কথা তো না বললেই নয়। এক কথায় অসাধারণ। মনে রাখার মতো।
কালের কণ্ঠ : প্রথম দর্শনে কেমন লাগল বাংলাদেশ?
বরোনহিলডে ফুকস : বাংলাদেশের উদ্দেশে ভিয়েনা থেকে আমরা যাত্রা করি ২০ অক্টোবর সকালে। সত্যিকথা বলতে কি, বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা নিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু হয়। অন্তত আমার। আমাদের দুজনেরই ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আছে। বিমানে আসন গ্রহণ করে আমি এরনসট গ্রাফটকে বলেছি বাংলাদেশে ভারতের চেয়ে গরিব মানুষ অনেক বেশি দেখতে হবে। কে জানে, হয়তো এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার পথে ভিখিরিরা হাত পাতবে। আমার ধারণা ছিল বাংলাদেশে এসে দেখব, ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি, এবড়োখেবড়ো রাস্তাঘাট। কিন্তু এয়ারপোর্টে নামার পর আমার ধারণা পাল্টে গেল। যে ধারণা নিয়ে রওনা হয়েছিলাম, তা একেবারেই ভুল প্রমাণিত হলো। বলতে গেলে প্রথম দর্শনেই আমি মুগ্ধ। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে যাওয়ার পথে তেমন কোনো দৃশ্য দেখিনি, যা আমাকে বিব্রত করে। রাস্তায় যানজট আছে। এতে তো প্রমাণিত হয়, মানুষের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য আছে। মানুষ বের হচ্ছে। কাজ করছে। অবকাঠামো ভালো লেগেছে। মানুষের ভিড় আমার খারাপ লাগে না। কিন্তু বাংলাদেশে গিয়ে ঘরবাড়ি, কাপড়, খাবার নেই এমন মানুষ চোখে পড়েনি।
কালের কণ্ঠ : এরনসট গ্রাফট, এবার আপনার অভিজ্ঞতার কথা শুনি।
এরনসট গ্রাফট : আমার অভিজ্ঞতাও ঠিক একই। আমিও তো নেতিবাচক ধারণা নিয়েই বিমানে উঠেছিলাম। প্রথম দর্শনেই ধারণা পাল্টে যেতে পারে, এ ছিল আমার কাছে অবাক করার মতো ঘটনা। আমি সত্যি অভিভূত। আমি আরো যা কিছু বলতে পারতাম তা বরোনহিলডে ফুকস বলে দিয়েছেন। নতুন করে কিছু যোগ করার নেই। বাংলাদেশে না এলে এ দেশ সম্পর্কে আমার ভুল ধারণা থেকে যেত। আমার ভুল ভেঙেছে। এখন বাংলাদেশ সম্পর্কে কেউ নেতিবাচক কথা বললে আমি তার প্রতিবাদ করতে পারব। বাংলাদেশে যেতে পেরে আমি সত্যি খুব আনন্দিত। আমার এখানকার বন্ধুদের কাছে আমি বাংলাদেশ সফরের গল্প বলেছি। বাংলাদেশের কথা শুনে তারাও রোমাঞ্চিত। বাংলাদেশে না এলে অনেক কিছুই আমার অজানা থেকে যেত।
কালের কণ্ঠ : আপনারা ঢাকায় গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সম্মেলনে যোগ দিতে। সম্মেলন সম্পর্কে আপনাদের অভিজ্ঞতা নিশ্চয় আমরা শেয়ার করতে পারি?
বরোনহিলডে ফুকস : অবশ্যই। এ এক অন্য অভিজ্ঞতা। সত্যি বলতে কি, রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সম্পর্কেও আমার খুব বেশি কিছু ধারণা ছিল না। দলটি পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী। স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে জানি। দলটি ক্ষমতায় আছে। কাজেই দলটির নেতাকর্মী-সমর্থক অনেক বেশি থাকবে, তা স্বাভাবিক। কিন্তু এ সম্মেলন ঘিরে তাদের যে আবেগ আমি দেখেছি, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এমন অভিজ্ঞতা আমার নেই। এত বড় একটি জায়গায় একটি দলের জাতীয় সম্মেলন হচ্ছে, সেখানে তৃণমূল পর্যায় থেকে নেতাকর্মী-সমর্থকরা আসবেন। কারা ডেলিগেট হবেন, কারা কাউন্সিলর হবেন, এটা তো আগে থেকেই নির্ধারণ করা ছিল। কিন্তু বাইরেও উত্সুক অনেক মুখ আমি দেখেছি। অনেকের সঙ্গে আমার কথাও হয়েছে। আমি তাদের আবেগ বুঝতে চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয়েছে, নেতাকর্মী-সমর্থকদের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দলটি।
কালের কণ্ঠ : আওয়ামী লীগের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পর আপনার অনুভূতি কী, এরনসট গ্রাফট?
এরনসট গ্রাফট : আমারও তেমনই মনে হয়েছে। যে দল মানুষের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে যায়, সেই দলের পক্ষেই মানুষের জন্য কিছু করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। আমিও অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। সম্মেলনস্থলের বাইরে অনেক মানুষ ছিল। ভেতরে কী হচ্ছে, তা জানার আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল তারা। আর সম্মেলনের কথা কী বলব, লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে এমন সুশৃঙ্খল একটি সম্মেলন যে করা যায়, তা-ও দুই দিন ধরে, আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে উপস্থিত না থাকলে তা আমি উপলব্ধি করতে পারতাম না। এটা আমার ধারণার অতীত। আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমি তো মনে করি, আমাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : আপনারা ক্ষমতাসীন দলের আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন। অনেক কিছুই হয়তো আপনাদের চোখ এড়িয়ে গেছে। এমন তো হতেই পারে?
বরোনহিলডে ফুকস : স্বাভাবিক। খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরাও তো রাজনীতি করি। একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দীর্ঘদিন সংশ্লিষ্ট আমরা। আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে নির্দিষ্ট ঘেরাটোপের মধ্যে আমাদের থাকার কথা। কিন্তু জানার চেষ্টা করলে জানা যাবে না, তা নয়। কিছু বিষয় উল্লেখ করি। বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদীরা প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, বুদ্ধিজীবীদের ওপর আক্রমণ করেছে, অনেককে হত্যাও করেছে। ধর্মান্ধদের এই যে হিংস্রতা, সত্যি খুব দুঃখজনক। এসব খবর যে আমাদের অজানা, তা নয়। সরকার এ বিষয়ে কী পদক্ষেপ নিয়েছে বা নিচ্ছে, তা খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি আমি। যত দূর জেনেছি, আমার কাছে মনে হয়েছে, সরকার জঙ্গি-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিহত করতে যথাযথ পদক্ষেপই নিয়েছে। প্রশ্ন করা যেতে পারে, মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশকে আজ কারা এমন অসহিষ্ণু করে তুলছে? প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে গেছি আমি। থেকেছি অল্প দিন। তার পরও আমার মনে হয়েছে, সেখানে প্রতিক্রিয়াশীল একটি গোষ্ঠী আছে। উদারনৈতিক বাংলাদেশ তারা চায় না। বিরুদ্ধবাদীরা সুযোগটি নিচ্ছে কি না, তা আমি বলতে পারব না। নিলেও তো নিতে পারে।
কালের কণ্ঠ : বরোনহিলডে ফুকসের এই বক্তব্য আপনি কিভাবে দেখছেন?
এরনসট গ্রাফট : এ বক্তব্যের সঙ্গে আমিও একমত। স্বাধীনতার পর থেকেই তো বিরুদ্ধবাদীরা তত্পর। ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশের মহান স্থপতিকে হত্যা করা হয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। একটি পক্ষের স্বার্থে তো আঘাত লেগেছে। তারা অস্থিরতা সৃষ্টি করবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তৃতীয় বিশ্বের দেশে এটাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কী করছে? সরকার কি যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পেরেছে? সরকার কি ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করতে পারছে? সরকারের পদক্ষেপ কি সাহসী? এসব প্রশ্নের উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে বলতে হবে আশান্বিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। সরকার যদি জনগণের আবেগ বুঝতে পারে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারে, তাহলে যেকোনো দেশের অগ্রগতি হবে। কোনো অপশক্তিই তা বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। আমি তো মনে করি, সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশ সরকার যে ব্যবস্থা নিয়েছে তা যথাযথ।
কালের কণ্ঠ : ইতিবাচক আর কোন দিক আপনাদের চোখে পড়েছে?
বরোনহিলডে ফুকস : আমার কাছে মনে হয়েছে দারিদ্র্য দূরীকরণে এ সরকারের ভূমিকা প্রশংসনীয়। বিশ্বমন্দার সময়ও বাংলাদেশের সমৃদ্ধি থেমে ছিল না। দারিদ্র্য দূর করতে নিজেদের মতো করে ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ। উন্নয়নের মডেল হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় বলে আমি মনে করি। একটি দেশে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা, জাতীয় সংসদের স্পিকার, মন্ত্রিসভার অনেক সদস্য, জাতীয় সংসদ সদস্য, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রাজনৈতিক দলের নেতা, সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার উচ্চপদে নারীর অবস্থান—বিশ্বে এটা বড় উদাহরণ বলে আমার ধারণা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে শুধু সক্রিয় রাজনীতিতে নন, নানা পেশায় নারীদের যুক্ত করার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। এ জন্য তিনি নিজেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছেন।
কালের কণ্ঠ : এরনসট গ্রাফট কি কিছু যোগ করতে চান?
এরনসট গ্রাফট : আমার কাছে মনে হয়েছে, তথ্য-প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। আমি মানুষের হাতে হাতে মোবাইল ফোন দেখেছি। মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিংবা পথ চলতে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। বাংলাদেশে না এলে আমি তো এ দৃশ্য দেখতে পেতাম না। এ দেশ সম্পর্কে অনেক কিছুই আমার অজানা থেকে যেত।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশ আগামী দিনে আরো এগিয়ে যাবে। আপনারা দুজনই উন্নত দেশের রাজনৈতিক নেতা। সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন। দীর্ঘ মেয়াদে উন্নয়ন করতে আমাদের আর কী করা উচিত?
বরোনহিলডে ফুকস : আমি আমার ধারণার কথা বলি। এরনসট গ্রাফট নিশ্চয় তাঁর মূল্যায়ন করবেন। আমি মনে করি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে এ দেশের আরো অনেক কিছু করার আছে। আমার দেশ অস্ট্রিয়ার কথা যদি ধরি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অস্ট্রিয়া আজ যে অবস্থানে আছে, সে অবস্থানে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়েও কাজ করা যেতে পারে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য হচ্ছে যেকোনো জাতির বুনিয়াদ। এই ভিত্তি শক্ত করতে না পারলে সব উন্নয়ন ব্যর্থ হয়ে যাবে। ধরে রাখা যাবে না। সরকারের উচিত হবে, এই দুই সেবা খাতে আরো বেশি করে দৃষ্টি দেওয়া।
এরনসট গ্রাফট : অর্থনীতি ও বাণিজ্যের মানুষ হিসেবে আমি এদিকে দৃষ্টি দিতে পারি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে দলনেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশের সমপর্যায়ে পৌঁছবে। আমি উন্নয়নের যে গতি দেখলাম, তাতে আমার মনে হয়েছে, ২০৪১ সাল নয়, অনেক আগেই উন্নত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ স্থান করে নিতে পারবে। শর্ত হচ্ছে এই গতি আরো ত্বরান্বিত করতে হবে, বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। তার সঙ্গে শিক্ষার বিষয়টি তো থাকছেই। তবে খেয়াল রাখতে হবে, সামাজিক গঠন যেন ভেঙে না যায়। সমাজ ভেঙে গেলে অনেক বড় উন্নয়নও মুখ থুবড়ে পড়ে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে। এ ধারা ধরে রাখতে হলে নিজস্ব সম্পদের বেশি বেশি ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও তো দেখা হয়েছে আপনাদের। কথাও হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে কি কিছু বলতে চান?
বরোনহিলডে ফুকস : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ প্রগতিশীল নেতৃত্বের কথা আগে শুনেছি। ঢাকায় যাওয়ার আগে আপনিও তাঁর সম্পর্কে বলেছেন। এবার ঢাকায় গিয়ে সামনাসামনি তাঁকে দেখেছি। তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে আমার। দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে আগামী দিনে তাঁর সরকার কী করবে সেসব পরিকল্পনা তিনি আমাদের জানিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা অগাধ। দেশের মানুষকে তিনি সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে থাকেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে গর্ব করেন।
কালের কণ্ঠ : এরনসট গ্রাফট, আপনার কী মনে হয়?
এরনসট গ্রাফট : আমি তো মনে করি, শেখ হাসিনার মতো বিজ্ঞ, দৃঢ়চেতা, দূরদর্শী নেতা পেয়ে বাংলাদেশের মানুষের গর্বিত হওয়া উচিত। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ সমৃদ্ধির লক্ষ্যে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে। এখন দেশকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশের মানুষের।
কালের কণ্ঠ : আপনারা দুজনই ব্যস্ত মানুষ। এর পরও আমাদের সময় দিয়েছেন। এ জন্য আপনাদের ধন্যবাদ।
বরোনহিলডে ফুকস : আপনি আমাদের বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতার কথা জানতে চেয়েছেন। এ জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আবারও বলি, বাংলাদেশের আতিথেয়তার কথা আমাদের অনেক দিন মনে থাকবে।
এরনসট গ্রাফট : চমৎকার কয়েকটি দিন কেটেছে আমাদের। এই সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পেরে ভালো লাগছে।
©somewhere in net ltd.