নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পাখির মতো উড়তে চাই, মুক্ত বাধাহীন।বন বনানীর মাথার উপর অাকাশ সীমাহীন।

গিরি গোহা

ইচ্ছে হলেই চলো ব্লগে

গিরি গোহা › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার শেষ ফরিয়াদ।

২৩ শে মার্চ, ২০১৭ দুপুর ২:৪৫


১.
মাগরিবের নামায মাত্র শেষ হয়েছে। ফরিদা বেগম, তাঁর ছেলের ঘরের দিকে ছুটলেন। ঘরে ঠোকার আগে আঙ্গিনার কোনা থেকে ঝাড়ুটা ‍কুঁড়িয়ে নিলেন। কোমরের পুরনো ব্যাথাটিকে উপেক্ষা করে ঘর ঝাড়ু দিতে শুরু করলেন। এমন সময় কাজের মহিলাটি হন্তোদন্ত হয়ে ছুটে এলো। এসে বলল, ‘খালাম্মা! আইজক্যাও আপনে এই ঘরে আইছেন! আপনের এই শরীর নিয়া আইতে কইছে কেঠায়? খালুজান দেখলে আমারে আস্তো রাখবো না। নগদে বাড়ি থাইক্ক্যা বাহির কইরা দিবো। তাছাড়া এই ঘরে বা থাকে কেঠায়। তারপরও আপনে প্রতিদিন এই ঘরখ্যান ঝাড়ু দেন ক্যান খালাম্মা? ভাইজান কবে না কবে আইবো নাকি আইবোই না’!

এইসব ফরিদা বেগম প্রায় চিৎকার করে বললেন, ‘জমিলার মা! কি সব বল না বল। মুখে দেখি তোমার কিছুই আটকায় না। যাও দেখি, তোমার খালুজান কিচ্ছু বলবে না। আমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র ছেলে। ওর ঘরটা যদি আমিই না পরিষ্কার করি তবে কে করবে! সারাজীবন তো আমিই পরিষ্কার করলাম। আজ বাদে কাল এসে যদি দেখে তার ঘরটা নোংরা হয়ে পড়ে আছে। তখন ও কষ্ট পাবে না, বল?’

জমিলার মা মৃদু স্বরে বলল, ‘ভাইজানরে কি আর আইতে দিবো! এই স্বৈরাচার সরকার তো ভালা মানুষগুলারে দেখবারই পারে না। ধইরা ধইরা জেলে ভইরা রাখে আর না হয় নাটক সাজাইয়া গুলি কইরা মাইরা ফালায়। আম্মা, ভাইজান সত্যিই আইবো তো?’
ফরিদা বেগম দির্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘আল্লাহ চাইলে একদিন নিশ্চয়ই আসবে’।

২.
জেলখানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে শিমুল। বাবা মা বড় শখ করে নাম রেখেছেন আসাদুজ্জামান শিমুল। তার জন্মের সময় বাড়ির পিছনের শিমুল গাছটিতে ধোকায় ধোকায় শিমুল ফুল ফুটেছিল। দূর থেকে শিমুল গাছটিকে দেখলে মনে হতো, লাল পাহাড় দাড়িয়ে আছে। সেই লাল পাহাড়ের সৌন্দর্য্য দেখে মা তার ডাক নাম রাখেন শিমুল।

মধ্যরাত। শিমুলের কেমন জানি খুবই ছটফট লাগছে। জেলখানাটিকে আজকে খুব বেশিই নিস্তবদ্ধ মনে হচ্ছে। জেলখানার এই নিস্তবদ্ধতা যেন শিমুলের ভিতরের প্রফুল্লতাকেও নিস্তবদ্ধ করে দিয়েছে। নিজের ভিতরকার এই অস্বস্তিকর নিস্তবদ্ধাটি শিমুলকে খুব বেশিই পিড়া দিচ্ছিল। কেন জানি মনে হচ্ছে, ‘আমার কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। খুব চেনা এবং বড় আপন কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কি হারিয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে পারছে না।’
এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে নিজেকে শান্তকরার এই মুহুর্ত একটি পথই খোলা আছে। আর তা হল, মহান সৃষ্টিকর্তার সামনে প্রশান্ত চিত্তে দাঁড়ানো। আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মনের অস্বস্তিকর এই অবস্থাটিকে খুলে বলা।

শিমুল কারারক্ষির অবস্থান দেখে নিল। কারারক্ষি ঘুমে প্রায় কাতর। জেলখানায় আবার সব নিয়মেই বেশ কড়াকড়ি। দশটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়তে হবে। কেউ জেগে থাকতে পারবে না। এরপর জেলখানার বাথরুম থেকে ওযু করে এসে তাহাজ্জুদের নামাযে দাঁড়িয়ে গেল শিমুল।

৩.
আসাদুজ্জামান শিমুল। ফরিদা বেগমদের একমাত্র আদরের ধন। সে, রংপুর কারমাইকেল কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে মাষ্টার্স করছে। মাষ্টার্সে ভর্তি হবার পরপরেই দেশে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তিব্র আকার ধারণ করল। শিমুলের আবেগটি একটু বেশিই কাজ করল। ভোটার তালিকায় শিমুলের নাম উঠেছে। এইবারই প্রথম সে জাতীয় নির্বাচনে ভোট প্রদানের অধিকার অর্জন করেছে। দেশ পরিচালার গদিদে কে বসবে সেই বিষয়ে বাংলাদেশের সংবিধান শিমুলের মতামত জানতে চায়। এইসব ভেবে শিমুল একটু বেশিই উৎফুল্ল ছিল। কিন্তু হঠাৎ শুনতে পেল, সে নাকি ভোট দিতে পারবে না। অর্থাৎ তার নাকি ভোট প্রদানের প্রয়োজনই নেই। ভোট ছাড়াই দেশের ক্ষমতার আসনে স্বৈরাচার সরকার খুঁটি গেড়ে বসেছে। ভাবখানা এমন যেন, দেশখানা তার বাবার!

এইঅবস্থায় দেশে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের ডাক এলো। শিমুল বিশ্বাস করল, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তারও এই আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়া ‍উচিত। প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করা উচিত। কারমাইকেল কলেজে বের হল স্বৈরাচার বিরোধী মিছিল। সেই মিছিলে অংশ নিতে একটু দ্বিধা করলো না শিমুল। মিছিল কিছুদূর আগানোর পরপরই থ্রিম থ্রিম করে কয়েকটি আওয়াজ শোনা গেল। তারপরই সব অন্ধকার। এরপর শিমুলের যখন জ্ঞান ফিরল তখন সে নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করল। কিছুটা নড়াচড়া করতে গিয়ে দেখল, তার হাতটি কোথায় যেন আটকানো। এরপর ভাল করে তাকিয়ে দেখল, তার হাতে হাতকড়া। পুলিশ, র‌্যাব এবং বিজিবির যৌথবাহিনী সেই মিছিলে আক্রমন করলে টিয়ারশেলের আঘাতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে শিমুল। তারপর তাকে গ্রেফতার অবস্থায় হাসপাতালে পৌছে দেয় পুলিশ। এরপর কেটে গেছে দেড়টি বছর। দেশ যেমন স্বৈরাচারের হাত থেকে রেহাই পায় নি, তেমনি শিমুলও জেলখানা থেকে ছাড়া পায় নি।

৪.
রাত আনুমানিক ৩ টা হবে হয়তো। এমন সময় ফরিদা বেগম তার পাশে ঘুমিয়ে থাকা স্বামীর শার্টটি টেনে ধরল। এরপর প্রচন্ড শক্তি দিয়ে খামচে ধরার চেষ্টা করল। এরপর সব নীরব। ফরিদার বেগমের স্বামী ঘুম থেকে উঠে আপন স্ত্রীর এই অবস্থা দেখে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন।

জমিলার মা স্বামী এবং একমাত্র মেয়ে জমিলাকে নিয়ে শিমুলদের বাড়িতেই থাকে। জমিলার বাবা শিমুলদের জমিজমা দেখাশোনা করে আর জমিলার মা বাড়ির ভিতরের কাজ কর্ম করে থাকে। তাদের জায়গা জমি না থাকায় ফরিদা বেগম তাদেরকে নিজের কাছেই রেখে দিয়েছেন।

জমিলার মা এবং বাবা চিৎকার শোনার সাথে সাথে ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠল। এরপর তারা ফরিদা বেগমের ঘরের দিকে ছুটল। সেই মধ্যরাতে বহুকষ্টে এ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা করে ফরিদা বেগমকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হল। কিন্তু হাসপাতালে নেবার কিছুক্ষন আগেই এই ইহজগত ত্যাগ করেছেন ফরিদা বেগম। একমাত্র ছেলের মুক্তির আশায় পথ চেয়ে থাকতে থাকতে ছেলের মুক্তিটাই আর দেখে যেতে পারলেন না।

৫.
অন্যান্য দিনের মত জেলের ভিতরে সবাইকে গমের মোটা রুটি দেওয়া হল। এই রুটি এবং এক চিমটি গুড় দিয়ে সকালের নাস্তা করতে হয়। এটাই নাকি সেই ব্রিটিশ আমল থেকে জেলখানার সকালের নাস্তা হিসেবে চলে আসছে। সবার সাথে নাস্তা করে জেলখানার এক কোনে চুপ করে বসে আছে, শিমুল। তার অস্বস্তি ভাবখানা যেন কাটছেই না। এমন সময় মিয়া সাহেব এসে বলল, আসাদুজ্জামান শিমুল! ভিজিটর কল এসেছে।

দর্শনার্থী ঘরে গিয়ে শিমুল দেখে তার বাবা এবং এলাকার আরো কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তাদের মাঝে আম্মা নেই। আম্মা নেই কেন? শিমুলের মনে খটকা লাগে। শিমুলের বাবা লোহার শিক ধরে এক মনে তাকিয়ে আছে। তারপর কান্না জড়ানো গলায় বললেন, ‘বাবা, তোমার আম্মা আর ইহজগতে নেই। গতরাতে সে ইন্তেকাল করেছে।’

৬.
দুপুরে যোহরের নামাযের পর শিমুল তখনো জায়নামাযে বসে আছে। একজন কারারক্ষি এসে বলল, ‘আপনার প্যারোলে জামিন হয়েছে। আপনার আম্মার জানাযার জন্য আপনাকে নিয়ে যাওয়া হবে। আপনি তৈরী হয়ে থাকুন’।
গত দুইটা ঈদ শিমুলকে জেলখানাতেই করতে হয়েছে। এক ঈদে শিমুলের আম্মা তাকে একটি পাঞ্জাবী পাঠিয়েছিল। আজ সেই পাঞ্জাবীটি পরে নিল শিমুল। এরপর শিমুলকে নিয়ে প্রিজন ভ্যান রওনা হল তার গ্রামের বাড়ির দিকে।

গ্রামের মানুষ শিমুলের জন্যই এতোক্ষন অপেক্ষা করতেছিল। এরপর শিমুল যখন মায়ের লাশের সামনে এসে উপস্থিত হল, তখন উপস্থিত সকলেই হুহু করে কাঁদতে শুরু করল। সেই কান্নার প্রভাবে হয়তো আকাশেরও মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাতাসটাকে তখন আরো বেশি ভারি মনে হতে লাগল। এরপর শিমুল দাঁড়িয়ে গেল মায়ের জানাযায় ইমামতি করতে।

জানাযা শেষে শিমুল দু’হাত তুলে দোয়া করতে শুরু করল। সে চিৎকার করে কেঁদে বলল, ‘ইয়া রাব্বুল আলামীন! আম্মার জীবনের শেষ কটা দিন তিনি আমাকে কাছে পান নি। এযে কতোটা কষ্টের তুমি ঠিকই জানো। আমার আফসোস নেই কিন্তু তোমার নিকট শেষ ফরিয়াদ করছি। এই কষ্টের বদলায় আমাদের মা ছেলেকে একসাথে জান্নাতে থাকার তৌফিক দান কর।’
উপস্থিত সকলেই বুক ফাঁটা চিৎকার দিয়ে বলেছিল, ‘আমীন’।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে মার্চ, ২০১৭ দুপুর ২:৫৩

ওমেরা বলেছেন: আমীন !!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.