নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অর্ক

অহরিত

কিছু বলার নেই।

অহরিত › বিস্তারিত পোস্টঃ

ঈশ্বর

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:৪২

মুরহাউজের ভেতরে আজকে অন্যরকম আলো খেলা করছে। লেন্ডল হেলশায়ার, মুরহাউজের বর্তমান মালিক তার মেয়ের জন্মদিনে তাকে একটা ছোট্ট বাদামী ঘোড়া উপহার দিয়েছেন। সেই খুশিতে মেয়ে বাবাকে আজকে প্রথম তার প্রিয় হোভহানেস পিয়ানো বাজিয়ে শোনাবে। মা লরা ক্লানেস খুব সুন্দর করে সেজেছেন সান্ধ্য উৎসবের জন্য। লেন্ডল গায়ে চড়িয়েছেন তার সবচেয়ে প্রিয় লেডারহোসেন স্যুট। বাদামী রঙের মোটা অভিজাত কাপড়ের শার্টের নিচে মসলিনের মত স্বচ্ছ কাপড় গুজে দেয়া। ১৬ বছরের উপরে ভদ্রলোকেরা বাভারিয়াতে এমন পোষাক পড়েননা। কিন্তু লেন্ডুলের প্রিয় পোষাক এই ৪২ বছর বয়সেও সে ছাড়তে পারেনি। তবে অভিজাত পুরু গোফের এমন পৌরুষদীপ্ত মানুষটাকে এই পোষাকেও কিন্তু বেশ মানিয়ে যায়। সারাবাড়িতে সবাই গুনগুন করে গান গাইছে আর ভাবছে কখন সন্ধ্যা হবে আর জমকালো অনুষ্ঠান শুরু হবে। ১১৭ পদের জার্মান খাবার আজকে উপস্থাপন করা হবে মান্যবর অতিথিদের সম্মানে। শহরের মেয়র কার্ল গেস্প্রভ নিজে আজকে কথা দিয়েছেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন বলে। ছোট্ট ওর্পসীডের সবুজ গ্রামে সত্যিই বেশ বড় একটা উদযাপন হবে আজ।

সূর্য যখন নিভু নিভু তখন লেন্ডলের আদরের মেয়ে এনি তার নতুন সিল্কি জামা পড়ে বাবার কাছে এসে আহলাদের স্বরে বললো, বাবা আমাকে কেমন লাগছে দেখো তো?
লেন্ডল মাথা নেড়ে হেসে বললো, আমার মনেই হচ্ছেনা তোমার বয়স মাত্র ১৭ হলো আজকে।তুমি তো বড় হয়ে যাচ্ছো এনি।
এনি লজ্জা পেয়ে বললো, বাবা আমি বাগান বাড়ির দিকে যাচ্ছি একটু। একটু একা হাটবো।
লেন্ডল একটু চিন্তিত হয়ে ভ্রু কুচকে বললো, ওখানে যে পরিত্যক্ত রুমটা আছে সেখানে যেওনা শুধু। জানো তো কেন তাই না? তুমি আঘাত পেতে পারো। ঠিক আছে?
এনি মাথা নেড়ে বাবার হাতে আনন্দে চুমু খেয়ে দৌড়ে বাগানের দিকে চলে গেলো। লেন্ডল মেয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো যতক্ষণ না মেয়েটা দৃষ্টির বাহিরে চলে যায়। তার মাথায় আজকে অন্য একটা বুদ্ধি এসেছে। মেয়রের ছেলেটা আজকে অনুষ্ঠানে আসলে ওর সাথে এনির ভালোমত আলাপ করিয়ে দেয়া দরকার। এগুলিস ওফেরো, মেয়রের ছেলেটার বয়স ২৩ এর মত। কিন্তু এখনই তাকে বেশ হৃষ্টপুষ্ট যুবক মনে হয়। দেখতে খারাপ না, একেবারে বাভারিয়ার ছেলেই মনে হয়। মেয়রও প্রায়ই তাকে মেয়ের কথা জিজ্ঞাসা করে। মনে হয় তারও এ ব্যাপারে বেশ আগ্রহ আছে। লেন্ডল অবশ্য মেয়রকে পছন্দ করেনা। একটু বুনো শূয়োরের মত নোংরা স্বভাবের লোকটা। প্রায়ই বিভিন্ন মেয়ের সাথে তাকে দেখা যায় মেয়র হাউজে। কিন্তু সবাই জানে মেয়রের কাছে তার পরিবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মেয়র যেমন করে তার স্ত্রী আর দুই মেয়ের খেয়াল রাখে তাতে তাকে বেশ স্নেহশীল বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।লেন্ডল চায় এনি খুব তাড়াতাড়ি এ বাড়ি থেকে চলে যাক।কেন তা পাঠক একটু পরেই জানবেন।

লেন্ডল যখন সবকিছু তদারকিতে নিজ ঘর থেকে বের হলো হঠাৎ করে সে ভয়ানক চিৎকার শুনতে পায় এনির। হলরুমের সাথে লাগানো দরজা দিয়ে সে দৌড় দেয় বাগান বাড়ির দিকে। সাথে চিৎকার করে তার চাকর পল কে বললো, তিন চারজন লোক নিয়ে আমার পেছনে বাগান বাড়ির দিকে চলো।
লরা তখন নিজ রুমে বসে সাজসজ্জা করছিলো। মেয়ের চিৎকার শুনে সে ভয় পেয়ে গেলো। তাড়াতাড়ি আয়নার সামনে থেকে সরে সে দৌড়ে হলরুমে চলে এলো বোঝার জন্য কি হচ্ছে। তাকে দেখে একজন ভৃত্য ভয় ভয় চোখে বললো, এনির চিৎকারের শব্দটা এসেছে বাগানবাড়ির ওই পরিত্যক্ত রুমটার পাশ থেকে।আপনার স্বামী পল আর আরোও কয়েকজনকে নিয়ে সেখানে গেছে।
লরার মুখ রক্তশূণ্য হয়ে গেলো। তাদের ৭ একর জায়গার উপর বানানো বিশাল প্রাসাদসম বাড়ির কোথাও যেতে মানা ছিলো এনির শুধু ওই ঘরটা ছাড়া। সে জানে ওই ঘরটায় এখন কিছু একটা সমস্যা আছে যার জন্য ওটার আশেপাশে যেতেও সবার নিষেধ আছে বর্তমানে। জায়গাটা তাই বড় ওক গাছ দিয়ে ঢাকা থাকে এবং ভেতরে যাওয়ার গেটের চাবি শুধু তার স্বামীর কাছেই আছে। এনি কি কোনভাবে সেখানে চলে গিয়েছিলো।এসব ভাবতে ভাবতে লরা হঠাৎ আরেকটা ভয়ানক চিৎকার শুনতে পেলো। মনে হয় যেন একটা ভয়ানক জন্তুর কেউ গলা কেটে নিয়েছে। লরা চারপাশে তাকিয়ে বললো, আমার সাথে চারজন তোমরা চলো। আমি এভাবে বোকা পশুর মত দাঁড়িয়ে থাকতে পারবোনা।

পাঁচ মিনিট পর লরা যখন পরিত্যক্ত জায়গাটার কাছে পৌছালো সে অবাক হয়ে খেয়াল করলো কে যেন ভেতরে ঢোকার আগে যে লোহার গেট আছে ওটা ভেঙ্গে ফেলেছে। তার সাথের চাকররা আরো ভয় পেয়ে গেলো। লরা তাদের দিকে তাকিয়ে বললো, ভয় পেওনা। ভেতরে ঢুকে দেখো কি সমস্যা। আমি আসছি তোমাদের সাথে।
লরার ভালো লাগছিলো না একদম। সে যেমন ভয় পাচ্ছিলো তেমন একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো কিছু একটা তার দিকে এগিয়ে আসতে চাচ্ছে। তার ক্ষতি করতে চাচ্ছে। যে এমনটা চাচ্ছে সে এই পৃথিবীর কেউ না। তবুও মেয়ে আর স্বামীর প্রতি ভালোবাসার টানে সে আস্তে আস্তে ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করে। গেটের ভেতরে ঢুকতেই সে দেখতে পায় পল রক্তাক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাপছে। লরাকে দেখে সে মাথা নিচু করে বসে পড়লো, ভেতরে যাবেন না। ওখানে শয়তান, শয়তান, শয়তান। ফিস ফিস করে পল শুধু শয়তান শয়তান শব্দটা উচ্চারণ করতে থাকলো। লরা খেয়াল করলো, পলের মাথার একপাশে কে যেন চুল উপড়িয়ে ফেলেছে। জায়গাটা ভয়ানক রক্তাক্ত হয়ে আছে। মিন মিন করে সে জিজ্ঞাসা করলো, আমার স্বামী কোথায়।
পল কাপা কাপা হাতে ঘরটার দিকে তার একটা আঙ্গুল নির্দেশ করলো। যখন লরা ওদিকে আগাতে থাকলো তখন পল উদভ্রান্তের মত চিৎকার করে বললো, শয়তান শয়তান আছে। যাবেন নাআআআআআ...

লরার সাথের দুজন চাকর ভয়ে পালিয়ে গেলো। বাকি দুজনকে নিয়ে সে অনেক সাহস করে ঘরের পাশে দাড়ালো। পুরনো কাঠের দরজার অনেকটাই খোলা। একটা লোহার কড়া দরজার সাথে কোনভাবে ঝুলে আছে টান দিয়ে খোলার জন্য। অবশ্য দরজাটা হালকা খোলাই আছে। লরার সাথে ভীতু চাকররা কেউ সাহস পাচ্ছিলোনা। তাই লরা নিজেই প্রথম ঘরের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলো। দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেই সে হা করে তাকিয়ে থাকলো। হলদে মোমবাতির আলোয় খুব বেশি ভেতরে দেখা না গেলেও খুব বোঝা যাচ্ছিলো সারাঘরে রক্ত ছড়িয়ে আছে। ভয়ে তার মুখ বন্ধ হচ্ছিলোনা। একটু সামনে এগিয়ে গেলে সে একটা দেহের সাথে বাড়ি খেলো। চোখ বন্ধ করে সে নিচে কি আছে বোঝার চেষ্টা করলো। তারপর যখন চোখ খুললো তখন সে তার দুজন চাকরের ঘর থেকে চিৎকার করে বের হওয়াটাই শুধু দেখলো। মাটির দিকে সে চোখ অর্ধখোলা রেখে তাকিয়ে খেয়াল করলো সেখানে তার স্বামীর শরীর পড়ে আছে। তার প্রিয় জামাটা সারা গায়ে রক্তে ভিজে লেপ্টে আছে যেন। আস্তে আস্তে হাতের মোমটা নিয়ে লেন্ডলের শরীরটা সে ছোয়ার চেষ্টা করলো। হয়তো সে বেঁচে আছে। হাত দিয়ে ধরে সে খেয়াল করলো শরীরটা বেশ উষ্ণ। লরা ভাবলো নাকটা একটু ছুয়ে দেখতে। হয়তো নিঃশ্বাস চলছে। লরা মুখের দিকে হাত নেয়ার চেষ্টা করলে দেখলো, সেখানে কিছু নেই। গোঙ্গাতে গোঙ্গাতে সে মোম আগিয়ে মুখ দেখার আরেকটা চেষ্টা করলো খেয়াল করলো, গলার উপরে আর কিছু নেই। মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আগে সে একবার সিলিং এর দিকে খেয়াল করলো। আবছা আলোতে দেখতে পেলো লেন্ডলের মাথাটা মাঝখান দিয়ে দুভাগ করে ওপরে ঝোলানো। দুইভাগের দুই চোখেই কেমন যেন একটা জান্তব দৃষ্টি। নাহ কোন ভয় নেই। লরার মনে হচ্ছিলো যেন লেন্ডল মারা যাওয়ার আগে খুব অবাক হয়েছে। বড় বড় চোখে না জানি সে কোন বিস্ময় ফুটে উঠেছিলো।

চাকররা যখন দৌড়ে সেখান থেকে পালাচ্ছিলো তখন একজন এনির শরীরের সাথে ধাক্কা খায়। এনির নিথর নগ্ন শরীরটা পরিত্যক্ত ঘরটার পেছন দিকে আকাবাকা হয়ে পড়ে ছিলো। বাম হাতের দু আঙ্গুল কে যেন কেটে দিয়েছে। সারাটা মুখ তার রক্তাক্ত। কিন্তু কারো সে দিকে নজর দেয়ার সময় ছিলোনা। যে যার মত দৌড়ে পালালো। এনি মৃত ছিলোনা, কিন্তু কারও তা দেখার সময় ছিলোনা।

১৮৯৫ সালে মুরহাউজের সেই ভয়ংকর রাতের কথা ইতিহাসে কোন এক কারণে খুব সুস্পষ্টভাবে লেখা হয়নি। জার্মানীর ভেতর ছোট্ট শহর ওর্পসীডের কেন্দ্রে অবস্থিত এই হাউজটা আজ মিউজিয়াম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এমন ভয়ংকর হত্যাকান্ডের পর এমন একটি স্থাপনা পরিত্যক্ত হওয়ার কথা ছিলো। পরিত্যাক্ত হলেও তা অজানা থাকেনি হাজার মাইল দূরে একটা ছোট্ট দেশ বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ বলে শান্ত নদীঘেরা শহরটিতে বাস করা এক কবির জন্য। কবির নাম অদিত রয়। গাংগাটিয়া জমিদার বাড়ি বলে যাকে আমরা চিনি সেখানেই এই কবির জন্ম। ছোট্ট জমিদার পরিবারে অদিত ছিলো সবার আদরের। তার বাবা অংশুমান রয় নিজেও ছিলেন বেশ সংস্কৃতিমনা। ছেলে অদিতকে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি ব্রিটিশরাজের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। অদিত সেখানে শিল্প ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করতো। সেখানে পড়াশোনা করার এক পর্যায়ে তার সাথে পরিচয় হয় লেন্ডল হেলশায়ারের। লেন্ডল নিজেও সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। কোন এক সাহিত্য সভায় অদিতের সাথে লেন্ডলের বেশ ভালো খাতির হয়ে যায়। হত্যাকান্ডের মাস তিনেক আগে লেন্ডল অদিতকে চিঠি লেখে তার সাথে জার্মানীতে কয়েকটা দিন অবসর কাটিয়ে যাওয়ার জন্য। ৩৪ বছরের অদিত তাকে উত্তর দিয়েছিলেন তিনি আসবেন এবং বন্ধুর সাথে সময় কাটাবেন। অদিত তখন জানতোনা কি ভয়ংকর এক সত্তা তার জন্য প্রবল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে।
প্রিয় পাঠক, মিউজিয়ামটি দর্শনে যেয়ে হঠাৎ করে কোণায় মলিন হয়ে পড়ে থাকা অদিত রয়ের ব্যক্তিগত ডায়েরীটা আমি হাতে পাই। তাতে পেচানো হরফে বাংলা লেখা দেখে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। সেই ডায়েরী থেকে যতটুকু জানা গেছে বোঝা গেছে তার সবটুকু যতটুকু সম্ভব এই লেখাতে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে আমার দুর্বল কল্পনাশক্তির আশ্রয় নিতে হয়েছে।আসুন তবে অদ্ভূত এক অশুভ সময়ে ফিরে যাই।

অদিত রয় যখন উত্তর সাগরে প্রবল স্রোতে দুর্বার ভেসে চলা জাহাজের মাস্তুল ধরে দাঁড়িয়ে জ্যোৎস্না উপভোগ করছিলেন তখন তার বন্ধু পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছিলো। আর তিনদিন পর সে হামবুর্গ পোর্টে পৌছাবে। বাল্টিক কোস্ট ধরে এগিয়ে চলা জাহাজটা যতই হামবুর্গের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো ততই অদিত রয়ের কেমন যেন একটা অশুভ বোধ হচ্ছিলো। সেই রাতে রবিঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করতে করতে সে যখন ঘুমিয়ে পড়লো, এক অদ্ভূত স্বপ্ন তাকে আচ্ছন্ন করলো। চোখ বোজার একটু পর সে হঠাৎ খেয়াল করলো সে একটা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন বনে একা দাঁড়িয়ে আছে।সে পা ফেলে এগোতে চাচ্ছিলো কিন্তু কে যেন তার পা টা জাপটে ধরে আছে। হঠাৎ সে তার মৃত পিতার ফিসফিসে কন্ঠ শুনতে পেলো। কিন্তু বুঝতে পারছিলোনা সে কি বলছে। অনেক কষ্টে মাটি থেকে পা উঠিয়ে সে আস্তে আস্তে সামনে পা ফেললো। পুরো জায়গাটা কর্দমাক্ত, এবং আশপাশ জুড়ে নাম না জানা অনেক রকম গাছাপালায় ঘেরা। মাঝে মাঝে গাছের পাতার ফাক দিয়ে একটু করে অর্ধচাঁদটা উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু কেউ যেন চাচ্ছেনা তার চলার পথে আলোর আবির্ভাব ঘটুক। অদিত কোনরকমে এগিয়ে যেতে থাকে।তাকে সামনের অজানা পথ খুব টানছে। সে জানে সে একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। এটা শুধুই স্বপ্ন, কিন্তু এতোটা বাস্তব স্বপ্ন সে আগে কখনো দেখেনি। এইযে কেমন ঠান্ডা হাওয়া তাকে ছুয়ে যাচ্ছিলো, তাতে অনুভূত ছমছমে ভাবটা কতটা বাস্তব লাগছিলো। অদিতের একসময় মনে হলো, কিছু একটা তার পিছন পিছন এগিয়ে আসছে। পেছন ফিরে তাকিয়ে তার নিঃশ্বাস আটকে গেলো। সে খেয়াল করলো একটা নেকড়ে বাঘের মত জন্তু তার দিকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে। আস্তে আস্তে ওটা তার দিকে এগোতে থাকলো। অদিত নিজেকে বাচাতে জোরে দৌড়াতে শুরু করলো, কিন্তু লাভ নেই। জন্তুটা তার কাছাকাছি চলে আসছিলো। একসময় সে বনের মত জায়গাটার মাঝে একটা ছোট্ট ঘর দেখতে পেলো। সে বুঝতে পারছে তাকে এই ঘরে প্রবেশ করতে হবে বাঁচার জন্য। আরেকটু এগোতেই নেকড়েবাঘ তার পায়ে মনে হয় যেন কামড়ে ধরলো। অদিত ছ্যাচরাতে ছ্যাচরাতে ঘরের কাছে এগোতে থাকে। নেকড়েটা করুণ স্বরে গোঙ্গাতে থাকলো। অনেক চেষ্টা করেও অদিত পারলোনা তার পা ছাড়াতে। যখন সে ঘরের দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকার চেষ্টা করছিলো, তখন হঠাৎ করে মনে হলো তার বাবা পিছন থেকে চিৎকার করে বললো, নাআআআ...
অদিতের বুকে তখন উত্তেজনায় ধ্রুম ধ্রুম আওয়াজ চলছে। তার সামনে খোলা দরজা, সেখানে একটা কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু পেছনে হয়তো তার বাবা তাকে কিছু একটা বলছে। ভয়ে ভয়ে সে পেছন ফিরে তাকালো, দেখলো পেছনে শুধুই ধোঁয়া। কিন্তু কোথা থেকে যেন তার বাবা গুঙ্গিয়ে বলছে, বাবা ভেতরে যাস না... না... না...
অদিত চোখ বন্ধ করে মুখটা সামনে ঘুরিয়ে আনলো। সে জানে তার সামনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। একটু পর সেই অস্তিত্বটা তার কাছে এসে পড়বে। নেকড়েবাঘটাও তার পা ছেড়ে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে ওটা বেশ আহত। অদিত আস্তে আস্তে পেছনে ঘোরা শুরু করলো। সে জানে তার এখন ঘুম ভেংগে জেগে ওঠাটা খুব প্রয়োজন। হঠাৎ কেউ একজন তার কাঁধে হাত রাখলো। তার কানের পাশে একটা মানবী বেশ স্পষ্ট স্বরে বললো, তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। অদিত চোখ খুলে যখন মানবীর চেহারা দেখার চেষ্টা করলো তখন এক সাথে অনেক আলো কোথা থেকে যেন জ্বলে উঠলো। অদিত স্পষ্ট দেখতে পেলো কি সৌম্য একটা নারী মূর্তি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তার কেমন যেন লাগছে। মনে হচ্ছে এখনি ভয়ংকর একটা কিছু হবে। অদিত কিছু বলার আগেই মেয়েটা চোখগুলো কেমন যেন লালচে হয়ে গেলো। মনে হচ্ছে যেন ভেতর থেকে রক্ত ঝরছে। মেয়েটা তার দাঁত বের করে হেসে বললো, আমি তোমার ধ্বংস, তোমার সৃষ্টি। তোমাকে আমি অবিনশ্বর বানাবো। আসো আমার কাছে।

অদিত আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কে?

মেয়েটা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলো। এরপর কিছু একটা হলো। অদিতের ভেতরটা যন্ত্রণায় ছিন্নভিন্ন হতে লাগলো যেন। মেয়েটার চেহারা থেকে সৌম্যভাবটা কোথায় যেন উধাও হয়ে গেলো। আবার চারদিক অন্ধকার হয়ে গেলো। অদিতের একদম মুখের সামনে এসে মেয়েটা বললো, আমাকে চিনিস না নর্তকীর জারজ সন্তান? আমি শয়তান...আমি তোর মাঝে, তোদের মত মানুষরুপী হায়েনাদের মধ্যে বাস করি। আমিইইই শয়তান।

এরপর চারদিক থেকে বিকট শব্দে শয়তান শব্দটা বিভিন্নভাবে বেজে উঠলো। অদিতের মনে হলো সে মারা যাচ্ছে। তার জেগে ওঠা জরুরী। সে চিৎকার করে উঠলো আর ঠিক সেই সময়ই তার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ধড়মড় করে উঠে বসে সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সে তার জাহাজের চিরচেনা কেবিনে শুয়ে আছে। কিন্তু তার কানে তখনো বাজছে ভয়ংকর সেই ধ্বনি, আমিই শয়তান,আমিই।

প্রিয় পাঠক, পরের অংশটা অদিত রয়ের ব্যক্তিগত জার্নাল থেকে তিনি ঠিক যেভাবে লিখেছেন সেভাবেই প্রকাশ করছি। অদিত রয় নিজের মাঝে আত্নমগ্ন থাকতেন, খুব বেশি বলতে এবং লিখতে পছন্দ করতেন না। তাই তার লিখা থেকে খুব বেশি কিছু জানা কিংবা বোঝা যায়নি।তাই পাঠকেও বোঝার সুবিধার্থে আমি কিছু অংশ নিজে সংযোজন করলাম। তাতে মূল লেখার কোন পরিবর্তন হয়নি বলে দৃঢ় বিশ্বাস রাখি।
***************************
আমি যখন ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে মুরহাউজের গেটের কাছে পৌছালাম, তখন বেশ অসুস্থ বোধ করছিলাম। আমাকে দেখে মুরহাউজের একজন বয়স্ক ভৃত্য এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলো আপনি কি জনাব লেন্ডলের অতিথি, সাগর পাড়ি দিয়ে এসেছেন?
আমি কোনরকমে মাথা নাড়িয়ে জার্মান ভাষায় হা জানালাম। বৃদ্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, পথে আসার সময় আপনি কিছু শুনেছেন কিনা জানিনা! আমরা অত্যন্ত দুঃখিত আপনাকে নিতে লোক পাঠাতে পারিনি বলে। আসলে এতোটাই বিষন্নতা চারদিকে আমরা আতিথেয়তার ভদ্রতাটা ভুলেই গিয়েছিলাম। ক্ষমা করবেন।

আমি উনাকে বললাম, আমি বেশ অসুস্থ। আমাকে একটা বিশ্রামের জায়গা দেখিয়ে দিলে খুব উপকার হবে। আমি সব ঘটনাই জেনেছি এখানে আসার আগে। মিসেস লেন্ডল এবং পরিবারের সকল সম্মানিত সদস্যদের সাথে আমি একটু বিশ্রাম নিয়ে দেখা করতে চাই। এখন আর দুটো মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার মত শক্তিটাও আমার নেই।

বৃদ্ধ লোকটি আমার কথা শুনে আমাকে দ্রুত মুরহাউজের ভেতর নিয়ে গেলেন। একটা বেশ পুরনো রুমের ভেতর আমার থাকার জন্য একটা ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। আমি রুমের ভেতর ঢুকে একটা বিছানা পেয়ে কোন কথা না বলে শুয়ে পড়লাম। মুরহাউজের বিষণ্ণতা, তাতে বসবাসকারী লোকগুলোর চোখে ভয়মাখানো দৃষ্টি সবকিছুই আমার মনে হচ্ছে যেন সাজানো দৃশ্যপট। আমি যেন আঁধারে গেলানো নীলপর্দার রঙ্গমঞ্চে, আর সবাই তাতে নগ্ন অভিনেতা। কারো ভেতর জীবন নেই, সবাই ছাইরঙ্গা ফসিল।

ঘুম কখন ভেঙ্গেছিলো মনে নেই। আমার ক্লান্ত দেহটা বিছানা ছেড়ে উঠতে চাচ্ছিলোনা। কিন্তু এতোটা অভদ্রতা দেখানোর অধিকার আমার নেই বোধ করি। রুমের বাহিরে যেয়ে মিসেস লেন্ডল আর তার বাকি পরিবারের থেকে ক্ষমা চেয়ে আমার অবস্থানটা ব্যাখ্যা করাটা জরুরী। বিছানা থেকে উঠে জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি বাহিরে একটা ঘোড়া চুপ করে শুয়ে আছে। এতো সুন্দর বাদামী রঙের ঘোড়া আমি আগে কখনো দেখিনি। পাশে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে সূর্যের দিকে মুখ করে।মেয়েটার চেহারা খুব একটা ভালো করে দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার জানালা থেকে মেয়েটার দূরত্ব প্রায় ২০০ মিটার ছিলো আর বিকেলের কমলা আলোও তখন পড়তির দিকে তাই হয়তো ঝাপসা আলোতে একটা অদ্ভূত পবিত্র অনুভূতি হচ্ছিলো। এভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মেয়েটা যেন আমার জানালার দিকে মুখ ফেরালো।আমি এই প্রথম এনিকে দেখলাম আবছা আলোতে। বিশাল একটা ধাক্কা খেলাম। মাত্র ১৭ কি ১৮ বছর বয়স হবে অথচ ওকে দেখে মনে হচ্ছে যেন সে এই জগতের সবকিছু জানে। তার চোখে ভাসছে হাজার বছর অপেক্ষায় থাকা একাকী প্রেমিকা অথবা মহাকালের পথে যাত্রা করা পথহারা নাবিক। আমি তার থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না। আমার জানালার খুব কাছাকাছি এলে সে প্রথমবার আমার দিকে তাকালো। আমি মাথা নেড়ে তাকে সম্ভাষন জানানোর একটা ব্যর্থ চেষ্টা নিলাম। এনি আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো, তার চোখে মুখে আমি স্পষ্ট সাহায্যের প্রার্থনা দেখলাম।জানিনা আমার ভাবনা কতটা ভুল ছিলো।

“মিসেস লেন্ডল, আমি অত্যন্ত দুঃখিত এসে আপনাদের সাথে দেখা করতে না পেরে”; ঘর থেকে বেরিয়ে হলরুমের মাঝে তাকে দেখতে পেয়ে আমি একটু লজ্জা পাচ্ছিলাম।
মিসেস লেন্ডল আমার দিকে তাকিয়ে একটা বিমর্ষ হাসি দিয়ে বললেন, আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত আপনাকে ঠিকমত গ্রহণ করতে পারিনি বলে।আসলে সেই ঘটনার পর আমি এখনও স্বাভাবিক হতে পারিনি। জানিনা কখনো পারবো কিনা।আপনি আমাদের সম্মানিত অতিথি। এইসব নিয়ে একদম ভাববেন না।
আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম লেন্ডলপত্নী বেশ ভালোই ইংরেজী বলতে পারেন। তিনি যে একদম ভেঙ্গে পড়েছেন তা উনাকে দেখলেই বেশ বুঝা যাচ্ছে। আমি উনাকে কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। একটু নীরবতার পর উনাকে বেশ আন্তরিকতার সাথে আমার সহমর্মিতা জানালাম। মুরহাউজে আসার আগে জনৈক বৃদ্ধের কাছে এক সপ্তাহ আগে ঘটে যাওয়া পুরো ব্যাপারটা শুনে আমি খুবই আহত হয়েছিলাম। লেন্ডল আমার বেশ ভালো বন্ধু ছিলেন। আমরা ঠিক করেছিলাম এক সাথে ছবি আঁকবো, সাহিত্য নিয়ে গল্প করবো। তার একটি আধুনিক নভোবীক্ষণ যন্ত্র আছে বলে আমাকে জানিয়েছিলেন। আমার নক্ষত্র দেখার বেশ আগ্রহ আছে শুনেই প্রথম তিনি আমাকে তার বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম দূর পাশ্চাত্যে এলে সর্বপ্রথম তার বাড়িতেই আসবো এবং একসাথে রাতের তারা উপভোগ করবো।
লরা ভদ্রতাসূচক একটা হাসি দিয়ে বললেন, আপনি বিশ্রাম নিন। আপনার জন্য সব প্রস্তুত থাকবে।
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমার বাহিরে হাঁটার অভ্যাস ছিলো। তাই মুরহাউজ থেকে কাছের বাগানটায় আমি যখন হাঁটছিলাম তখন কিছুটা দূরে এনিকে আবার দেখলাম।এনি আমাকে দেখে আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে বললো, বাবা বলেছিলো আপনি ভালো কবিতা লিখতে পারেন। জানেন আমিও কবিতা লিখতে পারতাম।
হঠাৎ করে এভাবে কবিতা নিয়ে ওর সাথে কথা হচ্ছে ভেবে একটু অদ্ভূত লাগলো। আমার মনে হলো মেয়েটা একটু অপ্রকৃতস্থ। ওকে প্রত্যুত্তরে বললাম, কেমন কবিতা লিখো তুমি?
মেয়েটা একটা ফ্যাকাশে হাসি দিয়ে বললো, আমি ভালোবাসার কবিতা লিখি। আমার কবিতায় লাল নীল পৃথিবী থাকেনা, থাকে ধূলোয় ঘেরা অমসৃণ জনপদ। সেখানে এক একাকী কিশোরী অপেক্ষা করে তার ভালোবাসার মানুষের জন্য। কিন্তু অপেক্ষাটা বিফলে যায়। আমি আমার কবিতায় কিশোরীর চোখের জলে যে নদী জন্মায়, তারপর মৃতপ্রায় পৃথিবীটা যেমন করে সবুজ হয়ে ওঠে তার কথা বলি।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। এই অল্প বয়সে তার ভাববোধ আমাকে বিমোহিত করে। তার চোখে চোখ পড়তেই আমি বিব্রত হয়ে পড়ি। এরপর মুখ ফুটে আচমকা বের হয়ে যায়, তুমি এতো সুন্দর করে কথা বলো কেমন করে?
এনি লজ্জা পায়। চাদের আলোতে ওর লাজভরা গাল আমি বেশ দেখতে পাই। হঠাৎ অনুভব করি মাত্র পরিচয় হওয়া মেয়েটাকে আমার বেশ ভালো লেগে গেছে। ও বয়সে আমার অর্ধেক হবে হয়তো, কিন্তু মনটা আমার থেকেও শক্ত। এনি আমার সাথে হাটতে হাটতে বললো, আমার বাবা গল্প লিখতেন। তার ইচ্ছা ছিলো একটা উপন্যাস লিখে বাধাই করে সবাইকে পড়তে দেবেন। সেই উপন্যাসের নায়িকার নাম হবে আমার নামে।আচ্ছা আমার বাবাকে আপনার কেমন লাগতো?
আমি হেসে বললাম, আমার উনাকে বেশ জ্ঞানী মানুষ মনে হতো। কত কিছু জানেন। একটা অদ্ভূত ব্যাপার অবশ্য ছিলো। এক রাতে উনি আমাকে মদ্যপ অবস্থায় বলেছিলেন, ঈশ্বর উনার মত সত্তাকে বেশ ভয় পায়।
এনির চোখ হঠাৎ বড় বড় হয়ে গেলো। আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, বাবা ঈশ্বর বিশ্বাস করতেন। প্রচন্ড বিশ্বাস করতেন। কিন্তু উনি ঈশ্বরকে দুর্বল ভাবতেন, মনে করতেন তার প্রতিপক্ষ। উনি তাই গীর্জায় যেতেন না।
আমি একটু অবাক হলাম। এমন কিছু একটা আমি নিজেও ধারণা করেছিলাম লেন্ডল সম্পর্কে। এনিকে নরম কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কি তোমার বাবার মতই এমনটা বিশ্বাস করো?
এনি আমার থেকে চোখ নামিয়ে বললো, আমি জানিনা। আমার কোন কিছুতে কোন রকম বিশ্বাস নেই।
এনির সাথে সেরাতে অনেক গল্প করলাম। ওর সম্পর্কে জানলাম। বেশ রাত হলে আমি ওকে বিদায় নেয়ার আগ মুহূর্তে অপ্রীতিকর ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে চাইলাম। ওকে বললাম, তোমার সাথে, তোমার পরিবারের সাথে যা হয়েছে তার জন্য আমি দুঃখিত।আমি জানি সেদিন তুমি খুব বাজে সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছো। আমি তোমাদের বাড়িতে একমাস থাকবো। তোমার যখন মনে চাইবে আমার সাথে যেকোন কিছু নিয়ে গল্প করতে পারো।

এনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো একটা অদ্ভূত দৃষ্টিতে। আমি যখন চলে যাচ্ছিলাম তখন সে পেছন থেকে বললো, একটু শুনুন।
আমি কাছে এগিয়ে গেলে এনি আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে বললো, আপনি এখান থেকে যেতে পারবেন না এটা জানেন?
আমি এনির দিকে তাকালাম। চাঁদের আলোতে ওর মুখে একটা অপরিচিত প্রতিবিম্ব দেখলাম। মেয়েটার চেহারাটা কেমন যেন অপরিচিতের মত লাগলো। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন পারবোনা?
এনি আমার সাথে কথা না বলে পেছন ঘুরে চলে যাচ্ছিলো। আমিও নিজের ঘরে ফেরত আসছিলাম। ফিসফিস কন্ঠে নিজেকে নিজেই জিজ্ঞাসা করছিলাম, কেন এ বাড়ি থেকে যেতে পারবোনা। হঠাৎ খেয়াল করলাম সবকিছু কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।একেবারে কোন শব্দ নেই কোথাও। চারপাশটা কেমন লালচে অন্ধকার। কে যেন মনে হলো আমার কানের কাছে এসে ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বললো, শয়তান তোমাকে মুক্তি দেবেনা তাই!
আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখান থেকে ছিটকে সরে এলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি এনি দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখে একটা অশ্লীল হাসি, আমার দিকে খুব করুণার চোখে তাকিয়ে একসময় চলে গেলো। আমি ওর হেঁটে যাওয়া দেখলাম। আমি খুব ভালোভাবে বুঝলাম, কিছু একটা সমস্যা আছে এই পুরো বাড়িতে। আমার মন বলছিলো, সামনে ভীষণ বিপদ। আমার যেন মুক্তি নেই।

পরদিন সকালে সবাই যখন একসাথে নাস্তা খেতে বসলাম তখন লেন্ডলের স্ত্রী লরা আমার দিকে তাকিয়ে বেশ দুঃখভরা কন্ঠে জানালো, খুব বেশি আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। কারণ তার বাড়ির চাকরবাকর একেবারে এখন নেই বললেই চলে। তাকেই সব রান্না করে নিতে হয়। আমি বেশ বিব্রত বোধ করলাম তার কথা শুনে। তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, আমি সকালে দুটো শুকনো রুটি পানি দিয়ে ভিজিয়ে খেয়ে নিতেই তৃপ্তি বোধ করি। এতো কিছু আয়োজনের কোন দরকার ছিলোনা।

দুপুরে আমি বাড়িতে থেকে যাওয়া চার ভৃত্যের সাথে কথা বললাম। এরমধ্যে একজনকে খুব অদ্ভূত মনে হলো। তার নাম ছিলো পল। পল আমাকে সেদিনের সমস্ত ঘটনা অগোছালোভাবে বললো। কিন্তু যতবার সে তার ওই অভিশপ্ত ঘরে ঢোকার কথা বলতে চায়, ততবার কেমন যেন ঘাবড়ে গিয়ে চুপ হয়ে পড়ে। ছেলেটার বয়স খুব বেশি হলে ২২/২৩ হবে। সুদর্শন, পেটা শরীর। দেখে মনে হবেনা সে একজন চাকর।চামড়াটা বাদামী দেখে মনে হচ্ছে কোন এক সাদা চামড়ার অবৈধ সন্তান বলেই হয়তো তার আজ এই অবস্থা।আমি পলকে বলি, এনিকে তোমরা খুজে পেয়েছিলে কিভাবে?
পল আমতা আমতা করে বলে, উনাকে কেউ খুজে পায়নি। উনি বিবস্ত্র অবস্থায় ওই শয়তানের ঘর থেকে নিজে নিজে উঠে আসেন। আমি তখন খুব আহত ছিলাম। মাথায় আঘাত পেয়ে একদম বাজে অবস্থা ছিলো। এই দেখুন মাথায় কি বড় একটা কাটা দাগ।বিশ্বাস করুন কিভাবে মাথায় এমন আঘাত পেলাম কিচ্ছু মনে পড়ছেনা। শুধু মনে আছে, ওই ঘরে ঢোকার পর কে যেন আমাকে ছিটকে বাহিরে ফেলে দেয়। আমি কোনরকমে পালিয়ে আসি। আমরা এখন কেউ ওখানে যাইনা। গীর্জা থেকে লোক পাঠানো হয়েছিলো, ফাদার নিজে এসেছিলেন।সবাইকে না করেছেন ওদিকটায় যেন আর না যাই। আমার এ বাড়িতেই আর মন টিকছেনা। মনে হচ্ছে, কোথাও চলে যাই।কিন্তু পারছিনা।

আমি পলের বলা অবিশ্বাস্য গল্পে কেন যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি শয়তানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করিনা। কারণ ঈশ্বর আলোকিত, তার গড়া সৃষ্টিতে অন্ধকারের স্থান নেই। আমার সাথে বেশ কয়েকদিন ধরে ঘটে যাওয়া অদ্ভূত ব্যাপারগুলোর পরেও আমি এই অশুভ অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে পারছিনা। সন্ধ্যায় তাই যখন এনির সাথে হাঁটতে হাঁটতে গতরাতের ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলছিলাম তখন বারবার ওকে বলছিলাম আমি এসবে বিশ্বাস করতে পারিনা। এনি আমার দিকে না তাকিয়ে ডুবে যাওয়া সূর্যটা খুব আগ্রহ নিয়ে উপভোগ করছিলো। দুদিকে হাত ছড়িয়ে একসময় বললো, কাল রাতে আপনাকে বিব্রত করার জন্য দুঃখিত। মাঝে মাঝে কি যে হয় আমি জানিনা।
আমি হালকা আলোতেও বেশ পরিষ্কার দেখতে পারছিলাম এনির ডান হাতের দুটো আঙ্গুল নেই। বুঝতে পারছিলাম না তাকে জিজ্ঞাসা করাটা ঠিক হবে কিনা। অনেক সংকোচের সাথে তবুও ওকে মিনমিন করে বললাম, কিভাবে তোমার হাতে এমনটা হলো?
এনি আমার দিকে না তাকিয়ে আগের মত হাত উচিয়ে বললো, ও কামড়ে দিয়েছিলো। আমাকে হয়তো পছন্দ হচ্ছিলোনা। ওকে বিরক্ত করার একদম ইচ্ছা ছিলোনা। কেন যে সেদিন ওখানে গেলাম।
আমি ওর কথা শুনে একটু জমে গেলাম, বলতে বাধ্য হচ্ছি যে কেমন যেন একটা অশুভ বোধ হচ্ছিলো আমার। ভয় বললে একদম ভুল হবেনা। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, এনি আমাকে ওখানে নিয়ে যাবে?
এনি ধপ করে হাতটা নামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ওখানে যাবেন না। ওখানে পৃথিবী শেষ হয়। আর কখনো এমনটা ভাববেন না। যদি স্বপ্নেও আপনি সেখানে যান আপনাকে ও খুব কঠিন শাস্তি দেবে। ও অবিশ্বাসীদের ঘৃণা করে। ও ঈশ্বর ঘৃণা করে। আর কখনো এমনটা বলবেন না। আমরা এমনিতে বন্দী হয়ে আছি। ও সবাইকে খুব কষ্ট দিয়ে মারবে। আমাকে, মা কে এবং আপনাকে।
আমি ওকে ভয়ার্ত কন্ঠে বলি, এখান থেকে চলে গেলেই তো পারো।
এনির শরীর খুব কাঁপছিলো। আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ও খুব কাঁদছিলো। এতোটা অসহায় আমি খুব কম মানুষকে দেখেছি। আমার ওর জন্য মায়া হচ্ছিলো। ও আমাকে কাঁদতে কাঁদতে বললো, কোথাও যেতে পারবোনা। আমরা সবাই বন্দী। আপনি চেষ্টা করে দেখুন। পারবেন না যেতে।

আমার কবিতা ভালো লাগতো। বঙ্কিমের সাহিত্য আমার অনুপ্রেরণা দিতো কিন্তু তা মনে তৃপ্তি দিতোনা। আমি তৃপ্তি পেতাম রবিঠাকুরের কবিতায়। সে কেমন করে যেন আমার মনের কথাগুলো খুব গুছিয়ে ছন্দের সমুদ্রে ভাসিয়ে দিতো। আমি খাবি খেতাম অবিরত। জোড়াসাকোর ঠাকুর পরিবারের সাথে আমার খুব একটা পরিচয় ছিলোনা। চিঠি পাঠিয়েছি দুটো। রবি বাবু হয়তো খুব ব্যস্ত থাকতেন, তাই আর উত্তর দিতে পারেননি। আমি যে খুব প্রত্যাশা করে বসে ছিলাম ঠিক তাও নয়। আজকে হাজার হাজার মাইল দূরে বসে একটা ভূতুড়ে বাড়িতে বিশ্বাস অবিশ্বাসীর নীরব যুদ্ধে আমার সেই কবিতাগুলোর কথা বেশ মনে পড়ছে। আমি মাঝে মাঝে ভাবতাম ঈশ্বর কথা বলেন কাব্যে। কবিরা ঈশ্বরের ভাষা রপ্তে তাদের সারাটা জীবন সাধনা করেন। কেউ কেউ হঠাৎ করে ছন্দে সুরে তাতে আলোড়ন তোলে। তাদের মাঝে তখন ঈশ্বর, তার ভালোবাসা গেঁথে যায়। আমি কবি নই, একদম সাধারণ দেবীর পানে মাথা ঠেকানো মেছো বাঙ্গালী। তবুও আমি যখন মানুষের ভেতরে উঁকি দেই তখন ঈশ্বরকে অনুভব করি। আমি যখন সবুজের বনে দীপাবলীর আলো হাতড়ে বেড়াই, তখন বুকে ঈশ্বরের সংগীত খুব বাজে। আমি চারপাশে ঈশ্বরের অস্তিত্ব খুজি। মুসলমান নামাজে যখন সেজদায় যায়, ব্রাক্ষ্মণ ভোর সকালে চান করে যখন তার প্রভুকে ডাকেন, খ্রিস্টরা মিষ্টি করে হেসে তার যিশুর বাণী শুনায় আমি সবকিছুতে ওই একক পরমেশ্বরকে খোজার প্রয়াস দেখি।আমি কোন ধর্মকে আকড়ে ধরতে পারিনি, এ আমার দুর্বলতা বললে ভুল হয়না। নিজেকে এখনো মনে হয় শিশু, মস্তিষ্কটা একদম কাচা। যেদিন তাকে সত্যিই সম্মান করার সামর্থ্য হবে সেদিন শুধু তার জন্যই প্রার্থনা করবো। তাকে আরো খুজবো, ভাববো এবং তার সৃষ্টিকে আকড়ে ধরবো।এই পবিত্রতার সমারোহে আমি অপশক্তিকে অস্বীকার করি। আমি শয়তানের অস্তিত্ব মানতে নারাজ, এবং তাকে দুর্বল জন্তু ছাড়া আর কিছুই ভাবিনা। ঠিক করেছি বন্ধু লেন্ডলের হত্যার ব্যাপারটা খুব ভালো ভাবে বুঝবো। সেই প্রচেষ্টাতেই আমার প্রথম প্রয়াস হবে বাড়ির সবাইকে জানার।

পরদিন মৃতবন্ধুর স্ত্রী লরার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম। সকালে বাড়ির সবার খাওয়া হলে লরা একা একা বাগানে বসে থাকেন। সেখানেই তার পাশে দাঁড়িয়ে প্রথম কথা বললাম, “লেন্ডলকে আমার মাঝে মাঝে অন্যরকম মনে হতো। ওর সাথে বিলাতে যে তিনবছর কাটিয়েছি তাকে মনে হয়েছে খুব কট্টোর, জমিদার প্রথায় অবিশ্বাসী। কিন্তু ঈশ্বরে কেমন একটা ঘৃণা ছিলো। তাই না?”
লরা একটু চমকে আমার দিকে তাকালো। তারপর মাথা নিচু করে বললো, অনুগ্রহপূর্বক এমন করে বলবেন না। এসব কথা চার্চে ছড়ালে আমাদের এখানে বাস করার শেষ যে আশাটা ছিলো তাও নষ্ট হয়ে যাবে। এখানে চার্চ রাণীর দেশের মত সহনশীল নয়।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, মিসেস লেন্ডল আমি দুঃখিত এমনভাবে বলার জন্য। জানতে ইচ্ছা হচ্ছে আপনিও কি নাস্তিক?
লরা অনেকক্ষণ নিশ্চুপ থাকলো। আমি তাকে সময় দিলাম কথা গুছিয়ে নেয়ার। কিন্তু উত্তরটা আমি পেয়ে গিয়েছিলাম। তবুও তার কথা মন দিয়ে শুনলাম। সে আস্তে আস্তে পা ফেলে সামনে এগিয়ে বললো, আমি তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করি। এমনকি চার্চেও মাঝে মাঝে যাই। আমি পশ্চিম জার্মানীর যে প্রান্ত থেকে এসেছি সেখানে মানুষ ধর্মে খুব বিশ্বাসী। এজন্য কেউ কেউ হঠাৎ করে কেমন যেন উগ্রও হয়ে ওঠে। আমার বাবা একবার পথসঙ্গীত গাইতো এমন একজনকে পুড়িয়ে মেরেছিলো।সে ঈশ্বরকে অপমান করে গান বানিয়েছিলো তাই বাবার সেটা সহ্য হয়নি। আমি নিজ চোখে লোকটিকে পুড়ে মরতে দেখেছি। এরপর থেকে একটু অন্যরকম হয়ে গেছি।
আমি মুখ দিয়ে চুকচুক আওয়াজ করে বললাম, আপনার ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। কিন্তু লেন্ডলের এমন অভক্তির কারণটা কি ছিলো?
লরা কি যেন একটা কথা বলতে যেয়েও বললোনা। আমার দিকে নির্বিষ হাসি দিয়ে বললো, ও নিজেই জানে শুধু। আমি কখনো ওকে জিজ্ঞাসা করিনি। এসব বাদ দেই না। ও বলতো আপনি খুব সুন্দর করে কবিতা পড়তে পারেন। আমি ইংরেজী যে খুব ভালো বলতে পারিনা তা তো বুঝতেই পারছেন। তবুও একটা কবিতা শোনান দেখি কিছু বুঝে উঠতে পারি কিনা।

আমি লরাকে একটা ভালোবাসার কবিতা শোনালাম। দেখলাম লরার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আমি আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে এলাম। নারী দুর্বোধ্য, লরা ব্যতিক্রম নয়।
এরপর ভাবলাম লেন্ডলের চাচাতো ভাই যে এই ব্যবসাতেও লেন্ডলের একরকম সহকারী ছিলো তার সাথে কথা বলবো বলে ঠিক করলাম। লোকটার নাম এরফলগার। লেন্ডলের সাথে চেহারাতেও খুব মিলে যায়। নাকের নিচে পুরু গোফ, কেমন একটা রাগী ভাব নিয়ে থাকেন। কিন্তু কথা বলে মনে হলো লোকটা আসলে খুবই বোকা। এবং পানির মত সহজ।জানতে পারলাম এই বাড়িতে সে বসবাস করেনা। এইরকম খারাপ সময়ে মুর পরিবারের যেন কোন সমস্যা না হয় তাই এসেছে সহযোগিতা করতে। লেন্ডল তাকে যথেস্ট স্নেহ করতো ছোট ভাইয়ের মত। যদিও বয়সে তারা খুব কাছাকাছিই ছিলো। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম ওই অভিশপ্ত ঘরটা সম্পর্কে।ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আমি বোকাসোকা মানুষ। জানিনা সেদিন কি হয়েছিলো। সব শুনে খুব ভয় পেয়েছি।আমি ওদিক দিয়ে যাইনা। আমি অনেকবার লেন্ডলকে বলেছি, সাবধান করেছি ওসবে না জড়াতে।
আমি বেশ কৌতুহলী হয়ে উঠলাম। আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলাম, কিসে না জড়াতে?
এরফলগার আমতা আমতা করে বলতে থাকলো, আমি ওসব বুঝিনা। কি বলবো আর আপনাকে?
আমি ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। এরপর কাঁধে হাত দিয়ে বললাম, আমি বুঝি। আমাকে বলুন না। আমি আপনাদের পরিবারের বন্ধু।
এরফলগার অসহায়ের মত এদিক সেদিক তাকিয়ে বললো, ও সাধনা করতো।অনশ্বরের সাধনা। এর বাহিরে আর কিছু জানিনা। আমার যেতে হবে এখন। মেয়রের সাথে কাজ আছে। আপনি ভালো থাকুন জনাব।

এনির সাথে দুদিন ধরে দেখা হচ্ছিলোনা। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম ব্যাপারটা আমার ভেতরে একটা অস্বস্তি তৈরী করেছে। আমার ওর সাথে কথা বলতে ভালো লাগে। ওকে কেমন যেন দেবীর মত লাগে। আমার প্রায় আধ বয়সের কারো প্রতি এমন দুর্বলতাটা খুবই দৃষ্টিকটু। কিন্তু ও যখন শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, ধীরে ধীরে জীবনের কথা বলে আমি ওর থেকে না আমার দৃষ্টি- না মনটা ফেরাতে পারি। ঘুম থেকে উঠে আজ যখন ওকে দেখলাম খুব ভালো লাগলো। ওর কাছে যেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কোথায় ছিলে?
ও হেসে বললো, পালিয়ে পালিয়ে থেকেছি। মাঝে মাঝে আমি এমন ডুব মেরে থাকি। কেন যেন আপনার সাথে একটু কথা বলতে ইচ্ছা হলো তাই আসলাম।

আমি একইসাথে বিব্রত বোধ করলাম সেই সাথে কেমন একটা ভালো লাগাও যেন কাজ করলো। ওর হাত ধরে ফেললাম নিজের অজান্তে। তারপর বললাম, আজকে সারাদিন তুমি আমার সাথে গল্প করবে। মাঝে মাঝে কেমন অদ্ভূত সব কাজ করে ভয় দেখাও না হয় তাই করবে।
এনির গালটা লাল হয়ে গেলো। আমারও মনে হলো একটু বেশি ওকে বলে ফেলেছি। হাতটা ছেড়ে দিয়ে বললাম, দুঃখিত। তোমাকে খুব আপন মনে হয়েছে তাই এমনটা বলে ফেললাম।
এনি মুখ ফিরিয়ে বললো, না কিছু না। আপনি আপনার গল্প বলুন না শুনি। আমি কখনো কোন ছেলে মানুষকে এভাবে জানতে চাইনি।আপনারা কেমন করে ভাবেন?
আমি হেসে বললাম, ঠিক তোমাদের মত করেই ভাবি। শুধু একটু পার্থক্য রয়েছে।
ও জিজ্ঞাসা করলো, কেমন?
আমি বললাম, আমরা মাঝে মাঝে লাভ ক্ষতিটা একটু বেশি বুঝি। সম্পর্কে ভয় পাই, দূরত্বে অসহায় বোধ করি। এইতো।
এনি আমাকে ইশারায় ডেকে বাগানে নিয়ে এলো। আমাকে বললো, এটা আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা।ওইযে নদীর পার, ওখানে আমি প্রায় দিন বসে থাকি। ভাবি, অনেক অনেক কথা ভাবি। কিন্তু মাঝে মাঝে একটু সমস্যা হয়।
আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি সমস্যা হয়?
ও ফ্যাকাশে মুখে বললো, মাঝে মাঝে আমি হারিয়ে যাই। আপনাকে মাঝে মাঝে কেমন কেমন সব কথা বলিনা, ওগুলো এর জন্যই হয়। আমি জানি আমি এমন অদ্ভূত কথা বলতে চাইনা। কিন্তু কেমন করে যেন বলে ফেলি।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। চোখ সরাতে পারছিলাম না। ওর চোখের অসহায়ত্ব দেখতেও ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে ওকে নিজের কাছে রেখে দেই। কিন্তু একটা কেমন যেন অসহায় বোধ হয় যখন মনে হয় আমরা কত ভিন্ন সমাজের, ধর্মের অংশ। কিন্তু জানিনা এতো কাছের মানুষ কেন মনে হয় ওকে। ১৮ বছর বয়সে বাবা আমার সাথে শখ করে আল্পনা রয়ের বিয়ে দিয়েছিলো। ৯ বছরের বধূটা আমার সাথে ভয়ে ঠিকমত কথা বলতে পারতোনা। আমি খুব কায়দা করে ওকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম। ওকে ছুঁয়ে দিলেই ভীষণ কাঁদতো।ও ছিলো বাবা মায়ের খুব আদরের। ৭ বছর সংসার করার পর, একদিন হঠাৎ করে ও আমার দিকে তাকিয়ে বললো তোমাকে ভালোবাসা হলোনা যে?
আমি বললাম, তোমার চোখে যে অনেক ভালোবাসা। শুধু কাঁদলেই মনে হয় ঝরে পড়ে।বাকীটা সময় খুব কষ্ট হয় আগলে রাখতে, তাই না?
আলপনা রয় লজ্জা পেয়ে কপাল পর্যন্ত ঘোমটা দিয়ে বললো, একটা আবদার আছে। রাখবে?
আমি ওর হাত টেনে বুকে লাগিয়ে বললাম, বলেই দেখোনা।
ও আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমার খুব বিশ্রাম দরকার। কেমন যেন হাঁপিয়ে গেছি। দেবে?
আমি অদিত রয় জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা সেইসময়টা করে বসলাম। বললাম, দিলাম তোমায় আজীবনের জন্য ছুটি। এখন শুধু আমাকে ভালোবাসবে, চোখে চোখ রেখে তোমার স্বপ্নে আমাকে ভাগ দেবে। দেবে না?
আমি শুধু ওর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনেছিলাম। আমার দীর্ঘশ্বাসটা আরো লম্বা ছিলো যখন ওর লাশটা নিয়ে চন্দন কাঠের শেষ বিছানায় শুইয়ে দিলাম। আমার হাতে মারা যাওয়ার আগে ও আমাকে বলেছিলো, তোমাকে আমার মত করে একজন খুব ভালোবাসবে।
আমি ওর কালচে শিট পড়া গালে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে বললাম, আমার যে তোমাকে খুব দরকার।
ও আমার হাতটা ছুয়ে বললো, ও মাগো! ছেলেমানুষের এমন করে কাঁদতে নেই যে। চোখটা মোছো। আমিই আসবো। তোমার শক্তপক্ত হাতগুলো আবার ধরে থাকবো।

এরপর সব নিশ্চুপ, নিঃশব্দ। শুধু ওর হারিয়ে যাওয়া শব্দের নীরব, নিষ্ঠুর সমীরণ আমার ভেতরটা চিড়ে দিলো, সারাটা জীবনের জন্য। আমার চোখের জল আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম।ভালোবাসাটা পারিনি। তখন বিকেলের কমলা রোদ্দুর আল্পনার বিছানার পাশের জানালাটা দিয়ে আমার গালে ফুটে ফুটে ঝরছিলো। আমি সারাটা রাত্রি ওর মাথাটা আমার কোলে নিয়ে নানান স্বপ্নে বিভোর ছিলাম। ওকে ভাবছিলাম, ওর সাথে কাটানো প্রত্যেকটা সময়কে আবার জাগিয়ে উপভোগ করছিলাম। কাকডাকা ভোরে বাবা আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, ওর শেষকৃত্য করতে হবে যে অদিত।
আমি বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম, বাবা এইটুকু মেয়েটাকে তুমি আমার হাতে সমার্পন করেছিলে ঠিক এই ঘরেই মনে আছে? আমি হাতটা ধরতেই বলেছিলো, তোমার হাতটা বড্ড ঠান্ডা। আরেকবার ছুয়েছো কি দেবো দৌড়। বাবা আমার হাতটা ধরে দেখো তো, এখনো কি ঠান্ডা হয়ে আছে? ও তাহলে দৌড়ে কোথায় পালিয়ে গেলো।

৮ বছর পর আজকে যখন এনির সাথে বসেছিলাম এক পড়ন্ত বিকেলে তেমনই এক কমলা রোদ্দুর আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছিলো। আমি প্রতিবার ওকে দেখি আর মনে হয়, আরে এই যে আমার জাগতিক ভালোবাসার আস্তানা সব এই দূর দেশের সপ্তদর্শীর মায়াবী মুখে আশ্রয় নিয়েছে। আলপনা রয় কি ফিরেই আসলো তবে আমাকে উদ্ধারে এই নিষ্প্রাণ পৃথিবীতে? এসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন এনি আমার হাত ধরে বসলো। আমাকে বললো, এভাবে তাকিয়ে থাকেন কেন?
আমি বললাম, কিভাবে?
ও আমার কাছে এগিয়ে এসে আলতো করে ঠোটে চুমু খেয়ে দৌড়ে পালালো।আমি হতভম্ব হয়ে বসে থাকলাম। এই স্পর্শটা আমার অনেক পরিচিত। সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেলো। সবকিছু।

মুরহাউজে আমার প্রায় এক মাস আরো কেটে গেলো। এর মাঝে আমার মুরহাউজের অনেকের সাথে দেখা সাক্ষাত হলো। সবার সাথে কথা বলে একটা ব্যাপার খুব পরিষ্কার হলো। ওরা কেউই তেমন লেন্ডলকে বুঝতোনা। আমি জানতাম লেন্ডল একটু রাশভারী মানুষ, কিন্তু পরিবারের মানুষের সাথে এতোটা দূরত্ব বজায় রাখেন তা জানা ছিলোনা। সেদিন লেন্ডলের খুব কাছের বন্ধু সিমনের সাথে বেশ আলাপ হলো। উনি মানসিক রোগের ডাক্তার। আমার এই বিষয়ে আগ্রহ আছে শুনে আমাকে বললো কাল উনার বাসায় যেতে। আমাকে বেশ কিছু বই পড়তে দেবেন, ইংরেজীতে লিখা।প্রস্তাবটা লোভনীয়।আমি সানন্দে উনাকে সম্মতি জানালাম।

পরদিন আমি ঠিক সময়ে উনার বাসায় পৌছে গেলাম। লেন্ডলের বাসা থেকে তা খুব কাছে। সিমন আমাকে দেখে খুব খুশি হলো। গল্প করতে করতে একসময় আমাকে বললো, অদিত আমি বিজ্ঞানের মানুষ। বুজুরুকি, কুসংস্কার বিশ্বাস করিনা। কিন্তু একটা অদ্ভূত ব্যাপার কি জানো। লেন্ডলের মৃত্যুটা আমার বিশ্বাসটা অনেকটা কাঁপিয়ে দিয়েছে।
আমি কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললাম, শুনেছি আপনি ঘটনার পর প্রথম ওই বাড়িতে গিয়েছিলেন, সেরাতেই।
সিমন আমার দিকে তাকিয়ে বললো, হুমম। লেন্ডলের লাশটা দেখে আমি প্রায় মুর্ছা গিয়েছিলাম। এভাবে কোন মানুষকে অন্য কোন মানুষ হত্যা করতে পারে আমি বিশ্বাস করতে পারিনা। তোমাকে একটা কথা বলবো, তুমি নিজের ভেতরেই রেখো।
আমি হাসিমুখে বললাম, বলে ফেলুন নির্দ্বিধায়।
সিমন একটু নড়েচড়ে বসে বললো, লেন্ডল আমার বন্ধু ছিলো। বেশ ভালো বন্ধু। বছরখানেক আগে ও আমাকে একটা উপাসনায় আসতে বলে।আমি জানতাম ও ঈশ্বরে বিশ্বাস করেনা। এবং ও...
আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। জানতাম ও কি বলবে, তাও আমি চাচ্ছিলাম ওর মুখ থেকে পুরো ব্যাপারটা শুনে বুঝতে।
সিমন একটু থেকে বললো, ও শয়তানের পূজো করতো।ও বলতো প্রতি বছরের ১৫ তম পূর্ণিমায় শয়তানের জন্য বিশেষ উপাসনা করলে একসময় সে অমর হয়ে যাবে। এই পৃথিবীর সব রহস্য ওর সামনে উন্মোচিত হবে। ও হবে সকল জ্ঞানের অধিকারী।
আমি সিমনের কথা শেষ না হতে দিয়ে ওকে বললাম, আপনি গিয়েছিলেন?
সিমন আমতা আমতা করে বললো, আমি গিয়েছিলাম। কিন্তু যখন ও বলি দেয়া শুরু করলো আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। চলে এসেছি।অদিত তুমি বিশ্বাস করবেনা, এমন কোন পাপাচার ছিলোনা যা সেখানে হতোনা। মুরহাউজকে তুমি যেভাবে দেখো, ওটা ওমন না। এর ভেতরে অনেক রক্ত খেলা চলেছে। আমি তোমাকে কেন বললাম এসব জানো?
আমি কিছু বলিনা। সিমনের দিকে মনোযোগ দিকে তাকিয়ে থাকি। সিমন মনে হয় একটু উত্তেজিত হয়ে গেছে। ও হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, আমি চাই এসব বন্ধ হোক। এই গ্রামের অনেকেই জানে ওখানে কি হয়। কিন্তু কেউ কিছু করতে পারেনা। সবাই ভয় পায়।সব কাপুরুষ। আমিও হয়তো ওদের দলে।আমি ছাড়া আমার পরিবার অর্থব হয়ে পড়বে, এই ভয়ে আমি আটকে পড়েছি। লেন্ডল মারা গিয়েছে তো কি হয়েছে, এসব বন্ধ হবেনা। কারণ এখন ওই বাড়িতে শয়তান বাস করে। লেন্ডল যাকে ডেকে এনেছে সেই ওকে এমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করলো।অদিত একটা কথা রাখবে?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, বলুন।
সিমন বললো, এনিকে আমি খুব ভালোবাসি। আমার মেয়ের মত। মেয়েটার জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে তুমি ওকে রক্ষা করো। পারলে ওকে নিয়ে কোথাও চলে যাও।তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি পূণ্য আত্না। তোমার কোন ক্ষতি হবেনা আমি জানি।পারবে না?শুধু একটা কথা মনে রেখো, কাউকে বিশ্বাস করোনা। কাউকে না।
সিমনের বাসা থেকে চলে আসার পর আমার কাছে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে গেলো। মুরহাউজে ঢোকার পথে হঠাৎ করে দুটা ছায়াকে আমার থেকে একটু দূরে দৌড়ে যেতে দেখলাম। অন্ধকার হয়ে গিয়েছিলো তাই ঠিকমত চিনতে পারিনি। ওরা যেদিকে দৌড়ে গেলো আমিও সেখান আস্তে আস্তে এগোতে থাকলাম। আমার ভেতরে কেউ একজন বললো, যেও না।
আমি ব্ল্যাক আর্ট নিয়ে বেশ কিছু লেখা পড়েছিলাম। আফ্রিকার কোন এক অজানা জঙ্গলের নাতিবু বলে এক উপজাতি থেকে প্রথম কালোজাদুর ধারণা আসে। ইউরোপের বেশ কিছু লোভী নাবিক ওই উপজাতির সাথে মেলামেশা করতো ওসব শেখার জন্য। আস্তে আস্তে নানান দেশে নানান রঙ্গে তা ছড়িয়ে পড়ে। আমার কাছে কখনোই এসবকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। কারণ আমি পরমেশ্বরে বিশ্বাস করি। তার সৃষ্ট জগতে এমন ক্রুটি থাকতে পারে আমি মানিনা। যে স্রষ্টা এতো ভালোবাসা নিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তাই এই সৃষ্টিকে শয়তানের মত কোন অস্তিত্ব ক্ষতি করতে পারে আমি বিশ্বাস করিনা। আমার ভাবতে অবাক লাগে লেন্ডলের মত কেউ এতোটা আগ্রাসী হতে পারে নিজেকে মহাকালে ছড়িয়ে দেবার জন্য।

আমি হেটে হেটে যখন অশুভ স্থানটায় পৌছালাম তখন খেয়াল করলাম চারদিকে চাদের আলোটা কেমন যেন অশ্লীলভাবে হেলে পড়ে আছে। ঠকঠক আওয়াজে চারদিক একটু পরপর কেপে উঠছে মনে হচ্ছে যেন। খেয়াল করলাম কাঠের ছোট্ট ঘরটায় একটা নিভুনিভু লালচে আলো জ্বলছে যার খানিকটা আভা বাহিরে এসেও পড়ছে। বিস্ময়ের সাথে খেয়াল করলাম ঠিক এমন একটা ঘর আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম কোন একদিন। আমি ভেতরে না গিয়েও অনুভব করি তিন/চারজনের উপস্থিতি। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি আজ ভরা পূর্ণিমা। বুঝতে পারলাম আজ কিছু একটা হতে চলছে এই অশুভ কামরায় এবং আমি অদিত রয় আজ হয়তো নতুন কিছু অস্তিত্ব অনুভব করবো। ভয় লাগছেনা তা বলবোনা, কিন্তু নিজেকে বারবার বুঝাচ্ছিলাম পরমসত্তার অনিবার্য উপস্থিতিকে। হাজার বছর পথভ্রষ্টরা নিজেকে অমর করতে, অশুভ ক্ষমতা পেতে এমন অনেক শয়তানকে পৃথিবীতে দাওয়াত করেছে। তারা কেউ ঈশ্বরের পথে চলা মানুষের অদম্য সাহসিকতার সাথে পেরে ওঠেনি। আজ কেন তার ব্যতিক্রম হবে। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি এই শয়তান মানুষের ভেতরের গহীনে বাস করে। দুষ্টের দল শুধু একে টেনে বের করে আনে। আমি জানি এই শয়তান আমার ভেতরেও বাস করে, কিন্তু ঈশ্বরের আলো আমাকে রক্ষা করে প্রতিটা মুহূর্তে।

আমি দরজাটা ঠেলে যখন ভেতরে ঢুকলাম তখন দেখলাম ভেতরে মুরহাউজের বিশ্বস্ত ভৃত্য কয়েকজন মাথা নিচু করে কি যেন জপছে। আমি ঠিক ওদের মাঝে দাঁড়িয়ে বললাম, আপনারা এখানে কেন?

পেছন থেকে খুব পরিচিত একটা নারীকন্ঠ আমার কাধে হাত দিয়ে বললো, আপনাকে বলতে চেয়েছি অনেকদিন ধরে আমাদের সাথে থাকার জন্য। উনি আপনাকে বেশ পছন্দ করেন। মনে হয় ভালোওবাসেন।
আমি লরার দিকে তাকিয়ে অনেক কিছু বোঝার চেষ্টা করলাম। মাথায় কিছু আসছিলোনা ঠিকমত। লরা আমাকে কাছে টেনে ওষ্ঠে ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে বললো, আপনার ভেতরে যে সত্তাটা বাস করে তা বড় দুর্বল। ও ছাড়া কেউ একে শক্তিশালী করতে পারবে না। আসুন আমাদের সাথে ওর উপাসনা করুন।
আমি মিনমিন করে বললাম, লেন্ডলকে হত্যা করেছিলেন কেন?
লরা আমার কাঁধ ধরে টেনে নামিয়ে সবার পাশে বসালো। আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ও দুর্বল হয়ে গিয়েছিলো। ও আসলে ওদিয়াকে কখনো ঠিকমত ধারণ করতে পারেনি। যখন ওর কাছে ওদিয়া মূল্য চাইলো তখন সে পিছিয়ে গেলো। তাই ওকে শাস্তি দেয়া হলো। না আমরা কেউ ওকে ছুয়ে দেইনি। ও আমাদের পথপ্রদর্শক ছিলো, পথহারাদের আশ্রয়দাতা। আমরা ওকে ভালোবাসতাম। ওদিয়া নিজ হাতে ওকে হত্যা করেছে। আমাকে ব্যক্তিগতভাবে যদি জিজ্ঞাসা করেন, আমি কসম খেয়ে বলছি ওকে আমি অনেক বেশি ভালোবাসতাম। আমি গত ২১ বছর ওর সাথে ছিলাম, প্রতিটা পূর্ণিমায় আমি ওর সাথে পূজো করেছি ওদিয়ার। যতবার ও মানুষ হত্যা করেছে আমি সেই হত্যার রক্ত মুছে দিয়েছি। ওকে এমনভাবে ওদিয়া শাস্তি দেবে আমি জানতাম না। যখন ওর দু ভাগ হওয়া শরীরটা দেখলাম তখন ভয় পেয়েছিলাম। আমি ওদিয়ার ভালোবাসাটাই শুধু জানলাম। ও যে কতটা ভয়ংকরভাবে ওর অবিশ্বাসীদের শাস্তি দিতে পারে আমি জানতাম না।

আমি লাল আলোতে ঠিকমত চোখে দেখছিলাম না। কোন অপ্রাকৃত কিছু আমি নিজ চোখে দেখিনি, বিশ্বাস করিনি। এই বিংশ শতাব্দীতে এমন অবাস্তব অপ্রাকৃত কিছু আমি প্রত্যাশাও করিনা। কিন্তু হঠাৎ করে ঘরের ভেতর একটা উৎকট হাওয়া যেন প্রবেশ করলো। আমি দেখলাম কিভাবে সেই হাওয়াটা ঘূর্ণি খেতে খেতে সবাইকে ছুয়ে দিলো। ঠিক আমার কাছে এসে সেটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে চারদিক ছড়িয়ে পড়লো। তারপর মনে হলো যেন নেই।

আমার চোখ মনে হলো যেন কোটর থেকে খুলে পড়তে চাইছে। লরা থেকে শুরু করে সবাই মাথা মাটির সাথে ঠেকিয়ে ঠিক প্রণাম করার মত একটা ভঙ্গি করে একেবারে স্থায়ী হয়ে গেলো। আমি কথা বলার মত শক্তি পাচ্ছিলাম না। কেউ একজন যেন কানের কাছে এসে খুব বাজে শব্দ করে খসখসে কন্ঠে বললো, দূর দেশের জমিদারপুত্র তোমার ঈশ্বর এখানে বাস করেন না। আসো আমাকে আলিঙ্গন করো। তোমাকে আমি ভালোবাসবো।
আমি চোখ খুলে ধোয়াটে ঘরটায় দেখতে পেলাম এক অন্যরকম এনিকে। এনি আমার গালে বুকে ছুয়ে দিয়ে বললো, তুমি আমাকে ছুয়ে দাও। ভালোবাসা দাও। আজ আমি তোমার আলপনা, তোমার নতুন ভালোবাসা এনি। আজ আমি তোমার পৃথিবী হবো।তুমি যখন এই শরীরটাকে নিজের মত করে উপভোগ করে সব চাহিদা মিটিয়ে নেবে, এরপর আমি এনির শরীরটাকে একেবারে নিজের মত করে গড়ে নিবো। তোমার শুধু ওর নশ্বর দেহটা থেকে মাথাটা আলাদা করে ফেলতে হবে।পারবে জমিদার?
আমি চারপাশে তাকিয়ে লরাকে বললাম, তোমার এই অসুর তোমার মেয়েকে হত্যা করতে চায়। তুমি এটা জানতে তাই না? কেমন মা তুমি আর কেমন তোমার এ ভগবান?

এনি আমার গলা টিপে বললো, খবরদার বেজন্মা তোর ভগবানের সাথে আমাকে মিলাবিনা।আমি তোর ভগবানের মত উপরে বসে মজা নেইনা। নিজের কাছে ক্ষমতা রেখে শ কোটি মাংসের দলাকে তেলাপোকা বানিয়ে নিজের মত নাচাইনা। আমি তোদের মত কুৎসিত জানোয়ারগুলোকেও ক্ষমতা দেই। ভালোবাসি নিজের মত। এর বিনিময়ে আমি শ বছরের দাসত্ব দাবী করিনা। শুধু একটু রক্ত চাই। এই মেয়ে তোর কোথায় চুমু খেয়েছে যে এতো ভালোবাসা উথলে পড়ছে বেজন্মা শূয়োরের বাচ্চা।

লরা আমার কাছে এগিয়ে এসে বললো, অবুঝ মানব এতো সাহস করোনা। তোমাকে মহান প্রভু ওদিয়া ভালোবাসেন। খুব কাছের ভাবেন। যেদিন তুমি সমুদ্রে পাড়ি দিলে আমাদের এখানে আসতে সেদিন থেকে ও তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। আসো এনিকে গ্রহণ করো।

আমি খেয়াল করলাম একটু পর আমার শরীরটা ঘরের এক পাশে যেন ছিটকে পড়লো। এরপর মনে হলো যেন আমার শরীরটা কিভাবে যেন মাটি থেকে অনেক উপর উঠে গেলো। ছাদের সাথে লাগানো একটা পেরেক আমার গাল ফুটো করে ঢুকে জিভ ছুঁয়ে দিলে আমি চিৎকার করে উঠলাম।

এনির মুখ থেকে ওদিয়া অশ্লীলভাবে হেসে বললো, তোর ভগবান দেখ কোন দেবদেবীর বিছানায় যেয়ে মজা নিচ্ছে। তোরা এই ভগবানের পূজো করিস না? দেখ তোর ভগবানের গড়া শরীরে আমি কেমন করে ছেদিয়ে দিয়েছি।

ওদিয়া ঠিক বাংলা ভাষায় আমার সাথে কথা বলছিলো। কিন্তু এতোটা নোংরা করে এই মমতামাখা ভাষাটা কেউ বলেছে বলে আমার মনে পড়ছেনা।আমার মাঝে রাগ হয়না। আলপনা মারা যাওয়ার পর থেকে রাগ ঘৃণা সব যেন উঠে গিয়েছিলো। একটাকালে যেই জেদী অদিত রয়কে সবাই ভয় পেত সে এতোটাই মিইয়ে গিয়েছিলো যে তাকে অনেকেই চিনতে ভুল করতো। আজ হঠাৎ করে আবার সে রাগটা যেন ফিরে আসলো। আমি মাটি থেকে উঠে খপ করে এনির হাতটা ধরলাম। এই হাতটা এতোটা ঘৃণা নিয়ে ছুইতে হবে ভাবিনি। আমি চোখ খুলে আকাশের দিকে মুখ তুলে বলেন, আমার পরমেশ্বর মানুষকে বড্ড ভালোবাসেন জানো। ও এই পৃথিবীতে তোমার মত অসুরকে পাঠিয়েছেন বোঝাতে আমরা চাইলে ওর বিশ্বাসটা বুকে ধরে তোমাদের নিঃশেষ করে দিতে পারি এক পলকে। আমি অদিত রয় তোমাকে বলছি, অন্ধকারের জীব তুমি জানো আমাদের এই মাংশের দলার ভেতর সবচেয়ে মহান, সবচে শক্তিশালী কে বাস করে। স্বয়ং পরমাত্না। তাই আমরা মানুষকে ভালোবাসতে জানি, আর এর থেকে বড় শক্তি আর কি আছে। ঈশ্বরে আমি যতটা বিশ্বাস করি মানুষকে ততই ভালোবাসতে পারি। এই দেখো আমি এখন এনিকে ভালোবাসবো। ওর ভেতরে তোমার মত জানোয়ারটার স্থান নেই।

আমি শক্ত করে এনিকে চেপে ধরে রাখি। ওর কানে মুখ লাগিয়ে বলি, তোমাকে আমি মাত্র কিছুদিন ধরে চিনি।। ঠিকমত জানিনা। তুমি আমার প্রায় অর্ধেক বয়সের। কিন্তু যেদিন প্রথম দেখলাম সেদিন থেকে তোমাকে ভালোবাসি। যতটা ভালোবাসলে তোমার ভেতরের মানুষটা শয়তানটাকে ছিটকে ফেলে আসবে ঠিক ততটা। আলপনাকে ভালোবাসতাম ওর মাঝের মায়ার জন্য, হাজার মাইল দূরের এই দেশে তুমিও যে এমন একটা মায়া নিয়ে বেঁচে আছো তা কি জানো? এনি আমি তোমাকে খুব খুজছি, বের হয়ে আসো? আমার যতক্ষণ শ্বাস আছে, তোমার প্রতিটা নিঃশ্বাসের মূল্য আমি দেবো।

ওদিয়া মনে হলো ভয় পেয়ে চিৎকার করছে। আর আমি এনি, আমার মা, আমার বাবা, আলপনা সব ভালোবাসার মুখগুলোকে চোখ বন্ধ করে ভাবছি। এখন আমিই যে ঈশ্বর, আমার ভেতরের রক্ত মাংস সব ঈশ্বরের দখলে। কেউ আমায় ছুতে পারবেনা।

লরা আমার কাছে এসে বললো, তুমি লেন্ডলের মত দুর্বল। ওকে যেভাবে মেরে ফেলেছে ঠিক একইভাবে তোমাকেও মেরে ফেলবে আমাদের প্রভু।
আমি লরার হাত ধরে বলি, তোমার মেয়েটার মুখের দিকে তাকাও।দেখতে পাও ওর মাঝে সৃষ্টির সকল সৌন্দর্য, সকল সুর লুকিয়ে আছে। তোমার এত্ত বছরের মায়া ভালোবাসা ওর প্রতিটা রক্তকণায়। ওকে এমন এক শয়তানের হাতে তুলে দেবে?পারবে?

লরা আমার দিকে অদ্ভূত চোখে তাকিয়ে বললো। তারপর চারদিকে তাকিয়ে বললো, তোমার ভগবান কি আমাকে ভালোবাসার শক্তি দেখাতে পারবে? ওদিয়ার মত কাউকে দিনের পর দিন উপাসনা করে অন্ধকার জগত থেকে ডেকে এনে যে অন্যায় আমরা করেছি তার প্রায়শ্চিত করতে দেবে?
আমি কিছু বলার আগেই খেয়াল করলাম লরা আর তার সাথের সবার চোখ কেমন উলটে যাচ্ছে। শয়তান ওদিয়ার অস্তিত্ব চিৎকার করে বলছে, আমার সাথে বেইমানী।আমি তোদের বাঁচতে দেবো না! সবগুলোকে আমি চিড়ে ফেলবো। তোদের রক্ত পান করবো আমি।

খেয়াল করলাম এনির শরীরটা কেমন নেতিয়ে পড়ছে।আমি এনিকে জড়িয়ে ধরে সোজা হয়ে দাড়ালাম। চোখ বন্ধ করে সেই চেতনা হবার পর থেকে যতবার স্রষ্টার অস্ত্বিত্তকে বুকে ধারণ করেছি তার সবগুলোকে স্মরণ করে চিৎকার অরে বললাম, করুণাময় ঈশ্বর তুমি তোমার সৃষ্টিকে, তাতে মায়ায় বাধা ভালোবাসাকে রক্ষা করে।
ওদিয়া চারপাশ থেকে চিৎকার করে বললো, তুই কে বেশ্যার ছেলে আমাকে দূর করতে চাস পৃথিবী থেকে? আমি সবার আগে তোর মাথা কেটে ফেলবো।তোকে ছিন্নভিন্ন করবো। দেখ আমাকে দেখ, আমি নশ্বর। আমি তোর ঈশ্বরের মুখে থুথু পারি। আমাকে কেউ, তোর ঈশ্বরের মত এমন আরো হাজার ঈশ্বর কিচ্ছু করতে পারবেনা।

আমি শান্ত চোখে আশেপাশে তাকিয়ে ওকে দেখার চেষ্টা করি। আমার চোখ তখন ক্রোধে লাল হয়ে আছে। আমি আমার বুকে হাত দিয়ে বলি, ঈশ্বর কেন, তার এই মাটির মানুষটা তোমাকে আজ ধ্বংস করবে। আমার শক্তিটা দেখবে, যেই শরীরের রন্ধ্রে ঈশ্বর বাস করে তার শক্তি দেখবে ওদিয়া?

একটু থেমে আমি আমার গলায় সব শক্তি জড়ো করে চিৎকার করে বললাম, যাওওওওওও!! মর্ত্য থেকে নভঃ, এই সুন্দর পৃথিবীর জল মাটি কোন কিছুতে তোমার অধিকার নেই। তুমি পরাসৃষ্টি, নোংরা। তুমি দুর্বল, অকল্যাণ। আমি ঈশ্বরের হাতে গড়া অদিত রয় তোমাকে নির্বাসন দিলাম এই সুন্দর পৃথিবী থেকে আজীবনের মত। যাও, চলে যাও।

কিছুক্ষণ, তারপর ঘরের ভেতরের সব ঝড় যেন থেমে গেলো। এনির মুখটা মনে হলো কেমন যেন রক্তশূণ্য। ঘরের ভেতর বাকি সবাই জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে আছে। আমি এনিকে নিয়ে বের হয়ে এলাম। চারদিক ভয়ংকর অন্ধকার হয়ে আছে। সিমনের কথা মনে পড়লো, ও বলেছিলো কাউকে যেন বিশ্বাস না করি। আমি এনিকে কোলে নিয়ে পাগলের মত ছুটে গেলাম ঘোড়ার আস্তাবলে। সেখান থেকে একটা ঘোড়ার দড়ি তাতে এনিকে নিয়ে উঠে বসলাম। এই অশুভ বাড়ি থেকে ওকে আমার নিয়ে যেতে হবে। এখানে ঈশ্বর বাস করতে অস্বস্তি বোধ করেন, কারণ এখানে শুধু শয়তানের পূজা হয়। ঈশ্বরের জন্য কারো মনে ভালোবাসা নেই।

যতদ্রুত সম্ভব ঘোড়া ছুটিয়ে আমি বন, রাস্তার পাশের অন্ধকার বন সব মাড়িয়ে চললাম। এনি হঠাৎ মনে হলো যেন একটু নড়ে উঠলো। আমি ঘোড়া থামালাম না। ওর্পসীডে পার হওয়ার পথে একটা পানশালা পড়ে। এই রাতে সেটা বন্ধ থাকবে তা আমি জানি। তবুও সেখানে যেয়ে আমি কিছুটা আশ্রয় খোজার চেষ্টা করলাম। বন্ধ দরজার পাশে ঘোড়া থামিয়ে যখন নামতে চাচ্ছিলাম তখন এনি আমার হাত ধরলো। আমাকে বললো, অনেক ভালোবাসেন আমাকে?
আমি ওকে বললাম, হয়তো।এসব কথা পরে হবে। আগে কোথাও যেয়ে বিশ্রাম নিতে হবে।আমার এখানে একমুহূর্ত ভালো লাগছেনা।
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও খুব ক্লান্ত। আমি ওর হাত ধরে বললাম, মাটির মায়া যে দেশের বুকে বাস করে সে দেশে যাবে?
এনি আমার দিকে তাকিয়ে খুব দুর্বল একটা হাসি দিয়ে বললো, আমার হাত ভরা রক্ত। আপনি জানেন না আমি কে! আমার মাঝে ও বাস করে, ওকে আমার থেকে আলাদা করা যায়না। মাঝে মাঝে আমি তাই ঠিক আপনার মত মানুষ থাকি। তখন খুব মানুষের ভালোবাসা খুজি। কিন্তু ও যখন আমার মাঝে থাকে তখন আমি মানুষের রক্তের ঘ্রাণে আনন্দ পাই। বিভৎস আনন্দ।আমি চাইতামনা শয়তানের পূজো করতে। বাবা মা আমাকে জোর করে নিয়ে যেতো। যখন চোখের সামনে অসহায় মানুষের বলি দিতে দেখতাম আমি ভয় পেতাম। তারপর একদিন ও শয়তানদের রাজা ওদিয়া আমাদের কাছে এসে। আমার শরীরের ভেতর ঢুকে আমাকে চীড়ে ফেলে। ও এখন আমার মাঝেই বাস করে অদিত। আপনি আমাকে ফেলে পালিয়ে যান।

এনিকে জড়িয়ে ধরি আমি। ওর মাথায় হাত দিয়ে বলি, ও আমার মাঝেও বাস করে। সব মানুষের মাঝে এমন একটা অশরীরি বাস করে। সেটাকে জয় করতে ঈশ্বরকে ভালোবাসতে হয়। আমি তোমাকে তা শেখাবো।

এনি আমার হাত ধরে বললো, বাবাকে যখন নিজ হাতে এমন জঘণ্যভাবে মেরে ফেলি তখন আমার একটুও খারাপ লাগেনি জানেন। আমার মাঝের শয়তানটা আমাকে বাবার রক্ত পান করতে বাধ্য করেছিলো। আমি আমার ভেতরের মানুষটাকে নিয়ে তখন খুব যুদ্ধ করেছিলাম, আমার হাতের আঙ্গুল তখন আমি নিজেই ওর কথায় কেটে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমি যে আর মানুষ নই। আপনি জানেন সত্যিই আপনার ঈশ্বর আমাকে গ্রহণ করবে?

আমি ওকে কিছু বলিনা। মাথা নাড়ি। ওর দিকে তাকিয়ে বুঝাই, আমার ভালোবাসাটা সকল অপশক্তি থেকে অনেক শক্তিশালী।

*********************************************
লেখকের কথাঃ
আমি অনেক চেষ্টা করেও এরপর ওদের কি হয়েছিলো জানতে পারিনি। কৌতুহলবশত গাংগাটিয়া জমিদার বাড়িতে গিয়ে কবির খোজ নিয়েছিলাম। মুগ্ধ হয়ে তার প্রথম বউ আলপনার একটা ম্যুরাল দেখেছিলাম, এতো সুন্দর একটা মেয়ে এতো অল্প বয়সে মারা গেলো বলে খুব আফসোস হচ্ছিলো। ওই বাড়িটা এখন আর জমিদার বাড়ি নেই। তার এক উত্তরসূরী বাদল সরকার থেকে জানতে পারলাম অদিত কখনো দেশে ফিরে আসেনি। সে কোথায় কিভাবে বেঁচে না মরে ছিলো কেউ জানেনা।

কিশোরগঞ্জ থেকে ফিরে আসার সময় একটা অদ্ভূত ব্যাপার ঘটলো। আমি যখন নদী পার হবার জন্য ডিঙ্গী নৌকায় উঠলাম তখন অল্পবয়সী এক তরুণী আমার পাশে বসে বললো, অদিতের খুব বিপদ। ওকে বাঁচাতে পারবে?
চমকে উঠে পাশে তাকিয়ে দেখি একটা বড় করে ঘোমটা টানা মেয়ে আমার দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে। আমি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললাম, আপনি কে?
মেয়েটা মনে হলো যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। চাঁদের আলোয় আমি স্পষ্ট দেখলাম একটা লিকলিকে শুকনো হাত আমার হাতের উপর। কি শুভ্র সেই হাত। আমার কানের কাছে সেই ছায়াটা যেন ফিসফিস করে বললো, ওর আত্নাটা আটকে আছে। ওকে মুক্ত করে আনবে?
আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। এরপর বন্ধু আফসার আর মাঝির সহায়তায় আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলে ওদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম মেয়েটাকে দেখেছে কিনা। আফসার ভয়ে ভয়ে মাথা নেড়ে বললো, কই কেউ তো ছিলোনা তোর পাশে।
মাঝি আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললো, যারে দেখছো তারে আর মনে কইরোনা। ও যা চায় তা কেউ দিবার পারবোনা। এরা একটু শান্তি চায়। ভুলে মাঝে মাঝে মাইনষের কাছে আইসা চায়া ফেলে। আমাগোর তো ওরে কিছু দেয়ার খেমতা নাই ভাই।

আমি এরপর আর কখনো কারো সাথে এই গল্পটা লিখার আগে এই নিয়ে আলাপ করিনি। কিন্তু এখন খুব বিপদে পড়ে লিখতে হচ্ছে। নাহলে আমার যে মুক্তি নেই। প্রিয় পাঠক যা লিখেছি তা শুধু গল্প মনে করে ভুলে যাবেন। মনে লাগাবেন না, একটুও ভাববেন না। যে যুদ্ধ আমি গত সাড়ে নয় মাস ধরে করছি তা আর কেউ না করুক।আমি মুক্তি চাই প্রতিরাতের বিভৎস স্বপ্নগুলো থেকে। আমার জন্য প্রার্থনা করুন।

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১:১৭

গুলজার আহমদ বলেছেন: আপনার ব্লগ আমি নিয়মিত ভিজিট করি। আপনি যদিও বছরে দুটি বা একটির বেশী গল্প লিখেন না তারপরও আশায় থাকি হয়তো আরো লেখা পাব।
আপনার নিকট আমার একটি অনুরোধ এবং একটি প্রশ্ন ছিল।
অনুরোধ- আপনার ফেসবুক আইডির লিঙ্ক দিবেন প্লিজ যাতে আপনার লেখা রেগুলার পড়তে পারি।
প্রশ্ন- আপনি নিয়মিত লিখেন না কেন?

ভালোবাসা নিবেন।

১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:৩০

অহরিত বলেছেন: প্রিয় গুলজার আহমদ, সময় করে ওঠা হয়না কিছু গুছিয়ে লিখার জন্য। আমি লিখি যখন আমার ভেতরে কিছু আঘাত করে, মাথায় নয়। তাই একটু সময় লেগে যায়। আর তাছাড়া আমি যাই লিখি সব কিছুই এই ব্লগে প্রকাশ করি। এর বাহিরে আর কিছুই লেখা হয়না।

২| ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ ভোর ৪:৩২

প্রবাসী পাঠক বলেছেন: গতকাল রাতেই দেখেছিলাম আপনার নতুন লেখা এসেছে, সময় নিয়ে পড়ব বলে আর গত রাতে পড়া হয় নি। আজকে পড়লাম, এবং বরাবরের মতোই মুগ্ধ।

ঈশ্বর বলে যদি কোন কিছু থেকে থাকেন তাহলে তা আমাদের মধ্যেই বিরাজমান। আমরাই পারি ঈশ্বরের অস্তিত্ব কে ঐশ্বরিক বানাতে অথবা নিজেদের কুৎসিত পরশে নির্মম শয়তান!

১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:৩০

অহরিত বলেছেন: প্রিয় পাঠক, অনেক ধন্যবাদ।

৩| ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:৪৯

বিজন রয় বলেছেন: নতুন পোস্ট দিয়েছেন!! ধন্যবাদ।

আপনারা পুরানো ব্লগাররা নিয়মিত হলে আমাদেরই লাভ।

নিয়মিত লিখুন।
শুভকামনা।

১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:৩১

অহরিত বলেছেন: প্রিয় বিজন রয়, ধন্যবাদ।

৪| ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:৪১

মহামহোপাধ্যায় বলেছেন: বহুদিন পর ব্লগে এসে এভাবে আপনার গল্পটা পেয়ে যাব ভাবি নি। বেশ ভালো লেগেছে। আরও ভালো লেগেছে এটা দেখে যে আপনার গল্পের বিষয় নির্বাচনের বৈচিত্রতা ক্রমেই উর্ধ্বমূখী। গল্প নিয়ে তো নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে শুরুতে মনযোগ ছুটে যাচ্ছিল বারবার!! সেটা বোধকরি আমার বহুদিনের পাঠ অনাভ্যাসের ফল।

ভাল থাকুন প্রিয় ব্লগার, শুভকামনা রইল :)

১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:৩২

অহরিত বলেছেন: প্রিয় ব্লগার, হাহা। বিভিন্ন বিষয়ে আমি আজকাল ফাজলামী করি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.