![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সময়ের সাথে দৌঁড়ে পারিনা, জীবনের দৌঁড়েও পিছিয়ে আমি!খুঁজে ফিরি আপন মানুষ, মাঝে মাঝে হই বেহুঁশ...হৃদয়ে অবিরাম স্বপ্ন গাঁথন, বলব আজ নিপুণ-কথন।
প্রায় বছরখানেক বাদে ইলিশ কিনলাম। কিনলাম বললে ভুল হবে, স্কুলফ্রেন্ডকে দিয়ে কেনাতে সক্ষম হলাম। ৩টা ইলিশ মিলে ১ কেজির একটু কম হয়েছে ওজন। দাম নিয়েছে ৭৭০ টাকা।
ঠকলাম না জিতলাম? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গুগলের শরণাপন্ন হলাম। গুগল জানালো, কানকো খুলে দেখলে যদি লাল দেখা যায়, তবে বুঝতে হবে ইলিশ টাটকা আছে। আমার ইলিশগুলোর ফুলকা লাল নয়, একটার কিছুটা লাল হলেও অন্যটা খয়েরি। টাটকা ইলিশের চোখ নাকি নীল থাকে, কিন্তু আমারটায় হলুদ! মাছটা নরম দেখে আরও সন্দেহ বাড়লো, পঁচা না তো?
কাজেই, অভিজ্ঞদের পরামর্শের জন্য আরেক বন্ধুকে ফোন দিলাম, যে পদ্মাপাড়ের মানিকগঞ্জের মানুষ, কেনাকাটায় মোটামুটি ওস্তাদ। সে ভালো ইলিশ চেনার উপায় জানালো: ইলিশের কানকো উঁচা করলে পঁচা গন্ধ না বেরোলে মাছ চলবে। মাছের গায়ে আঙুল দিয়ে টিপ দিলে যদি সেই চামড়া উঠে আসতে দেরী হয়, তবে বুঝতে হবে দীর্ঘদিন ফ্রিজে ছিলো অথবা পঁচা। সাইজ দেখে ও বললো এগুলো নাকি জাটকা! আমি ও মা প্রতিবাদ করলাম যদিও, আবার এটাও জানালাম যে আমি নিজে এটা কিনিনি।
এটা আমার জীবনে চুতুর্থবার ইলিশ কেনা বা কেনানো। গত ১৬ বছরে মোটে এই চারবার ইলিশ কিনে খাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। কেনার সামর্থ্য যে ছিলো না, তা নয়। কিন্তু শত্রুদের কারণেই এই অবস্থা। ২০১৭ সালে চাকরি নিয়ে ফরিদপুর আসার পর একদিন প্রায় ৪ হাজার টাকার ইলিশ কিনেছিলাম। বাবার এক কবি ছোটভাই আড়তে কাজ করেন, তিনি বলেছিলেন সকাল সকাল যেতে। ক্লাস নিয়ে যেতে যেতে আমার হয়ে যায় দেরী। চোখ বন্ধ করে হাজী শরীয়তুল্লাহ বাজারের মাছ বাজার থেকে ইলিশগুলো কিনে বাড়ি এসে খুব কান্না পেলো। বাবা নেই, মা খায় না! কার জন্য আনলাম এত ইলিশ আমি? নতুন ফ্রিজে কার জন্য রাখবো? কেননা ২০০৮ সালে বাবা কবি বাবু ফরিদীর রহস্যজনক অকালমৃত্যুর পর আর মাছ কেনা হয়নি। আমি থেকেছি ঢাকায় পড়ালেখার কারণে আর মা ফরিদপুরে শ্রী অঙ্গনের সভাপতি কান্তিবন্ধুর কুপরামর্শে নিরামিষ খেতেন।
যাহোক, কাটার সময় মা বলে মাছগুলো কেমন নরম নরম লাগে! কিন্তু পঁচা কিনা তা বলতে পারলো না। আসলে ৯ বছর না খেলে আর না কাটলে যা হয়! আমার অবস্থা আরও খারাপ। বাবা বেঁচে থাকতে কোনোদিন বাজার করা লাগেনি। একমাত্র সন্তান আমি, ছিলাম বড় আদরে। স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন একদিন বাজার থেকে বড় একটা শোল মাছ এনে বাবা জেদ করে বললো, মাছটা ধর। আমি সেই মাছ ধরতে গিয়ে সে কী কান্নাটাই না করেছিলাম! তবু মাছটা ভালো করে ধরিনি, শুধু একটা আঙুল ছুঁইয়েছিলাম। ধরলে যদি মাছ ব্যাথা পায়, তাই! মাছ আমি এমনিতেও পছন্দ করতাম না। ছোটবেলায় ইলিশের কাটা গলায় বিঁধেছিলো। সেই থেকেই মাছে অনীহা। তাই নটরডেম কলেজে পড়াকালীন রামকৃষ্ণ মিশনের বিবেকানন্দ বিদ্যার্থী ভবনে খাদ্যতালিকায় থাকা মাছগুলো প্রায়ই পুরোটা খেতে পারতাম না, মাঝে মাঝেই বিলিয়েও দিতাম।
সেই আমাকে বাধ্য হয়ে ২০০৮ থেকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। ফরিদপুরের আমার আত্মীয়-স্বজনে ভর্তি। মেঝোকাকা শিবু গুহ মহিম স্কুলের মোড়ে আর্টের কাজ করে, থাকে দাদুর ভিটায়, দুই মেয়ের একজন স্কুলশিক্ষক, আরেকজন ডায়াবেটিক হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার হয়েছে আমার বাবার মৃত্যুর পর তাঁর বড়ভাই সামাদ কাকুর সুপারিশে। আমি ঢাকায় থাকাকালীন তাঁকে অনেকবার বলেছি মাঝে মাঝে মাকে বাজার করে দিতে। তিনি কোনোদিন দেননি। শ্রী অঙ্গনের ডাক্তার হিসেবে বাসায় একার জন্য কোনোদিন রান্না করতে ইচ্ছা না হলে মা শ্রী অঙ্গনের খেসারি ডাল আর মোটা চালের ভাত খেয়েই ছেলের জন্য প্রার্থনা করে দিন কাটিয়ে দিতো।
সেই আমার ঘরে মাছ এলো, তাও পঁচা! নিয়ে গেলাম দোকানে ফেরত দিতে। কিন্তু আড়তি ফেরত নেবে না! আমিও ভোক্তা অধিকারে অভিযোগ দেবো বলে জানাই। এরপর বাবার সেই ছোটভাই ও প্রিয়জন কবি মামুন কাকা আড়তদারকে ম্যানেজ করেন পঁচা মাছগুলো ফেরত নিতে। এরপর আরও নানা শত্রুতার জেরে আমার বদলি হয়। তারপর আবার ইলিশ কেনা হয় হেলিপোর্ট বাজার থেকে, দুইটা মাছে এক কেজি, দাম ১ হাজার টাকা। আর গতবার বাসায় ভ্যানে করে এক মাছবিক্রেতা মাছ দিয়ে যায় অনেক বেশি দামে। দুইটা মাছে ১ কেজি ৪০০ গ্রাম হয়েছে বলে দাবি করে তিনি মোট ২৩০০ টাকা নিয়ে যান। এরপর বহুদিন তিনি আমাকে মাছ দিতে পারেননি। আজও তাঁর কাছে ইলিশ চাইলে তার দাম অনেক বেশি বলে তা না দিয়ে চিংড়ি আর কই নিয়ে এসেছেন!
কিন্তু আমার কেন যেন আজ ইলিশ খাওয়ার জন্য মনটা ব্যাকুল ছিলো। কোনোদিন এমন হয় না। খাবারের প্রতি লোভ নেই বলেই বাবার মৃত্যুর পর মাত্র ২-৩ হাজার টাকায় জগন্নাথ হলে মাস কাটিয়েছি। যাহোক, হঠাৎ মনে হলো টেপাখোলায় তো শুনেছি সস্তায় তাজা মাছ পাওয়া যায়, কারণ কাছেই পদ্মা। যাব নাকি একবার? সাম্প্রতিক কয়েক দফা হামলার কারণে মা বের হতে দেয় না। টেনশনে থাকে। লালমনিরহাটের পহেলা বৈশাখের আয়োজন শুধু ফেসবুকে দেখলাম। কত সুন্দর পাঞ্জাবি পরে পান্তা-ইলিশ দিয়ে উদযাপিত হলো (নাকি করতে বাধ্য হলো?) আর আমাকেই দূরে রেখেছে। ডিসি-এসপি আমার উপর হামলাকারীদের প্রকাশ্যে কথা দিয়েছেন আমি যেন কর্মস্থলে ঢুকতে না পারি তা তাঁরা দেখবেন। আমিও আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কলেজে ঢুকতে পারি না।
তো, যেহেতু অসুস্থ, সারারাত প্রতিবেশী শত্রুরা ঘুমাতে দেয়নি শব্দদূষণ ও ঘরের চালে ঢিল মেরে, ভোরে আনন্দ শোভাযাত্রায় যেতে পারিনি বা কেউ মন থেকে ডাকেনি বলেই যেতে ইচ্ছা হয়নি, সারাদিন ঘুমানোর চেষ্টা করেছি, তাই ইলিশও কপালে জোটেনি। কেউ বাসায় দাওয়াতও দেয়নি ঈদের মতোই। বিকেলেও পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছি। তাই আজ হিন্দুয়ানী বাংলা নববর্ষের দিন ভাবলাম ইলিশ ব্যবস্থা করা দরকার। অনেক খুঁজে একটা স্কুলের বন্ধুকে পেলাম যে ঐ এলাকায় থাকে। তাকে ফোন করে অসুস্থতার কথা জানালে ও বাসায় বাজার নাই জানালে সে কথা দিলো যে সে বাজার নিয়ে আসবে। আমি টাকা পাঠিয়ে দিলে সেই বাজার করে সন্ধ্যার পর নিয়ে এলো। আমি তার অপেক্ষায় দুপুর থেকে খাইনি। ও এলে, ওকেই প্রথম মাছের ভাজা পিছটা দিলাম। ও আবার আমার হাতে মাছের কিছুটা তুলে দিয়ে টেস্ট করতে বললো পঁচা কিনা। সাথে মা আজ অনেকদিন পর কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করেছে, সেটা আর সকালে কেনা চিংড়ি দিলাম। বাগদা চিংড়ি ৭৩টায় এক কেজি, নিলো ৮০০ টাকা!
বন্ধু এসেই উঠিউঠি করে। কারণ সেও ভয় পায়, তারও পরিবার আছে, স্ত্রী-সন্তান আছে। আমার প্রতিবেশীদের হামলার শিকার হতে চায় না। ও যে এসেছে, এই বেশি। আমার প্রতিবেশী শহর মৎসজীবী লীগের আহবায়ক মনতোষ সাহা ও এলাকার পূজা কমিটির সভাপতি শ্যামল সাহা (শ্যামল মাস্টার) গং-য়ের ভয়ে যেখানে ভ্যানে করে মাছবিক্রেতা নীলকান্তদাই ইলিশ এনে দিলো না, সেখানে ও তো অনেক ছোট মানুষ! ঠগলাম না জিতলাম জানি না। কিন্তু এই যে এত প্রতিবন্ধকতা স্বত্বেও ইলিশ কিনে খেতে পারলাম, এটা নতুন বছরের অনেক বড় একটা অর্জন আমার জন্য। ধন্যবাদ জানাই স্কুলের বন্ধুকে। ওর নিরাপত্তার কারণেই ওর নামটা লিখলাম না। একজন হুজুর হয়েও সে এক হিন্দু বন্ধুর বাড়িতে দুর্দিনে বাজার এনে দিয়েছে। মহান স্রষ্টা ওর দুই ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করুক।
ওকে অটোতে তুলে দিয়ে এসে দেখি মা আড়ালে চোখ মুছে! ধরা না দিয়ে বসে রইলাম। মা খুব বিরক্তি দেখালো। একসাথে এত মাছ একদিনে! সাথে ৫ কেজি আলু, পটল, শসা, পেঁয়াজ, আড়াই কেজি মুরগিও এনেছে। কে খাবে এতোকিছু? মাকে বললাম, আস্তেধীরে খাওয়া যাবে। তোমার স্বাস্থ্য ভালো করা দরকার। কিন্তু মা এই এলাকায় থেকে আর ধর্ম ব্যবসায়ীদের দ্বারা এতটাই প্রভাবিত হয়েছে যে খেতেই চায় না, সারাদিন শুধু ধর্মকর্ম করতে চায়। জোর করে খাওয়ালেও জেদ করে। আজ একটা মাছের পিছ দুজন ভাগ করে খেলাম। কিছুটা আমার আদরের বিড়াল কালুকেও দিলাম। হয়তো কালুর মতো নিরীহ প্রাণীদের খাওয়ালে আমার হতভাগা বাবার (সন্তানের কামাই খাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি যার) আত্মাও কিছুটা ভাগ পাবে-- এই আশায়। দেব দুলাল গুহ।
ইলিশের ভিডিও: https://www.facebook.com/share/v/1BnB2AaE5h/
©somewhere in net ltd.