নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মন্ত্রক

আমি আমার দেশের জন্যে

মন্ত্রক › বিস্তারিত পোস্টঃ

আত্মঘাতী নারী জঙ্গি

২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:০৫

ঢাকার পূর্ব আশকোনার সূর্যভিলায় মাঝরাতে বর্তমানের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ও আলোচিত জঙ্গিদল নব্য জেএমবি’র একটি আস্তানা পুলিশি অভিযানের মুখে পড়ে। গত ১লা জুলাইয়ে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় নৃশংস হামলা করে ২২ জনকে হত্যা করার দায়ে অভিযুক্ত সংগঠনটির মূলহোতারা কল্যাণপুর, নারায়ণগঞ্জ, আজিমপুর, রূপনগর, গাজীপুরসহ সম্প্রতি চালানো সাতটি পুলিশি অভিযানে নিহত হলে ভেঙে পড়া সংগঠনটির হাল ধরেন মইনুল ইসলাম মুসা নামের একজন প্রাক্তন স্কুল শিক্ষক। সূর্যভিলার জঙ্গি ডেরায় অনেক বিস্ফোরক ও অস্ত্রসহ নব্য জেএমবি’র শীর্ষ নেতাদের স্ত্রী ও সন্তানদের অবস্থান জঙ্গিদলটির সাংগঠনিক অবয়ব, অপারেশনের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের চিত্রকে কিছুটা হলেও স্বচ্ছ করেছে। পুলিশি অভিযানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে শীর্ষ দুই জঙ্গি নেতার স্ত্রী ও সন্তান নিজেদেরকে পুলিশের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করে ধরা দেয়। জঙ্গিদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার লক্ষ্যে পুলিশের সুচারু কৌশল বেশ ফলপ্রসূ হলেও এক জঙ্গির স্ত্রী নিজের সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে আত্মসমর্পণের ভান করে বাড়ির বাইরে এসে কোমরে বাঁধা আত্মঘাতী বেল্টে লুকানো গ্রেনেড বিস্ফোরণ করে স্বর্গ জয়ের প্রত্যাশায় মৃত্যুকে অবলীলায় আলিঙ্গন করে। বিস্ফোরণে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে তার পাঁচ বছরের ছোট শিশুটি হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। অভিযান শেষে ১৪ বছরের এক কিশোরের মৃতদেহ পাওয়া যায়। নিহত কিশোর আজিমপুর অভিযানে আত্মহত্যাকারী জঙ্গি নেতা তানভির কাদরির ছেলে আফিফ কাদরি হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। ঘরে ছিটিয়ে থাকা দুইটি পিস্থল, গুলি ও ১৯টি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড পাওয়া যায়।
আত্মসমর্পণকারীরা হলেন রূপনগরে পুলিশি অভিযানে নিহত জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী ও তার সন্তান এবং বর্তমানের কর্ণধার হিসেবে পরিচিত মইনুল ইসলাম মুসার স্ত্রী তৃষ্ণা ও তার কোলের সন্তান। আত্মঘাতী হয়েছে অপরিচিত জঙ্গি সুমন সাগরের স্ত্রী এবং আহত হয় তার সন্তান।
গত অক্টোবরে আজিমপুর জঙ্গি ডেরায় পুলিশি অভিযানকালে তানভির কাদরি নিজের গলায় ছুরি চালিয়ে আত্মহত্যা করে। সঙ্গে আরো তিন জঙ্গির পরিবার ধরা পড়ে। সেখানে জঙ্গিদের স্ত্রীরা পুলিশের উপর ছুরি ও মরিচের গুঁড়া নিয়ে হামলা করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হয়। হলি আর্টিজানের হামলা থেকে এ পর্যন্ত পুলিশি অভিযানের তোপে ইতোমধ্যে প্রায় ৩৫ জন জঙ্গি নিহত হয়েছে। শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের ইহলোক ত্যাগের পর সংগঠনটি ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে। নতুন নেতৃত্ব তাকে জোড়া লাগানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা চালালেও পূর্বের অবস্থায় নিয়ে যেতে পারেনি। নেতৃত্ব ও নেটওয়ার্ক পুলিশের গোয়েন্দা রাডারে থাকায় জঙ্গি চলাচল, আস্তানাগুলো আগের মত গোপনীয়তা রক্ষা করতে পারছে না। ফলে পুলিশের সফল অভিযানগুলো তাদের কর্ম তত্পরতার স্বাধীনতা হরণ করেছে এবং সহজেই ধরা পড়ছে। ফলে জননিরাপত্তার শঙ্কা কমেছে। মাঝে মাঝে জঙ্গি বিরোধী অভিযানগুলো জনমনে স্বস্তির মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে। পুরনো ক্ষতি পুষিয়ে সক্ষমতা বাড়াতে নতুন রিক্রুটিং অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। জঙ্গিরা নিজেদের পরিবারকে কেন্দ্র করে কর্ম তত্পরতা চালু রাখার চেষ্টা করছে। পরিবারকে আস্তানা করার গুটি হিসেবে ব্যবহার কিছুটা হতবাক করার মতো।
প্রশ্ন জাগে নারী জঙ্গি বাহিনী তৈরি করে হামলার নতুন কৌশলের পাঁয়তারা করছে জঙ্গিরা নাকি নিজেদের পরিবারকে সহযোগী বানিয়ে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় আস্তানাকে গোপন রাখার সহজ উপায় হিসেবে ব্যবহার করছে। আশকোনার সূর্য ভিলায় জঙ্গি সুমনের স্ত্রী শাকিরা এবং আজিমপুর ডেরায় নিহত তানভীর কাদরির ১৪ বছরের কিশোর ছেলে আফিফ কাদরি জঙ্গি দর্শনে আসক্ত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেওয়ায় আগামী দিনের জঙ্গি হামলায় নারী ও কিশোরদের অংশগ্রহণের নতুন ঝুঁকির শঙ্কা তৈরি হলো বলে অনেকে মত প্রকাশ করেছেন।
বিশ্বের অনেক দেশে আত্মঘাতী হামলায় নারী ও কিশোরদের অংশগ্রহণ নতুন নয়। আফ্রিকার জঙ্গিদল বোকোহারাম সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করছে নারী ও কিশোরদের। এমনকি অবুঝ শিশুদের গায়ে সুইসাইডাল বেল্ট জড়িয়ে দিয়ে জনাকীর্ণ এলাকায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা করেছে। শ্রীলঙ্কার তামিল টাইগারদের নারী আত্মঘাতী বা যোদ্ধার অস্তিত্ব অনেক বেশি ছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধীকে হত্যায় নারী আত্মঘাতীর অংশগ্রহণ বিশেষ উদাহরণ হিসেবেই রয়ে গেছে। বিশ্বের মোট জঙ্গি হামলার শতকরা ১৫ ভাগে নারীদের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গেলেও বাংলাদেশে জঙ্গি সুমনের স্ত্রী শাকিরা প্রথম নারী জঙ্গি আত্মঘাতী হওয়াই জনমনে শঙ্কা তৈরি করেছে। জঙ্গিবাদে নারীদের সম্পৃক্ততার গভীরতা ও মাত্রা এবং কারণ উদঘাটনে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন। হাল্কা ধারণার উপর ভিত্তি করে নারী জঙ্গিদের বিপদ নিয়ে বিশারদদের ছড়ানো শঙ্কা জনমনে অহেতুক ভীতির সৃষ্টি করেছে এবং বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশি জঙ্গিবাদের চিত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। জিহাদি আফিমে আসক্ত মা ও বাবারা নিজ সন্তানদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার প্রতি যত্নবান নয় এবং প্রয়োজনে বলি দিতেও পিছপা হবে না আশকোনার ঘটনা থেকে এ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে।
ইসলামিক স্টেট বা আই এসের শীর্ষ নেতা আবু বকর আল বাগাদাদির মতাদর্শে আকৃষ্ট হয়ে অনেক নারী ও কিশোরিকে সিরিয়ায় হিজরত করতে দেখা গেলেও মাঠের যুদ্ধে নারীদের উপস্থিতি খুব একটা লক্ষ্য করা যায়নি। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে কিছু নারীদের উপস্থিতি দেখা গেলেও মূলত মেয়েদের ব্যবহার করা হয়েছে জঙ্গিদের যৌনসুখ ও সন্তান জন্মের যন্ত্র হিসেবে। নতুন যোদ্ধা আকৃষ্ট করার মাধ্যম হিসেবেও নারীদের ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে। আই এস অধিকৃত সিরিয়ায় আল খানসা নামে একটি মহিলা ইউনিটের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও তাদেরকে নিয়োগ করা হয়েছিল নারীদের শরিয়া শৃঙ্খলা রক্ষার আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে। অপরদিকে আইএসের বিরোধী লড়াইয়ে ব্যাপকভাবে কুর্দি নারীরা যুদ্ধের ময়দানে সাহসীযোদ্ধা হিসেবে অবতীর্ণ হতে দেখা গেছে।
ধর্মীয় জঙ্গিবাদে নারীদের যোদ্ধা হিসেবে জায়গা নেই বললে অত্যুক্তি হবে না। বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলোকে নারীদের যোদ্ধা বানানোর খুব একটা প্রয়াস নিতে দেখা যায়নি। জঙ্গিরা জীবনসঙ্গীকে মতাদর্শে অনুরক্ত করে নিজেদের নিরাপদ করতে চেয়েছে। জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের গোপনীয়তা রক্ষার উদ্দেশ্যে পরিবারকে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে রেখেছে। তানভীর বা জাহিদের মত শিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হবার পরে নিজ স্ত্রীকেও সাথী করে নিতে চেয়েছে। জিহাদি মতাদর্শের চেয়ে পারিবারিক বন্ধনের টান জঙ্গিবাদে নারীদের বেঁধে রাখতে বেশি ভূমিকা রেখেছে। জীবনের মায়া ও সন্তানদের মমতা আত্মসমর্পণে অনুঘটক হলেও সবার ক্ষেত্রে একই প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
প্রথম প্রজন্মের হরকাত আল জিহাদ আল বাংলাদেশ (হুজি)’র সংগঠনে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারী জঙ্গিদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। পরিবারকে দূরে রেখে জঙ্গিত্ব করেছে। আদালতের রায়ে ফাঁসি হওয়া জেএমবি নেতা শায়ক আব্দুর রহমান তার স্বীকারোক্তিতে বলেছিলেন তাদের কোনো নারী জঙ্গি ইউনিট নেই। ৫০ থেকে ৬০ জন জঙ্গি নারী আছে যারা মূলত তাদের পরিবার। বাংলাদেশে ধরা পড়া নারী জঙ্গিদের প্রায় সকলে জঙ্গির স্ত্রী অথবা নিকট আত্মীয় হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছেন। বগুড়ায় আটক হয়েছে চট্টগ্রামে নিহত জেএমবি নেতা রাইসুল ইসলাম ফারদিন-এর স্ত্রী মাসুমা আখতার। সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে আটক হওয়া নারী জঙ্গিদের পরিচিতি জঙ্গির স্বামী বা নিকটজন কেন্দ্রিক। আজিমপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে ধরা পড়া নারী জঙ্গিদের সবাই ছিলেন পরিবারের সদস্য। ঢাকা থেকে র্যাবের হাতে আটক হয়েছিলেন মানারাত বিশ্ব বিদ্যালয়ের তিন ছাত্রী ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এক ইন্টারনি ডাক্তার। এখানে জঙ্গি মতাদর্শের বাহক হিসেবে তাদের পরিচিতি পাওয়া গেছে। নব্য জেএমবির পরিবার জড়ানো জঙ্গি কৌশল সংগঠনের জনবিচ্ছিন্নতাকেই তীব্রভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। মতাদর্শিক অভিযাত্রী হিসেবেই তাদের চরিত্রকেও তুলে ধরেছে।
বাংলাদেশের সার্বিক প্রেক্ষাপটে নারী জঙ্গি হামলার ঝুঁকির মাত্রা নিঃসন্দেহে খুবই কম। তবে মৌলবাদ বিস্তারে নারীদের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। হিজবুত তাহরির ও ইসলামি ছাত্রী সংস্থা মেয়েদের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সক্রিয় রয়েছে যেখান থেকে ভবিষ্যত্ ঝুঁকি উত্থিত হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। পরিবারের মধ্যমনি হিসেবে বিরাজমান মাতা অথবা ভবিষ্যত্ মাতাদের লক্ষ্য করে মৌলবাদকে গ্রোথিত করার প্রয়াস চোখে পড়ার মত। মৌলবাদের আফিমে পরিবারকে আসক্ত করতে মাতার ভূমিকা ক্রিয়াশীল করতেই এটাকে সুদূরপ্রসারী জঙ্গিবাদি কৌশলের অংশ হিসেবেই দেখতে হবে। মৌলবাদী সমাজ জঙ্গি সংগ্রহের মূলক্ষেত্র। মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে জঙ্গিবাদ রোখা যাবে না। নিরীহ মানুষের জীবনের হুমকি সৃষ্টিকারী কতিপয় জঙ্গি নির্মূলে পুলিশ বাহিনী সক্ষমভাবে অবদান রেখে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করে চলেছে। বড় দিন ও খ্রিষ্ট্রীয় নতুন বছরের উত্সবে জঙ্গি হামলার বিষয়টি সর্বজনবিদিত। ইউরোপ ও আমেরিকায় ইতোমধ্যে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। আশকোনা জঙ্গি ডেরায় গ্রেনেডের মজুদ থেকে হামলার প্রস্তুতির বিষয়টিই উন্মুক্ত হলো।
বাংলাদেশ জঙ্গি নিধন হলেই রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ভিন্নভাবে প্রবাহিত হয়। জঙ্গিবাদের প্রতি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য জননিরাপত্তার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব তৈরি করে। জঙ্গিবাদ বিষয়ে রাজনীতির মতপার্থক্য প্রকারান্তরে জঙ্গিবাদকে সুরক্ষা দেয় এবং উত্সাহিত করে। নারী জঙ্গি বাংলাদেশে অদূর ভবিষ্যতে তেমন ঝুঁকি সৃষ্টি করবে বলে মনে হয় না। মৌলবাদই জঙ্গিবাদের বীজতলা। মৌলবাদ প্রসার রোধে রাজনৈতিক ও সামাজিক উদ্যোগ এবং সক্রিয়তাই জঙ্গিবাদের বীজতলা ধ্বংস করতে পারবে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.