![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নারী উন্নয়নের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় বেগম রোকেয়া থেকে শেখ হাসিনা পর্যন্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বেগম রোকেয়ার লালিত নারী উন্নয়নের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়িত হয়ে চলেছে তাঁর আদর্শপুষ্ট শেখ হাসিনার হাতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবারের বেগম রোকেয়া দিবসে আবারো ব্যক্ত করলেন তাঁর নারী উন্নয়ন পলিসিতে বেগম রোকেয়ার আদর্শ বাস্তবায়নের কথা। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারীকে বাদ দিয়ে সর্বাত্মক উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়—এই উপলব্ধি উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপন্ন। নারী সমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রদেয় বেগম রোকেয়া পদকের সংখ্যা পাঁচে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নারী উন্নয়ন কর্মীদের উত্সাহিত করেন। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে নারীরা তাদের পরিবার এবং সমাজ গঠনে যাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে সেজন্যে তাঁর সরকার নারীদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মকাণ্ডে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। সমাজে নারীর অবস্থান শনাক্ত করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী একটি রূঢ় সত্য স্বীকার করেন যে, আমাদের দীর্ঘ বাহিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজে একজন নারী চাইলেই সব কিছু পেতে পারেন না। তারপরও প্রধানমন্ত্রী নারীদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে ওঠার আহ্বান জানান। নারীদের নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি নারী উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশের বৈশ্বিক স্বীকৃতির কথা জানান।
প্রধানমন্ত্রীর দাবি অমূলক নয়। প্রশস্তিতে বুক ফুলে ওঠে যখন দেখি খোদ প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারটিতে বসে আছেন একজন নারী। বিরোধী দলের শীর্ষ আসনটিতেও রয়েছেন একজন নারী। কিংবা জাতীয় সংসদের স্পিকারের পদ, সুপ্রিমকোর্টের জাস্টিসের পদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদসহ আরো অনেক অনেক শীর্ষপদে নারীর অধিষ্ঠান আমাদের নারীদের অগ্রযাত্রার দৃশ্যমান দ্যোতক হিসেবে জ্বলজ্বল করছে। তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নারী ক্ষমতায়নের বর্ধিষ্ণু সূচকগুলোও খাটো করে দেখবার অবকাশ নেই। বিশ্বের মুসলিম প্রধান দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে নারীর অবস্থান অনেক বেশি সন্তোষজনক। চলতি বছরের হিসাবেও যেখানে ইন্দোনেশিয়া, ইরাকি কুর্দিস্তান, ইয়েমেনসহ আফ্রিকার ২৭টি দেশের ২০০ মিলিয়ন নারী (১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী) বিজ্ঞান ধিকৃত এফজিএম (ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন) ব্যবস্থার শিকার হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের মেয়েদের তো অনেক বেশি নিরাপদই মনে হয়।
এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার শত সহস্র নারী আজো FGM-এর মতো বর্বর সামাজিক প্রথার নির্মম শিকার হয়ে জীবন্ত সেক্স ডল কিংবা সন্তান জন্মদানের মাংসল যন্ত্র হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। এখনো মিসরের ৯৭ শতাংশ নারী FGM-এর শিকার। অথচ এ ধরনের নৃশংস যৌনাচার গঙ্গারিদ্দি থেকে বাংলাদেশের কোনো কালেই এদেশে প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়নি। ভারতের মতো বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রগর্বী দেশে এখনো প্রকাশ্যে কথিত ডাইনি শিকারের (witch hunting) নামে ভয়ঙ্কর নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। আসাম হোম কমিশনের তথ্যমতে, ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এ রাজ্যে উইচ হান্ট আক্রমণে ৭৭ জন নিহত এবং ৬০ জন আহত হয়েছে। ডাইনি শিকার প্রতিহত করণে অ্যান্টি উইচ হান্টিং অ্যাক্ট পাস করা হয়েছে। বাংলাদেশে ডাইনি শিকারের ঘটনা অতিবিরল। প্রান্তিক জনপদের কোথাও কখনো এই প্রবণতা দেখা গেলেও সরকারি ও সামাজিক প্রতিরোধে তার প্রকোপ বাড়ে না। নারী সমাজের প্রতি এ-ধরনের বর্বর মধ্যযুগীয় আচরণ বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতিতে কখনোই প্রশ্রয় পায় না। এটি বাংলাদেশের নারী অগ্রযাত্রায় একটি ইতিবাচক দিকতো বটেই। তা ছাড়া, উন্মুক্ত প্রান্তরে খোলা আকাশের নিচে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাওয়া ভারতীয় রমণীদের অনেকের ধর্ষিত হওয়ার ঘটনার মতো কোনো ঘটনা বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। হেলথ এন্ড স্যানিটেশন ব্যবস্থার অগ্রগতি বাংলাদেশের প্রান্তিক নারীদের মাঠ-ধর্ষকের হাত থেকে বাঁচিয়ে চলেছে।
বাংলাদেশে সরকারি, অসরকারি উভয়ভাবেই নারী সমাজের অগ্রযাত্রা সাধিত হয়েছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পরই বাংলাদেশ দীর্ঘ অবহেলিত নারী সমাজের বিবিধ সমস্যা ও লৈঙ্গিক বৈষম্যের বিষয়গুলো বিবেচনায় এনেছে। বাহাত্তরের সংবিধানেও লৈঙ্গিক সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপারে প্রগতিশীল চিন্তাধারা স্থান পেয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশে নারী অধিকার এবং উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট অনেক আন্তর্জাতিক চুক্তি ও কনভেনশনের সঙ্গে সম্পর্কিত হচ্ছে। ১৯৮৪ সালে Convention on the Elimination of all forms of Discrimination Against Women (CEDAW) এবং ১৯৯৫ সালে Beijing Platform for Action (BPFA)-এর সঙ্গে সম্পর্কিত হয়েছে। অধিকন্তু নারী উন্নয়নে মিলেনিয়াম ডেভলপমেন্ট গোলস (MDGs) সহ আরো অনেক আন্তর্জাতিক চুক্তিনামার সহায়ক হিসেবে নিয়মিতভাবে কাজ করে চলেছে। সেসব আন্তর্জাতিক চুক্তির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। সরকারের লিঙ্গসাম্য সংক্রান্ত পরিকল্পনা বস্তুত চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা থেকে সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত হয়ে আসছে। তা ছাড়া, শেখ হাসিনার সরকার ১৯৯৭ সালে তাঁর প্রথম নারী উন্নয়ন পলিসি (WDP) প্রণয়ন করেছে এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৯৭ এবং ২০১৩ সালে দুটি ন্যাশনাল এ্যাকশন প্লান (NAP) গ্রহণ করেছে। এ ছাড়াও ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য সহায়ক কৌশল ও নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এদিকে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও লিঙ্গ সমতা উন্নয়নের বিষয়টিকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে মূল্যায়ন করে নারী উন্নয়নবান্ধব কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এ পরিকল্পনার অন্যতম প্রধান লক্ষ্যগুলোর মধ্যে লিঙ্গ সমতা, আয়সমতা এবং সামাজিক সুরক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বস্তুত ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে লিঙ্গসমতা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অর্জিত হয়। বিশেষ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক মাত্রায় লিঙ্গবৈষম্য দূর করা হয়। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যমান বিশাল নারী-পুরুষ বৈষম্য কমে আসে। নারীর অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা সংরক্ষণের জন্য নিয়ন্ত্রক কাঠামো সরবরাহ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশেষ অগ্রগতি সাধন করে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো ২০১১ সালের জাতীয় নারী উন্নয়ন পলিসি (NWDP) অনুমোদিত করা। এর লক্ষ্য এমন এক সমাজ বিনির্মাণ করা যেখানে নারী-পুরুষের সমান সুযোগ সুবিধা থাকবে এবং তারা সমতার ভিত্তিতে সকল মৌলিক অধিকার ভোগ করবে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং আইনগত অর্থাত্ জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ২০টি লক্ষ্য সম্বলিত একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়। জাতীয় সংসদে সদস্যপদ বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকে ত্বরান্বিত করা হয়। এই অগ্রগতির স্বীকৃতি স্বরূপ ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক কোরাম ২০১৪ সালে তার জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট (GGR) অনুযায়ী নারীর রাজনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিশ্বের ১৩৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে ১০ নম্বর দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের হিসেব মেলে বর্ধিষ্ণু শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের বহর দেখে। শিক্ষায় অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অধিকতর নারীর অনুপ্রবেশ ঘটে দেশের চলমান শ্রমশক্তিতে। আর এসব কিছুর পেছনে অন্যান্য অনুকূল পরিস্থিতির সঙ্গে মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করে চলেছে শেখ হাসিনার সরকারের নারী উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন।
©somewhere in net ltd.