নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মা রবা!
নিজেই যদি হল্লা করি, তাহলে ট্যুরটাই মাটি হবে। তাই বিগড়ে যাওয়া মেজাজে লাগাম দিলাম। ঢাকা ইউনিভার্সিটি ট্যুরিস্ট সোসাইটিতে আমার সভাপতি থাকাকালীন সবচেয়ে খারাপ ট্যুরটির কথা বলছি। ২০০৫ সাল বরণের বছর সম্ভবত। থার্টি ফাস্টে একটা ট্যুর করা দরকার। সে জন্য সুন্দরবনকে নির্বাচিত করা হলো। তিন দিনের ট্যুর। ফি ধরা হলো জনপ্রতি ১৯০০ টাকা।
সুন্দরবনে এর আগে আমরা গেছি আরো বেশি টাকা খরচা করে। এবার টাকার পরিমাণ কম হওয়ার কারণে প্রচুর সদস্য এবং অতিথি অংশ নিয়েছিলেন। তার উপর ততদিনে আমাদের ট্যুরের খ্যাতি ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়েছে। সে কারণে অনেক অতিথি শিক্ষার্থী পর্যটকও অংশ নিয়েছিলেন।
আমাদের সেবারের গন্তব্য সঙ্গী মা রবা। এ লঞ্চটির নীচতলাতে বিছানা করে থাকা যেতো। আর দোতলায় সাকুল্যে চারটে কেবিন। এ নিয়ে লঞ্চ। লঞ্চ বলা যাবে না। বলতে হবে লঞ্চের বাচ্চা। এর চেহারা দেখেই সকাল সকাল মনটা খুব খারাপ হলো। তবুও উপায় ছিলো না। বছরের শেষে সুন্দরবনে সব সময় রাশ। নিজের বোকামির জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিলো। যদিও এটা বাণিজ্যিক ট্যুর নয়, তবুও শিক্ষার্থী ট্যুরিস্টদের সর্বোচ্চ কমফেররট দেওয়াটা আমার দায়িত্ব। আমার বার বারই মনে হচ্ছিলো- এ ট্যুরের দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করতে পারিনি। আমার মেয়াদে এটিই আমার চোখে সবচেয়ে খারাপ ট্যুর।
মা রবা ঠিক করেছিল এনটিভির বাগেরহাট জেলা রিপোর্টার রবিউল ভাই। উনাকে বলেছিলাম, আমরা সুন্দরবন যেতে চাই। উনি এই লঞ্চটা ঠিক করে দিলেন। আমাকে জানালেন দোতলা লঞ্চ। এর আগে আমি দোতলা লঞ্চে সুন্দরবন গেছি। তাই এটা নিয়ে কোনো সংশয় থাকল না। তার উপর রবিউল এলাকার লোক। তাই ভুল হবার কথা নয় ধরে নিয়ে আমি নিশ্চিন্ত!
বছরের শেষ দিনের সকালে মংলাতে নেমে আমার মেজাজ চড়ে গেলো। এত্ত ছোট একটা লঞ্চ। সেই মেজাজ আরো চড়িয়ে দিলো লঞ্চের মালিক। এই লঞ্চে নাকি ১০০ জনকে কয়দিন আগে ঘুরিয়ে এনেছে দুবলার চর। অবম্য পরের ২ বছরে এটি বদলেছে। পুরো জাহাজই কেবিন বানিয়ে 'ফরেনার' নিয়ে ঘোরে লঞ্চটি।
সকালের নাশতার আয়োজন হলো। পরোটা সবজি। নাশতা খেয়ে সবাই মা রবা-য়। করমজল হয়ে আমরা ছুটছি কটকার দিকে। রাতে কটকায় আমরা অবস্থান করবো। এটা আগে থেকে ঠিক করা।
অনেকগুলো লঞ্চ কটকায়। রাতের আকাশ- বনের নীরবতা মিলিয়ে এক অন্যরকম রাত। সেই রাতে বছরের প্রথম মুহুর্ত সেলিব্রেট করার পরিকল্পনা ছিল আগে থেকেই। সে মতে, বড় সাইজের একটা কোরাল মাছ পোড়ানোর আয়োজন ছিলো। তবে মাছ পুড়িয়ে ক্লান্ত শরীরে নতুন বছরকে বরণে আমার বন্ধু এবং ডাটসের সেক্রেটারি বাবু আপত্তি করলো। ওর মতে, সারারাত জার্নি করে এসেছে সবাই। তাই এখন ঘুমানোকে সবাই সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করছে। আসলে ঘটনাও তাই।
ক্যাম্পাসে থাকলে আমরা সব সময় ১২ টা ১ মিনিটে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে আনন্দ-উল্লাস করি। সুন্দরবনেও একই ভাবে বর্ষবরণে আমরা ৫৫ জন এসেছি। বাবু এর বিপক্ষে। সে সাথে তার সহযোগিদের ক'জন। আমার সহযোগিরাও গাঁইগুই করছে। তবে এতে সাঁয় দিলাম না। এর কারণ হলো-- আমি চাইনি বর্ষবরণের আনন্দটা মাটি হোক! দ্বিতীয় কোরঅল মাছটা তাহলে আর পোড়ানো হবে না। কারণ আমাদের ফ্রিজিং ব্যবস্থায় এর জন্য যথেষ্ট জায়গা ছিলো না।
আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকার আরেকটি কারণ--ট্যুরের সিডিউল আগে থেকে ঠিক করা। সেটি সবাইকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ট্যুর শুরুর আগে সেটি নিয়ে আলোচনা-মিটিং হয়েছে। কেউ সেটি বদলাতে বলেনি। যারা ট্যুরে এসেছে তাদের সবারই রাত জেগে ট্যুর করার অভিজ্ঞতা পুরনো। এখন ট্যুরে এসে সিডিউল পরিবর্তন করার পক্ষে আমি থাকলাম না।
সিদ্ধান্তে অটল থেকে সবাইকে নিয়ে মাছ পুড়িয়ে গানে গানে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হলো। ঘুম থেকে উঠে আসায় অনেকে কষ্ট পেয়েছেন। অনেকে ধরে নিয়েছেন, আমি ক্ষমতা দেখাচ্ছি। ট্যুরের যে আইটেনারি করা হয়েছে; সেটি মেনে না চললে আমরা সব আয়োজন সঠিকভাবে শেষ করতে পারবো না। এটা সবাইকে জানালাম। বললাম, সিডিউল না মানলে আমাদের সব কিছু ঠিকঠাক হবে না। তখন সবাই আবার দোষারোপ করবেন! তাই রাতে যারা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তাদেরও ডেকে তোলা।
পরে অবশ্য সব ঠিক হয়ে গেছে। যারা শুরুতে বিপক্ষে ছিলেন, তারাও বিষয়টি মেনে নিয়েছেন চেহারা করে অংশ নিলেন। সুন্দরবনের দ্বিতীয় রাতে সবাই মিলে আমরা গান বাজনা করলাম। যাত্রাপালাও হয়েছে। সবাই দারুণ উপভোগ করেছে। আমাদের ছোটবোন লাভলী যাত্রাপালাটি লিখেছিল। ছোট ভাই মীর মামুন ছিল নায়ক। নায়িকার চরিত্রটি করেছিল সারজিনা। নায়িকার বাবা? সে আর কে! বদরাগী লোক হিসাবে এটা আমরই প্রাপ্য! বোঝেন অবস্থা। বাবুও একটা রোল করেছিল।
ওই ট্যুরে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়েছিল রাতে ঘুমাতে। কারণ নীচ তলায় আমাদের গণহারে ঘুমাতে হয়েছে। আমি ও বাবু রাত জেগে ছিলাম। সকালের দিকে সবাই উঠে ফ্রেশ হয়ে নাশতা করার পর আমরা ১/২ ঘণ্টা করে ঘুমাতাম।
সেই ট্যুরে আমরা মংলা থেকে জ্যান্ত মুরগি নিয়ে গিয়েছিলাম। দ্বিতীয়দিন সকালে একটা মুরগি কাঁচা থেকে বের হয়ে গেলো! সে কী কাণ্ড! আমার এখন ভাবতেই হাসি এবং অস্বস্তি-- দু'টোই লাগছে!
করমজল, কটকা, জামতলী, কচিখালী ও সুপতি ঘুরে- তিনদিন সুন্দরবনে কাটিয়ে আমরা ঢাকা ফিরেছি। সবার কাছেই এ ট্যুরের আনন্দময় অনেক স্মৃতি আছে। ট্যুরটিতে যাওয়া সারজিনা, তানিয়া, সেলিম, শামীমসহ অনেকের কাছে এই ট্যুর স্মরণীয় । তবে রাতে বর্ষবরণটা আর লঞ্চের কারণে অনেকের মন খারাপ ছিল। সে জন্য আমি ডাটসের পরের মিটিংয়ে দুঃখ প্রকাশও করেছিলাম। এখনো আমার মন খারাপ হয়। দুঃখ বোধ করি।
এ ট্যুরের মাস দুয়েক পরে সুন্দরবনে আরেকটি ট্যুরের আয়োজন করেছিলাম। সেটি অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের জন্য। তারা এখনো সে ট্যুরের গল্প করেন। দেখা হলেই বলেন, ভাইয়া আরেকবার যদি আপনার সাথে যাওয়া যেতো। কিন্তু হয় না। সব কিছু সব সময় হয়ে ওঠে না। ওই ট্যুরের গল্প আরেকদিন করবো।
©somewhere in net ltd.