নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শেষ পর্যন্ত লেখাটাই থাকে। টিভি, রেডিও, ওয়েবসাইট, চলচ্চিত্র, মঞ্চ, বিজ্ঞাপণ, ব্লগ - লেখার যতো মাধ্যম সবখানেই লিখতে হবে। পৃথিবী পাল্টে গেছে - এখন আমরা দুহাতের দশ আঙুলেই লিখি।

মুম রহমান

পেশাদার ও নেশাদার লেখক, মাঝে মাঝে কবি

মুম রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

আহ্, কী সুন্দর এই বেঁচে থাকা!

২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:২১



কাল রাতে - ফ্লাগুনের রাতের আঁধারে

যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ

মরিবার হলো তার সাধ!



বধূ শুয়ে ছিলো পাশে - শিশুটিও ছিলো;

প্রেম ছিলো, আশা ছিলো, - জ্যোস্নয়, - তবু সে দেখিল

কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?

অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল - লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।



জীবনানন্দ দাশ, আট বছর আগের একদিন, মহাপৃথিবী



ভালবাসা ছিলো আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে। হঠাৎ কী হলো, কেউ জানে না, একজন সরে গেলো দূরে। একজন বেছে নিলো অন্য এক জীবন, নিরুপায় ব্যথিত একজন বেছে নিলো নীল মৃত্যু। শোনা গেলো বিষের শিশি ঢেলে আত্মহত্যা করেছে সে। আরেকজনের কথা বলা যেতে পারে, সে ছিলো নেহায়েতই টগবগে এক কিশোর। চুল ঝাঁকিয়ে, গিটার বাজিয়ে গাইতো বব ডিলান। কেমিস্ট্রি ফাইনাল পরীক্ষায় পেলো ২৩ নম্বর। ১০ নম্বরের অভাবে পাস করতে পারেনি বলে বাড়ি ফিরেই খেয়েছিলো মায়ের থাপ্পড়। নিছক আকস্মিক অভিমানে ফ্যানের দড়িতে ঝুঁলে গেলো সে। আরও একজনের কথা জানি, সে ছিলো অসীম ধৈর্যবান। তার সহ্য ক্ষমতা অপার থাকলেও তাকে সইতে পারতো না বউ-ছেলে-মেয়ে। বেচারা নির্লিপ্তি দাড়িমুখো মানুষটি একদিন সব সহ্য ক্ষমতা হারিয়ে একদিন ট্রেনের তলে চলে গেলো। এটুকু তবু জানা। কিন্তু কবিতার সেই মানুষটির মৃত্যুর সঠিক ব্যাখ্যা আজও জানি না। সে গুণে গুণে পঞ্চশটা ঘুমের বড়ি খেয়েছিলো এক চাঁদনী রাতে।

এইভাবে জীবন থেকে দূরে, অসংখ্য মানুষ কেন চলে যায় মৃত্যুপুরীতে! স্বেচ্ছামৃত্যু বা ইচ্ছামৃত্যু নয়, জীবনই তাদের ঠেলে দেয় আত্মহননের পথে। যে মানুষ সবচেয়ে বেশি ভালবাসে নিজেকে সে মানুষই নিজেকে সঁপে দেয় মৃত্যুর কোলে! সুন্দর এই জীবন। সুন্দর এই পৃথিবী। বাবা-মা-ভাই-বো-আত্মীয়-পরিজন সবাইকে নিয়ে সুন্দর এই বেঁচে থাকা। গলিত স্থবির ব্যাঙও দুই মুহূর্তের জীবন ভিক্ষা চায়। জরাজীর্ণ রোগাক্রান্ত অতিবৃদ্ধ মানুষটিও জীবনকে আকড়ে ধরতে চায় শীর্ণ দুহাত দিয়ে। অথচ এই পৃথিবীতেই প্রতিদিন কোন না কোনো মানুষ আত্মহত্যা করছে! স্বেচ্ছায় চেনা জীবনকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে অনিশ্চিত অচেনা মৃত্যুর দিকে। তখনই মনে প্রশ্ন জাগে, এ তো বেঁছে থাকার তব্রি আকাঙ্খার ছড়াছড়ির মাঝে কেন মানুষ নৃশংস মৃত্যুর পথ বেছে নেয়? কেন মানুষ আত্মহত্যা করে? জীবনের চেয়ে মৃত্যুকে কেন বেশী নিরাপদভাবে কোন কোন মানুষ?

ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন (হু)-এর মতে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী প্রতি লাখে ১৬ জন ব্যক্তি আত্মহত্যা করে যা গড়ে প্রতিসেকেন্ডে ১ মৃত্যুর সমান। গত কয়েক বছরে বিশ্বব্যাপী শতকরা ৬০ ভাগ আত্মহত্যার হার বেড়েছে। মার্কিন এক জরিপ মতে শুধু মাত্র ১৯৯৮ সালে আমেকিরা যতো যতো হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার, এইডস ইত্যাদি রোগে মারা গেছে তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ আত্মহত্যায় মারা গেছে। বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশে উঠতি বয়সের ছেয়েমেয়েদের যদি এই অবস্থা হয়, অন্য কোন দেশের কথা না-ই বললাম। তরতাজা প্রাণগুলো কোন অভিমানে, কোন কষ্টে চলে যায় মৃত্যুপুরীতে এবং এ যাওয়াও তো কোন স্বাভাবিক প্রস্থান নয়। দেখা যায়, অধিকাংশ আত্মহত্যার পদ্ধতিই কষ্টকর, ভীতিকর। সাধারণ যে সব উপায়ে আত্মহত্যা হয় সেগুলো হলো -

১. দড়িতে ঝোলা,

২. উঁচু ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া,

৩. ঘুমের বড়ি খাওয়া,

৪. বিষাক্ত কিছু খাওয়া,

৫. গুলি করা,

৬. ছুরিকাঘাত,

৭. হাত-পায়ের রগ কেটে ফেলা,

৮. পানিতে ডোবা,

৯. ট্রেন বা বাসের চাকার নিচে পড়া,

১০. আগুনে পুড়ে মরা।

এছাড়াও অনেক ভিন্ন ভিন্ন পথ আছে। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হলো, এখানে উল্লেখিত দশটি পথের মধ্যে নয়টি পন্থাই তীব্র যন্ত্রণাদায়ক। মনোবিজ্ঞানীদের ভাষ্য, আত্মহত্যাকারী মৃত্যুর যে পদ্ধতি বেছে নেন তার মধ্যে তার মানসিক অবস্থার পরিচয় ফুটে ওঠে। আত্মহত্যার মধ্যে কেউ চায় পাপের প্রায়শ্চিত্ত, কেউ চায় চিরশান্তির ঘুম, কেউ চায় নিজে মরে অন্যকে কষ্ট দিতে, কেউ চায় জীবন জ্বালা জুড়াতে। কিন্তু এইসব চাওয়ার মধ্যে সত্যিকার আন্তরিকতা নেই। কেননা, বাধ্য হয়েই মানুষ আত্মহত্যা করে। কেউ শখ করে মরে যায় না। তাই বাধ্য হয়ে মরে যাওয়ার এই প্রবণতাকে আমরা ঠেকাতে পারি। চাইলেই আমাদের অবস্থান থেকেই আমরা বাঁচাতে পারি অনেকগুলো জীবন। আরেকটি লক্ষনীয় বিষয়, আত্মহত্যাকারীর মধ্যে কোন শ্রেণী নেই। যে কোন বয়সের যে কোন অবস্থানের লোক আত্মহত্যা করতে পারে। কবি, ধার্মিক, দার্শনিক, রিকশাচালক, দিনমজুর, ছাত্র, তরুণী, কিশোর, প্রবীণ, বৃদ্ধ যে কারও মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। কিন্তু আত্মহত্যা কোন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়, এটা পরিবেশ ও পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল। পারিপার্শ্বিক জটিলতা, অর্থনৈতিক-সামাজিক অবস্থা ইত্যাদি আত্মহত্যাকে ত্বরান্বিত করতে পারে। দেখা গেছে, গ্রামীণ জীবনের চেয়ে নাগরিক জীবনে আত্মহত্যার গড় হার বেশি। হয়তো নাগরিক জীবনের জটিলতাই এর কারণ। আদিবাসীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা নেই বললেই চলে। ধার্মিকদের তুলনায় নাস্তিকরা বেশি আত্মহত্যা করে। যে কোন কিছুতেই বিশ্বাস থাকলে বেঁচে থাকাটা হয়তো সহজ হয়ে যায়। লক্ষ্য করা গেছে, মধ্যবয়সীদের আত্মহত্যার চেষ্টা সচারাচর ব্যর্থ হয়, কম বয়সীদের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার হারটিও কম। মেয়েদের মধ্যে অনিশ্চয়তা ও আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি থাকলেও সারাবিশ্বে পুরুষরাই বেশি আত্মহত্যায় সফল হয়। বিবাহিতদের চেয়ে অবিবাহিতরা গড়ে বেশি আত্মহত্যা করে। কাজেই আত্মহত্যা নানা পরিবেশ-পরিস্থিতি মিলিয়েই হয়। এমনকি আবহাওয়ার দ্রুত বদল, পূর্ণিমা অথবা নতুন চাঁদ, বৃষ্টি ইত্যাদিও আত্মহত্যা প্রবণতাকে বাড়িয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে পূর্ণিমা বিষন্ন লোককে আরও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ করে তোলে যা আত্মহত্যার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু জন্মগতভাবেই কেউই আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে জন্মায় না। তাই চারপাশের বেঁচে থাকার আনুকল পরিবেশ, একটু সহানুভূতি, মানুরে প্রতি মানুষের বিশ্বাস, সহমর্মিতাই মানুষকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে, দিতে পারে জীবনের মধুর স্বাদ।

অনেকে মনে করেন, আত্মহত্যা মানসিক রোগ। এ ধারণা সঠিক নয়। আত্মহত্যা প্রবণতা কোন রোগ নয়, তবে বিষন্নতা, হতাশা মানসিক সমস্যাগুলো তীব্র আকার ধারণ করলে মানুষ আত্মহত্যা প্রবণ হয়ে ওঠে। আর বিষন্নতা, হতাশা মানুষের জীবনে তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণেই তীব্র হতে পারে। তাই আবারও বলে রাখা দরকার, পরিবেশ-পরিস্থিতি মানুষকে আত্মহত্যায় উৎসাহ জোগাতে পারে। আশঙ্কার কথা হলো, আত্মহত্যার ভাবনা একবার মনে ঢুকে গেলে তা থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়। এমনও দেখা গেছে কেউ কেউ একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। প্রথমবার আত্মহত্যায় ব্যর্থ হলেও অনেকেই PTSD (Post-traumatic disorder)-এ ভোগেন দীর্ঘদিন। এমনও কেউ কেউ আছে আত্মহত্যা করতে না-পেরে মাদক দ্রব্য বেছে নিয়েছেন, কেউ উচ্ছৃঙ্খল, বেপোরোয়া হয়ে গেছেন, কেউবা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন সব কিছু থেকে। এইভাবে অনেকে সরাসরি আত্মহত্যা না করেও ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথ বেছে নিয়েছেন। ক্রমশ আত্মবিরোধী কাজের মাধ্যমে জীবনকে অস্বীকার করেন না। আসলে আত্মহত্যা জীবন বিরোধীতার সবচেয়ে বড় প্রবণতা।

সাধারণত অসহনীয় তীব্র জ্বালা-যন্ত্রণাই আত্মহত্যায় ধাবিত করে। দীর্ঘকালীন বেদনা ও বিষন্নতা মানুষকে আত্মহত্যা প্রবণ করে তোলে। অবহেলাও মানুষকে আত্মহত্যার পথে নিয়ে যায়। জীবনের সাম্প্রতিক অবস্থা ও আবেগের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে আত্মহত্যা করতে পারে। ভবিষ্যত সম্পর্কে কোন আশার আলো না দেখলেও মানুষ আত্মহত্যা করে। আমরা যখন ভাবতে থাকি, কোন মুক্তি নেই, এই ব্যথার কোন শেষ নেই, আগামীকালও ঠিক এইরকমই হবে, বা এরচেয়েও খারাপ হবে, অতএব মৃত্যুই একমাত্র সমাধান, তখনই আত্মহত্যা অবধারিত হয়ে পড়ে। মৃত্যু ভয়ের চেয়ে জীবনের ব্যথা বেড়ে গেলে আত্মহত্যা কাম্য হয়ে ওঠে, তখন মৃত্যুকেই বন্ধু মনে হয়। কাজেই সহজ করে বলা যায়, জীবন অসহীয় হয়ে গেলেই মানুষ আত্মহত্যাকে বেছে নেয়। নিরূপায়, হতাশ এবং তাৎক্ষণিকভাবে বিবেচনা বোধ হারিয়ে ফেলা মানুষ মৃত্যুকে আগলে ধরে। `Sucide is not chosen; it happens when pain exceeds resources for coping with pain.’

শুধু সাধারণ মানুষ নয়, জগতের অনেক বিখ্যাত শিল্পী সাহিত্যিকই আত্মহত্যা করেছেন। যে রৌদ্রকরোজ্জ্বল শস্যভ’মির ছবি তিনি এঁকেছিলেন জীবনের প্রতীক হিসেবে সেই ভূমিতেই দাঁড়িয়ে ১৮৯০ সালের ২৭ জুলাই তিনি নিজের বুকে অব্যর্থ গুলি ছুঁড়েছিলেন। ওল্ডম্যান এ- দ্য সী-এর মতো জীবনবাদী, মানবিক উপন্যাসের লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে দীর্ঘকাল বিষন্নতায় ভূগেছিলেন, ইলেকট্রিক শকও দেয়া হয়েছিলো তাকে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। হাসপাতাল থেকে ছাড়ড়া পাওয়ার পর ১৯৬১ সালের ২ জুলাই নিজেকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন তিনি। মার্কিন কবি সিলভিয়া প্লাথ আত্মহত্যা করেছিলেন বড় নির্মমভাবে। তিনি নিজের মাথাটি দিয়েছিলেন গ্যাস বার্নারের ভেতরে। ব্রিটিশ কবি টেড হিউজের সঙ্গে অসুখি দাম্পত্য সম্পর্ক এর আগেও দুবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৬৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তৃতীয়বারের চেষ্টায় তিনি মৃত্যুর কাছে আত্ম সমর্পণ করেন। আত্মহত্যা করেছিলেন হলিউডের জনপ্রিয়তম তারকা, সবার স্বপ্নদেবী মেরিলিন মনরোও। খ্যাতির শীর্ষে থাকা এই অভিনেত্রীকে ১৯৬২ সালের ৫ আগস্ট তার বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের বড়ি খেয়ে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন পৃথিবীর অসংখ্য পুরষের আকাঙ্খার নারী মেরিলিন মনরো। বলিউডের অভিনেত্রী দিব্যা ভারতীয়ও খ্যাতির শীর্ষে থাকা অবস্থায় ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন ৫ এপ্রিল ১৯৯৩ সালে। ব্রিটিশ লেখিকা ভার্জিনিয়া উলফ বাড়ির কাছের ওসু নদীতে ডুবে আত্মহত্যা করেছিলেন। বিট্যুইন দ্য এক্টস নামের উপন্যাস শেষ করার পর থেকেই তিনি তীব্র বিষন্নতায় ভূগছিলেন। এ ধরণের বিষন্নতা তাকে ইতোপূর্বেও গ্রাস করেছিলো। অবশেষে ১৯৪১ সালের ২৮ মার্চ তিনি ওভারকোটের পকেট ভর্তি পাথর নিয়ে নদীতে ডুবে মরেন। বিশ্বখ্যাত ফরাসি ছোটগল্পকার গী দ্য মোঁপাসা জীবনের শেষ দিকে হতাশা, মৃত্যু ভয়ে ভূগছিলেন। ১৮৯২ সালের ২ জুন নিজের গলা কেটে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তাকে চিকিৎসার জন্য মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানেই তার মৃত্যু হয় ৬ জুলাই।

বাংলাদেশের লেখক কায়েস আহমেদের আত্মহত্যা এখনও অনেককেই কষ্ট দেয়। জীবনানন্দ দাস ট্রামের চাকায় চাপা পড়ে মরে গিয়েছিলেন। তার এই মৃত্যুকে অনেকেই আত্মহত্যা বলে সন্দেহ পোষন করেন। হিটলার আত্মহত্যা করেছিলেন এমন সন্দেহও অনেকের মধ্যে রয়ে গেছে। হিটলারের মতোই গ্রেয়ন ট্রলারও মূলত অস্ট্রিয়ান ছিলেন। হিটলার ছিলেন প্রথম মহাযুদ্ধের কর্পোরাল আর ট্রলার ছিলেন এম্বুলেন্স বাহিনীর একজন। মাত্র ২৭ বছর বয়সে জার্মানীর এক্সপ্রেসনিস্ট কবি গ্রেয়ন ট্রাকলের আত্মহত্যাও উল্লেখ করার মতো। গোলাগোলুরি মধ্যেও কবিতাই ছিলো তার অবলম্বন। ট্রাকল যখন মেডিক্যাল কোরের ল্যাফটেনান্ট তার অধীনে ৯০ জন মারাত্নক আহত সৈনিক, কিন্তু তাদেরকে তিনি বাঁচাতে পারছেন না। অবশেষে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি। মানসিক হাসপাতালে বসেই আত্মহত্যা করলেন তিনি ১৯১৪ সালের ৩ নভেম্বর।

আত্মহত্যার নৈতিক দিক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমার জীবন আমি রাখবো কি রাখবো না, এটা আমার ব্যাপার। অনেকেই এমন মত প্রকাশ করেন। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেছেন আমরা যেহেতু সমাজ পরিবার রাষ্ট্রেরই অংশ সেহেতু আমার জীবন মানেই সব সিদ্ধান্ত আমার নয়। আমাদের অনেক ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের প্রভাব পরিবারের উপর, সমাজের উপর, ক্ষেত্রবিশেষে রাষ্ট্রের উপরও বর্তায়। আমার মরার অধিকার আছে। কিন্তু আমার মৃত্যু যদি আমার পরিবারকে ধ্বংস করে দেয় তাহলে আমার মরার অধিকার নেই। যে সব পরিবারে আত্মহত্যার ইতিহাস আছে তাদের সামাজিক অবস্থান স্বাভাবিক নয়। ফ্রয়োড মনে করতেন আত্মহত্যা আসলে নর হত্যা। ফ্রয়েডের মতে, বাবা মা ও অন্য গুরুজন যারা শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পাত্র ও যারা শাসক তারা মানুষের মনের ভেতর স্থায়ী অন্তর্মূতি (Imago ev internalized image) বাস করে। এই অন্তরমূর্তি বা Imago সব সময়ই সজাগ প্রহরীর মতো ব্যক্তির স্খলন, পতন বা ত্রটিতে মনের ভেতর এক ধরণের অপরাধবোধের জন্ম দেয়। জীবিত অবস্থায় কোন মানুষই এই শোচনা থেকে মুক্তি পায় না। এই অন্তর মূর্তির হাত থেকে রেহাই পাবার একমাত্র উপায় হলো নিজেকে হত্যা করা । ফ্রয়েডের মতে নিজেকে হত্যা করে এই অন্তর মূর্তিগুলোকে হত্যা করে মানুষ। জীবনের চূড়ান্ত সংকটপূর্ণ মুহূর্তেই সাময়িকভাবে আত্মহত্যা প্রবণতা দেখা দিলেও এ প্রবণতাকে কখনোই হাল্কা করে দেখা উচিত না। একটু সচেতন হলেই আমরা খুব কাছের মানুষটিকে আত্মহত্যা থেকে বাঁচাতে পারি। আশার কথা, যারা আত্মহত্যা করেন তাতের প্রায় সবাই কোন না কোন সূত্র বা সতর্কবাণী দেন। তাই আত্মহত্যার হুমকিকে কখনো অগ্রাহ্য উচিত না। আমি না থাকলে তুমি কাঁদবে, আমার চারিদিকে মৃত্যুর অন্ধকার, এ ধরণের কথাবার্তা যতো হাল্কাভাবেই বলা হোক তাকে গভীরভাবে নেয়া উচিত। আসলে কেউ মরতে চায় না। বেঁচে থাকার সামান্য সহায়ত পেলেই মানুষ খুশি হয়। বহু প্রতিক’ল অবস্থাতেও মানুষ যুদ্ধ করে। হেমিংওয়ে তার ‘দ্য ওল্ড ম্যান এ- দ্য সি’ তে লিখেছিলেন, মানুষল ধ্বংস হয়ে যায়, কিন্তু পরাজয় মাননে না। আর পরাজিত মরে যাওয়া নিশ্চয়উ এই দূলর্ভ মানব জন্মেরই অভমাননা। মনে রাখা দরকার, অধিখাংশ আত্মকারীই আসলে মরতে চায় না। তারা তাদের কষ্টটার লাঘব চায়। বহু বিষন্ন লোক একটা শান্তির মৃত্যু চায়। তারা ভাবে, ঘুমের মধ্যে একদিন মরে যাবে, কেউ টের পাবে না, অথবা অকস্মাৎ একটা দূর্ঘটনায় মারা যাবে। আসলে তারা বাঁচতে চায়। মৃত্যু আকাঙ্খার সঙ্গে বেঁচে থাকার আকাঙ্খার সব সময় দ্বন্দ্ব লেগে থাকে। সেই কারণে দেখা যায়, গুলি করলে গুলি গায়ে লাগে না। বেঁচে থাকার ইচ্ছাটা সব সময় কাজ করে। মৃত্যুর ইচ্ছা মাঝে মাঝে কাজ করে। তাই আত্মহত্যার কথা যারা ভাবছেন, তাদের বাঁচানো আমাদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। যে আত্মহত্যা করে সেও জানে মৃত্যু কোন সমাধান নয়। Suicide is not a solution, suicide is an end... before a solution is found. অধিকাংশ ক্ষেত্রে সহানুভূতির সঙ্গে সমস্যার কথা শুনলেই অনেককে আত্মহত্যার হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব। সাধারণত যারা মারাত্মকভাবে বিষন্ন ও আশাহীনতায় ভ’গছেন, যারা ইতোপূর্বে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছেন কিংবা যারা ইতোমধ্যেই মরার পরিকল্পনা করে ফেলেছেন তাদেরকে বিপদজনক হিসাবে দেখা উচিত। দ্রুত এদের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসা জরুরি। বিষন্নতার চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন। এ ধরণেল রোগীকে সব সময় আশাবাদী করার চেষ্টা করতে হবে। আত্মহত্যার প্রবণতা যাদের মধ্যে আছে, তাদের মনের জোড় বাড়ানো দরকার। তাদেরকে বোঝানো দরকার যে, Suicide is a permanent solution to a temporary problem. আত্মহত্যা একটি পলায়নবাদী বা escapism মনোভাব। এ ধরণের রোগীকে কখনো নিঃসঙ্গ থাকতে দেয়া যাবে না, সব সময় আনন্দঘণ পরিবেশে রাখা উচিত। অনেক ক্ষেত্রে ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপনেও উপকার পাওয়া যায়। ধর্মালোচনা, দার্শনিক আলোচনাও আত্মহত্যাকারীকে নিবৃত্ত করতে পারে। যে কোন শিল্প মাধ্যমে আগ্রহী করে তোলা কার্যকর ভূমিকা রাখে। মোট কথা, তাকে জীবনের অফুরান উপাদানের সন্ধান দিতে হবে। আত্মহত্যাকারীকে জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। যারা ইতোমধ্যে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে তাদের কাছ থেকে আত্মহত্যার উপাদান সরিয়ে রাখা জরুরি। প্রয়োজনে এদেরকে মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে বা কোন স্বাস্থ্য নিবাসে নিয়ে যেতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শে কোন মানসিক শান্তিকারি ওষুধ বা ট্রাঙ্কুলাইজার দিতে হবে। এদের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক অবস্থা পরীক্ষা করে আত্মহত্যা প্রবণতার মূল কারণ খুঁজে বের করতে হবে এবং তা নির্মূল করতে হবে।

আমাদেরই আশেপাশে একজন মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেবে আর আমাদের কিছু করার থাকবে না তা হতে পারে না। মনে রাখতে হবে, তারাই আত্মহত্যা করে যাদের কাছে চারপাশের পরিবেশ ও মানুষ অসহনীয় হয়ে ওঠে। এই চারপাশের সীশানায় আমরাও পড়ি। হয়তো আমাদেরই কারো না কারো ক্ষুদ্র আচরণ কিংবা অবহেলা একজনকে অনাকাঙ্খিত মৃত্যুতে ঠেলে নিয়ে যায়। সব আশা নিঃশেষ হয়ে যে মরে যেতে চায় তার মৃত্যুর কিছুটা দায় আমাদের উপর বর্তায়। তাই আত্মহননের পথ থেকে মানুষকে ফিরিয়ে আনা আমাদেরই দায়িত্বরে অন্তর্ভূক্ত। সাধারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আত্মহত্যা প্রবণতা সাময়িক। সবাই কম বেশি জীবনে একবার অন্তত মরে যাওয়ার কথা ভাবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আত্মহত্যা সাময়িক ভাবনার ফসল। একটু সময় নিয়ে ভাবার সুযোগ পেলে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে না। আপনার কাছে যেটা সামান্য সমস্যা আরেকজনের কাছে সেটাই ভয়াবহ সমস্যা। প্রবল আবেগের সময় মানুষের ভাবনা স্বচ্ছভাবে কাজ করে না। কাজেই এ সব ক্ষেত্রে অন্যের সহায়তা খুব জরুরি। জীবনে এমন মুহূর্ত আসে যখন অনেকেরই মনে হতে পারে মরে যাওয়া ভালো। জীবনে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করেনি এমন মানুষ পাওয়া দুস্কর। তাই বলে সবাই তো আর আত্মহত্যা করে না। আমরা যা ভাবি তা অধিকাংশ সময়ই তাৎক্ষণিকভাবে ঠিক প্রমাণিত হলেও পরে তা ভুল প্রমাণিত হয়। জরিপে দেখা যায়, অধিকাংশ আত্মহত্যাকারীই তাৎক্ষণিক আবেগের তীব্রতায় মৃত্যু বেছে নেয়। হঠাৎ মায়ের একটু বকুনি, পরীক্ষায় ফেল করা, প্রেমে ব্যর্থ হওয়া ইত্যাদি কারণেই আত্মহত্যা বেশি হয় এবং এই সবই সাময়িক। দুঃখজনক হলেও, এমনও দেখা গেছে যে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে আত্মহত্যার পর জানা গেছে সে ফেল করেনি, রেজাল।ট সিটেই ভুল ছিলো। যে প্রেম চলে গেছে বলে জীবন অসহনীয় মনে হয় বেঁচে থাকলে হয়তো সে প্রেম চলে যাওয়াটাই ভাল মনে হতে পারতো। এমনও অনেকে আছেন আত্মহত্যা থেকে ফিরে এসেছেন এবং পরে অনুধাবন করতে পেরেছেন বেঁচে থাকাটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই যে কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর অণÍত চব্বিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করা উচিত। ভাবা ও করার মধ্যে পার্থক্য আছে। কেউ নিজেকে হত্যা করার কথা ভাবলেই তার অর্থ এই নয় যে, ওই মুহূর্তে তাকে মরতে হবে। মরতে তো সবাইকেই হবে। চাইলে আমরা কেউ অনন্তকাল বেঁচে থাকবো না। যে কদিন সুযোগ পাওয়া যায় সে কদিন বেঁচে থাকাই অনেক বড় ব্যাপার। অনেক সাধনায় নাকি এই মানব জন্ম পাওয়া যায়। মৃত্যু একমুখী যাত্রা। সেখান থেকে চাইলে তো আর ফেরত আসা যায় না।

উর্দু কাব্যের বিখ্যাত কবি মীর্জা গালিব একবার জওকের মুখে একটি শের শুনে লাফিয়ে উঠেছিলেন। শেরটি হলো -

আবতো ঘাবড়াকে কেহতা হু মর যায়েঙ্গে

মরকে ভি চেন না পায়ে তো কিধার যায়েঙ্গে।

অর্থাৎ

এখন তো ঘাবড়ে গেলেই বলি, মরে যাবো

মরেও যদি শান্তি না পাই তবে কোথায় যাবো।

গালিবের কাব্যে বিষন্নতার ছড়াছড়ি থাকলেও অন্যের কাব্যে জীবনের একটু ছোঁয়া পেয়ে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। উর্দূ সাহিত্যের আরেক গম পছন্দ বা দুঃখপ্রেমী মীর তকী মীর লিখেছেন অনেক মৃত্যু আর হাহাকারের কথা। তবু তার শায়েরীতেই আছে বেঁচে থাকার আনন্দ। পরস্পরকে বোঝার আনন্দ -

গরমিয়াঁ মুত্তসিল রহেঁ রবাহম

নে তসাহিল হো, নে তপাফিল্ হো ।।

অর্থাৎ

এসো আমরা পরস্পরের আসক্ত থাকি চিরদিন,

না যেন হারাই আগ্রহ, না আসে উদাসীনতা।

আসলে বেঁচে থাকার আসল কথা এখানে। উদাসীন হওয়ার কিছু নেই। আগ্রহ হারাবার কিছু নেই। পশুই বলি আর মানুষই বলি জীবন মানেই কষ্ট থাকবে, ঝামেলা থাকবে। কিন্তু এতো সব কিছুর মাঝেও সুখে দুঃখে মানুষ পরস্পরকে আকড়ে ধরে বেঁচে থাকবে, নিজের জন্যে তো বটেই, অপরের জন্য বেঁচে থাকবে মানুষ। একটু ব্যথা বা ব্যর্থতার মানে এই নয় যে, মরে যেতে হবে। জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে মরে যাওয়ার মধ্যে যে কোন বাহাদূরী নেই সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর আপনার কাছে যেহেতু এই গ্যারান্টি নেই যে, এখন যেভাবে আছেন, মরে গেলে তারচেয়ে ভাল থাকবেন, তাই মরে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত না হওয়াই ভালো। মরে তো যাবেনই, আর কয়েকদিন এই পৃথিবীটাকে দেখুন, নিজের জন্য বাঁচুন, অন্য কারো জন্য বাঁচুন, অথবা এমনি এমনি বেঁচে থাকুন। বেঁচে থাকা ব্যাপারটা মন্দ নয়।

আসুন আমরা সবাই একত্রে বলে উঠি, কী সুন্দর এই বেঁচে থাকা!

তথ্যসূত্র

১. অস্বাভাবিক মনস্তত্ত্ব, ডা: অরুণ কুমার রায় চৌধুরী, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, ১৯৮৪

২. গালিবের গজল থেকে, আবু সয়ীদ আইয়ুব, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা

৩. মীরের গজল থেকে, আবু সয়ীদ আইয়ুব, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা

৪. অন্য দেশের কবিতা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা

5. Abnormal Pscychology and Mordern man, James C Coleman, India 1975

6. Abnormal Pschology - James D, New York 1947

7. Chris’s Suicide Help page

8. Dr. GHOHOL’s Mental Health Page

9. http://www.have-a-heart.com/sucide.html

10. http://www.nami.org/helpline/sucide.html

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:৪২

রোহান খান বলেছেন: ভালো লাগলো। কস্ট করেছেন অনেক ।

২| ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ১১:৩৬

মামুন রশিদ বলেছেন: খুব চমৎকার বিশ্লেষণে আত্মহত্যার মত একটা নৃশংস ব্যাপার উঠে এসেছে ।

৩| ২০ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:০৪

নূর আদনান বলেছেন: আপনজন দের সাহা্য্য-সহানুভুতিই পারে কাউকে আত্মহত্যার পথ থেকে ফেরাতে।

তবে এটা ঠিক যে, আত্মহত্যার ভাবনা একবার মনে ঢুকে গেলে তা থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়।

আপনার প্রচেস্টায় প্লাস

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.