![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সেটা ছিল তার স্বপ্নের শহর। মাঝে মাঝেই সে বেড়াতে যেত স্বপ্নের শহরে। সিনেমা দেখতে যেত শহরে। ছেলেটা ভ্যান চালাত। অন্যের মাল ভ্যানে করে পৌছে দিত শহরে। গায়ে পাঁঠার মত শক্তি, লাবন্যতায় ভরা দেহ। জানিনা, তবে মনেহয় ওর শরীরের রক্ত আর পাঁচ জন মানুষের চেয়ে বেশী লাল! টগবগে যুবক। বিয়ে করেছিল ভালবেসে। শখ ছিল বৌ আর মা-বাবাকে নিয়ে কোন একদিন থাকবে এই শহরে।
অদৃষ্ট পরিহাস করে সুখের প্রতি। কোনো এক অজানা কারনে সে ফেঁসে যায় আইনের মারপ্যাঁচে। কোমরে দড়ি বেঁধে গ্রামের সবার সামনে দিয়ে পুলিশ তুলে নিল নিষ্ঠুর নীল রঙ্গের গাড়িতে। কালো ধোঁয়া উড়িয়ে চলছে জেলা সদরের হলুদ উঁচু দেওয়ালের হাজত খানার দিকে। গাড়ির ভেতর ছোট্টো জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছে হারিয়ে যাওয়া পথের বাঁক। এটা তাঁর পরিচিত রাস্তা। সে চলছে তাঁর স্বপ্নের শহরে দিকে!
আমি এখানে ছেলেটির গল্প বলতে আসিনি! চর্চা করতে আসিনি সাহিত্য! আমি এই ঘটনার পরের একটা ছোট্টো ঘটনা বলতে এসেছি।
আমি ঐ শহরেরই বাসিন্দা। আমার এক বন্ধু ছিল, ঐ ছেলেটির প্রতিবেশী। নামটা বলতে চাইছিনা। ছেলেটি যেদিন জামিনে মুক্তি পেয়েছিল সেদিন আমি আর আমার বন্ধু ওকে আনতে গিয়েছিলাম। একটা পুরনো শীতের বিকেল ছিল ওটা। জ্যাকেট পরে লেকের পাড়ে গরম সিঙ্গারা আর আলুর চপ খাওয়া বিকেল। হাজতের সামনে গিয়ে দেখি ছেলেটিকে কারো জন্য অপেক্ষা করছে। হয়তো অপেক্ষা করছে অভির জন্য। যাইহোক বলেই ফেললাম বন্ধুর নাম। অভিকে পেয়ে ছেলেটা জড়িয়ে ধরল বুকে। চোখের কোনায় চিকচিক করছিল নোনা জল। ছেলেটার গায়েছিল একটা চাঁদর, নীচে একটা জীর্ন লুঙ্গি। ছেলেটি আমার সাথে কোন কথাই বললনা। হনহন করে হাটছিল সামনের দিকে। পেছনের দিকে তাকানোর সময় নেই। আমরাও চলছি সাথে সাথে। একটা চা-সিগারেটের দোকান থেকে কিনল দামী একটা সিগারেট, মূল্য ১২! সিগারেট জ্বালিয়ে চলছে কোনো এক সুখের দেশে। দেশটির নাম আমার জানা ছিলনা।
সোজা চলে গেল বাস স্টপে। আমার বন্ধু থাকত মেসে, ছেলেটিকে রাতে মেসে থেকে যেতে বলল। কিন্তু সে আজ কারো কথা শুনবে না, মানবে না বাঁধা। সে যাবে তাঁর বাড়ি, তার সুখের ঠিকানায়। মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে চায় হয়ত, অথবা বৌকে দেখতে চায় বনলতার বেশে। দেখতে চায় বাড়ির সামনে বয়ে যাওয়া নদীর ঘোলা জল। এ শহর তাঁর কাছে নরক, বাড়িই তাঁর স্বর্গ। হয়ত এসব কবির কল্পনা, তবুও কবি নীরব।
আমি ভেতর থেকে কিছু একটা অনুভব করতে পারছিলাম। রক্ত চলাচল বেড়ে গিয়েছিল। তখন কিছু বুঝতে না পারলেও, আজ বুঝি "বাড়ি ফেরা" মানে কি। আজ বুঝি কেন সে হনহন করে হাটছিল, আজ বুঝি কেন সে পেছনের দিকে তাকায় নি।
কিছু কিছু মানুষের বাড়ি ফেরাটা বড্ড জরুরি। সে হোক পুজোয় বা ঈদে। বা কোন ফালতু অজুহাতে বা বাবা-মাকে একবার চমকে দেওয়ার জন্য অথবা হারানো প্রেমিকাকে লুকিয়ে একপলক দেখার জন্য।
মানুষ গুলোর একবার হলেও দেখার অধিকার আছে, তাঁর হাতে পোতা আম গাছে পাখি বাসা বেঁধেছিল কিনা। নিজ হাতে দুধ খাইয়ে বড় করা বিট্টু নামের কুকুরটি তাঁর গায়ের গন্ধ ভুলে গিয়েছে কিনা। বাড়ির পেছনের বাঁশ বাগানটা কি আগের মতই আছে? পাড়াতো ছোট্টো ভাইটির মুখে গোঁফ গজিয়েছে কিনা। তাঁর অধিকার আছে প্রথম সাঁতার শেখা পুকুরে একটি ডুব দিয়ে পুণ্যের স্নান করতে। তাঁর জানতে ইচ্ছে হয় তাঁর ক্লাসের ভোলাভালা বন্ধুটি একবার হলেও সিগারেট ঠোঁটে নিয়েছিল কিনা।
আসলে কিছু মানুষের বাড়ি ফেরাটা খুব জরুরী। অনুভূতির ঈশ্বর আজ আমাকে বুঝিয়েছে,সাইবেরিয়ান পাখি গুলো কেন প্রতিবছর ২২ হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে কেন আবার বাড়ি ফিরে যায়।
[আজ ষষ্ঠী পুজো। পুজোয় বাড়ি ফেরা প্রত্যেককে শুভেচ্ছা। আর যারা যেতে পারেনি তাদের সাথে আমি বা পথভোলা গুটিকয়েক সাইবেরিয়ান পাখি সমব্যাথি।]
কোলকাতা
(অকাল বোধন, ২১ আশ্বিন ১৪২৩, বঙ্গাব্দ)
©somewhere in net ltd.