নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

www.oputanvir.com

অপু তানভীর

আমার চোখে ঠোঁটে মুখে তুমি লেগে আছো

অপু তানভীর › বিস্তারিত পোস্টঃ

টিউলিপ ম্যানিয়াঃ বিশ্বের প্রথম স্পেকুলেটিভ বাবল

১০ ই মে, ২০২৫ রাত ১১:০৭



স্পেকুলেটিভ বাবল হলো এমন একটা অর্থনৈতিক অবস্থা, যেখানে কোনো সম্পদের দাম অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যায়। এই দাম বৃদ্ধি সাধারণত বিনিয়োগকারীদের অতিরিক্ত উৎসাহ, লাভের প্রত্যাশা এবং স্পেকুলেশন (অনুমানভিত্তিক ক্রয়-বিক্রয়) কারণে হয়ে থাকে। এবং দাম বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে পিক অবস্থায় পৌছায়। তারপরই বাবল ব্লাস্ট করে এবং সেই দাম বিদ্যুতের বেগে কমতে থাকে। আজকে তেমনই এক দাম বৃদ্ধি এবং তার পতনের গল্প।

ইউরোপের অর্থনীতির ইতিহাস যদি আপনি দেখেন, তাহলে দেখবেন যে ইংল্যান্ড কিংবা ফ্রান্সের আগে আরেকটা দেশ ছিল, যেটা পুরো ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ ছিল। দেশটা হচ্ছে ডাচ বা নেদারল্যান্ডস। ডাচদের উত্থান শুরু হয় ১৫৮৮ সাল থেকে এবং সেটা মোটামুটি ১৬৭২ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই সময়টি "ডাচ গোল্ডেন এজ" নামে পরিচিত। এই সময়ে নেদারল্যান্ডস সমুদ্রবাণিজ্য, শিল্প এবং শিল্পকলায় অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি লাভ করে। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (VOC) ছিল বিশ্বের প্রথম মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগে এটার জন্ম হয়েছিল। লন্ডনের গুরুত্ব বাড়ার আগেই আমস্টারডাম ছিল তখন বিশ্বের ফাইনান্সিয়াল ক্যাপিটাল। এই সময়ে ডাচরা অত্যন্ত সম্পদশালী হয়ে ওঠে। সবার হাতেই টাকাপয়সা চলে আসে। আর মানুষের হাতে যখন টাকা আসে, তখন মানুষ বিলাসদ্রব্যের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। সেই সময়ে এমনই এক বিলাসদ্রব্য ছিল টিউলিপ ফুল।

ভৌগোলিকভাবে টিউলিপের জন্ম ইউরোপে নয়। এই ফুলটা ইউরোপে এসেছিল অটোমান সাম্রাজ্য থেকে। সেই সময় ইউরোপে যেমন ফুল ফুটত, সেই সব ফুলের তুলনায় টিউলিপ ছিল একেবারে অন্য রকম। সেই সময়ে টিউলিপের মতো এত রঙিন ফুল ইউরোপে ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের আগ্রহ বাড়ে এই ফুলের ওপর। সবাই চাইত যেন এই ফুল তাদের বাড়ির বাগানে ফোটে। কিন্তু পরে ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে এই ফুল হয়ে ওঠে আভিজাত্যের প্রতীক। এই ফুল যদি কারো বাগানে না থাকে, তাহলে তার মান-সম্মান থাকত না।

টিউলিপের বিশাল এক মার্কেট সৃষ্টি হল। সবাই এখন টিউলিপ কিনতে চায়। যেভাবেই হোক, টিউলিপ তাদের চাই-ই চাই। তবে এক সময় এই ফুলটা আর শুধুমাত্র স্ট্যাটাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না। শুধুমাত্র অভিজাত ব্যক্তিদের মধ্যেও এটা সীমাবদ্ধ রইল না। এটা হয়ে উঠল বিনিয়োগের বস্তু। সাধারণ মানুষজন (যেমন, কারিগর বা ছোট ব্যবসায়ী) এই টিউলিপ মার্কেটে প্রবেশ করল।

এমনটা হওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। যখন কোনো বস্তু মানুষ তীব্রভাবে চায়, যার বাজারে প্রচুর চাহিদা থাকে, তখন সেই জিনিসটা হয়ে ওঠে ইনভেস্টমেন্ট প্রোডাক্ট। সবাই তখন সেই জিনিসটা বেশি পরিমাণে কিনে অন্যের কাছে বিক্রি করতে চায়। এখানেও ঠিক একই ঘটনা হল। ১৬৩০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এই টিউলিপ বাল্বের ব্যবসা হয়ে উঠল সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। সবাই সব ধরনের কাজ বাদ দিয়ে কেবল টিউলিপ চাষ করতে লাগল, নয়তো টিউলিপের বাগানে কাজ করতে লাগল। মানুষ ফসলের বদলে চাষ করল টিউলিপ। মানুষ নিজের চাকরি বাদ দিয়ে বাগানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে শুরু করল। কারণ সেখানে বেতনের বদলে পাওয়া যেত টিউলিপ। একটা টিউলিপের দাম ছিল অনেক। সেই সময়ে একটা টিউলিপ বাল্ব দিয়ে একটা বিশাল বিলাসবহুল বাড়ি পর্যন্ত কেনা যেত। একটা টিউলিপ বাল্বের দাম একজন সম্ভ্রান্ত চাকরিজীবীর বার্ষিক বেতনের কয়েক গুণ ছিল। সেই সময়ে সেম্পার অগাস্টাস বাল্বের দাম ৬ হাজার ফ্লোরিন পর্যন্ত উঠেছিল, যা একজন দক্ষ শ্রমিকের ১০/১২ বছরের বেতনের সমান। একবার ভাবুন।

এর আগে সেম্পার অগাস্টাস টিউলিপ বাল্ব নিয়ে একটু বলি। এটা ছিল সেই সময়ে টিউলিপ বাল্বের একটা ধরন। এই ধরনের ফুলের পাপড়িতে ডোরাকাটা নকশা দেখা যেত। এটা দেখতে খুবই চমৎকার ছিল, তবে এটা খুবই বিরল ছিল তখন। মূলত টিউলিপ ফুলে টিউলিপ ব্রেকিং ভাইরাসের আক্রমণে ফুলের রং পরিবর্তন হয়ে যেত। তবে এই কথা সেই সময়ে কেউ জানত না। এই বিরলতার কারণেই এর দাম খুব বেশি ছিল।

এই সময়ে ফিউচার কন্ট্রাক্টের ব্যবহার হতে শুরু হয়। টিউলিপের ফুল চাষ শুরু হত শরৎকালে আর সেই ফুল তোলা হত গ্রীষ্মে। এই কারণে বছরের একটা লম্বা সময় ফুল হত না। কিন্তু ফুল হবে না বলে তো ব্যবসা বন্ধ থাকতে পারে না। তখন ব্যবসায়ীরা এই ফিউচার কন্ট্রাক্ট ব্যবহার করে। এতে করে ফুল হওয়ার আগেই তারা সেই ফুল বিক্রি করে দিতে পারতেন। নিয়মটা খুব সোজা। ধরুন, আমি আমার বাগানে ১০০টা টিউলিপের ফুল সবে মাত্র লাগিয়েছি। এখন আপনি আমার কাছে এসে জানালেন আমার এই বাগান থেকে ১০টা ফুল কিনতে চান এখনই এবং এখনই সেই দাম দিয়ে দিলেন। এর বিপরীতে আমি আপনাকে একটা কাগজে লিখে দিলাম যে যখন এই ফুল বড় হবে তখন এখান থেকে ১০টা ফুলের মালিক হবেন আপনি। এইভাবে ফুল ফোটার আগেই ফুল বিক্রি হয়ে যেত। এবং এই ফিউচার কন্ট্রাক্টের কাগজগুলো চাইলে আপনি আবার অন্যের কাছে বিক্রিও করতে পারতেন। এভাবে এই কন্ট্রাক্টের কাগজ হাত বদল হতে থাকলে এবং এই প্রক্রিয়াতেই তৈরি হল উইক ট্রেড। এক সময়ে এই কাগজগুলো নিয়ে নিলাম শুরু হল। যে যত দাম হাঁকিয়ে কিনতে পারে, কিনত। তড়িৎ গতিতে এই টিউলিপ বাল্বের দাম বাড়তে থাকল, আগেই বলেছি। তবে এখন ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে পৌঁছালো মানুষ নিজের বাড়িঘর বিক্রি করে, ধারদেনা করেও হলেও এই ফিউচার কন্ট্রাক্টগুলো কিনতে শুরু করল এবং বেশি দামে বিক্রির আশায় নিজের কাছে সেগুলো মজুত রাখতে শুরু করল। কারণ একটু অপেক্ষা করলেই দাম বাড়ছিল। যখন মানুষ দেখে কোনো জিনিসের দাম বাড়ছে তখন সেটা তারা তখনই বিক্রি না করে দিয়ে কিছু সময় ধরে রাখতে চায়। এইভাবে কয়েক বছর চলে। ১৬৩৬/৩৭ সালে টিউলিপের দাম বাজারে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় বা বলা যায় একেবারে শীর্ষে পৌঁছে যায়। কোনো জিনিসের এই রকম অস্বাভাবিক দাম বেড়ে যাওয়াটাকে মার্কেট বাবল বলে। পানিতে আমরা যখন কোনো বুদবুদ দেখতে পাই তখন সেটার সঙ্গে কী ঘটে? বাবলটা ফুলতে ফুলতে এক সময়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় এবং তারপর ফেটে যায়। মার্কেটেও ঠিক একই ঘটনা ঘটে। কোনো জিনিসের দাম বাড়তে বাড়তে এমন এক পর্যায়ে যায় যে তারপর সেটা ব্লাস্ট হয়। এবং সেটা একেবারে মূল্যহীন হয়ে পড়ে। টিউলিপ বাল্বের বেলাতেও ঠিক একই ঘটনা ঘটল।

১৬৩৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের এক নিলামে এই বেচাকেনার সময় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। আগে যখন টিউলিপের ফিউচার কন্ট্রাক্টের পেপার বিক্রি হত তখন সব সময় আগের দিনের থেকে বেশি দামে বিক্রি হত। কিন্তু সেই দিন এমনটা হল। সেদিন আগের দিনের থেকে বেশি দামে কেউ ফিউচার পেপার কিনতে রাজি হল না। এমনটা কেন হয়েছিল সেই ব্যাপারে ধারণা যায় যে সেই নিলামে যারা আসলে অংশ নিয়েছিল তাদের সবার কাছেই যথেষ্ট পরিমাণ পেপার ছিল বলেই সেদিন তারা নতুন পেপার কিনতে আগ্রহ বোধ করেনি। কিন্তু এতেই যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গেল। পুরো শহরে গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে টিউলিপ বাল্বের দাম কমে গেছে, কেউ কিনতে চাচ্ছে না। ব্যাস, আর কিছু দরকার ছিল না। সবাই তাদের ফিউচার পেপার বিক্রি করতে দৌড় দিল। এখন সবাই চায় বিক্রি করতে, কেউ আর কিনতে চায় না। এমন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই জিনিসের দাম কমে যায়। এখানে দাম কমে বিদ্যুতের বেগে। মাত্র দুই দিনের মধ্যে টিউলিপ বাল্ব এবং সেই ফিউচার কন্ট্রাক্ট পেপারের দাম একেবারে মূল্যহীন হয়ে গেল। সাত দিনের ভেতরে টিউলিপের পুরো মার্কেট ক্র্যাশ করল পুরোপুরিভাবে। এই যে কয়েক দিন আগেও যে একটা টিউলিপের বাল্ব দিয়ে একটা আস্ত বিলাসবহুল বাড়ি পর্যন্ত কিনে ফেলা যেত, সেই টিউলিপ প্রায় মূল্যহীন হয়ে পড়ল। এটাই অর্থনীতির ইতিহাসের প্রথম স্পেকুলেটিভ বাবলসের ঘটনা। এমনটা প্রতি ক্ষেত্রেই ঘটবে, এটাই স্বাভাবিক। যখন কোনো পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে তখন সবাই সেই পণ্যটা কিনতে দৌড় দেয় এবং সেটার দাম আরও বেড়ে যায়। কিন্তু দাম বাড়তে বাড়তে এক সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। এটা হচ্ছে পিক পয়েন্ট। এই পিক পয়েন্টে পৌঁছানোর পরে একটা সময়ে আসে যে কেউ আর সেই পণ্য কিনতে চায় না। তখন এর দাম পড়তে থাকে। আর যেহেতু অস্বাভাবিকভাবে দাম বেড়েছিল তাই দামের পতন কয়েকগুণ দ্রুত গতিতে।

আধুনিক বিশ্বেও এমন ঘটনা বেশ কয়েকবার ঘটেছে। নব্বইয়ের দশকে ডটকম বাবলস তেমন একটা ঘটনা। সেই সময়ে ইন্টারনেট কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারপর ২০০০ সালের দিকে সেই বাবলস ফেটে যায়। আরেকটা ঘটনা হচ্ছে ২০০৮ হাউজিং বাবলস। ২০০৮ সালের আগে আমেরিকাতে রিয়েল এস্টেটের দাম ভয়ানকভাবে বেড়ে যেতে থাকে। তখন মানুষ কেবল থাকার জন্যই নয়, ইনভেস্টমেন্টের জন্যই বাড়ি, ফ্ল্যাট, কন্ডো, হাউজ কিনতে শুরু করে। ধারদেনা করেও হলেও এই কাজ তারা করে। একটা সময়ে এসে দেখা যায় সবার কাছে বাড়ি রয়েছে একাধিক, সবাই এখন বাড়ি বেচতে চাচ্ছে কিন্তু কেউ আর কিনতে চাচ্ছে না। কারণ এই বাড়িগুলো তারা থাকার জন্য কিনেনি, কিনেছিল বিক্রি করার জন্য। সর্বোচ্চ পিকে পৌঁছে দাম তারপর ক্র্যাশ করে। এর ফলস্বরূপ বিশ্বব্যাপী মন্দা শুরু হয়। ২০১৭/১৮ সালের দিকে ক্রিপ্টোকারেন্সি বাবলসের ঘটনা ঘটে।



সর্বশেষ যে বইটার অনুবাদ করেছি তার ভেতরে এই গল্পটা রয়েছে। এখানে গল্পটা পোস্ট করা হল। এছাড়া এটা লেখার জন্য একটা ইউটিউব ভিডিও, উইকিপিডিয়া এবং গ্রকএআইয়ের সাহায্য নিয়েছি।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই মে, ২০২৫ রাত ১১:৪২

সৈয়দ কুতুব বলেছেন: আপনার লেখা পড়ে অনেক কিছু জানলাম ।

২| ১১ ই মে, ২০২৫ রাত ১:১২

ভুয়া মফিজ বলেছেন: আমার প্রফেশনাল বিষয় নিয়া লেখার জন্য ধন্যবাদ। তবে এই লেখা পূর্ণতা পাইতো যদি ফুটনোটে বাংলাদেশের উদাহরনও দিতেন।

১৯৯৬ আর ২০১০ সালে আওয়ামী সরকারের সময়ে দুইবার বাংলাদেশের শেয়াবাজারে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে। দুইবারই মূল হোতা ছিল দরবেশ বাবা। ১৯৯৬ সালের বিপর্যয়ের পরে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শাহ এএসএম কিবরিয়া 'আমি শেয়ার মার্কেট বুঝি না' বইলা একটা যুগান্তকারী মন্তব্য করে। আর ২০১০ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাণী দেয়, 'এই কেলেঙ্কারীতে জড়িতদের নাম প্রকাশ করা যাবে না, করলে অসুবিধা আছে।'

এই দুই কেলেঙ্কারীতে মাত্র কয়েকদিনেই হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয় আর সাধারন বিনিয়োগকারীরা পথে বসে।

অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে আওয়ামী লীগের পারফরমেন্স আসলেই অতুলনীয়!! এইটা বাংলাদেশের একমাত্র দল যার নেতা-নেত্রী, কর্মী-সমর্থক সবাই চোর!!!!! :P

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.