নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পরিচয় বলতে আপাতত দেয়ার মত কিছু নেই!
যখন লিখতে বসেছি তখন আমি মোটামুটি সুস্থ তবে নাকের ভিতরে প্লাস্টিক থাকার কারনে কথা বলতে বা খাওয়া-দাওয়া করতে অস্বস্তি হয়। আচ্ছা এবার শুরু থেকে শুরু করা যাক।
বরিশাল আমার কাছে একটা নস্টালজিয়া সেই সাথে শের-ই-বাংলা মেডিকেলও।এবারের আগে হাসপাতালে একবারই থাকা হয়েছিলো এবং সেটাও এখানেই,নানুর ক্যান্সারের সময়। নানু সবসময়ই প্রাসঙ্গিক। জীবনের কোনো না কোনো ক্ষেত্রে প্রায় প্রতিদিনই নানু প্রাসঙ্গিক। এবার যখন অপারেশনের সবকিছু ঠিক ঠাক হয় তখনই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম যে এবার হাসপাতালে থাকবো এবং নানু যেখানে ছিলো সেই ওয়ার্ড ঘুরে দেখবো। তা সবই দেখা হয়েছে কিন্তু ওইভাবে কিছু মনে করতে পারিনি,২০ বছর আগের কথা তো।তখন তো আর জানতাম না ২০ বছর পরে ঘটনাক্রমে আমাকে আবার এখানে হাজির হতে হবে।
হাসপাতালে থাকতে হয়েছে আমাকে একরকম যুদ্ধ করেই।নয়ন,সৌরভ,শুভ,আকিব সবার কাছেই থাকার যায়গা ছিলো এবং সবার জোরাজুরির সত্যেও আমি হাসপাতালে থাকারই সিদ্ধান্ত নেই।নয়ন তো পারলে তুলে নিয়ে যায়।পরে ওরে যখন কারন ব্যাখ্যা করলাম ওর তো হাসতে হাসতে বিাষম খাওয়ার অবস্থা।
জীবনে সবরকম অভিজ্ঞতাই কম-বেশি দরকার আছে। সজ্ঞানে হাসপাতালে থাকর অভিজ্ঞতা, রোগী, ভিজিটর এবং মানুষদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করাই ছিলো আমার ওখানে থাকর মূল উদ্দেশ্য।
প্রথম দুদিন গড়ে ৩ ঘন্টাও বোধহয় ঘুম হয়নি। আমার পাশের বেডেই থাকতেন এক দম্পতি। উনারা প্রায় ৪৫ দিন ধরে এখানে ছিলেন। ভদ্রলোকের কানে অনেকগুলো সেলাই দেখেছিলাম।সম্ভবত কোনো একটা এক্সিডেন্টে তার কান মাথা থেকে অলমোস্ট আলাদা হয়ে গিয়েছিলো। অসুস্থ হওয়া সত্যেও উনার স্ত্রীকে বেডে ঘুমাতে দিয়ে উনি নিজে ঘুমাতেন ফ্লোরিং করে আমার বেডের পাশে। প্রথম দিন রাতে বিছানায় শুয়েছি, ঘুম আসবে আসবে ভাব এমন সময় তার ঢেকুর উঠেছে। উঠেছে তো উঠেছেই তা আর থামার নাম নোই।ভাবলাম বলি যে পানি খান।পরে ভাবলাম না থাক মুরুব্বি মানুষ কি না কি মনে করে। পরের রাতে আবার একই ঘটনা। খুবই বিরক্তি লাগছিলো।এমনিতেই আগের রাতে ঘুম হয়নি মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। তখন মনে হচ্ছিল নয়ন এত করে বলছিলো ওর বাসায় গেলেই ভালো হতো। পরেরদিন সকালে ডাক্তার যখন রেগুলার ভিজিটে আসে তখন তাদের জানায় যে আজকে তাদের রিলিজ করে দিবে। এই খবর শোনার পরে ভদ্রমহিলার যে রিএ্যাকশন আমি দেখেছি তা জীবনে ভুলবোনা। এমন ভয়ংকর চোখ আমি আমার জীবনে দেখিনি। দীর্ঘ ৪৫ দিন পরে ছাড়া পাওয়ার আনন্দের প্রতিফলন তাদের চোখেমুখে স্পষ্ট ফুটে উঠতে দেখেছি। তাদের তখনকার আনন্দ দেখে গত দু'দিনের সকল বিরক্তি দূর তো হয়ে ছিলোই এমনকি আমার নিজেরও আনন্দ হচ্ছিল। আনন্দ কি সংক্রামক? দুঃখের মত! পরে অবশ্য জানতে পারি উনার ঢেকুরের কারন মূলত হাই পাওয়ারের ঔষধ।
উনারা চলে যাওয়ার পরে ওই সিটে আসে আরো এক দম্পতি। লাইক টু লাইক সাবস্টিটিউট বাট মাচ মোর ইয়াংগার, হাহাহা।এর আগে যারা ছিলেন তারা ছিলেন দাদা-দাদি আর এখন যারা আছেন তাদের বাচ্চার বয়স কেবল ৫।
আমার কাছে মনে হয় জেলখানা আর হাসপাতালের মধ্যে অনেকখানি মিল আছে।দুইটা দিকের কথা সরাসরি বলাই যায়।দুই যায়গাতেই ফ্রিকোয়েন্টলি মানুষ চলে যায় আবার নতুন মানুষ তার শূন্যস্থান পূরণ করে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে জেলে এবং হাসপাতালে সবাই আপনার আপন এখানে কোনো শত্রু নাই। এই কথার প্রমান সামনে লেখার মধ্যেই আসবে। যদিও কখনো জেলের এক্সপ্রিয়েন্স হয়নাই তবে ইচ্ছা আছে নিশ্চই।
আমাদের ওয়ার্ডের ৩ জনের অপারেশন আজকে।সকাল ৮টায় সবাইকে ওটির সামনে থাকতে হবে এবং এরপরে সবাইকে সিরিয়াল অনুযায়ী ওটিতে ঢোকানো হবে। আমরা সবাই ওটির সামনে অপেক্ষা করছি। অন্য ওয়ার্ডের ২/১ টা অপারেশনের পরেই আমাদের ওয়ার্ডের একজনের ডাক আসলো। ওরে ভিতরে ঢোকানো হলো,ওর অপারেশন হচ্ছে আর বাইরে আমরা অপেক্ষা করছি।ওয়ার্ডের অন্যান্য রোগীরা যাদের অপারেশন হয়েছে এবং সামনে যাদের হবে তারা কিছুক্ষণ পরপরই খোঁজ নিচ্ছেন, কিছু লাগবে কিনা জানতে চাচ্ছেন।একদম বিশুদ্ধ আন্তরিকতা এখানে কোনো ভনিতা নেই। মনে হতে পারে এটা তো স্বাভাবিকই কিন্তু আমার কাছে এটা বিশেষ কিছু কারন অন্য রোগীদের অপারেশনের সময় আমি যাইনি বা যাওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। কিন্তু উনারা যখন খোঁজ খবর নিতে আসলেন তখন আমার উপলব্ধি বদলে গেলো। কারো বিপদের সময় একটুখানি পাশে থাকা যে কতখানি সাহস দেয় তা ওই সময়ের ভিতর দিয়ে না গেলে কখনোই বোঝা সম্ভব না। এজন্যই কিছুক্ষণ আগে বলেছিলাম জেলে এবং হাসপাতালে সবাই আপনার আপন এখানে কোনো শত্রু নাই।
আচ্ছা এইবার আমার অপারেশন অভিজ্ঞতার কথা বলা যাক। আমি আসলে নার্ভাস ছিলাম কিংবা একটু ভয়েও।এই কারনে না যে অপারেশন হবে কি না কি হবে। আমার ভয়টা ছিলো শুধু আমি যাতে কাঁটাছেঁড়ার সময় টের না পাই ব্যাস এটুকুই পরে যা হবার হবে। অপারেশন থিয়েটারে ঢুকলাম,এনেস্থিসিয়া পুশ করলো তার কিছুক্ষণ পরেই আমি অজ্ঞান। জ্ঞান হারানোর আগে টের পেলাম ভিতরে নয়ন আছে এবং মামা আছে। পরে আম্মুর থেকে জেনেছি আমি ভিতে ঢোকার ২ মিনিট পরেই মস্তফা মামা ওটিতে গিয়েছে। আর নয়ন একবার বের হয়ে ওর ওটি ড্রেস গায় দিয়ে আবার ঢুকেছে। নয়ন আর মামা ভিতরে আছে এই বিষয়টা আম্মুকে খুব সাহস দিয়েছে। এখানেও নানু প্রাসঙ্গিক, নানুর কথা মনে পড়ে যায়। নানুর ক্যানসার ধরা পরে, নানু তখন হাসপাতালে ভার্তি। মস্তফা মামা তখন কেবল স্টুডেন্ট, সুযোগ পেলেই নানুকে দেখে যাচ্ছেন খোঁজ খবর নিচ্ছেন। আর এখন কালের পরিক্রমায় তিনি ডাক্তার আমি তার পেশেন্ট। কাকতালীয়? আচ্ছা কথা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। আমার যখন জ্ঞান ফেরানো হলো তখন বোঝার চেষ্টা করলাম কি হচ্ছে, আমার কি অপারেশনের মাঝেই জ্ঞান ফিরে এলো? প্রথমেই আমি যে প্রশ্নটা করলাম তা হলো,অপারেশন শেষ?উত্তর এলো,হ্যা। তখন একদম হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, এটলিস্ট অপারেশনের সময় তো আলাপ পাইনি। এরপরে আবার মনে হলো ধীরে ধীরে জ্ঞান হারাচ্ছি। জ্ঞান হারানোর আগে শুধু এটুকু আছে,আমাকে ওটি থেকে স্ট্রেচারে করে পোস্ট ওটিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আর স্ট্রেচার থেকে নামানোর সময় সৌরভ আমার কোমর ধরে আছে। এরপর আর কিছু মনে নেই। আমার অপারেশন হতে সময় লাগে ১ ঘন্টার কিছু বেশি। সৌরভ হাসপাতালে আসছে সকাল ৮টায় আর আমাকে ওটিতে থেকে বের করছে দুপুর ২টায়। এই পুরাটা সময় ও আমার, আম্মুর পাশে ছিলো।ও না থাকলে হয়ত আমাকে ওটিতে নেয়ার পরে আম্মু ভেঙে পরত। একই সাথে পুরাটা সময় আমার ছোট বোনকে সামলিয়েছে যা কিনা দুনিয়া সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর মধ্যে একটা। আম্মু পারে আমারে বলতেছে, তুই হইলে জীবনেই পারতিনা। আমারও মনে হয় আমার পক্ষে এগুলো সম্ভব না।
জীবনে বিভিন্ন সময় নানান রকম মানুষ থেকে আনএক্সপেক্টেড ভালোবাসা পেয়েছি। আমাকে যে এত মানুষ ভালোবাসে তা জানা ছিলোনা, এই সামান্য অপারেশন আমাকে জানান দিয়ে গেলো।
আমার জীবনের অন্যতম ফ্লেক্স হচ্ছে আমার বন্ধুরা। এরজন্য ফ্যামিলি থেকে,আত্মীয়-স্বজন থেকে নানা রকম কথাও শুনতে হয়েছে বিভিন্ন সময়। তাই আমিও সুযোগ পেলে খোঁচা দিতে ছাড়িনা। এই অপারেশনের পুরোটা সময় ওরা আমাকে যেভাবে আগলে রেখেছে তার সবটা না হলেও কিছুটা কথা আমি শেয়ার করতেই চাই। বরিশালে যাওয়ার পর থেকে মেডিকেল রিলেটেড কোথায় কি লাগবে সবরকম হেল্প নয়ন করেছে একদম গার্ডিয়ানের মত করে। টেস্ট করানো,এক্সরে করানো, অপারেশন রিলেটেড কোয়েরি করা, এখানে দৌড়ায় ওখানে দৌড়ায়। হাসপালে থাকতে দিবেনা আমাকে ওর বাসায় নিবেই।পরে অবশ্য ওর বাসায় গিয়ে একদিন থেকেছি। আর আমিতো ওরে জ্বালিয়েছিই।পুরোটা সময়ই ওর একটা ভালো ব্যস্ততা গিয়েছে। আর সৌরভের কথা তো আগেই বলেছি। ও না থাকলে সমস্যাই হয়ে যেত। অপারেশন শেষে ওটি থেকে যখন পোস্ট ওটিতে নেয়া হচ্ছে স্ট্রেচারে করে তখন অল্ল অল্প জ্ঞান আছে। স্ট্রেচার থেকে যখন বেডে নামানো হচ্ছে তখন চোখ বন্ধ কিন্তু আমি টের পাচ্ছি সৌরভ আমার কোপরের দিকটা ধরে আছে। বেডে শোয়ার পরে আবার দুই ঘন্টা কোনো জ্ঞান নেই।এরপরে যখন জ্ঞান আসলো তখন আমাকে পোস্ট ওটি ওয়ার্ড থেকে নাক-কান-গলা ওয়ার্ডে সিফ্ট করা হবে। তখন ডাক দেয়া হলো নাঈমের লোকজন করা আছেন উনাকে একটু ধরতে হবে।দেখি সজল,আমিন,তন্ময় উপস্থিত। আমি জানতামনা ওরা আসছে। তখন আমার মনে হয়েছে আমার বন্ধুরা বোধহয় আমাকে একমুহূর্তের জন্যেও চোখের আড়াল হতে দিবেনা। ওইদিন একটা ফ্রেন্ডের বিয়ে ছিলো। ওইখানে ওদের থাকা লাগছে, তা সত্যেও ওরা টাইম ম্যানেজ করে চলে আসছে। ওরা না আসলে হয়ত সমস্যা ছিলোনা কিন্তু তারপরেও এইযে চলে আসা দিন শেষে এইসব মুহুর্ত গুলোই থেকে যায়। আর বাকি থাকে শুভ,শুভর ফ্যামিলি। আমি আসলে ওদের কথা আলাদা ভাবে বলতে চাইনা। কারন ওইটা আমারই আরেকটা ফ্যামিলি। আম্মু বরিশাল যাওয়ার পরে ওদের বাসায়ই থেকেছে। আন্টি খোঁজ খবর নিয়েছে কখন কি লাগবে না লাগবে।শুভ অফিস টাইমের আগে,অফিস টাইমের পরে যখনই সুযোগ পেয়েছে সময় দিয়েছে। ওইসব কথা পরে হবে। অনেকেই হয়ত আসার ইচ্ছে থাকার পরেও আসতে পারেনি। অনেকেই ফোন করেছে,বারবার খোঁজ নিয়েছে,কন্সার্ন সো করেছে।অনেকেই নিয়মিত আপডেট নিয়েছে। সবার কথা আলাদা ভাবে লিখতে গেলে লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে তাই আলাদা করে আর লিখলাম না। সবার কাছেই আমি কৃতজ্ঞ। আমি ক্ষুদ্র মানুষ,অনেক অনেক ঋণী হয়ে রইলাম সকলের কাছে। এই ছোট্ট জীবনে সঞ্চয় বলতে এইসব ভালোবাসাই।
২৭.১১.২৪
২| ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৮
রাজীব নুর বলেছেন: আহারে---
মায়া হচ্ছে আপনার জন্য।
©somewhere in net ltd.
১| ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮
শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু বলেছেন: বন্ধুত্ব চিরকালের। দোয়া করি সুস্থ হয়ে উঠুন।