![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মিনিট তিরিশের মত হলো। মাথাটা কিঞ্চিত ঝিমঝিম করছে। চায়ের কথা বলা হয়েছিল অনেক আগে। এখনো আসেনি। গত বছরের এই সময়েই কাজটা পেয়েছিল আদিল। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। শুরুতেই দশ হাজার টাকা চলে গিয়েছে। একে দেও, ওকে দেও। একজনকে পাঁচশত কম দিয়েছিল বলে কত কথাই না শুনতে হয়েছিল। কাজ পাবে না বলে কত হুমকি। কিন্তু কাজ পাওয়ার সব যোগ্যতাই ছিল আদিলের। তারপরও সিস্টেমের গ্যাড়াকল। ৩লাখ টাকার কাজ পাবে বলে কথা হয়েছিল। সবিশেষ মাত্র আশি হাজার! ভাবতেই মাথাটা গুলিয়ে আসে আদিলের। এর কাছ থেকে ওর কাছ থেকে টাকা ধার করা হয়েছে। ছোট মানুষ সে। কোন পুঁজি নাই। দুমাসের মধ্যে বিল দেবার কথা ছিল। সেখানে আজ ১০ মাস! মাথার ঝিমঝিমটা বেড়েই চলছে। লাভের টাকা পুরোটাই তো শুরুতে শেষ। পাওনাদারদের সামনে যেতে ভীষন লজ্জা করে। কম কথা শুনতে হয়নি। এইতো গত মাসেও একজন কি গালটাই না দিল। ভাবতেই আদিলের ভিতরটা কেমন যেন চুপসে আসে। এই ১০ মাসে এই টেবিল ওই টেবিল ঘুরতেই তার জুতার তলা ক্ষয় হতে চলছে। জুতার দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকে আদিল। গত ঈদে নতুন জুতার কেনার জন্য কত পীড়াপীড়িই না করেছিল পারুল। কিন্তু ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে আর কেনা হয়নি। পারুলকে একটা শাড়ী কিনে দিবে বলেছিল আদিল। বিল পাবার কথা ছিল। কত স্বপ্ন যে তার বিলীন হয়ে গেল। কিন্তু কিছুই দেয়া হয়নি। পারুল বলেছিল, আপনি বাইরে বাইরে থাকেন এক জোড়া জুতার খুব দরকার। আমরাতো সব সময় ঘরেই থাকি। কিন্তু কেনা হয়নি। বাবুর কাপড় কিনতেই তার হাত খালি।
চা এসেছে। লেবু চা। সুবাস আসছে। পিয়নটা দাঁত কেলিয়ে বলল, ভাই দেরী হয়ে গেল। খান চা খান। আদিল আবার আনমনে হয়ে যায়। ভাবে কত মানুষ এভাবেই তো বাড়ি গাড়ি করল। গরীবের পেটে লাথি মেরে আজ কোটিপতি। আর আদিলরা এভাবেই ধুকে ধুকে মরে। ঘৃনায় আদিলের মনটা ভরে যায়। চা বিষাদ লাগা শুরু করছে। কেমন যেনো তেতো লাগছে। হয়তো লেবু বেশি হয়েছে। ধাৎ! নিজের অজান্তেই বলে উঠে আদিল।
সরকারী অফিসে শুনেছি আগে এমন হয়। ফাইল চালাচালি। এখন বেসরকারী অফিসেও এমন! এত টাকা বেতন পায় তারপরেও ঘুষ খেতে হয়? ভাল মানুষের আসলে বড় অভাব।
পারুলের কথা মনে পড়ে আদিলের। বড় ভাল মেয়ে। বছর তিনেক হল তাদের বিয়ে হয়েছে। কি কষ্টই না সে করছে আদিলে সাথে থেকে। মুখ ফুটে কিছু বলে না। কোন চাওয়া পাওয়া নেই। আসলে গরীবদের চাওয়া পাওয়া থাকতে নেই। আদিলের কত স্বপ্ন ছিল। বিল পেলে এটা কিনে দিবে ওটা কিনে দিবে। পারুল শুধু হাসত। বলত, আগেতো বিল পান, তারপর না হয় দিয়েন। পারুলের হাসিমাখা মুখটা খুব মনে পড়ে।
”সরি আদিল সাহেব। আপনার বিলটা তো খুঁজে পাচ্ছিনা। মনে হয় হারিয়ে গেছে।”
আদিল সম্বিত ফিরে পায়। ”কি বলেন স্যার?”
হ্যা। টেবিলেই ছিল এখন পাচ্ছিনা।
আদিলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। এখন কি বলে এসব। বিল হারিয়ে যাওয়াটা তো ভাবতেই পারছে না। সে নিজ হাতে সব টেবিল থেকে সই করিয়ে তার টেবিলে দিয়ে এসেছে। এখন বলে বিল নাই।
হয়ত বিলটা নতুন করে আবার করা লাগতে পারে। ভ্র“ কুঞ্জিত করে কথাটা বললেন রহমান সাহেব।
আদিল আর ভাবতে পারছে না। নতুন করে বিল করা মানে আবার সব টেবিলে টেবিলে দৌড়ানো। কিন্তু সে টাকা পাবে কই? রক্ত বেচা ছাড়া আর কোন উপায় দেখছে না আদিল। কিন্তু বিল হারাবে কেন? টাকা খাওয়ার নতুন কোন ফন্দি নাকি? আদিলের মাথা ঘুরছে। কি বলবে সে?
আচ্ছা আমি আরো একবার খোঁজ করে দেখি। রহমান সাহেব কথাটা বলতে বলতে চলে গেলেন।
আদিল এখন কি করবে? কোথায় পাবে সে টাকা? আসলেই কি হারিয়ে গেছে? নানা প্রশ্ন আদিলের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে? কিন্তু এর সমাধান কি?
এইতো কিছুদিন আগে পারুলের নাকফুল আর কানের দুল জোড়া বন্ধক রেখেছিল আদিল। বিল না পাওয়ায় তা আর ছাড়ানো হয়নি। পারুলের কথা মনে পড়তেই ভিতরটা কেমন যেন মুষড়ে উঠে আদিলের।
আদিল উঠে দাড়ায়। রহমান সাহেবের রুমের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। আদিল খেয়াল করছে তার পা কাপছে। দরজা ভিজানো ছিল। দরজা হালকা ঠেলে গলা গলিয়ে দিল আদিল।
স্যার আসতে পারি?
হ্যা আসুন।
স্যার আমি অত্যন্ত গরীব মানুষ। অনেক ঋণ করে এ কাজটা করেছিলাম। মানুষের কাছে এখন লজ্জায় মুখ দেখাতে পারিনা।
আদিল সাহেব আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। কিন্তু..............
আদিল তার হাতের দিকে তাকায়। বাম হাতে ওয়েস্টার ব্যান্ডের ঘড়ি। বিয়ের সময় এটা পেয়েছিল। দামি ঘড়ি। ৩ হাজার টাকা। খুব যতœ করে পড়ে সে। পারুল ও এ ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি। সেও এই ঘড়িটা খুব পছন্দ করে। প্রায়ই ও বলে, দেখেন ঘড়িটা খুব যতœ করে পড়বেন। কোথায় যেন একটু ঘষা না লাগে। আদিলও খুব যতœ করে। দেখতে একদম নতুনের মত।
স্যার আমার কাছে আর কিছু নাই। এটা রাখেন। ব্যান্ডের ঘড়ি। একদম নতুন। আপনার হাতে খুব মানাবে। কেউ বলবেই না এটা সেকেন্ড হ্যান্ড।
আদিল গলা জড়িয়ে আসে। সে কথা বাড়াতে পারছে না।
স্যার আমি কালকে আসব। দয়া করে কালকে বিলটা পাইয়ে দিবেন। প্লিজ স্যার।
রহমান সাহেব কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। তার চোখ চকচক করছে।
আদিল দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসে। তার শরীর কাপছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কি জবাব দিবে সে পারুলকে। কিন্তু তারতো কিছু করার ছিল না। আদিলের ভীষন কান্না পাচ্ছে। সে সিড়ির মাঝে ধপ করে বসে পড়ে। গলা বন্ধ হয়ে আসছে। কাঁেচর বাইরে দিয়ে সে আকাশ দেখে। মেঘগুলো খুব দ্রুত কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। দূর থেকে আরো দূরে। নীল আকাশ ক্রমশ ধূসর হয়ে আসে আদিলের কাছে।
©somewhere in net ltd.