নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চিন্তা হচ্ছে কাজের সূক্ষ্ম শরীর

"আকাশে নক্ষত্র দেখে নক্ষত্রের মতন না হয়ে পারিনি আমি / নদী তীরে বসে তার ঢেউয়ের কাঁপন, / বেজেছে আমার বুকে বেদনার মত / ঘাসের হরিৎ রসে ছেয়েছে হৃদয়"। _আহমদ ছফা

আবু নাঈম

'আগুনের ছবি দেখতে আগুনের মতো দেখালেও পোড়াবার ক্ষমতা থাকে না' _ আহমদ ছফা

আবু নাঈম › বিস্তারিত পোস্টঃ

মেঘনাদ সাহা : জগৎ সভায় বাংলার মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন যে বাঙালি বিজ্ঞানী

২১ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১২:৪৪

আগামী ২৩ অক্টোবর সকালে মেঘনাদ সাহার স্মরণে গাজীপুর চৌরাস্তায় চান্দনা উচ্চ বিদ্যালয়ে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ আলোচনা সভাকে সামনে রেখে মূলত স্কুলছাত্রদের উপযোগী করে বিজ্ঞানী সাহার জীবনী তুলে ধরে একটি ছোট পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়েছে। আমি ওই পুস্তিকাটি সামহোয়্যারের পাঠক বন্ধুদের জন্য ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করব। সাথে সাথে যারা গাজীপুর এবং আশেপাশে অবস্থান করেন তাদের সবাইকে অনুষ্ঠানে আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।





মেঘনাদ সাহা

পর্ব - ১



আজ থেকে একশ বছর আগের ঘটনা। ১৯০৫ সাল। বড়লাট লর্ড কার্জন বাংলাকে দুই ভাগে ভাগ করার ঘোষণা দিয়েছেন। তার এ পরিকল্পনার উদ্দেশ্য সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তির অন্যায় শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাংলার প্রতিবাদী জনতার শক্তিকে ভাগ করে দুর্বল করে ফেলা। আর সে কারণে ওই ঘোষণার প্রতিবাদে সারা বাংলা জুড়ে চলছে আন্দোলন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ চালু করলেন রাখি-বন্ধন; তিনি লিখলেন “বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল, / পুণ্য হউক পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।” হৃদয়ের সমস্ত আবেগ উজাড় করে তিনি লিখলেন, “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি”। বাংলা জুড়ে শুরু হল বিদেশী পণ্য বয়কট, হাটে-বাজারে বিদেশী কাপড় বিক্রি বন্ধ এবং পুড়িয়ে ফেলা, পাশাপাশি স্বদেশী পণ্য ও কাপড় ব্যবহার।

এ আন্দোলন চলার সময়ই তৎকালীন ঢাকার সেরা স্কুলের একটি, কলেজিয়েট স্কুল থেকে কয়েকজন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হল। কি অপরাধ তাদের? না, তারা পরীক্ষায় নকল করেনি বা কোনো শিক্ষককে অপমান-অসম্মানও করেনি। তারা সেদিন খালি পায়ে স্কুলে গিয়েছিল। কিন্তু এ সামান্য ঘটনাও সেদিন স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে বেশ বড় অপরাধ হিসাবে গণ্য হল। কারণ সেদিনই স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন তৎকালীন বাংলার গভর্নর বামফিল্ড ফুলার। এই ফুলারের হাতে সেদিন বাংলাদেশে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের অসংখ্য কর্মী নির্মমভাবে নির্যাতিত হয়েছিল। ফলে তার আগমনের প্রতিবাদে সেদিন স্কুলের ছাত্ররা অনেকেই খালি পায়ে স্কুলে গিয়েছিল। আর এ অপরাধেই তাদের বহিষ্কার করা হল।

কিন্তু ইতিহাসের কি উল্টো গতি! একদা বহিষ্কৃত ছাত্রকেই তিরিশ বছর পর সাদরে ডেকে নিয়ে গেলেন কলিজিয়েট স্কুল কর্তৃপড়্গ। শুধু তাই নয়, তারা ঘোষণা করলেন বহিষ্কৃত এ ছাত্রের জন্য কলিজিয়েট স্কুল গর্বিত। কে সেই ছাত্র, কি তাঁর পরিয়চয়? তাঁর নাম মেঘনাদ সাহা, যাঁকে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের (Astrophysics) জনক হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়, যিনি নোবেল পুরস্কারের জন্যও মনোনীত হয়েছিলেন; যাঁর সম্পর্কে বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলতেন - “Dr. M. N. Saha has won an honoured name in the whole scientific world”।



ঢাকার অদূরে বংশাই নদীর তীরে শেওড়াতলী গ্রাম। বর্তমানে এই গ্রামটি অবস্থিত গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর থানায়। ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর এই গ্রামেই জন্মেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা। তাঁর পিতার নাম জগন্নাথ সাহা, মায়ের নাম ভুবনেশ্বরী। স্থানীয় বলিয়াদী বাজারে ছিল পিতার ছোট মুদি দোকান। পাঁচ ভাই ও তিন বোন নিয়ে বিশাল পরিবার। দিন চলত অভাবের সাথে যুদ্ধ করে।

সাত বছর বয়সে মেঘনাদ সাহা ভর্তি হন গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। তাঁর বয়স যখন দশ, তখন প্রাইমারি স্কুলের পাঠ শেষ করে হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার সময়। গ্রামে হাইস্কুল না থাকায় পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। পিতামাতাও চাইতেন ছেলে লেখাপড়া না করে বরং বাবার সাথে মুদি দোকানদারি করুক। তাতে অভাবী পরিবারের কিছুটা হলেও উপকার হবে।

বাড়িতে পড়াশোনার তেমন কদর ছিল না। মেঘনাদের বাবা-মা কেউই তার পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে খুশি হলেন না। শোনা যায়, পড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বাবা তাঁকে বহুবার লাঠিপেটা করেছেন। কিন্তু মেঘনাদ সাহার পড়াশোনায় প্রচণ্ড আগ্রহ। বাবার বিরূপ মনোভাবও তাঁকে দমাতে পারেনি। মায়ের একটা নীরব সমর্থন ছিল। আর বড় ভাই জয়নাথের ইচ্ছা ছিল ছোট ভাইয়ের পড়া অব্যাহত থাকুক। তিনি এসে পাশে দাঁড়ালেন। বাড়ি থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে শিমুলিয়া মিডিয়ম ইংলিশ স্কুলে তাঁর ভর্তির ব্যবস্থা করে দিলেন। প্রথম দিকে প্রতিদিন দশ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে আসা-যাওয়া করতেন। পরে অনন্ত কুমার দাস নামের একজন ডাক্তার তার বাড়িতে বিনাখরচে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। কিন্তু তাতে কষ্ট কমেনি। লজিং বাড়িতে থালা-বাসন মাজা, গরুর ঘাস কাটার কাজও তাঁকে করতে হয়েছে। মধ্য-ইংরেজি (মাইনর) পরীক্ষায় মেঘনাদ সমগ্র ঢাকা বিভাগের (ঢাকা প্রেসিডেন্সি) মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পিতা একভাবে মনস্থির করেই রেখেছিলেন -- এবার মেঘনাদকে মুদি দোকানে বসাবেন। কিন্তু মেঘনাদ শুধু যে ভাল ফল করলেন তাই নয়, মাসিক চার টাকা বৃত্তিও লাভ করলেন। এর ফলেই অভাবী পিতা তাঁকে ঢাকায় পড়তে পাঠাতে রাজি হলেন।



১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভর্তি হন ঢাকার কলিজিয়েট স্কুলে, বিনাবেতনের ছাত্র হিসাবে। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে দেশ তখন উত্তাল। আন্দোলনের সমর্থনে বিলাতি পণ্য বর্জন করে খালি পায়ে স্কুলে যাওয়ায় (মতান্তরে প্রতিবাদ সভায় যোগ দেওয়ায়) স্কুল থেকে বিতাড়িত হন মেঘনাদ। জানা যায়, তিনি এমনিতেই খালি পায়ে স্কুলে যেতেন। বাংলার তৎকালীন গভর্নর বামফিল্ড ফুলারের পরিদর্শন উপলক্ষে প্রধান শিক্ষক সবাইকে জুতো পায়ে দিয়ে স্কুলে আসতে আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু মেঘনাদ সে আদেশ মানেন নি। এই অপরাধে তাঁর ছাত্রত্ব গেল, সঙ্গে ফ্রি-স্টুডেন্টশিপও। সাহা পড়ল অথৈ জলে।

কলিজিয়েট স্কুলের পাশেই ছিল কিশোরীলাল জুবিলি স্কুল। এটি পরিচালিত হত স্থানীয় জমিদার ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সহায়তায়। এই স্কুলের কর্তৃপক্ষ বিনা খরচে পড়ার সুযোগ করে দিলে তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে সক্ষম হন। বলে রাখা ভাল, সেদিন কলিজিয়েট স্কুল থেকে বহিষ্কৃতদের মধ্যে আরও ছিলেন নিখিলরঞ্জন সেন। ইনিও পরবর্তীতে শুধু দেশে নয়, সারা দুনিয়ায় বিজ্ঞানী হিসাবে পরিচিতি ও খ্যাতি লাভ করেছিলেন।



এ সময় তিনি একটি খ্রিস্টান মিশনের (ব্যাপটিস্ট মিশন) রচনা প্রতিযোগিতায় বয়োজ্যেষ্ঠ্য ডিগ্রি ক্লাসের ছাত্রদের পরাজিত করে ১০০ টাকা পুরস্কার লাভ করেন। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ববঙ্গের ছাত্রদের মধ্যে প্রথম এবং গণিত-সহ চার বিষয়ে সকল পরীক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে এন্ট্রান্স পাস করেন। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ঢাকা কলেজ থেকে ১৯১১ সালে আই·এস·সি· পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান লাভ করেন। পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন আরেক বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু।

এরপর মেঘনাদ সাহা গণিত বিষয়ে অনার্স পড়ার জন্য ভর্তি হন কলিকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৯১৩ সালে বি·এস·সি· পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। প্রথম হয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ১৯১৫ সালে এম·এস·সি· পরীক্ষায় ফলিত গণিতে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। এবারও প্রথম হন সত্যেন বসু। বাংলার এ দুই রত্ন ছিলেন পরস্পরের বন্ধু, কিন্তু দু’জনের মধ্যে প্রতিযোগিতাও ছিল। অবশ্য ওই সময়টাই ছিল যেন রত্নগর্ভা। একদিকে কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র, জগদীশ চন্দ্র বসু, ডি এন মল্লিক প্রমুখ। তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জে· এন· মুখার্জী, নিখিলরঞ্জন সেন প্রমুখ যাঁরা পরবর্তীকালে সকলেই বিজ্ঞানী হিসাবে বিখ্যাত হয়েছিলেন। সাহাদের ওপরের ক্লাসে ছিলেন প্রশান্ত চন্দ্র মহালনবিশ ও নীলরতন ধর। এ দু’জনও বিজ্ঞানে বিশিষ্ট অবদানের জন্য খ্যাতিমান হয়ে আছেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন মেঘনাদের এক ক্লাস নিচের ছাত্র। কিন্তু দুজনের মধ্যে খুব অল্পদিনের মধ্যেই নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে যা আজীবন বজায় ছিল।



১৯১৪ সালে বাংলা অঞ্চলে বন্যার সময় তিনি ত্রাণ কাজে নিযুক্ত হন এবং স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করেন। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলতেন - ‘বিজ্ঞান অপেক্ষা করতে পারে, কিন্তু স্বরাজ অপেক্ষা করতে পারে না।’('Science can wait but Swaraj can not') আচার্য রায়ের এই কথা মেঘনাদ সাহাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। জানা যায়, তিনি বিপ্লবী অনুশীলন সমিতির সদস্য হয়েছিলেন। বিপ্লবী দলের সদস্য বাঘা যতীন, পুলিন দাশ প্রমুখের সাথে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। পুলিন দাশের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটেছিল ঢাকায়। আর বাঘা যতীন কলকাতায় এলে সাহাদের কলেজ স্ট্রিটের মেসেই উঠতেন। এসব বিপ্লবীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অপরাধে ব্রিটিশ সরকার মেঘনাদ সাহাকে ফিনান্স পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দেয়নি। ফলে কয়েক বছর অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটান। ১৯১৭ সালে তাঁর প্রথম প্রবন্ধ ‘অন ম্যাক্সওয়েল স্ট্রেসেস’ প্রকাশিত হয় ফিলজফিক্যাল ম্যাগাজিনে। এ সময় থেকেই তাঁর বিভিন্ন গবেষণাপত্র প্রকাশিত হতে থাকে। এরপর ১৯১৮ সালে নবগঠিত বিজ্ঞান কলেজে অধ্যাপনার কাজ পান। এখানে গবেষণা করে পর পর দুই বছরে ডি·এস·সি· এবং পি·আর·এস· হন। গবেষণার বিষয় ছিল রিলেটিভিটি, প্রেসার অফ লাইট ও অ্যাস্ট্রোফিজিক্স। ১৯১৮ সালেই এস· চক্রবর্তীর সাথে যুগ্মভাবে ‘আলোর চাপ’ গবেষণা পত্রটি রচনা করেন। ১৯১৯ সালে ‘আলোর চাপ’ সংক্রান্ত গবেষণার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি লাভ করেন। এ বছরই ‘অন দ্য হাভার্ড ক্লাসিফিকেশন অব স্টেলার স্পেকট্রা’ বিষয়ে গবেষণার জন্য প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন। পরের বছর ‘অরিজিন অব লাইনস ইন স্টেলার স্পেকট্রা’ বিষয়ে তিনি গ্রিফিথ পুরস্কার লাভ করেন।

১৯১৯ সালে সহপাঠী ও সতীর্থ সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সাথে মিলে আইনস্টাইনের ‘থিউরি অব রিলেটিভিটি’ অর্থাৎ আপেক্ষিকতার তত্ত্বটি মূল জার্মান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে বলা যায়, মূল জার্মান থেকে প্রথম ইংরেজি অনুবাদের কৃতিত্ব তাঁদেরই। এরপর মাত্র ২৭ বছর বয়সে ১৯২০ সালে ‘থিওরি অব থার্মল আয়নিজেশন’ (Theory of thermal ionization বা তাপীয় আয়নন তত্ত্ব) বিষয়ে গবেষণার জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও পরিচিতি অর্জন করেন। এটিই পরে Saha’s equation (সাহার সমীকরণ) নামে পরিচিতি লাভ করে। তাঁর এই তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে দেয়। এই তত্ত্বের সাহায্যে সাহা ব্যাখ্যা করলেন কেন সূর্যের বর্ণালীতে সিজিয়াম বা রুবিডিয়াম থাকবে না। সেই সাথে তিনি এও ভবিষ্যদ্বানী করেন, যদি সূর্যের দেহের অপেক্ষাকৃত কম তাপ বিশিষ্ট অংশের বর্ণালী নেওয়া যায় তবে সেখানে মৌলগুলির উপস্থিতি দেখা যাবে। গবেষণার সাহায্যে তিনি যে তত্ত্ব আবিষ্কার করলেন সেটি ল্যাবরেটরিতে ব্যবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে প্রদর্শনের জন্য আমন্ত্রণ পেলেন লন্ডন ও বার্লিন থেকে।



সাহা সমীকরণ সূর্যের বর্ণমণ্ডলের রহস্য ভেদ করে তার সঠিক ব্যাখ্যা দুনিয়ার সামনে হাজির করেছিল এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে এনেছিল আমূল পরিবর্তন। জ্যোতিঃপদার্থ বিজ্ঞান এক রুদ্ধদ্বারে আটকা পড়েছিল। কেবল তথ্য সংগ্রহ করা ছাড়া আর কোনো অগ্রগতি ছিল না। এই রুদ্ধদ্বার উন্মুক্ত হল যখন মেঘনাদ সাহা তার তাপ আয়নন তত্ত্ব প্রকাশ করে জ্যোতিঃপদার্থ বিদ্যায় এর প্রয়োগ ব্যাখ্যা করলেন। বলা যায়, গ্যালিলিওর পরে জ্যোতির্বিজ্ঞানে যত আবিষ্কার হয়েছে সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দশটি আবিষ্কারের মধ্যে অন্যতম হল মেঘনাদ সাহার এই আবিষ্কার। এ আবিষ্কারের জন্য সাহার নাম নোবেল কমিটিতে প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু তখন পর্যন্ত জ্যোতিঃপদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল প্রদানের বিষয়টি চালু না হওয়ায় তিনি নোবেল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হন - এমনটাই অনেকের ধারণা। অবশ্য কারো কারো ধারণা, ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় এর ৭ বছরের মাথায় আরো একজন বাঙালি ভারতীয় নোবেল পুরস্কার পাবে এটা নোবেল কমিটির সদস্য এবং অনেক ইউরোপীয় বিজ্ঞানীর সায় পায়নি।



ইউরোপ থেকে দুই বছর পর ভারতে ফিরে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স বিভাগে প্রথম ‘খয়রা অধ্যাপক’ হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৯২৩ সালে বেঙ্গল রিলিফ কমিটিতে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সাথে সহযোগী হিসাবে কাজ করেন। ১৯২৩ খ্রি· এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং সেখানে ১৫ বছর কাজ করে ‘স্কুল অব ফিজিক্স’ নাম দিয়ে পদার্থবিদ্যার শিক্ষাকেন্দ্র ও গবেষণাগার গড়ে তোলেন। ১৯৩৪ খ্রি· বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে তিনি সর্বপ্রথম ভারতের সর্বাঙ্গীন উন্নতিতে বিজ্ঞান প্রয়োগের কথা বলেন। বক্তৃতায় সীমাবদ্ধ না রেখে ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাঁর ‘শিল্প প্রসার ও জাতীয় পরিকল্পনা’র কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পন্ডিত জওহরলাল নেহেরম্ন, নেতাজী সুভাষকে জানান। ১৯৩৮ খ্রি· কলকাতায় ফিরে এসে তিনি বিজ্ঞান কলেজের ‘পালিত অধ্যাপক’ হন।



বিজ্ঞান চর্চা ও এর প্রসার ছিল সাহার আজীবন সাধনা। কিন্তু রাজনীতির সাথেও ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ সংযোগ। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। বিশেষত সুভাষ বসুর সাথে কলেজ জীবন থেকেই তাঁর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। ১৯৩৮ সালে সুভাষ বসু কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলে সাহা অত্যন্ত আনন্দিত হন এবং তাঁকে অভিনন্দন জানাতে যান। কংগ্রেসের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে বিজ্ঞান চর্চা এবং শিল্প স্থাপন সম্পর্কে যে মনোভাব প্রকাশিত হচ্ছিল তাতে সাহা খুবই ক্ষুব্ধ ছিলেন। কংগ্রেসের, বিশেষত গান্ধীর খাদি, চরকা কাটা, হস্তশিল্পায়ন নীতির তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। কারণ তাঁর মতে, এগুলি এ যুগে অচল এবং গ্রামে ফিরে যাওয়ার ভাবালুতা ছাড়া আর কিছু নয়। গান্ধীর নীতিকে তিনি ‘গরুর গাড়ির নীতি’ আখ্যা দিয়েছিলেন। বাজে কথায় সময় নষ্ট না করে তিনি সুভাষের কাছে দেশের সমস্যা দূর করার উপায় এবং বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণার বিষয়ে কংগ্রেসের পরিকল্পনা জানতে চান। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে সুভাষকে অতিষ্ঠ করে তুললেন। এসব ব্যাপারে কংগ্রেসের তেমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না, সুভাষও এ নিয়ে তেমন ভাবেননি। সুভাষ বললেন, দেশের স্বাধীনতা এলেই ক্রমে ক্রমে সব সমস্যার সমাধানের কথা ভাবা যাবে। সুভাষ বুঝতে পারলেন তাঁর উত্তর সাহাকে সন্তুষ্ট করেনি। তিনি তখন জানতে চাইলেন এ বিষয়ে সাহার কোনো প্রস্তাব আছে কিনা। সাহার প্রস্তাব ছিল একটি জাতীয় পরিকল্পনা কমিশন গঠনের। গুরুত্ব উপলব্ধি করে সুভাষ মেঘনাদ সাহার এ প্রস্তাবের রাজি হলেন এবং তাঁকে কংগ্রেসের দিল্লী বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। সেবারই গঠিত হল জাতীয় পরিকল্পনা কমিশন। সাহা ওই কমিশনের সদস্য হওয়ার পাশাপাশি জ্বালানি ও শক্তি সাব-কমিটির চেয়াম্যান এবং নদী নিয়ন্ত্রণ ও সেচ সংক্রান্ত সাব-কমিটির সদস্য নির্বাচিত হলেন। মেঘনাদ সাহার পরিকল্পনার সূত্র ধরেই পরে দামোদর নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।

১৯৩১ সালে এলাহাবাদে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইউ পি একাডেমি অব সায়েন্সেস’ যা বর্তমানে ‘ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস’ নামে সুপ্রতিষ্ঠিত। ১৯৩৫ সালে তিনি কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সেস’। এটি এখন দিল্লীতে স্থানান্তরীত করা হয়েছে এবং এর বর্তমান নাম ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স একাডেমি’। ওই বছরই তিনি কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ এসোসিয়েশন’। প্রকাশ করলেন এই সংস্থার মুখপত্র ‘সায়েন্স এন্ড কালচার’। এ পত্রিকা মারফত দামোদর উপত্যকা সংস্কার, ওড়িষ্যার উন্নয়ন, খাদ্য ও দুর্ভিক্ষ, ভারতের জাতীয় গবেষণা সমিতি, নদী-উপত্যকা উন্নয়ন ইত্যাদি ভারতের বিভিন্ন সমস্যা বিষয়ে বিজ্ঞানীমহল এবং সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।



চলবে ... ...

মন্তব্য ১৪ টি রেটিং +১২/-২

মন্তব্য (১৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১২:৫৩

আলী আরাফাত শান্ত বলেছেন: চলুক ভাইয়া.........
++

২১ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১:১৪

আবু নাঈম বলেছেন: চলবে তবে আর এক পর্ব মাত্র ... ধন্যবাদ।

২| ২১ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১২:৫৪

রাতমজুর বলেছেন: চলুক

২১ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১:১৫

আবু নাঈম বলেছেন: ধন্যবাদ ...

৩| ২১ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১২:৫৭

প্রণব আচার্য্য বলেছেন: ++

২১ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১:২৮

আবু নাঈম বলেছেন: ধন্যবাদ ...

৪| ২১ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১:০০

অনীয়ম বলেছেন: চলুক

২১ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ১:৩১

আবু নাঈম বলেছেন: ধন্যবাদ

৫| ২১ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ২:২৩

রাগিব বলেছেন: এটা কি আপনার নিজের লেখা? যদি তা হয়ে থাকে, তবে এই লেখার তথ্যগুলো বাংলা উইকির মেঘনাদ সাহার জীবনী নিবন্ধে যোগ করে দেয়ার অনুরোধ করছি। আপনার এই লেখা থেকে মেঘনাদ সাহার জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম, সেজন্য অনেক ধন্যবাদ।

২১ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ৩:২৯

আবু নাঈম বলেছেন: লেখাটা আমার নিজের, আরো একটা পর্ব আছে।
উইকি-তে দিতে আগ্রহী কিন্তু কি করে সেখানে দেওয়া যায় ... জানি না, এর আগে একবার উইকি-তে একটা লেখা যুক্ত করতে চেয়েছিলাম কিন্তু লগইন করার ঝামেলা আছে ... জানালে উপকৃত হব।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

৬| ২১ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ২:৩৭

শয়তান বলেছেন: আমাদের গর্ব আর অহংকার

২১ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ৩:৩০

আবু নাঈম বলেছেন: আমাদের গর্ব আর অহংকার ...

৭| ২১ শে অক্টোবর, ২০০৯ সকাল ৯:১৯

আউটসাইডার_আউটসাইডার বলেছেন: ধন্যবাদ তথ্যবহুল লেখার জন্য।++

৮| ২৮ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ৩:২৫

নিকো৮১২৩ বলেছেন: লেখাটারে মাইনাস দিল কেন??? না তোমারে দিল??????

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.