নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সত্যই সুন্দর

নিয়ামত মাষ্টার

লালনগীতির ভাবার্থকারী, গবেষক, সংগ্রাহক ও প্রবন্ধকার। সত্যই সুন্দর

নিয়ামত মাষ্টার › বিস্তারিত পোস্টঃ

মহাত্মা লালন ফকিরের জীবন কাহিনী ভিত্তিক ইমপ্রেস টেলিফিল্ম “মনের মানুষ” প্রদর্শণ ও জন প্রতিক্রিয়া।

৩০ শে এপ্রিল, ২০১৪ দুপুর ১:১৬

পূর্বকাল ও সমকালে ধর্মীয় উগ্র অনুশাসন বিরোধী মহাত্মা লালন ফকিরের কাল্পনিক জন্মকাহিনী ও জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ ‘মনের মানুষ’ নামে যে ইমপ্রেস টেলিফিল্মটি তৈরি করেছেন এবং লালন ফকিরকে অযৌক্তিকভাবে ‘লালন কর’ নাম নিয়ে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত করে প্রেক্ষাগৃহ ও দূরদর্শনে প্রদর্শনের প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও লালন প্রেমিদের রোষের শিকার হয়েছেন। যার প্রমাণ ২০১১ ইং সালের ১৯ জুলাই আরটিভি কর্তৃক প্রচারিত অনুষ্ঠান। পত্রিকার মধ্যে- ২০১১ সালের ১৯ জুলাই এফ এন এস। ২১ জুলাই ঢাকার দৈনিক সমকাল, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক নয়াদিগন্ত, যশোরের গ্রামের কাগজ এবং ঝিনাইদহের নবদিগন্ত। উল্লেখ্য যে, ১৯ জুলাই দিনব্যাপী লালন অনুরাগী ও শিষ্যবৃন্দ, ছাত্র-শিক্ষক-জনতা এবং ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ড উপজেলা সদরে মানববন্ধন কর্মসূচির মাধ্যমে এর প্রতিবাদ জানায়। এছাড়া বৃহত্তর কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, যশোর, মাগুরা জেলায়ও লালন ফকিরের চরিত্র বিকৃতি ও উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে তাকে বিশেষ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত করার প্রতিবাদে তারা কর্মসূচি পালন করেছিলেন। তাদের একমাত্র দাবি ‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রটির অংশ বিশেষ পরিবর্তনের মাধ্যমে ছবিটি সংশোধন করতে হবে। তা-না হলে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে বলে তারা ইউএনও অফিসে স্মারকলিপিও পেশ করেন।

বিগত দু‘শ বছর পুর্বে লালন ফকিরের দশ সহস্রের অধিক ভক্ত ও শিষ্য ছিলো এবং বিবিসির জরীপ মতে বিশ্বের সেরা ২০ জন বাঙালির মধ্যে তিনি অন্যতম বলে বিবেচিত হয়েছিলেন। এমন একজন বিশেষ ব্যক্তিকে নিয়ে শুধুমাত্র অনুমানের উপর নির্ভরকরে মনগড়া, অযৌক্তিক কল্প ও কথ্য কাহিনীর সৃষ্টি করে, লাখ লাখ লালন অনুগামী ও অনুরাগীর মনে ব্যথা দিয়ে বিশ্বমানব পরিচয় দানকারী ‘মানুষ লালনকে’ (লালন কর) নামে পরিচয় দিয়ে শুধু বিশেষ জাতির সম্প্রসারণবাদ নীতিকেই আস্কারা দেওয়া হয়েছে বলে প্রতিবাদকারীগণ মনে করেন তৎসঙ্গে আমি নিজেও ঘোর প্রতিবাদ জানায়।

কাহিনীটির উদ্ভবের সূতিকাগার সম্ভবতঃ আব্দুল আহসান চৌধুরী ‘লালন শাহ’ গ্রন্থটি। সেখান থেকে কাহিনীটিকে কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই না করে কল্পিতভাবে ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাকে উপন্যাসে রূপদান করেছিলেন। সেখান থেকে গৌতম ঘোষের কাছে নবযৌবন প্রাপ্ত হয়ে নব উদ্যমে ‘মনের মানুষ’ নাম দিয়ে ছবিটি অসংখ্য লালনপ্রেমীর অন্তরে ব্যথা দিয়ে এখনও প্রদর্শিত হচ্ছে। যারা কাহিনীটির হোতা তাদের যথাযত শাস্তির দাবী জানায়।

লালন এমন একটি সাধারণ নাম, যা সমস্ত ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষই “নাম” হিসাবে এটি ব্যবহার করতে পারেন। এ নামটি ব্যবহারে বিশেষ কোনো জাতি বা ধর্মীয় ব্যক্তি বলে বোঝা যায় না। লালন ফকির যে লোকজ ধর্মের “মানব ধর্ম” অনুসারী ছিলেন সে ধর্মেও নির্দিষ্ট কোনো প্রর্বতক ছিলেন না। তার কাছে জগতের সব মানুষই তার “স্বজন”, সব মানুষই “আত্মীয়”। এমন একটি বিশ্ব মানবতাবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষবাদী মহামানবকে ‘লালন কর’ নামকরণের মাধ্যমে তাকে ক্ষুদ্র ধর্ম, গোণ্ঠি ও সম্প্রসারনবাদীতার যাঁতাকলে পিষে মারার চেষ্টা করা অত্যন্ত অন্যায় ও গর্হিত অপরাধ বলে তারা মনে করেন। আমিও তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করছি।

মাহাত্মা লালন ফকির তার নিজের সম্বন্ধে কি বলেগেছেন আসুন তা বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা যাকঃ

লালনঃ সব লোকে কয় লালন ফকির হিন্দু কি যবন

লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান

একই পথে আসা যাওয়া, একই পাটনি দিচ্ছে খেয়া।

অর্থাৎ আমি হিন্দু কি মুসলিম তা নিজেই জানিনা। সকলেই মায়ের উদর থেকে ভবে আসেন এবং জাগতিক কর্ম সম্পাদন শেষে একদিন “মাটি মার” কোলে শেষ আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই যে আসা-যাওয়া চক্র “এর হাত” কেও অব্যহতি পায় না। এছাড়া মানুষের আর কি বিশেষ পরিচয় থাকতে পারে? এটাই তার বড় পরিচয় যে, সে “মানুষ” লালন ফকিরের মূল বক্তব্যও মানুষকে নিয়ে। লালনের এ লিখিত বক্তব্যের পরেও আর কি কিছু বলার থাকতে পারে? তিনি তো জগতে শুধুমাত্র ‘মানুষ’ পরিচয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা তাকে সংকীর্ণ জাতাজাতির বেড়াজালে আটকে তার মূল দর্শন থেকে তাকে বিচ্যুত করেছি এবং “মনের মানুষ” চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মূল কাহিনীকার, ঔপন্যাসিক এবং পরিচালক মহোদয়গণ মিলে তার অগ্রগণ্য ভূমিকা পালনে ব্রতী হয়েছেন।

মহাত্মা লালন ফকির নিজে তার জন্ম পরিচয় ও জন্মস্থান নিয়ে কখনও মাথা ঘামাননি। তিনি তার অসংখ্য গীতিকারদের পংতিতে পংতিতে নিজেকে শুধু “মানুষ” বলে পরিচয় দিয়ে গেছেন সেই জন্য তাকে বিষেশ জাতি গোষ্ঠিভুক্ত করার উদ্দেশ্য হল একপেশে ও বিশেষ উদ্দেশ্য প্রনোদিত এবং একটি হিন চক্রান্ত ছাড়া আর কিছু নয়।

সর্প বিষের পরিমিত ব্যবহার রোগের উপশম হয় ঠিকই কিন্তু ব্যবহার না জানলে মৃত্যু ও ঘটে। অথাৎ আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজ ভাড়া নেওয়ার কথা চিন্তা করা বোকামী ছাড়া আর কিছু নই, আমি চলচ্চিত্র সমালোচক নই। কিন্তু ‘মনের মানুষ’ ছবিটিতে চরিত্রায়নের ন্যাক্কারজনক ব্যবহার দেখে একেবারেই কিছু না বললে বিবেকের কাছে দায়ী থাকতে হবে। শুধু সে জন্য জানাচ্ছি যে, ছবিটি পরিচালনা করার পূর্বে গৌতম বাবুর ‘সাধু ফকিরদের’ কাছে নারী সম্বন্ধে বিশদভাবে জানা ও শোনা উচিত ছিলো। সবার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে, লালনপন্থী সাধুদের নিকটে নারীর দুটি রূপ পরিদর্শিত হয়। একটি কল্যাণীয়া মাতৃমূর্তি ও অপরটি ধ্বংসের প্রতিমূর্তি। কল্যাণীয়া মাতৃমূর্তি রূপটি সাধুদের নিজ সাধন সঙ্গীনি বা চেতনগুরু রূপ, যেমন- রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সাধন সঙ্গিনী ‘সারদা দেবী ছিলেন। অপরটি হচ্ছে ধ্বংসের প্রতিমূর্তি, যেমন ‘মনের মানুষ’ ছায়াছবিতে কাহিনীকারদের সৃষ্ট ব্রাহ্মণকন্যার উদ্ধত ও উদগ্রযৌবনা বিধবার চরিত্রায়নটি। দেখে মনে হয়েছে, “সাধুসঙ্গে” নারীদেহের প্রদর্শনী বা নারীদেহের বেসাতি চলছে। গৌতম বাবুর জানা উচিত ছিলো, খিলকা-খেলাফত নেয়ার পর লালন পস্থিদের নারীর প্রয়োজন হয় শুধুমাত্র “সাধন-ভজনের” ক্ষেত্রে, কখনও কাম চরিতার্থের জন্য নয়। শুধুমাত্র অনুমান ভিত্তিক ও লোক মুখে শুনে সাধু ফকিরদের সম্বন্ধে কখনোই কিছু জানা সম্ভব নয়। সে জন্য তাদের নিয়ে লেখাও উচিত নয়। তিনি কল্পনার ওপর ভর করে চিরশান্ত, চিরনম্রস্বভাবী সাধুফকিরদের দিয়ে লাঠি খেলার প্রশিক্ষণ পর্যন্ত প্রদর্শন করিয়েছেন। কর্মকর্তাদের যদি একান্তই সাধুফকিরদের সম্বন্ধে জানার কৌতুহল থাকে, তাহলে তাদের সমভিব্যহারে বাঁশ বাগানের নিচে অথবা আম-কাঁঠাল বাগানে সহস্র মশার দংশন সহ্য করে রাত্রি জাগরণপূর্বক একান্ত নিষ্ঠার সাথে সাধু করনীর মূল বিষয়গুলি জানতে হবে এবং তখনই সাধু বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান সম্পন্ন হবে।

লালনঃ মন চোরা সে রসের নাগর, তলে আসে তলে যায়

আবার, উপর উপর বেড়াই ঘুরে, জীব সবাই

অর্থাৎ মোন চোরার খবর তলে তলে অর্থাৎ গভীরে সংঘটিত হয় এবং সাধারণ জীব (মানুষের) করণ উপরে উপরে হতে থাকে। যেমন শিবের খবর জীবে বলতে পারে না। যে জীব শিবের মত গুণসম্পন্ন হন, তিনিই শুধু শিবকরনী জানেন। লালনগীতি ও লালন ফকির সম্বন্ধীয় কর্মকান্ড গুলি একে অপরটির পরিপূরক। গানের সঙ্গে সাধন-ভজনের বিষয়বস্তু অভিন্ন অর্থাৎ কোন পার্থক্য নেই। লালনগীতিকে ফকিরগণ সাঁইজির কলাম বলে মান্য করেন, যেমন ধার্মিকগণ তাদের ধর্ম গ্রন্থকে মনে করে থাকেন, ঠিক তেমন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে লালনগীতি কি? কিভাবে এগুলোকে গাওয়া উচিত, তা আগে জানতে হবে। সাধু ফকিরগণ লালনগীতিকে নাদব্রহ্ম বা ব্রহ্মনাদ ও-উ-ম অর্থাৎ ওঙ্কারনাদের সাথে তুলনা করে থাকেন। ওঙ্কারনাদ বিষয়ে যার জ্ঞান নেই, তার পক্ষে লালনগীতি গাওয়া কখনো উচিত নয়। ‘মনের মানুষ’ ছবিতে সবচেয়ে সমালোচনার বিষয় হচ্ছে ছবিটির ‘মিউজিক সিস্টেম’। মনে হয়েছে খুব দ্রুত দায়সারার জন্য যাকে তাকে দিয়ে কিছু গান গাইয়ে নেয়া হয়েছে। দু একজন শিল্পী হয়তো ভালো গেয়েছেন। কিন্তু সংগীত পরিচালক নিজে ও তার পরিচালনা ছিলো সবচেয়ে নিম্নমানের। আবহ সংগীত ছিলো না বললেই চলে। উল্লেখ্য, কয়েকজন শিল্পীর কণ্ঠে লালনগীতি একেবারেই বেমানান-বেসুরো ও বেতালা ছিলো। কিন্তু পাত্র-পাত্রীগণের অভিনয় ছিলো সবচেয়ে উত্তম এবং ত্রুটিমুক্ত।

পরিচালক মহোদয় লালন ভাষার পরিবর্তে কোন্ অঞ্চলের অখ্যাত আমদানী করা ভাষা ব্যবহার করেছেন তা একেবাই বোধগম্যের বাইরে। লালনের লিখিত কোনো গানেই এমন কোনো আঞ্চলিক ভাষার দৌরাত্ম চোখে পড়ে না। তার গানগুলি পরিশুদ্ধ, পরিশীলিত এবং প্রমিত বাংলা ভাষায় রচিত। এমতিতেই আমরা চুয়াডাঙ্গাবাসী দূরদর্শন, বেতার ও চলচ্চিত্রে আঞ্চলিক ভাষার দৌরাত্মে প্রমিত ও পরিশীলিত এবং শুদ্ধ বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান দেখা ও শোনা একরকম প্রায় তুলতেই বসেছি। সব সময় ড. শহিদুল্লাহ সাহেবের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান নিয়ে বসে থাকতে হয় যে, আঞ্চলিক ভাষাভাষিরা কখন কোন শব্দ বলে বসেন। সর্বপরি তাদের বক্তব্য বোঝার জন্য। আশ্চর্য এ দেশের ভাষা ব্যবহারের রীতিনীতি। অসংখ্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, স্বনাম ধন্য শিক্ষিত ও বিদ্বান ব্যক্তিগণ এবং প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ যারা কথা বলেন নিরেট গেঁয়ো আঞ্চলিক ভাষায়, যা আমাদের বুঝতে হলে ইংরেজীর মত অনুবাদ করে নিতে হয়। তাহলে “বাংলা” আন্তর্জাতিক ভাষারূপে সম্মান পেয়ে আমাদের লাভটা হলো কি ? যারা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারেন না বা চাননা তারা প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী হন কী করে?

পরিশেষে, অতি গোপনে ‘কানে কানে’ একটা কথা বলে রাখছি, বিদেশিরা ছবিটিকে পুরস্কৃত করেছেন তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে। কিন্তু এ দেশে ‘আহা-বেশ বেশ ও আহা বেশ-বেশ’ গাওয়া জারি গানের দোহাধরা বা দোয়ার্কির দল উক্ত চলচ্চিত্রটিকে পুরস্কৃত করেছেন কোন্ দৃষ্টিকোণের আলোকে ? তা জানতে পারলে মনের খেদ মিটে যেতো।



মো: নিয়ামত মাষ্টার

(লালনগীতির ভাবার্থকারী, গবেষক, সংগ্রাহক ও প্রবন্ধকার।)

গ্রাম: গোবিন্দপুর

ডাকঘর+থানা: আলমডাঙ্গা

জেলা: চুয়াডাঙ্গা।

মোবাইল নং- ০১৯৩৫ ৫০৭ ২০৩

ই-মেইল: [email protected]

লালন ঘরের শতাধিক গবেষণা মূলক প্রবন্ধ হতে।

পূর্বকাল ও সমকালে ধর্মীয় উগ্র অনুশাসন বিরোধী মহাত্মা লালন ফকিরের কাল্পনিক জন্মকাহিনী ও জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ ‘মনের মানুষ’ নামে যে ইমপ্রেস টেলিফিল্মটি তৈরি করেছেন এবং লালন ফকিরকে অযৌক্তিকভাবে ‘লালন কর’ নাম নিয়ে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত করে প্রেক্ষাগৃহ ও দূরদর্শনে প্রদর্শনের প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও লালন প্রেমিদের রোষের শিকার হয়েছেন। যার প্রমাণ ২০১১ ইং সালের ১৯ জুলাই আরটিভি কর্তৃক প্রচারিত অনুষ্ঠান। পত্রিকার মধ্যে- ২০১১ সালের ১৯ জুলাই এফ এন এস। ২১ জুলাই ঢাকার দৈনিক সমকাল, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক নয়াদিগন্ত, যশোরের গ্রামের কাগজ এবং ঝিনাইদহের নবদিগন্ত। উল্লেখ্য যে, ১৯ জুলাই দিনব্যাপী লালন অনুরাগী ও শিষ্যবৃন্দ, ছাত্র-শিক্ষক-জনতা এবং ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ড উপজেলা সদরে মানববন্ধন কর্মসূচির মাধ্যমে এর প্রতিবাদ জানায়। এছাড়া বৃহত্তর কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, যশোর, মাগুরা জেলায়ও লালন ফকিরের চরিত্র বিকৃতি ও উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে তাকে বিশেষ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত করার প্রতিবাদে তারা কর্মসূচি পালন করেছিলেন। তাদের একমাত্র দাবি ‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রটির অংশ বিশেষ পরিবর্তনের মাধ্যমে ছবিটি সংশোধন করতে হবে। তা-না হলে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে বলে তারা ইউএনও অফিসে স্মারকলিপিও পেশ করেন।

বিগত দু‘শ বছর পুর্বে লালন ফকিরের দশ সহস্রের অধিক ভক্ত ও শিষ্য ছিলো এবং বিবিসির জরীপ মতে বিশ্বের সেরা ২০ জন বাঙালির মধ্যে তিনি অন্যতম বলে বিবেচিত হয়েছিলেন। এমন একজন বিশেষ ব্যক্তিকে নিয়ে শুধুমাত্র অনুমানের উপর নির্ভরকরে মনগড়া, অযৌক্তিক কল্প ও কথ্য কাহিনীর সৃষ্টি করে, লাখ লাখ লালন অনুগামী ও অনুরাগীর মনে ব্যথা দিয়ে বিশ্বমানব পরিচয় দানকারী ‘মানুষ লালনকে’ (লালন কর) নামে পরিচয় দিয়ে শুধু বিশেষ জাতির সম্প্রসারণবাদ নীতিকেই আস্কারা দেওয়া হয়েছে বলে প্রতিবাদকারীগণ মনে করেন তৎসঙ্গে আমি নিজেও ঘোর প্রতিবাদ জানায়।

কাহিনীটির উদ্ভবের সূতিকাগার সম্ভবতঃ আব্দুল আহসান চৌধুরী ‘লালন শাহ’ গ্রন্থটি। সেখান থেকে কাহিনীটিকে কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই না করে কল্পিতভাবে ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাকে উপন্যাসে রূপদান করেছিলেন। সেখান থেকে গৌতম ঘোষের কাছে নবযৌবন প্রাপ্ত হয়ে নব উদ্যমে ‘মনের মানুষ’ নাম দিয়ে ছবিটি অসংখ্য লালনপ্রেমীর অন্তরে ব্যথা দিয়ে এখনও প্রদর্শিত হচ্ছে। যারা কাহিনীটির হোতা তাদের যথাযত শাস্তির দাবী জানায়।

লালন এমন একটি সাধারণ নাম, যা সমস্ত ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষই “নাম” হিসাবে এটি ব্যবহার করতে পারেন। এ নামটি ব্যবহারে বিশেষ কোনো জাতি বা ধর্মীয় ব্যক্তি বলে বোঝা যায় না। লালন ফকির যে লোকজ ধর্মের “মানব ধর্ম” অনুসারী ছিলেন সে ধর্মেও নির্দিষ্ট কোনো প্রর্বতক ছিলেন না। তার কাছে জগতের সব মানুষই তার “স্বজন”, সব মানুষই “আত্মীয়”। এমন একটি বিশ্ব মানবতাবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষবাদী মহামানবকে ‘লালন কর’ নামকরণের মাধ্যমে তাকে ক্ষুদ্র ধর্ম, গোণ্ঠি ও সম্প্রসারনবাদীতার যাঁতাকলে পিষে মারার চেষ্টা করা অত্যন্ত অন্যায় ও গর্হিত অপরাধ বলে তারা মনে করেন। আমিও তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করছি।

মাহাত্মা লালন ফকির তার নিজের সম্বন্ধে কি বলেগেছেন আসুন তা বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা যাকঃ

লালনঃ সব লোকে কয় লালন ফকির হিন্দু কি যবন

লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান

একই পথে আসা যাওয়া, একই পাটনি দিচ্ছে খেয়া।

অর্থাৎ আমি হিন্দু কি মুসলিম তা নিজেই জানিনা। সকলেই মায়ের উদর থেকে ভবে আসেন এবং জাগতিক কর্ম সম্পাদন শেষে একদিন “মাটি মার” কোলে শেষ আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই যে আসা-যাওয়া চক্র “এর হাত” কেও অব্যহতি পায় না। এছাড়া মানুষের আর কি বিশেষ পরিচয় থাকতে পারে? এটাই তার বড় পরিচয় যে, সে “মানুষ” লালন ফকিরের মূল বক্তব্যও মানুষকে নিয়ে। লালনের এ লিখিত বক্তব্যের পরেও আর কি কিছু বলার থাকতে পারে? তিনি তো জগতে শুধুমাত্র ‘মানুষ’ পরিচয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা তাকে সংকীর্ণ জাতাজাতির বেড়াজালে আটকে তার মূল দর্শন থেকে তাকে বিচ্যুত করেছি এবং “মনের মানুষ” চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মূল কাহিনীকার, ঔপন্যাসিক এবং পরিচালক মহোদয়গণ মিলে তার অগ্রগণ্য ভূমিকা পালনে ব্রতী হয়েছেন।

মহাত্মা লালন ফকির নিজে তার জন্ম পরিচয় ও জন্মস্থান নিয়ে কখনও মাথা ঘামাননি। তিনি তার অসংখ্য গীতিকারদের পংতিতে পংতিতে নিজেকে শুধু “মানুষ” বলে পরিচয় দিয়ে গেছেন সেই জন্য তাকে বিষেশ জাতি গোষ্ঠিভুক্ত করার উদ্দেশ্য হল একপেশে ও বিশেষ উদ্দেশ্য প্রনোদিত এবং একটি হিন চক্রান্ত ছাড়া আর কিছু নয়।

সর্প বিষের পরিমিত ব্যবহার রোগের উপশম হয় ঠিকই কিন্তু ব্যবহার না জানলে মৃত্যু ও ঘটে। অথাৎ আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজ ভাড়া নেওয়ার কথা চিন্তা করা বোকামী ছাড়া আর কিছু নই, আমি চলচ্চিত্র সমালোচক নই। কিন্তু ‘মনের মানুষ’ ছবিটিতে চরিত্রায়নের ন্যাক্কারজনক ব্যবহার দেখে একেবারেই কিছু না বললে বিবেকের কাছে দায়ী থাকতে হবে। শুধু সে জন্য জানাচ্ছি যে, ছবিটি পরিচালনা করার পূর্বে গৌতম বাবুর ‘সাধু ফকিরদের’ কাছে নারী সম্বন্ধে বিশদভাবে জানা ও শোনা উচিত ছিলো। সবার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে, লালনপন্থী সাধুদের নিকটে নারীর দুটি রূপ পরিদর্শিত হয়। একটি কল্যাণীয়া মাতৃমূর্তি ও অপরটি ধ্বংসের প্রতিমূর্তি। কল্যাণীয়া মাতৃমূর্তি রূপটি সাধুদের নিজ সাধন সঙ্গীনি বা চেতনগুরু রূপ, যেমন- রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সাধন সঙ্গিনী ‘সারদা দেবী ছিলেন। অপরটি হচ্ছে ধ্বংসের প্রতিমূর্তি, যেমন ‘মনের মানুষ’ ছায়াছবিতে কাহিনীকারদের সৃষ্ট ব্রাহ্মণকন্যার উদ্ধত ও উদগ্রযৌবনা বিধবার চরিত্রায়নটি। দেখে মনে হয়েছে, “সাধুসঙ্গে” নারীদেহের প্রদর্শনী বা নারীদেহের বেসাতি চলছে। গৌতম বাবুর জানা উচিত ছিলো, খিলকা-খেলাফত নেয়ার পর লালন পস্থিদের নারীর প্রয়োজন হয় শুধুমাত্র “সাধন-ভজনের” ক্ষেত্রে, কখনও কাম চরিতার্থের জন্য নয়। শুধুমাত্র অনুমান ভিত্তিক ও লোক মুখে শুনে সাধু ফকিরদের সম্বন্ধে কখনোই কিছু জানা সম্ভব নয়। সে জন্য তাদের নিয়ে লেখাও উচিত নয়। তিনি কল্পনার ওপর ভর করে চিরশান্ত, চিরনম্রস্বভাবী সাধুফকিরদের দিয়ে লাঠি খেলার প্রশিক্ষণ পর্যন্ত প্রদর্শন করিয়েছেন। কর্মকর্তাদের যদি একান্তই সাধুফকিরদের সম্বন্ধে জানার কৌতুহল থাকে, তাহলে তাদের সমভিব্যহারে বাঁশ বাগানের নিচে অথবা আম-কাঁঠাল বাগানে সহস্র মশার দংশন সহ্য করে রাত্রি জাগরণপূর্বক একান্ত নিষ্ঠার সাথে সাধু করনীর মূল বিষয়গুলি জানতে হবে এবং তখনই সাধু বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান সম্পন্ন হবে।

লালনঃ মন চোরা সে রসের নাগর, তলে আসে তলে যায়

আবার, উপর উপর বেড়াই ঘুরে, জীব সবাই

অর্থাৎ মোন চোরার খবর তলে তলে অর্থাৎ গভীরে সংঘটিত হয় এবং সাধারণ জীব (মানুষের) করণ উপরে উপরে হতে থাকে। যেমন শিবের খবর জীবে বলতে পারে না। যে জীব শিবের মত গুণসম্পন্ন হন, তিনিই শুধু শিবকরনী জানেন। লালনগীতি ও লালন ফকির সম্বন্ধীয় কর্মকান্ড গুলি একে অপরটির পরিপূরক। গানের সঙ্গে সাধন-ভজনের বিষয়বস্তু অভিন্ন অর্থাৎ কোন পার্থক্য নেই। লালনগীতিকে ফকিরগণ সাঁইজির কলাম বলে মান্য করেন, যেমন ধার্মিকগণ তাদের ধর্ম গ্রন্থকে মনে করে থাকেন, ঠিক তেমন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে লালনগীতি কি? কিভাবে এগুলোকে গাওয়া উচিত, তা আগে জানতে হবে। সাধু ফকিরগণ লালনগীতিকে নাদব্রহ্ম বা ব্রহ্মনাদ ও-উ-ম অর্থাৎ ওঙ্কারনাদের সাথে তুলনা করে থাকেন। ওঙ্কারনাদ বিষয়ে যার জ্ঞান নেই, তার পক্ষে লালনগীতি গাওয়া কখনো উচিত নয়। ‘মনের মানুষ’ ছবিতে সবচেয়ে সমালোচনার বিষয় হচ্ছে ছবিটির ‘মিউজিক সিস্টেম’। মনে হয়েছে খুব দ্রুত দায়সারার জন্য যাকে তাকে দিয়ে কিছু গান গাইয়ে নেয়া হয়েছে। দু একজন শিল্পী হয়তো ভালো গেয়েছেন। কিন্তু সংগীত পরিচালক নিজে ও তার পরিচালনা ছিলো সবচেয়ে নিম্নমানের। আবহ সংগীত ছিলো না বললেই চলে। উল্লেখ্য, কয়েকজন শিল্পীর কণ্ঠে লালনগীতি একেবারেই বেমানান-বেসুরো ও বেতালা ছিলো। কিন্তু পাত্র-পাত্রীগণের অভিনয় ছিলো সবচেয়ে উত্তম এবং ত্রুটিমুক্ত।

পরিচালক মহোদয় লালন ভাষার পরিবর্তে কোন্ অঞ্চলের অখ্যাত আমদানী করা ভাষা ব্যবহার করেছেন তা একেবাই বোধগম্যের বাইরে। লালনের লিখিত কোনো গানেই এমন কোনো আঞ্চলিক ভাষার দৌরাত্ম চোখে পড়ে না। তার গানগুলি পরিশুদ্ধ, পরিশীলিত এবং প্রমিত বাংলা ভাষায় রচিত। এমতিতেই আমরা চুয়াডাঙ্গাবাসী দূরদর্শন, বেতার ও চলচ্চিত্রে আঞ্চলিক ভাষার দৌরাত্মে প্রমিত ও পরিশীলিত এবং শুদ্ধ বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান দেখা ও শোনা একরকম প্রায় তুলতেই বসেছি। সব সময় ড. শহিদুল্লাহ সাহেবের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান নিয়ে বসে থাকতে হয় যে, আঞ্চলিক ভাষাভাষিরা কখন কোন শব্দ বলে বসেন। সর্বপরি তাদের বক্তব্য বোঝার জন্য। আশ্চর্য এ দেশের ভাষা ব্যবহারের রীতিনীতি। অসংখ্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, স্বনাম ধন্য শিক্ষিত ও বিদ্বান ব্যক্তিগণ এবং প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ যারা কথা বলেন নিরেট গেঁয়ো আঞ্চলিক ভাষায়, যা আমাদের বুঝতে হলে ইংরেজীর মত অনুবাদ করে নিতে হয়। তাহলে “বাংলা” আন্তর্জাতিক ভাষারূপে সম্মান পেয়ে আমাদের লাভটা হলো কি ? যারা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারেন না বা চাননা তারা প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী হন কী করে?

পরিশেষে, অতি গোপনে ‘কানে কানে’ একটা কথা বলে রাখছি, বিদেশিরা ছবিটিকে পুরস্কৃত করেছেন তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে। কিন্তু এ দেশে ‘আহা-বেশ বেশ ও আহা বেশ-বেশ’ গাওয়া জারি গানের দোহাধরা বা দোয়ার্কির দল উক্ত চলচ্চিত্রটিকে পুরস্কৃত করেছেন কোন্ দৃষ্টিকোণের আলোকে ? তা জানতে পারলে মনের খেদ মিটে যেতো।



(নিয়ামত মাষ্টারের লালন বিষয়ক শতাধিক প্রবন্ধ থেকে।)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৪ দুপুর ১:২১

পরিবেশ বন্ধু বলেছেন: মহাত্মা লালান সাইয়ের জীবন ও কর্ম কে বিকৃত করার অপকৌশল । বিষয় টি জানতে পেরে খুবই খারাপ লাগল । এদের বিরুদ্ধে জুড়াল প্রতিবাদ করা উচিত ।

২| ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৪ দুপুর ১:৩৮

মাঘের নীল আকাশ বলেছেন: আপনার এ বিশ্লেষণধর্মী লেখাটি সংশ্লিষ্টের কানে পৌঁছালে হয়
পোস্টে প্লাস ++++

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.