নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ইনডিয়ার আসামে বাঙালি মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চালায় বোড়ো সন্ত্রাসীরা। গত ১ ও ২ মে’র হামলায় এখন পর্যন্ত ৪৩ জনের লাশ উদ্ধার করো হয়েছে। নিখোঁজ আছে আরো অনেকে। ওই আক্রমণে বেঁচে যাওয়া মানুষদের গল্প শোনাচ্ছেন তানিম ইশতিয়াক।
আকাশ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টিধারাও তাদের অশ্রু লুকাতে পারে। কিন্তু আসামের জাইন উদ্দিনের কান্না বোধ হয় এ জনমে আর মুছবে না। জাইন উদ্দিন আলী তার সাত বছর বয়সী কন্যা জয়গুন্নেসাকে হারিয়েছেন। গত ২ মে আসামের খাগড়াবাড়ি গ্রামে বোড়ো সন্ত্রাসীরা তার মেয়েকে হত্যা করে।
‘আমি বিকাল তিনটার দিকে বেকি নদীর ওপারে ভাঙ্গারপাড় বাজারে ছিলাম। বাজারের লোকেরা আমাদের গ্রামে আগুন দেয়া নিয়ে আলাপ করছিল। অনেকের সাথে আমিও নদী পার হয়ে বাড়ির দিকে আসি। আমাদের গ্রামে পৌঁছালে গুলির শব্দ শুনি আর আগুনের শিখা দেখতে পাই। আক্রমণের ভয়ে আমরা একটি জঙ্গলে পালিয়ে থাকি। এক ঘণ্টা পর বাড়ি ফিরে দেখি তিনটা গুলিবিদ্ধ লাশ পড়ে আছে। ঘরগুলোতে আগুন জ্বলছে। কিন্তু আমার স্ত্রী ও তিন সন্তানকে খুঁজে পেলাম না।’
৩৫ বছর বয়সী কৃষক জাইন উদ্দিন এভাবেই তার সব হারানোর বর্ণনা দেন। আসামের গুয়াহাটি থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে বাকসা জেলার গোবারধানা থানায় কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
assam-muslim-5.jpg
পরদিন সকালে বেকি নদীর তীরে জাইন তার কন্যা জয়গুনের লাশ পাওয়া যায়। কিন্তু তার স্ত্রী ও দুই সন্তানের খোঁজ এখনও পাওয়া যায় নি।
জাইনের ধারণা, প্রাণের ভয়ে তার স্ত্রী সন্তানেরা বেকি নদী পার হয়ে ওপারের ভাঙ্গারপাড় বাজারে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল।
পুলিশ পোস্ট মর্টামের জন্য ৮টি লাশ ট্রাকে তুলছিল। জাইন তার কন্যা জয়গুনের মুখটা একবার দেখে নেন। আরো ৭টি লাশের পাশে শুয়ে আছে তার প্রিয় জয়গুন। আছে ছয় মাস বয়সী একটি শিশু মোতালেব আলী। আরও যারা আছে: আরিফুল ইসলাম (৮), লিনা খাতুন (৪), জয়ফুল খাতুন (৮), আরিফুল ইসলাম (৭), হাসনা বেওয়া ((৬৫) ও মর্জিনা খাতিুন (৩২)। এর সবাই ২ মে বৃহস্পতিবারের হামলায় নিহত হয়েছেন।
একই গ্রামের কৃষক ফখরুদ্দিন (৫৩) তার ১২ বছর মেয়ে আলিয়ার ছবি নিয়ে সারা গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বৃহস্পতিবারের হামলার পর তাকে আর পাওয়া যায় নি।
ফখরুদ্দিন তার মোবাইল ফোনে মেয়ের ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘ওরা আমাদের গ্রামে হামলা করলে আমি তাড়াতাড়ি বাজার থেকে বাড়ি ফিরে আসি। কিন্তু গুলির আর আগুনের মুখে আমি এগুতে পার নি। আমার পরিবারের সাত জন সদস্য জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু আলিয়াকে পাওয়া যাচ্ছে না।
আট বছর বয়সী সাজিদা জানান, তার চোখের সামনে মা রহিমা আর ছোট বোন আমিনাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়।
সাজিদা বলেন, জানের ভয়ে আমরা দৌড় দিই। আমার মা আর দুই বোন আমার পেছনে ছিল। বিকট শব্দ শুনে আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি- আমার মা আর দুই বোন পড়ে গেছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সব। রক্ত দেখে আমি চিৎকার দিই। ছোট বোন হাফিজাকে আঁকড়ে ধরে দৌড়ে পালিয়ে যাই। চারিদিকে খুব অন্ধকার। আমি হাফিজাকে বলি, কাঁদিস না, ওরা শুনতে পেলে এসে আমাদেরও মেরে ফেলবে।’
assam-muslim-4.jpgসাজিদা এখন নারায়ণগুড়ি আজাদ প্রাইমারি স্কুলের আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন। হামলার পর ঘরবাড়ি ছেড়ে এখানে ৫০০ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।
বাকসা জেলা প্রশাসনিক অফিসার ত্রাণ বিতরণ পরিদর্শন করার সময় বলেন, এখানকার ৫০০ লোকের মধ্যে ২০০ জনের মতো শিশু রয়েছে। তারা এখনও আতঙ্কিত।
হালিমা খাতুন যখন সন্ত্রাসী আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য তার পাঁচ মাস বয়সী সন্তানকে কোলে নিয়ে বেকি নদীতে ঝাপ দিয়েছিলেন, তিনি কল্পনাও করেন নি, তিনি শেষবারের মতো তার সন্তানকে কোল নিচ্ছেন।
‘চারিদিকে শুধু গুলির শব্দ। কয়েকজন ফরেস্ট গার্ডের দিকে দৌড়াতে গিয়ে গুলিতে মারা গেছে। আমার ১০ বছরের মেয়ে ও ৭ বছরের ছেলেকে পিছনে হারিয়ে ফেলেছি। নদীতে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া আমার সামনে আর কোনো পথ ছিল না। ঘটনার সময় আমার স্বামী নদীর ওপারে বাজারে ছিল। আমি নদী পার হতে ঝাপ দিলে কোলর সন্তানকে ধরে রাখতে পারি নি। আমার চোখের সামনে সে স্রোতে ভেসে চলে যায়। ভাসমান একটা কাঠ দেখে আমি আঁকড়ে ধরি। আমার সন্তানকে আর পাই নি।’
assam-muslim-6.jpgহালিমা আরো বলেন, অনেকেই নদীতে ঝাপ দেয়। ওরা নদীতেও গুলি করতে থাকে। ভাগ্য ভালো যে আমার গায়ে গুলি লাগে নি। কিন্তু অনেকে পানিতে মারা গেছে।’
ওই আক্রমণে হালিমার দুই দেবরও নিহত হয়েছেন। নদীর প্রবল স্রোতে হালিমা তার কাপড়ও হারিয়ে ফেলেছিলেন। দুই ঘণ্টা পর সেনা কর্মকর্তারা তাকে উদ্ধার করে শরীর ঢাকার জন্য একটা লুঙ্গি দেন।
হাগরাবাড়ি গ্রামের আজিমুদ্দিন আলী বলেন, ‘আমি বাজারে ছিলাম। এপারে আসার মতো নৌকা ছিল না। আমি এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে নিদী পার হয়ে গ্রামে এসে দেখি সব শেষ হয়ে গেছে। দেখি আমার তিন ছেলে আর এক মেয়ের লাশ পড়ে আছে।’
পেশায় দর্জি আলী কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার স্ত্রী দুবছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে নদীতে ঝাপ দিয়েছিল। নদীর স্রোত তাকে নিয়ে গেছে। এখনো আমার একটা ছেলে ও একটা মেয়েকে খুঁজে পাচ্ছি না।
১৪ বছরের কিশোরী হাবিবাহ নেছা বলেন, আমার বাবা ও মাকে ওরা গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমি খাটের নিচে লুকিয়ে ছিলাম।
এমন গল্প আছে ৭৫ বছর বয়সী ইমান আলীর। তিনি তার স্ত্রীকে খুঁজে পাচ্ছেন না।
‘ফার্স্ট পোস্ট ইনডিয়া’, ‘ডেকান ক্রনিকল’ ও ‘গার্ডিয়ান’
তথ্যসূত্র : http://onlinebangla.net
©somewhere in net ltd.