নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার চারপাশের মানুষ গুলো অনেক ভাল।

নিথর শ্রাবণ শিহাব

মাটির মানুষ ভিজলে কাদা হয় না কেন প্রশ্ন জাগে, মানুষ গড়া অন্যকিছুয় আমার শুধু এমন লাগে।

নিথর শ্রাবণ শিহাব › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছুটি কিংবা অবসরের উপাখ্যান

২৬ শে আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১:০৭

ধরি আমার মৃত্যু হয়েছে। অংকের দুই পাশের পক্ষের মত আমার বেহুলা আছে, আমি লক্ষ্মীন্দর। আমার নশ্বর দেহটার পাশে আমার সমস্ত সত্ত্বা বা আমার লেখনি জীবন বেহুলার রূপ ধরে স্বামীর মৃতদেহ সঙ্গে নিয়ে অকূল সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে বিলাপ করে বেড়াবে হয়তো। নারায়ণদেবের বেহুলার সেই মর্মস্পর্শী পংক্তিগুলোর মত হবে সেই বেহুলার আর্তনাদ-



“জাগ প্রভু কালিন্দী নিশাচরে

ঘুচাও কষ্ট নিদ্রা ভাসি সাগরে।

প্রভু রে তুমি আমি দুই জন,

জানে তব সর্বজন।

তুমি তো আমার প্রভু আমি যে তোমার,

মড়া প্রভু নহ রে তুমি গলার হার।”




বেহুলা আর লক্ষ্মীন্দরের চরিত্র আমার জীবনে পরিবর্তনশীল, অদল বদল হবেই। কিন্তু পরিপূর্ণতার সমীকরণটা ঠিক পাই পাই করেই কষা থাকে, যদিও মানবিক সম্পর্ক কিংবা আত্মপ্রসাদের যত ছল চাতুরিতে ভরা। একজন লেখক কখনও এক জীবন যাপন করে না। তার যাপিত জীবনের সংখ্যা অসংখ্য। আর সেই অসংখ্য জীবনের সঙ্গিনী রূপে ভাষা প্রদানকারী তার লেখনী বরাবরই তার আরেকটা অংশ হয়ে ডালপালা মেলে ধরতে থাকে নিজের ভেতরে। জৈবিক মৃত্যু তার কাছে যতখানি দুঃখজনক, তার চাইতেও বেশি কষ্ট ও যন্ত্রণাদায়ক দু কলম লিখতে না পারার কষ্ট।

এ পাড়ার মেধো- ও পাড়ার মধুসূদনই সই, তাও যার একবার লেখার বিকারে পেয়েছে- সে পায়াভারী হোক সমস্যা নেই, কিন্তু নিজেকে সে আসলেই বিকিয়ে দিয়েছে অক্ষর সামন্তের কুচকাওয়াজে। হোক সুশৃঙ্খল কি বিশৃঙ্খল। প্রত্যহ এসেম্বলির অভ্যাস গড়ে ওঠা সৈনিক যেমন ঘুম ঘুম চোখেও প্যারেড গ্রাউণ্ডে দৌড়াতে ভোলে না, কবির কলমের নিব খস খসে কাগজের বুকে কারুকার্য না তুললে অপূর্ণতা রয়ে যায় সে রকম। বলছি না কিছু সৃষ্টি করতেই হবে। কিছু আনন্দ কিংবা দুঃখ সৃষ্টি হোক- মন্দ কি? তাও কিছু লাইনের জন্ম হোক। আত্মার আয়ু বাড়ুক।

নকল লেখাটা যে আদতে কি জিনিস তা নিয়ে স্বয়ং বহু বাঘা বাঘা সমালোচকও মাঝে মাঝে দ্বিধায় ভোগেন। ওস্তাদ মরহুম ফৈয়াজ খানের শিষ্য শ্রী সন্তোষ রায়ের এক বক্তব্যে পড়েছিলাম ফৈয়াজ খান নাকি রাস্তার এক ভিখেরি গাঁইয়ার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে তাকে বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে আদর আত্তি করেছিলেন গানের সেই অংশগুলো শিখে নেয়ার জন্য। কিছু টাকা দিয়ে সেই ভিখেরিকে বিদায় করে তারই গাওয়া গান আর সুর দিয়ে তৈরি করেছিলেন অতি উচ্চাঙ্গ ওস্তাদি গান। যা বড় বড় ওস্তাদদেরকেও তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। অথচ সরাসরি নকল বললেও চলে, কিংবা অন্যের ধান এনে নিজের কলে কুটে নিজের জমির চাল বলে বাজারে চালিয়ে দেয়ার মত ছিল ব্যাপারটা। কিন্তু ধান তো আর মানুষ খায় না, চালটাই সেদ্ধ করে খায়। তো এটাকে নকল কোন অর্থে বলবেন? মুন্সিয়ানা তো ধান ভাঙা কলের মালিকেরও কম নয়!

বই পড়তে গিয়ে জেনেছি এমন অনেক কাঁচা পাঁকা লেখক, কবির আবির্ভাব ঘটেছিল বিগত শতকে যারা টুকটাক লিখে সমালোচকদের তুকতাকের তোড়ে পড়ে লেখাই ছেড়ে কেরানীগিরি আরো ভাল করে চেপে ধরেছিলেন। এবং লেখক সত্ত্বাকে লক্ষ্মীন্দরের মত সাপে কেটে সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। যদি পাছে যমদূতের মায়া হয়। কিন্তু সাপে কাটুক আর সমালোচকের শাপে কাটুক- নিজেরা যে বেহুলার যমদূতের আজ্ঞায় লক্ষ্মীন্দরের পুণঃর্জীবন লাভের জন্য নৃত্য বা যজ্ঞ করেনি, সেটা আর খেয়াল নেই তাদের। খেয়াল থাকলে বেহুলার কর্মই করতেন।

খরায় থাকা লেখকদের বেহুলার সেই শ্রমের কথা মাথায় রাখা উচিত।

আমি প্রায়ই নতুন লেখকদের (আমি নিজে পুরাতন হইনি। এখনও গা দিয়ে কাঁচা লেখার গন্ধ শুকলেই বিস্তর পাওয়া যাবে!) প্রশ্নের সম্মুখে পড়ি- ভাইয়া আমি অনেকদিন হল লিখতে পারি না। আমার লেখার ক্ষমতাটা চলে গেছে? আমার কি আর লেখা হবে না?

আমি এ সময়টায় কিছু কমন উত্তর দিয়ে চুপ মেরে যাই। লেখকদের জন্ম রয়েছে। মৃত্যু নেই। লেখাকে যদি কর্মজীবনের সূচনা ধরা হয়, তবে এর অবসর বলে কিছু নেই। লেখায় খরা আসা সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত কিছু ধ্যান ধারণা রয়েছে। স্কুলে পড়ার সময় বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে দীর্ঘ এক কিংবা দেড় মাসের ছুটিতে চলে যাওয়া কম বেশি সবার জীবনেই হয়েছে। দীর্ঘ সেই ছুটি কাটিয়ে নতুন ক্লাসে ওঠার পর বছরের প্রথম দিন যখন কড়কড়ে নতুন বই হাতে নিতাম- আনন্দের পাশাপাশি ভয়ও জাগতো নতুন অংক দেখে। কেমন করে আগের ক্লাসের চেয়েও কঠিন অংক এবারে করবো? এই দেড় মাসে পড়াশোনা না করে তো সব ভুলে গেছি। লিখতেই জানি না!

অথচ সেই আমরাই দ্বিগুণ শক্তি আর তেজে সেই নতুন ক্লাসের বইগুলো ঝাঁঝরা করে ফেলতাম সেই বছরেও। হোক না আব্বা আম্মা কিংবা বড় চাচাদের ভয়ে। তাও তো শেষ করেছি! বসে তো আর থাকিনি। বরং আরো পরিপক্ক হয়েছি দিন দিন।

একজন লেখকের জন্মের পর থেকে সে কখনো কাঁচা হয় না, দিন দিন পাকতে থাকে। ডাবের খোলস ধীরে ধীরে নারকেলের শক্ত আবরণে পরিণত হতে থাকে।

আমি বলি- যখন তুমি লিখতে পারছো না, তারমানে তুমি ছুটিতে আছো। এক সময় তোমার ছুটি শেষ হবে। তুমি নতুন ক্লাসে ওঠার মত আগের থেকে পরিপক্ক হয়ে লেখায় ফিরবে। ভুলে যেও না- তুমি লেখক, তোমার আগের লাইনটার চেয়ে পরের লাইনটা সব সময়েই মারাত্মক হবে। হতে হয়। এটাই স্বাভাবিক। তুমি না চাইলেও হয়ে যাবে। সেটা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তোমার নেই। আর যখন লিখতে পারছো না, সেই সময়টা হচ্ছে তোমার পৃথিবীকে দেখার সময়। নিশ্চয় তুমি পৃথিবী দেখছো সেই সময়টায়। জার্মান কবি শিলার বলেছিলেন, “প্রকৃতি প্রবেশ করা মাত্র কবি অন্তর্ধান করেন।” তোমার প্রবহমান পৃথিবী সেই সময়টা তোমাকে নিশ্চয় হয় দুশ্চিন্তাগ্রস্থ করে রেখেছে, নয়তো আনন্দিত করে রেখেছে। এজন্য তোমার অবসর মিলছে না লিখার।

লেখক সব সময় লিখে না। সে আগে বাঁচে। উপভোগ করে সমস্ত আনন্দ, প্রতিকূলতা, বিষাদ কিংবা সংগ্রাম। এরপর লেখে। যদি মনে করো তুমি কিছুই করছো না এখন, ভুল ধারণা। তোমার প্রতিদিন বড় হতে থাকা নাক আর কানের কোষগুলো যদি আকৃতি বাড়ানোয় বিশ্রাম না নিয়ে থাকে, তোমার অলক্ষ্যে হাজার মিলি মাইক্রন করে বড় হতে থাকে- তোমার জীবনে এমন কোন সন্ন্যাস ব্রত এসে ঢুকেছে যে আমাকে বল তুমি কিছুই করছো না?

রবীন্দ্রনাথ কোন অর্থে ‘চৌর-পঞ্চাশিকা’ গীতিকাব্যে বলেছিলেন জানি না। তবে লাইনগুলো আমার জন্য অন্য এক অর্থে খুব অর্থবহ-



‘ওগো সুন্দর চোর

বিদ্যা তোমার কোন্‌ সন্ধ্যার

কনক-চাঁপার ডোর।’




লেখনী নিয়ে বরাবরই খুব সিরিয়াস যারা, একটু লিখতে না পারলেই যাদের হাঁসফাঁশ লাগা শুরু হয়ে যায়- তাদের জন্য লাইনগুলো। একটু আগেই আমি নকল-খাঁটি নিয়ে আমার কথা বলে ফেলেছি। এখন তাদেরকেই ব্যাঙ্গাত্মক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘চোর’ বললাম। লেখা নিয়ে এতো বেশি সিরিয়াস হওয়ার কিছু নেই। লিখতেই হবে এমন ভেবে বসাটা ভুল নয়, অন্যায়ও বটে। নিজের মধ্যে খুব দ্রুত হীনমন্যতার জন্ম দেয়। যেটা আপনার ছুটি থেকে ফিরে আসাটা আরো দীর্ঘায়িত করে দিতে পারে। নিজের বিদ্যাকে খুব মূল্যবান না ভাবাটাই উত্তম। তাতে আপনার হাত পায়ের কলকব্জায় নিয়মিত তেল দেয়া হবে। মরচে ধরবে না। মাঝে মাঝে পাঠক হওয়াটাও উচিত। আপনি পাঠক নন, অথচ লেখক- আপনাকে গ্রহ থেকেই বহিষ্কার করাই উত্তম কাজ হবে সমাজ ও জাতির।

আবারো রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি দিচ্ছি। তাঁর ‘কুটিরবাসী’ কবিতার ভূমিকাতে তিনি লিখেছিলেন, “যেখানে আশ্রয় নেবার ইচ্ছা থাকে সেখানে হয়তো আশ্রয় নেবার যোগ্যতা থাকে না।’

আপনি সাহিত্যে আশ্রয় নিতে চান- খুব ভাল কথা। সেটা লেখক হয়েই শুরুতে নিতে হবে, এটা ভুল। পাঠক হয়ে আশ্রয় নিন। ঋষির আশ্রমে দরবেশ হয়ে প্রবেশ হয় না, নমস্য সেবক হয়ে ঢুকতে হয়। ধীরে ধীরে ঋদ্ধি লাভ ঘটে। সাহিত্যেও তাই। পাঠক থেকেই লেখকের জন্ম হবে।

নিজেকে নিয়ে কনফিউজড্‌ হবার কোনো কারণ দেখি না আমি। সাধক কমলাকান্তের ভাষাতেই বলি-



‘জান না রে মন, পরম কারণ

কালী কেবল মেয়ে নয়।

সে যে মেঘের বরণ করিয়ে ধারণ

কখন কখন পুরুষ হয়।

হয়ে এলোকেশী, করে লয়ে অসি

দনুজতনয়ে করে সভয়।

কভু ব্রজপুরে আসি, বাজাইয়ে বাঁশী

ব্রজাঙ্গনার মন হরিয়ে লয়।’



লেখক বা কবির কবি সত্ত্বা, লেখক সত্ত্বা যে লিখেই যাবে, লিখেই যাবে- ভুল ধারণা। আপনার আরো অনেক কাজই আছে। আপনার দায়িত্ব খুব কম না। আপনার লেখনী খরা এ কারণেই আসবে যেন আপনি আপনার সেই সব কাজ নিবিষ্ট মনে করে যেতে পারেন। আপনার সংগ্রাম কিংবা আপনার সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজ কাগজে লিখে লিখে নিশ্চয় হবে না। হাতও লাগাতে হবে। আপনার অবসরটা সেই কাজেই দিন না? দেখবেন সে কাজ করার আত্মতৃপ্তি আপনাকে আবার লিখতে বসিয়ে দেবে। এবং লিখতে লিখতে ক্লান্তি আবার আপনাকে কর্মে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। লেখকের জীবন তো এমনই! হতাশ হবার মত তো কিছু দেখি না!

আশা করি আমার কথাগুলো খুব বেশি কঠিন হয়তো লাগেনি। জ্ঞান ঝারার ভান করে প্রবন্ধ লিখলে তাতে রসের চেয়ে কষ বেশি থাকে। কষটা সহ্য করে নিন আপাতত। নাহলে বাউলের সাথে গলা মিলিয়ে বলতেই হবে আমাকে-



‘ওগো রাইসাগরে নামল শ্যাম রায়,

তোরা ধর গো হরি ভেসে যায়!’




নিজেকে নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে ফেলুন। লেখকের দৈহিক মৃত্যু থাকে, সাহিত্যে মৃত্যু নেই। অতএব, ভয় কি!



২৪/০৮/২০১৪ ইং

বন্দর টিলা, চট্টগ্রাম।



উৎসর্গঃ

যারা লিখতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে আটকে গেছেন।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে আগস্ট, ২০১৪ রাত ১১:৪৯

robi82 বলেছেন: অসাধারণ লিখেছো গুরু! নমস্য।

২৭ শে আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ২:০৯

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে

২| ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৩৫

মাহমুদ০০৭ বলেছেন: দারুণ ! প্রিয়তে ।

১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:৫৫

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে

৩| ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:২৯

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: মুগ্ধ হলাম।

১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:৪৬

নিথর শ্রাবণ শিহাব বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ প্রফেসর সাহেব :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.