নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
স্মরণকালের ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে সাভার। হাহাকার। শূন্যতা। অপেক্ষা। উদ্ধারতৎপরতা। চিৎকার। কান্না। লাশের গন্ধ। সব কিছু মিশে গেছে সেখানে। চার দিন বাদে কালও ছিল স্বজনের মৃত-জীবিত অথবা আহত মুখ দেখার জন্য শত-সহস্র মানুষের অপেক্ষা। গত বুধবার সেখানে সাভার যুবলীগ নেতা রানার মালিকানাধীন ভবনটি ভেঙে পড়েছিল। এখনো সেখানে উদ্ধারতৎপরতা চলছে।
স্বজনদের অপেক্ষা কবে শেষ হবে? উদ্ধারতৎপরতা দেখভাল করার দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর আন্তঃবিভাগ জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) পরিচালক শাহিনুল ইসলাম সে জবাব দিতে পারলেন না। কেবল বললেন প্রাণের স্পন্দন থাকা পর্যন্ত উদ্ধারকাজ চলবে।
মৃতের সংখ্যা গতকাল এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ৩৬১ ছিল। একই দিনে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ২৯ জন। এখনো শত শত লাশ ভেতরে। জীবিতও আছেন অনেকে। ভরসা কেবল স্বেচ্ছায় আসা উদ্ধারকর্মীরা। সাথে ফায়ার ব্রিগেড। সেনারা পথ পরিষ্কার রাখছেন। ধসে পড়া বিল্ডিংয়ের আস্তরণ সরিয়ে উদ্ধারকর্মীরা একেক জনকে বের করা মাত্রই তাকে গ্রহণ করছেন সেনারা। ক্যামেরার সামনে তাদের মুখ। আরো অনেকে এসেছেন। ফটোসেশনে ব্যস্ত। সাভারে রানা প্লাজা ধসে বিপন্ন মানুষগুলোকে নিয়ে সেখানে চলছে এমন সব কাণ্ড, সে কাণ্ডে গণমাধ্যমকর্মীরাও কম যান না।
জীবিত বা মৃত কাউকে উদ্ধার করলেই তার ছবি তোলার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। এটা কতটা যুক্তিসঙ্গত? একজন স্বেচ্ছাসেবী সে প্রশ্ন করলেন। সে প্রশ্নের উত্তর দেয়া গেল না।
উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা এস আর ভবনের দেয়াল ভেঙে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার চলছে। লাশে পচন ধরেছে। গন্ধে বাতাস ভারী। সে লাশ এখনো উদ্ধার করা যায়নি। কেন যায়নি? তার জন্য কারিগরি দক্ষতার অভাবকে দায়ী করছেন অনেকে। তবে শেষ পর্যন্ত কতটা লাশ ফিরে পাবেন স্বজনেরা তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে কারো কারো মধ্যে। কাল দুপুরেও উদ্ধারকারীরা চিৎকার করে বিভিন্ন সরঞ্জাম চাচ্ছিলেন।
মৃত মানুষের শরীরগুলো ফুলে পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। তার মধ্যেও স্বজনের মুখ খুঁজছেন আত্মীয়রা। সাভার অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের বারান্দায় সারি সারি লাশ। সেখানে লাশের মুখ দেখার জন্য লম্বা লাইন। সেই লাইন পেরিয়ে পুলিশের কন্ট্রোল রুম। সেখানে এক নারী তার স্বজনের জন্য মূর্ছা যাচ্ছেন বার বার। নাম লেখাতে এসেছিলেন স্বজন খুঁজে না পাওয়া লোকদের তালিকায়।
পুলিশের সাভার থানার এসআই সাইফুল ইসলামনয়া দিগন্তকে জানান, নিখোঁজের যে তালিকা তার হাতে রয়েছে সেখানে ৯৪৭ জনের নাম লেখানো হয়েছে। তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে খুঁজে পাওয়া গেছে। তবে এ সংখ্যা খুবই কম।
ঘটনাস্থল রানা প্লাজা, ঝুলছে লাশ, পচছে মানুষ : ঘটনার চার দিন পরও স্বজনের আশা ছাড়েননি অনেকে। তাদেরই একজন লাইজু। রানা ভবন ধসে পড়ার পর বোনের খোঁজে সিরাজগঞ্জ থেকে ছুটে আসেন এ নারী। বোন সীমা বেঁচে আছেন। গতকাল শনিবার সকাল ১০টায়ও তার সাথে কথা হয়েছে। বলেছেন, টয়লেটে আটকা আছেন। ফোনে চার্জ নেই। তাই কথা বেশিক্ষণ বলা যাবে না। তাই হলো, কথা শেষ করার আগেই ফোন লাইন কেটে গেল।
বোনের জীবিত থাকার খবরটি তিনি পৌঁছানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু সে খবর কার কাছে দিতে হবে, সেটি জানেন না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা, তারপর এক সেনাসদস্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হলেন। তবে সে খবর উদ্ধারকারীদের পর্যন্ত পৌঁছায়নি। তবুও হাল ছেড়ে দিতে রাজি নন লাইজু।
বোন সীমাকে জীবিত দেখতে তার মন কাঁদছে। বললেন, সীমা তিনতলায় কাজ করতেন। এক ছেলের মা সীমা বুধবার সকালে ডিম ভাজি দিয়ে ভাত খেয়ে এলেন কাজে। তারপর নিখোঁজ। চার্জ নেই মোবাইলে। তবুও বোনের মন মানে না। রিচার্জ করে কিছু টাকা পাঠালেন বোনের ফোনে। কিছুক্ষণ পরপর বোনের মোবাইলে চেষ্টা করছিলেন। যদি কথা বলা যায়। যদি জানা যায় বোনটি কেমন আছে!
একই রকম অবস্থা মাসুদ রানার। বগুড়ার সোনাতলা থেকে এসেছেন। চার দিন ধরে সাভারে। বোন শাহিনূর ও ভাইয়ের মেয়ে নাজমার কোনো খবর জোগাড় করতে পারলেন না। ছুটছেন অধরচন্দ্র স্কুল, এনাম মেডিক্যাল, সিএমএইচ থেকে রানা প্লাজা। অপেক্ষার প্রহর তার কাটে না। চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। বাড়ি থেকে সবাই মিনিটে মিনিটে জানতে চাইছেন। কোনো উত্তর দিতে পারছেন না তিনি।
তিন ছেলে ও একমাত্র কন্যার কথা হয়তো মনে নেই আবুল কাসেম ভূঁইয়ার। হয়তো তিনি বেঁচে আছেন, অথবা নেই। কিন্তু তিনি জানতে পারছেন না তার প্রিয় সন্তান মোহাম্মদ শাফায়েত হোসেন। বাবা বলে তাকে ডাকার জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু না তার বাবা ফিরেনি। বড় ভাই মোহাম্মদ ইবরাহীম অধরচন্দ্র স্কুলে অপেক্ষা করছেন যদি লাশ আসে, শাফায়েত রানা প্লাজার সামনে যদি বাবাকে জীবিত দেখা যায়। তার মা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে, যদি প্রিয় স্বামীর দেখা মিলে। না সেসব আশা মিথ্যে। চার দিন বাদেও দেখা মেলেনি স্বজনের।
শাফায়েত জানাল, বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর স্কুলমাঠ থেকে তার বড় ভাই ইব্ররাহীমের মোবাইল ফোনটি চুরি হয়ে গেছে। তাই যোগাযোগে সমস্যা হচ্ছে। তবে সব সমস্যার মধ্যেও বাবাকে ফেরত চান শাফায়েত। বলেন, বাবা যে কোথায় জানতে পারছি না। অনেকে বলছেন, ঘটনার সময় নিচতলায় ছিলেন। আবার অনেকে বলছেন, ৯ তলায়। কিন্তু যেখানেই থাক না, তিনি যেন ফিরে আসেন।
উদ্ধারকর্মীর জবানবন্দী : মিরপুর থেকে ছুটে এসেছেন নাজমুল, মামুন, মাসুমসহ পাঁচ বন্ধু। নাজমুল নিজেকে হেফাজতের কর্মী পরিচয় দেন। ধসে পড়া ভবনের অনেক ভেতরে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছেন নাজমুল। বললেন, ভেতরে লাশ আর লাশ। এত লাশের ভেতরে অনেকে জীবিত আছেন। সেই জীবিত মানুষকে আমি দেখতে পাচ্ছি না, শুনতে পাচ্ছি শুধু তাদের শব্দ। কিন্তু উদ্ধার করা কঠিন। এখানে গার্মেন্ট ছিল। একটা মেশিন টানলে দশটা মেশিন পড়ে জীবিত মানুষই মারা যাবে। সাবধানে আমরা উদ্ধারকাজ করছি। দুই দিনে ছয়জনকে জীবিত উদ্ধার করেছেন নাজমুলরা। অক্ষতভাবে একটি লাশও উদ্ধার করেছেন তারা। চারতলায় তারা উদ্ধারকাজ করছেন জানিয়ে নাজমুল বলেন, ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমরা টর্চ নিয়ে শাবল নিয়ে ভেতরে ঢুকছি। উদ্ধারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। তবে আরো অনেক উদ্ধারকর্মী দরকার। এখানে অনেকে দেখতে আসেন, কিন্তু আসল কাজ উদ্ধার করা, সেখানে আমরা তেমন কাউকে পাচ্ছি না।
মিরপুরের শেওড়াপাড়া থেকে আসা নাজমুলদের মতো এ রকম অনেকেই এসেছেন উদ্ধারকাজ করতে। নাজমুল মনে করছেন ভেতরে এখনো অন্তত কয়েক শ’ লাশ রয়েছে। নাজমুল অনেককে দেখেছেন। মিশে গেছেন অনেকে। তবুও মানুষ বাঁচতে চান। তাদের বাঁচাতে পারলে নিজের আনন্দ, জানালেন নাজমুল। ধসে পড়া ভবন নিচের দিকে দেবে যাচ্ছে বলেও মনে করছেন উদ্ধারকর্মীরা।
তারা ভেতরে ঢুকে ডাকছেন, ‘কেউ কি আছেন, থাকলে আওয়াজ দেন।’ সাড়া পেলেই তারা ছুটে যাচ্ছেন। সে যেভাবেই হোক!
পোস্তগোলা থেকে দুই বন্ধু এসে উদ্ধারকাজে যোগ দিয়েছেন শুক্রবার। গতকালও তারা ছিলেন। এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে তারা এবার। কৌশিক ও সজীব নামে এই দু’জনের সাথে ধ্বংসস্তূপের পাশেই দেখা। কথা বলতে চাইলে একটু সরে দাঁড়ায়। বললেন, ভেতর ঢুকতেই কেবল লাশ আর লাশ। মানুষের এত মৃত মুখ আমরা আর কখনো দেখিনি। দেখতে চাইও না। ওরা দু’জনই জানালেন উদ্ধারতৎপরতা যতটা দরকার ততটা নেই। এখানে অনেকে লোক দেখানো কাজ করছে। কাজের কাজ করছেন অল্প কিছু মানুষ। তাই তারা নিজেরা দেখতে এসে কাজে নেমে পড়েছেন বলে জানান কৌশিক।
উদ্ধারকর্মী হিসেবে আনন্দ শিপইয়ার্ড থেকে এসেছেন ৩০ জনের একটি দল। কিন্তু যে যন্ত্রপাতি তারা নিয়ে এসেছেন তার সব কিছুর ব্যবহার তারা করতে পারছেন না বলে জানালেন তাদের দলের এক সদস্য জিলানী।
শুক্রবার থেকে তারা এখানে উদ্ধারকাজ চালাচ্ছেন। হাইড্রোলিক জগ নিয়ে এসেছেন তারা। এর ব্যবহার একেবারেই করতে পারেননি। কেবল ম্যাকানিক জগ ব্যবহার করে কিছু কাজ করেছেন বলে জানান জিলানী। এতে তারা কয়েকজনকে উদ্ধার করতে পেরেছেন। এ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন তারা।
ভাইকে খুঁজতে এসে নিজেই উদ্ধারকর্মী : শরিফ হোসেন এসেছেন তার ভাই মারুফ হোসেনকে খুঁজতে। কিন্তু চার দিনেও ভাইয়ের কোনো হদিস পেলেন না। ভাইকে খোঁজার জন্য প্রথমে অপেক্ষায় ছিলেন। পরে নিজেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধারকাজে নেমে পড়েন। বেশ কয়েকজনকে উদ্ধার করেও এনেছেন শরিফ। কিন্তু নিজের ভাইকে উদ্ধার করতে পারেননি। ভাইয়ের ফোনে কল দিচ্ছেন কিন্তু ফোন বন্ধ। তবুও আশা ছাড়তে রাজি নন কুলিয়ারচর, কিশোরগঞ্জের শরিফ হোসেন। বলেন, ‘এখানে সরকারের উদ্ধারের ওপর ভরসা পাচ্ছি না। তাই নিজেই নেমে পড়লাম।’
আইএসপিআরের ব্রিফিং : আইএসপিআরের পরিচালক শাহীনুল ইসলাম গতকাল আর এস টাওয়ারের নিচতলায় গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, উদ্ধার অভিযানে সেনাবাহিনীর প্রকৌশল বিভাগ এবং কমান্ডো সেনারা অংশ নিচ্ছেন। তারা বিল্ডিং কেটে গর্ত করে একের পর এক জীবিত মানুষকে উদ্ধার করে আনছেন।
শাহীনুল ইসলাম বলেন, রানা প্লাজার প্রতিটি ফোর ৩৫ হাজার বর্গফুটের। এখানে অনেক মানুষ ছিলেন। আমরা প্রতিটি ফোরে তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করছি। যতক্ষণ পর্যন্ত জীবনের স্পন্দন আছে ততক্ষণ উদ্ধার অভিযান চলবে।
নয়া দিগন্ত অনলাইন থেকে নেয়া
©somewhere in net ltd.