![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে বিএনপি’র দেওয়া প্রস্তাবনা খুবই অস্পষ্ট এবং দীর্ঘসূত্রিতার বিষয়। তাদের রূপরেখায় উল্লেখ আছে, ‘সর্বজন শ্রদ্ধেয়, সত্, নিরপেক্ষ, অভিজ্ঞ, প্রজ্ঞা এবং নৈতিকতা ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন’ পাঁচজন ব্যক্তিকে দিয়ে সার্চ কমিটি গঠন করতে হবে। তবে প্রস্তাবে যত সহজে তা বলা হয়েছে, বাস্তবে কিন্তু তা অনেক জটিল। নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে যতদিন পর্যন্ত সবাই একমত না হবেন, ততদিন পর্যন্ত আলোচনা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আলোচনা কতদিন চলবে। প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ ও যোগ্য ব্যক্তি যাদেরকে নিয়ে সার্চ কমিটি গঠন করার কথা হচ্ছে, তারাই আবার প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ অর্থাত্ নানা গুণে গুণান্বিত লোককে খুঁজে বের করবেন। কিন্তু এতো কিছু না করে সার্চ কমিটির পাঁচজনই তো নির্বাচন কমিশনার হতে পারতেন। কাজেই পর্যালোচনা করলে বিএনপি’র এই পুরো প্রক্রিয়ার মাঝে অনেক জটিলতা রয়েছে। তবে বিএনপি’র প্রস্তাবের ভালো দিক হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুপস্থিতি। নির্বাচন এলেই আমাদের এখানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আলোচনা বা দাবির ঝড় ওঠে। বিএনপি এবার সে দাবি থেকে সরে এসেছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত। বিএনপি’র প্রস্তাবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি না আসা একটি শুভবুদ্ধির উদয়। কিন্তু বিএনপি’র প্রস্তাবে নেতিবাচক দিক হচ্ছে, অত্যন্ত সুকৌশলে জামায়াতকে রক্ষা করার চক্রান্ত। এর চাইতেও মারাত্মক বিষয় হচ্ছে আরপিওতে পরিবর্তন। গত ৪০ বছরের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে সেনাবাহিনীকে রাজনীতি মুক্ত করা। বিশেষ করে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করে নিয়ে আসা। এর মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন যাবত্ জিয়াউর রহমান, হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ এবং খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে রাজনীতি করেছেন। কাজেই বিএনপি যে প্রস্তাব দিয়েছে তাতে ফের রাজনীতিকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার পাঁয়তারা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের সেনাবাহিনীকে নানাভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর যেভাবে কাজ করার কথা ছিল, তা নানা সময় সামরিক শাসকরা বিতর্কিত করেছেন। এক সময় মনে করা হত উর্দু, পাকিস্তান, বিএনপি এবং সেনাবাহিনী একাকার। এ থেকে বের হয়ে আসার পথ জননেত্রী শেখ হাসিনাই দেখিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে নতুন দিকের উন্মোচন হয়েছে।
সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচনকালীন নির্বাহী বিভাগ নির্বাচন কমিশনকে সাহায্য করবে- এটা কর্তব্য। তবে সেই কর্তব্য আরো বিস্তরভাবে আলোচনা হওয়া দরকার। নির্বাহী বিভাগ কিভাবে দায়িত্ব পালন করবে এবং সহায়তা করবে। আমাদের এখানে নির্বাচনী আইন-কানুন অন্যান্য দেশের তুলনায় উত্তম। আমাদের এখানে যখনই কোনো নির্বাচন হয়, তখন নির্বাচন কমিশন নিয়ে আলোচনা সমালোচনার ঝড় ওঠে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনার অনেক অভিজ্ঞ। আমরা যাদেরকে ভালো নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দাবি করি, আসলে সবাই একই রকমের। নির্বাচন কমিশনাররা দীর্ঘদিন থেকে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। মনে করা হয়, বিচারপতি এবং প্রধান বিচারপতিকে নির্বাচন কমিশনার বানালে নির্বাচন ভালো হবে। তবে এব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোষণ করি। নির্বাচন করার যে প্রক্রিয়া, তার সঙ্গে বিচারপতিরা পরিচিত নন। নির্বাচনে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, নির্বাচন ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করার বিষয়গুলো কোনো দিন কোনো বিচারপতি দেখেননি। কাজেই হাতে-কলমে নির্বাচন করার এবং দেখার অভিজ্ঞতা কেবল প্রশাসনিক ব্যক্তিদেরই রয়েছে। যাদের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা নেই, কেবলমাত্র প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ নানা গুণ রয়েছে এমন লোকদের দ্বারা নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ নির্বাচন সম্ভব নয়। সংবিধানের ১১৮ (৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন একেবারে স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ হিসেবে কাজ করবে। নির্বাচন কমিশনাররা কেবল সংবিধান এবং আইনের কাছে দায়বদ্ধ। সেই অর্থে নিরপেক্ষ লোক খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর। নিরপেক্ষ লোক চোর এবং পুলিশের উভয় পক্ষ থাকেন কি? কাজেই দেখতে হবে নিরপেক্ষ লোকটি কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের না বিপক্ষের, কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের না বিপক্ষের। ভারতের নির্বাচনের ইতিহাসে টি.এন. শ্যাসান সম্পর্কে বলা হয় সবচেয়ে ভালো নির্বাচন কমিশনার। বেশ কয়েকটি নির্বাচন করে তিনি সুনাম কুড়িয়েছেন। সংস্কার করে নির্বাচন কমিশনকে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। কিন্তু নির্বাচন শেষ হওয়ার পরপরই তিনি বিজিপিতে যোগদান করেছেন। এখন তিনি বিজিপির একজন সক্রিয় সদস্য। তিনি একজন বিজিপির লোক হলেও তার মন-মানসিকতা আগে বোঝার কোনো উপায় ছিল না। হঠাত্ করে তিনি বিজেপি হননি। মানসিকভাবে তিনি বিজেপিই ছিলেন।
রাজনৈতিক দলগুলোই নির্বাচনের প্রধান অংশ এবং তারাই নির্বাচন করবে। কাজেই এখানে নির্বাচনের স্টেকহোল্ডার কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোই। কিন্তু সেই রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে আলোচনা হয় না। নির্বাচন কতটা অংশগ্রহণমূলক হবে তা অনেক সময় নির্ভর করে রাজনৈতিক দলগুলোর উপর। রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে এটাই স্বাভাবিক। যদি সেই রাজনৈতিক দলের তৃণমূল পর্যায়ে কমিটি থাকে এবং তাদের নেতা-কর্মী কেন্দ্রে উপস্থিত থাকে তাহলে নির্বাচন নিয়ে চিন্তার কিছু থাকে না। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরাই নির্বাচনের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে কাজ করতে পারেন। কিন্তু তা না করে কেবল সংবাদ সম্মেলনে ১৩ পৃষ্ঠার দাবি উত্থাপন করলে সুষ্ঠু সুন্দর নির্বাচন হবে না। বর্তমানে বিএনপি’র কি অবস্থা? তাদের তৃণমূলের অবস্থা কি? বিএনপি’র ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা কমিটি ঠিক আছে কিনা, কমিটিতে কারা আছেন? কারা সংসদ নির্বাচনে নমিনেশন পাবেন? তারা কি বিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ, নৈতিকতা সম্পন্ন। সে ব্যাপারে ভাবা উচিত। যোগ্যতার প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনারকে অবশ্যই বাংলাদেশের পক্ষের হতে হবে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে না বিপক্ষে এমন প্রশ্নের উত্তর যদি আসে, আমি কোনো পক্ষের না, তাহলে এটি প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাসী হলে তাকে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের হতে হবে। নিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে যত যোগ্যতার কথাই বলা হোক না কেন, নির্বাচন কমিশনারকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক হওয়া বাঞ্ছনীয়। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে কারচুপি অনেকটাই কমে যাবে। বর্তমানে ডিজিটাল বাংলাদেশের ১০ কোটি মানুষের হাতে মোবাইল আছে, ক্যামেরা আছে। কাজেই এতোকিছুর পরও সহজেই কোনো একটা কিছু করে নির্বাচনে জেতা যাবে এমনটি ভাবার কারণ নেই। তবে আমাদের এখানে ইলেকট্রনিক ভোটিং সিস্টেম চালু করা দরকার। ভারতে ২০ বছর আগে থেকে ই-ভোটিং সিস্টেম রয়েছে। ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার সাথে সাথে ফলাফল ঘোষণা করা সম্ভব। ই-ভোটিং বর্তমান সরকারও অনেক চেষ্টা করেছিল, কিন্তু একটি পক্ষের বিরোধিতার জন্য তা সম্ভব হয়নি।
আরপিও পরিবর্তন করে রাজনীতিকে সেনাবাহিনীতে ফেরানোর আর কোনো সুযোগ নেই। নির্বাচন যখন আসে তখন সচরাচর সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। দেখা যায়, অনেক বড় অনুষ্ঠানে নিরাপত্তার স্বার্থে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সিসি ক্যামেরা শতভাগ কাজ করে না। তারপর পুরো এলাকায় ব্যানারে লেখা থাকে যে, এলাকাটি সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এর লক্ষ্য হলো দুষ্কৃতকারীরা যেন ভয়ভীতি পেয়ে তাদের কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের বিরত রাখে। তবে নির্বাচনের সময় নিরাপত্তার স্বার্থে সেনাবাহিনী টহল দিতে পারে। এর বেশি কিছু ভাবা ঠিক হবে না। নির্বাচনের কথা বলে সেনাবাহিনীকে আবার রাজনীতিতে জড়ানো যাবে না। গত শতকের নব্বই দশক থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, তত্সংশ্লিষ্ট নির্বাচনের কোনোটাকেই আমরা অন্তর থেকে গ্রহণ করিনি। তারপর নানাজন নানা অভিযোগ তুলেন। আগামীর নির্বাচনে যদি কোনো দল বলে যে, সেনাবাহিনীর কারণে তাদের পরাজয় হয়েছে, তবে তা জাতির জন্য দুঃখজনক হবে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ফলে রাজনীতি সেনানিবাসমুক্ত হয়েছে। দলের একজন নেত্রী সেনানিবাস এলাকায় বাস করে রাজনীতি পরিচালিত করবেন- যা একেবারেই অশোভন ছিল। কাজেই সেখানে যাওয়ার আর সুযোগ নেই। বিএনপি’র এবার নির্বাচন না করার কোনো কারণ নেই। তারা নির্বাচনে অংশ নিবেই। আর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্তর থেকেই চান সবার অংশগ্রহণে একটি শান্তিপূর্ণ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক। নানা সময় বিভিন্ন কথাবার্তা বক্তব্যের মাধ্যমে শেখ হাসিনার এমন দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া গেছে। এছাড়াও আওয়ামী লীগের ২০তম কাউন্সিলে নেতা-কর্মীদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যই ছিল নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেন। সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন হবে। তবে বিএনপি’র জন্য দল গোছানোর গুরুত্বপূর্ণ সময় এখন। অনেক জায়গায় বিএনপি’র কমিটি অনেক পুরনো। সেগুলো নতুন করে গঠন করার কোনো তাগিদ নেই। ভোট কেন্দ্রে যদি সব দলের নেতা-কর্মী উপস্থিত থাকে, তাহলে শতকরা ৮০ ভাগ স্বচ্ছ নির্বাচন হওয়া সম্ভব। কাজেই নির্বাচনী ফর্মূলা নিয়ে ব্যস্ত না থেকে বিএনপি’র এখন কাজ হওয়া উচিত দল গোছানো। নির্বাচন কমিশন গঠনের দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির। সর্বজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি পাওয়া বেশ কঠিন। কাজেই যতদূর সম্ভব যোগ্য এবং সঠিক ব্যক্তিকেই নির্বাচন কমিশনার হতে হবে।
বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করতে না পারলে সংবাদ সম্মেলন, সংলাপ, প্রস্তাবনা কোনো কাজেই আসবে না। বিএনপি’র রূপরেখায় জামায়াতের উপস্থিতি স্পষ্ট। বর্তমান সরকার জামায়াতের সাথে কোনো আপস করবে না। ২০ দলীয় জোটের মূল শক্তি হলো বিএনপি এবং জামায়াত। জামায়াতকে সাথে নিয়ে বিএনপি’র পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়। অনেকের ধারণা ছিল, বিএনপি জামায়াতের গোত্র ত্যাগ করেছে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। জামায়াতকে একাধিকবার সন্ত্রাসী দল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দলকে অপরাধী হিসেবে প্রমাণিত করে শাস্তির বিধান কার্যকর করার বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ আমরা কেবল মুখে বলবো জামায়াতের সঙ্গে রাজনীতি নয়, কিন্তু সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবো না, তা হয় না।
©somewhere in net ltd.