![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দুপুরের কড়া রোদ মাথায় নিয়ে হাসান হেঁটে যাচ্ছে। রাস্তাটা সোজা চলে গেছে নদীর দিকে। নদীতে এখন গভীর পানির উপর উন্মাতাল স্রোত।নদীর পাঁড়টা ফাঁকা। নদীতে দু একটা নৌকা এদিক ওদিক আছে কিন্তু কেউ একজন ঝাঁপিয়ে পড়লে তাদের বাঁচাতে আসতে আসতে হয়ত সে ব্যক্তি ততক্ষণে উপরে পৌছে যাবে। আত্মহত্যার জন্য খারাপ না।
হাসানের এ নিয়ে চতুর্থবারের মত নদীতে আত্মহত্যার জন্য আসা। প্রথমবার ক্লাশ এইটের মিড টার্মে ফেল করার জন্য। সেদিন বাবা-মা, বড় চাচা সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে তার কেউ নেই। তারপর ঝাঁপ দিতে আসা । দ্বিতীয়বারের টা বেশি পার্সোনাল বলাই যাবে না। তৃতীয় বারেরটা এস এস সিতে এ প্লাস না পাওয়ায়। হাসানের নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছিল সেদিন। জীবনটা এখানেই শেষ। নিজের আশা, বাবার আশা, তার চাচাতো ভাই যে এত ভাল করে পড়িয়েছিল তার আশা এমন সবার আশা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।কোন ভাল কলেজে ভর্তি হতে পারবে না। বাবার এত কষ্টের টাকা তার মত গর্দভের পেছনে খরচ করার কোন মানে হয় না। শেষে ঠিক করল এই নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করবে। কোন বারই আত্মহত্যায় সফল হওয়া হয়ে ওঠে নি। শেষ সময়ে জীবনের মায়া ফিরে এসেছে। মনে হয়েছে জীবনতো একটাই! মরে যাবো! কতজনতো তার থেকেও খারাপ করে বেঁচে আছে। বাবা কতটা কাঁদবে, ছোট বোনটা "টুশি" -সে তো কিভাবে মেনে নেবে, দাদু চাচু তারা? তারা যে কি করবে হাসান কল্পণা করতে পারে নি। তাদের ভালবাসার লোভ আটকে ফেলেছে। বেঁচে থাকার শিকল পড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়াও চারপাশটা, এই পরিবেশ। মরে গেলে কি এসব আর পাবে? বুকের ভেতর হৃতপিন্ড দপদপ করত এসব ভাবার সময়। শেষে নিজের কাছে পরাজিত হয়ে বাড়িতে গিয়ে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকত। একসময় ভুলেও যেত।
তবে আজকের তপ্ত পিচঢালা ফাঁকা রাস্তা তাকে শুধু রুক্ষ করেই তুলছে। বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে মরে যাও। বাতাসের কোন আগ্রহ নেই এই উদভ্রান্ত পথিককে একটু শান্তির পরশ দিয়ে যাবে। চারিদিকে সবুজ ধানের জমি। কিছু কাকতাড়ুয়া নিশ্চল দাঁড়িয়ে সুদূর পানে চেয়ে আছে। হাসানের বুকের চাপা পড়া পাথরের ভারে চলতে কষ্ট হচ্ছে। মন শুধু বলছে আর কতদূর, ধ্বংস হবার আর কতদূর।
আজকের ব্যাপারটা মেয়ে ঘটিত।হাসানের সাথে মেয়েটা সোজা বাংলায় প্রতারণা করেছে । পৃথিবীর মানুষগুলোর মাঝে যাকে সবথেকে বেশি বিশ্বাস করত সে সব বিশ্বাসের আলুভর্তা বানিয়ে ছেড়েছুুড়ে চলে গেছে। চলে গেছে মানে হাসানের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে আরেক ছেলের সাথে যোগাযোগ শুরু হয়ে গেছে। এই প্রতারণার প্রতিশোধ হিসেবে হাসান অনেক কিছু ভেবেছিল। যেমনঃ মেয়েটার গায়ে এসিড ছুড়ে মারবে, মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যাবে, মেয়েটাকে জোর করে বিয়ে করবে,মেয়েটার যে বয়ফ্রেন্ড তাকে খুন করবে, মেয়েটাকে খুন করবে বা নিজেই খুন হবে। সবভেবে শেষে দেখল তার কাছে শুধু একটা উপায় ছাড়া বাকি সব সে করতে পারবে না।উপায়টা হল সে নিজেই নিজেকে শেষ করে দেখিয়ে দেবে সে তাকে কত ভালবাসত। অবশ্যই মেয়েটার খুব আফসোস হবে। মেয়েটা নিশ্চই নিজেকে দোষারোপ করবে। কোনদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। কাঁদবে নিশ্চই এখন যেমন হাসান কাঁদে। হাসান বিশ্বাস করে তারমত কেউ মেয়েটাকে ভালবাসতে পারবে না, বুঝতে পারবে না। মেয়েটা একদিন টের পাবে এটা। হাসানের কাছে ফিরে আসার জন্য ছটফট করবে কিন্তু হাসানকে আর পাবে না।কারণ তখন হাসান নামক এই মানুষটি পৃথিবীতে থাকবে না। হাসানের এই কথাটা বারবার মনে পড়ে আর হাসি পায়। প্রতিশোধের হাসি এটা।
রাস্তা একসময় ফুরিয়ে যায়। সামনে উন্মাতাল নদী। বাতাসে নদীর গন্ধ। হাসান ঝাঁপ দেয়ার জন্য মন স্থির করে। পকেটের ফোনটা নিয়ে বিপাকে পড়ে। পানিতে ভিজলে নষ্ট হয়ে যাবে। অন্যদিকে সে তো মরেই যাচ্ছে, এই ফোন নষ্ট হল কি পানিতে ভেসে গেল আরতো যায় আসে না। শেষে ভাবল ফোনটাতো কোন দোষ করে নি । ফোনটা পাড়ে রেখে নদীতে ঝাঁপ দিল। বেশি কিছু না ভেবেই ঝাপ। ভাবার কারণে এর আগের গুলোতে সফল হতে পারে নি। তাই এবার নট ভাবাভাবি। নদীতে ঝুপ করে একটা শব্দ হল। ডুবে গেল হাসান।
হাসান নিজেকে আবিষ্কার করল সে ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করছে। প্রাণপণ যুদ্ধ। একটু ভেসে নিশ্বাস নেয়ার জন্য দেহের সব শক্তি দিয়ে পানিতে লাথি মেরে যাচ্ছে।
হাসান ডাঙায় উঠে এল। সাঁতার জানত সে। প্রবল স্রোতের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে ফিরতে পেরেছে এই একটা কারণে। কেন এই যুদ্ধ করল নিজেই বুঝতে পারল না। বোঝার মানসিকতাও পেল না। খুব দুর্বল লাগছে। জিনসের প্যান্ট আর গায়ের গেন্জিটা লেপ্টে আছে গায়ে। পানিতে চুপচুপ করছে।
যেখানে ফোনটা রেখেছিল সে যায়গা বের করে ফোনটা হাতে নিল। কেউ ফোন করে নি। পৃথিবী যেমন ছিল তেমন আছে। তাকে ঝাঁপ দিতেও কেউ দেখে নি।
বাসায় ফিরে এল হাসান ভেজা গেন্জি আর প্যান্ট পড়ে। কেন ভেজা প্যান্ট আর গেন্জি পড়ে ঘরে এল সেটা নিয়ে হাসানকে কেউ রাগ হবে না। মাথা মুছিয়ে দিতেও কেউ এগিয়ে আসবে না। কারণ বাসায় কেউ নেই। বাবা গেছে অফিসে। ফিরবে সেই রাত আটটায়। হাসানের মা নেই। মরে যায় নি। পালিয়ে গেছে। হাসান যখন ক্লাশ নাইনে তখন এক লোকের সাথে চলে যায় এই সংসার ছেড়ে। সেদিন হাসান মনের দুঃখে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। পৃথিবীকে খুব নিষ্ঠুর মনে হচ্ছিল সেদিন। দ্বিতীয়বারের মত গিয়েছিল অথৈ পানিতে লাফ দিতে। এই সেই খুব পার্সোনাল ব্যাপার।
হাসানের মায়ের সাথে হাসানের সাথে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়। মায়ের সংসারে একটা ফুটফুটে মেয়ে আছে। নাম "টুশি"। চার বছর বয়স এখন। হাসান টুশিকে মনের অজান্তেই অনেক স্নেহ করে। টুশির বয়স হয়নি এখনও হাসানকে সৎ ভাই ভাবার তাই হাসানের সাথে আধোআধো বুলিতে কথা বলে।
হাসানের মাকে হাসান হাজার খুজেও পায় না। এ মা যেন টুশির, তার নয়। একাকিত্ব ঘিরে রাখে সবসময়। পৃথিবীর কাছ থেকে নিষ্ঠুরতার শিক্ষা পায় বারবার। আবেগ যেখানে মূল্যহীন, হাসি যেখানে আনন্দহীন, দুঃখ যেখানে শব্দহীন। ছেড়ে যাওয়া মেয়েটার মাঝে হাসান সব ভুলে যেতে চেয়েছিল। মৃত্যুর মাঝে হাসান সব ভুলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু নদীর স্রোতের মত জীবন এগিয়ে চলছে বারবার আঘাতের পরও।
©somewhere in net ltd.