![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রইছ উদ্দিন তার পুরানো ছালাটা মনোযোগ দিয়ে দেখে। ছালার মাঝখানে ফেড়ে গেছে।সেলাই করা দরকার। বোন হাসনাহেনা নয় মাসের পোয়াতি, তার মধ্যে ডাক্তার বলে কি কি যেন সমস্যা হয়েছে তার। বোনকে সে ছালা সেলাই করার কথা বলতে সাহস পায়না। এই ছেড়া ছালা সে আগে যেই গ্যারেজে রিকশা চালাতো সেখানের মহাজন থেকে চুরি করে এনেছে। মহাজনের বাসার কাজের মেয়ের সাথে তার পীরিতি ছিলো। কাজের মেয়ের অবশ্য গ্রামে একটা স্বামী ছিলো। কিন্তু তবুও তাদের ভাব হয়েছিলো। বিশাল ভাব। প্রায়ই রইছ উদ্দিনকে শেফালী লাড্ডু খাওয়াতো। রইছ উদ্দিন লাড্ডু খেয়ে বেজার ভাব ধরে বসে থাকতো। মেয়েমানুষকে বেশি ভাব ভালোবাসা দেখানো ঠিক না। একটু ভাব ধরে রাগী মুখ নিয়ে বসে থাকতে হয়। এই জিনিসটা সে তার বাবার কাছ থেকে শিখেছে। তার মা যখন পাশের বাড়ির চাচার সাথে ভেগে যায় তখন সবাই বাবাকে খুব গালি দিছিলো। বাবা তার মাকে খুব আদর সোহাগ করতো। সারাদিন কামলা খেটে রাতের বেলা তার মাকে ডেকে একটা মিষ্টি পান ধরায় দিয়ে বলতো, "বুঝলা রইছের মা এই দিনের শেষ বেলা তোমার লগি একটা পান চিবাইন্ন্যা মজা আর কিচ্ছুৎ পাওয়া যাইবোনা"।
৩৩ বছরের রইছ উদ্দিনের মাথায় ধরেনা তার মা কি দুঃখে পালিয়ে গিয়েছিলো।
আজকে ছেড়া ছালা দেখতে দেখতে রইছের শেফালীর উপর রাগ ধরে আসে। শেফালীর জামাই যখন শেফালীকে নিতে আসে তখন রইছ মহাজনের বাড়ির নীল রঙের গেটের বাহিরে দাড়িয়ে নখ খুটতেছিলো। শেফালী তার কাছে এসে বলে, যাইতেছিগা। উপায় নাই। আমারে ভুইলা যায়ো।
রইছ মাথা নাড়ে, ভাব ধরে যেন এইটা কোন ব্যাপার না। আট বছর ধরে সে ভাব ধরেই বসে আছে। লাভ হচ্ছেনা। শেফালীর গায়ের থেকে কাজ করে আসার পর ঘামের গন্ধটা এখনও প্রায়ই নাকে বাড়ি খেয়ে যায়। রইছ পাত্তা দেয়না। তার জীবন এমনিতেই অনেক আপদে ভরা। তার বোন হাসনাহেনার বিয়ে দিয়েছিলো সে ১০০০০ টাকা খরচ করে মানুষ খাওয়ায়। বিয়ের পর স্বামী ট্রাকের চাপায় পড়ে ছেড়াবেড়া খেয়ে মরে গেছে। হারামাজাদা মরছে ভালো কথা, বোনরে পোয়াতি বানায় দিয়ে গেছে। বোন এখন তার সাথে থাকে।
১৯ বছরের মেয়ে হাসনাহেনা। বয়সের তুলনায় অনেক বড় হয়ে গেছে। রইছ প্রতিদিন বাসায় যেয়ে বোনকে একটা থাবড় দিয়ে দিন শুরু করে। ছোটকাল থেকে এভাবেই থাবড় দিয়ে চলছে। বিয়ে হইলে মেয়েরা নাকি বড় হয়ে যায়। রইছের তা মনে হয়না। রইছের মা পালিয়ে যাওয়ার সময় রইছের বোনকে নিয়ে যাচ্ছিলো। তখন রইছ কান্না করে মাকে বলেছিলো, "মা আমারে নিবানা"।
রইছের মা তার দিকে তাকায় নাই। বলে, "তুই কুড়াইন্না পুলা। ভাগ"
রইছের মা হাসনাহেনাকে একটা পুকুরে রেখে পালিয়ে যায়। কেন তাকে পুকুর পাড়ে রেখে গিয়েছিলো সে জানেনা। তার বাবা দুই বছর পর বুকের ব্যাদনায় মারা যায়। রইছ এরপর থেকে তার বোনকে পালে। কিন্তু তার বোনের উপর তার অনেক রাগ। রাগটা সেদিন থেকে যেদিন রইছের মা রইছকে ফেলে তার বোনকে নিয়ে ভেগে যেতে চায়। তার বাবাকে এরপর সে জিজ্ঞাসা করেছে অনেকবার সে কুড়াইন্যা পোলা কিনা। তার বাবা কিছু বলেনি।
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। রইছের আজকে শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছে। বেশিক্ষণ ধান্দা করা যাবেনা। রইছ নীলক্ষেতের মসজিদের পাশের গলিতে টিয়া পাখি নিয়ে ব্যবসা করে ভাগ্য গণনার। এই ব্যবসা সে বছরখানেক হলো শুরু করেছে। আয় খারাপ না। কষ্ট কম। মাঝে মাঝে একবেলা রিকশা চালাতে হয়। ঢাকা শহরে খরচ বাড়তি। পিয়াজের কেজি ৬৫ টাকা। তাও যেগুলো একটু ভিতরে পচা সেগুলো। তোতা পাখির জন্য খাবার কিনতে হয় মাসে ২২০ টাকার। তোতার বয়সও বেশ হয়েছে। বছর খানেক হয়তো আর বাচবে। কিভাবে সে তোতা কিনেছে সেই গল্প বাদ থাক। লম্বা কাহিনী। আসল কাহিনী হলো যখন বিকালের আগ দিয়ে পুলিশ তার দোকান উঠাতে যেয়ে তোতার মাথায় লাঠি দিয়ে বাড়ি দিলো। তোতা তার কাছে দৌড়িয়ে এসে কাধে বসলো। এরপর উপরের দিকে একবার তাকিয়ে হেলে দুলে পড়ে গিয়ে পা উচু অবস্থায় মরে গেলো। রইছ ঘটনার আকস্মিকতায় ঠান্ডা মেরে গেলো। সে পুলিশের দিকে তাকায় বললো, পাখিটারে মাইরা ফালাইলেন।
কনস্টেবল আফজার আলী রইছকে কয়েকটা খ অক্ষর চ অক্ষর গালি দিয়ে তার পিঠে আর পাছায় লাঠি দিয়ে বাড়ি দিয়ে বললো, "মন্ত্রী আসতেছে। যাবি নাকি খা-কীর পোলা?"
খা-কীর পোলা রইছ মরা পাখি নিয়ে বাসায় আসে। যেয়ে দেখে বোন মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পাশের বস্তির আকমলের মা রইছকে দেখে ছুটে এসে বললো, এক্ষুন আজিমপুর হাসপাতাল লয়া যা। মাইয়ার বাচ্চা হইবো। টেহা আছে?
রইছের কাছে তেমন টাকা নাই। ১০০ টাকার একটা নোট আছে। আজকে বাজার করার কথা ছিলো। আর ঘরের ভিতরে একটা হাড়িতে ৩২২ টাকা আছে। সে মরা পাখিটাকে ঘরের মধ্যে রেখে বোনকে কোলে নিয়ে একটা রিকশায় উঠিয়ে আজিমপুর যায়। হাসপাতাল যেতে তার ভয় লাগে। এমন এক হাসপাতালে তার বাবাকে নিয়ে গিয়েছিলো প্রতিবেশী লোকজন। সেই সময় ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের দালালগোছের এক লোক তার কাছে ১০০ টাকা চায় ভর্তির জন্য। রইছ তাকে ৬ টাকা দিতে পেরেছিলো। এর বদলে সে একটা থাপ্পড় খেয়েছিলো। ওই দালালের হাতে পায়ে ধরে রফিক চাচা বাবাকে মেঝেতে জায়গা করে দেয়। রাতের বেলা বাবা বুকের ব্যথা আর ঠান্ডায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলো। রইছ তার জামা খুলে বাবাকে ঢেকে রাখে। তার বোন তখন অনবরত শুধু কাদতো। রইছ কাদতো না। পোলামানুষের কাঁদতে হয়না। বাবা শিখাইছে। গরীব রইছ সেদিন একটা চাদরের জন্য রাস্তায় দাড়ায় প্রথম জীবনে ভিক্ষা করেছিলো। একটা চাদর পেয়েছিলো। সেটা দিয়েই বাবার লাশ পরেরদিন সকালে ঢেকে রাখতে হয়। তাও শুকরিয়া,খোলা লাশ কবর দেয়া ঠিক না।
আজকে আজিমপুর হাসপাতালে যেয়ে রইছ একটা লাইনে দাঁড়ায়। কাউন্টারের সামনে যেয়ে বলে "বোন পোয়াতি। কানতাছে, বাচ্চা হইবো"
কাউন্টারের লোক তখন নাকের লোম কাটছিলো একটা লাল কাচি দিয়ে। রইছকে বললো, পাশের লোকের সাথে কথা কও। পাশে একজন সাদা শার্ট গায়ে দেয়া ভদ্র লোক দাঁড়িয়ে ছিলো। পাশে হাসপাতালের এক কর্মচারী। মনে হয় পুরুষ নার্স। রইছকে দেখে বললো, "১৫০০ টাকা লাগবো। এক্ষুনি ভর্তি করায় দিতেছি"।
রইছ ভয়ে ভয়ে ২০ টাকা হাতে রেখে ৪০২ টাকা ভদ্রলোকের হাতে দিয়ে বলে, ভাই খুব গরীব মানুষ। বস্তিত থাকি। এই টাহাটা রাখেন। কাইলকা রিকশা চালায় বাকি টাকাটা দিয়া দিমু। বোইনে কানতেছে। অনেক কষ্ট পাইতেছে।
রইছের চোখে পানি, মুখে আর্তনাদ। পিছন থেকে বোনটা চিৎকার করে বলতেছে, "ভাইয়া গো, ও ভাইয়া। আমারে বাচাও"।
রইছ পায়ে ধরে, কিন্তু টাকা ছাড়া তারা ভর্তি নেয়না। তার পাশ দিয়ে অনেক লোক হেটে যায়। কেউ কেউ একটু দাড়ায়, দেখে। তারপর চলে যায়। শহর বেড়েছে, মানুষ বেড়েছে, মনুষত্ব্য কমে গেছে - এই যা।
রইছের বোনকে হাসপাতাল থেকে চিৎকার করার অভিযোগে ধাক্কা দিয়ে বাহিরে বের করা হয়। রইছ ভিতরে অনেক ধান্দাবাজি করে, এরে ওরে বোঝায় যে সে টাকাটা দিয়ে দেবে। কেউ তার কথা শুনেনা।
সন্ধ্যা হবে হবে তখন রইছের বোন রাস্তায় বাচ্চা প্রসব করে। কয়েকজন মহিলা শাড়ি দিয়ে ঢেকে নতুন একটা শিশুকে পৃথিবীর মুখ দেখায়। রইছ বাচ্চাকে কোলে নেয়। বাচ্চা পিট পিট করে তাকায় তার দিকে। রইছ জীবনে বহু বছর পর আবার কাঁদে। কি সুন্দর বাচ্চাটা, একেবারে তার বোনটার মত ফর্সা হয়েছে। টুকটুকে, ওজনও মাশাল্লাহ খারাপ না। বাচ্চাটা মারা যাওয়ার ঠিক তিন সেকেন্ড আগে তার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে কেমন একটা বেদনার মত চোখ করে চুপ হয়ে যায়। একেবারে রইছের বাবার মত। রাত ৩ঃ৪৫ এর দিকে রইছের বাবা রইছের হাত ধরে মারা যাওয়ার আগে ঠিক যেভাবে তাকিয়ে ছিলো, ঠিক সেভাবেই। রইছ তাকিয়ে থাকে বাচ্চার দিকে। একটু পরে হাসপাতাল থেকে লোক এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, "আমরা হাসপাতালের কর্মচারীরা এই বাচ্চার দাফনের সব খরচ নিবো। তোমারে আরো ২৫০০ টাকা দিতাছি। তুমি এইখানে আর থাইকোনা। মানুষের ভিড় হইলে সমস্যা আছে। রোগী আছে আরো, বুঝোনা। কষ্ট পাইবো হেরায় ভিড় হইলে।যাও বাসাত যাও।তোমার বইন ভালো আছে সমস্যা নাই। তারে পরের সপ্তাহে নিয়ে আইসো"।
রইছ কিছু বলেনা। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় থাকে। সে তার ছেড়া ছালাটা নিয়ে রাস্তায় বসে থাকে কোলে বাচ্চা। লুঙ্গির ভেতর থেকে সে একটা জামা বের করে, লাল রঙের উল বোনা জামা। ১৩৫ টাকা দিয়ে সে নিউমার্কেটের ভেতর থেকে কিনেছে। সেখানে ইংরেজীতে লেখা, Love u ma.
একটু পর নানান লোকজন টিভি সংবাদপত্র থেকে আসে। কি কি যেন বলে। রইছ তাদের শুদ্ধ ভাষার কথা বুঝেনা।অনেকে আফসোস করে। সে চুপ করে বসে থাকে। পাশে তার বোন শুয়ে আছে। তাকে জিজ্ঞাসা করে, "ভাইয়া বাচ্চাটারে একটু দেহি?"
রইছ বাচ্চাটারে নিচু করে দেখায়। বাচ্চার মা দরিদ্র অভাবী।এদের চোখে জল কম। কিন্তু ব্যথা বেশি। সে ব্যথাতুর চোখে তাকিয়ে বলে, "আমার বাচ্চার মুখে মাছি ক্যান ভাই, মাছি ক্যান?"
১৫ ই নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:০২
অহরিত বলেছেন: ধন্যবাদ রাতু০১।
২| ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১:৩৮
নির্বাক শাওন বলেছেন: শেষ বাক্যে চেতনা ফিরে পেলাম.......
১৫ ই নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:০৩
অহরিত বলেছেন:
৩| ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৯ বিকাল ৪:৪১
মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন:
ভাই গল্প পড়ে চোখে জল চলে এসেছে। জোড় করে আটকিয়ে রেখেছি।
গরীবের জীবনটা এমনি করেই কেটে যায় ব্যাথা-বেদনায়।
+++++++
©somewhere in net ltd.
১|
১২ ই নভেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৪:০১
রাতু০১ বলেছেন: আর একটু গোছানো হলে ভাল হতো। শুভকামনা।