![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জুবুথুবু একটা ভঙ্গিতে জানালা পাশে বিছানায় বসে আছে রাহেলা। জানালাটা বন্ধ, খোলা যাবে না এখন। বাইরে ভীষণ শীত আর কুয়াশা। এই সকাল বেলা ঘরটা এখন কিছুটা অন্ধকার, আবছা আলোয় ঘড়ির দিকে দেখে রাহেলা, ঘণ্টার কাঁটা মাত্র সাত টা পার হচ্ছে। বাবুর কড়া নিষেধ আছে, কোন মতেই এই শীতের মধ্যে রোদ না উঠলে দরজা-জানালা খোলা যাবেনা। রোদ উঠার অপেক্ষায় বসে আছে রাহেলা। গত কয়েকদিন হল প্রতি সকালেই ওকে সূর্য ওঠার অপেক্ষায় থাকতে হয়। জানালাটা খুলে বাইরে শিউলি গাছটা না দেখলে ওর ভালো লাগেনা। কিন্তু গত ক’দিন সকাল বেলা এত কুয়াশা আর ঠাণ্ডা পড়ছে বলার মত না। বাবুর নিষেধ এই ঠাণ্ডায় জানালা খোলা। এমনিতেও রাহেলার টনসিলের ব্যাথা টা বেড়েছে ঠাণ্ডার মধ্যে। তবু এই জানালাটা খুলে শিউলি গাছের দিকে তাকিয়ে থাকার লোভটা রাহেলা সামলাতে পারেনা। বহু বছরের অভ্যাস। ভোর বেলা নামায পড়ে এসে আর ঘুমায় না ও। লেপের মধ্যে পা ঢুকিয়ে জানালার পাশে বসে থাকে । রোদ ওঠার অপেক্ষায়।
ঘরের চারপাশে তাকায় রাহেলা। দেয়াল জুড়ে টানানো জামানের সব ছবি। ছবি গুলো একে একে দেখতে থাকে রাহেলা। প্রতিদিনই দেখে। প্রথম ছবিটা জামানের কলেজে ভর্তি হবার পর তোলা। কেমন ছিল তখন দেখতে জামান। ঢ্যাঙা, পাতলা। উস্কুখুস্কু চুল। ছবির দিকে তাকিয়েই বুঝা যায় নিতান্ত অনিচ্ছায় ওর এই ছবিটা তোলা হয়েছে। অথচ ছবি তোলার ব্যাপারে জামানের ভীষণ আগ্রহ ছিল। যেকোনো পছন্দের মুহূর্তকে ক্যামেরাবন্দী করে রাখতো জামান। পরের ছবিটা রাহেলার সাথে তোলা। ওরা তখনও বিয়ে করেনি। মাত্র প্রেমের শুরু ওদের তখন। কত লুকিয়ে লুকিয়ে রাখতে হত এই ছবি টা মনে পড়ে রাহেলার। বাবুর সব চেয়ে সব চেয়ে প্রিয় ছবি এটা। মা-বাবার এই ছবিটা ও নিজের ঘরেও বাঁধায় করে রেখেছে। বন্ধুরা কেউ আসলে গর্ব করে এটা দেখায়, রাহেলা ভীষণ লজ্জায় পড়ে যায় ছেলের পাগলামি দেখে। তার পরের ছবিটা ওদের বিয়ের দিনের। পাঞ্জাবি পরে একটা চেয়ারে বসে আছে জামান,পাশে লাল শাড়ি পরে চেয়ারের একপাশে দাঁড়ানো রাহেলা।
এই ছবিটার কথা মনে পড়লে হাসি পায় রাহেলার এখনও। বেচারা জামান,চেয়ারে বসে ছবি তোলার কথা বলায় যেই বসতে গেল চেয়ার টান দিয়ে ওকে ফেলে দিয়েছিল জামানের বন্ধুরা। নববধূর সামনে নতুন জামাই পড়ে গেল তাই নিয়ে বিয়েবাড়িতে ভীষণ হাসাহাসি। ভীষণ সরল ছিল মানুষটা।
পরেরটা বাবুর জন্মের ঠিক পরে তোলা। রাহেলার কোল জুড়ে শুয়ে আছে বাবু। বাবু খুব লজ্জা পায় ছবিটা দেখলে। বলে মা আমি কি আসলেই এমন ন্যাদা ন্যাদা ছিলাম নাকি? হাসে রাহেলা, হাসতে হাসতে বাবুর বন্ধুদের ছবিটা দেখায় রাহেলা। মা-বাবার ছবি নিয়ে বাবুর দুষ্টুমির শোধ তোলে।
এর পরের ছবিটা তোলা হয়েছিল জামান বিয়ের পর আগের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে যখন নতুন চাকরি তে ঢুকল তখন। এই ছবিটা বড় করে বাঁধাই করে রেখেছে বাবু। সাদা শার্ট আর নিল টাই পরে তোলা ছবিটা। নিচে টাইপ করে লেখা হাসানুর জামান, ১৯৫৩-১৯৮৯।
খুব বেশি দিন বাবাকে কাছে পায়নি বাবু। বছর দুয়েক। বাবার কথা কিছুই মনে নেই ওর। শুধু রাহেলার মনে স্মৃতি গুলো জ্বলজ্বল করে। কি পাগলামি ছিল বাবু কে নিয়ে জামানের। বাবু যখন ঠিক মত বসতেও শেখেনি তখনই ছেলেকে হাঁটতে শেখাতে ব্যস্ত হয়ে যেত জামান। ছোট্ট বাবুর দুই হাত ধরে এক পা দু পা করে হাঁটাতে চেষ্টা করত, ছেলের হাত ধরে ঘুরতে যাওয়ার জন্য আর তর সইত না তার। এসব কিছু মনে থাকার কথা নয় বাবুর। শুধু রাহেলার কাছ থেকে শুনে শুনে বাবাকে জেনেছে ও। বাবুর ভীষণ আক্ষেপ হয় কেন একটু আগে আগে হাঁটা শিখল না ও।
বাবু যেদিন প্রথম বার নিজে নিজে দুই পা হেঁটে এগিয়ে এসেছিল রাহেলার দিকে,মনে পড়ে রাহেলার, বাবুকে জাপটে ধরে সেদিন অঝোর ধারায় কেঁদেছিল রাহেলা,জামান মারা যাবার ঠিক তিন মাস পর।
দেয়ালের এক কোণায় আর একটা ছবির দিকে চোখ আঁটকে যায় রাহেলার। এই ছবিটা তোলা হয়েছিল শিউলি গাছটা যেদিন লাগায় জামান সেদিন। ছবিতে বাবুকে কোলে নিয়ে গাছে পানি ঢালছে জামান। জামানের খুব ইচ্ছা ছিল বাবুকে সাথে নিয়ে এই গাছের ফুল কুড়াবে বাবা ছেলে একসাথে। কিন্তু গাছে ফুল ফোটার আগেই একদিন দুপুরে জামানের অফিস কলিগরা জামানের লাশ নিয়ে ওদের উঠানে এসে দাড়ায়। বাবু তখন কেবল বাবা ডাকতে শিখেছে। এই শিউলি গাছের নিচেই খাটিয়ায় রাখা ছিল জামানের লাশ। ওই সময় প্রায় পাগল হয়ে যাওয়া রাহেলার একটা স্মৃতি খুব মনে পড়ে। মায়ের কান্না দেখে ভয় পেয়ে কাঁদতে থাকা বাবু সেদিন কিভাবে যেন খাটিয়ার একটা পাশ ধরে উঠে দাড়িয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বাবা বাবা বলে ডাকতে থাকে। সব সময় বাবা ডাকের উত্তর পেয়ে অভ্যস্ত বাবুও হয়ত সেদিন অবাক হয়ে গিয়েছিল বাবা আর কথা না বলায়। এই গাছটার নিচেই মানুষটার সাথে সেই শেষ দেখা রাহেলার।
সেই থেকে রোজ সকালে উঠে জানালা খুলে শিউলি গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে রাহেলা। জানেনা রাহেলা কেন তাকিয়ে থাকে,কিসের অপেক্ষায়। জামান মারা যাবার পর এত গুলো বছর রাহেলা একটা দিনের জন্যও শিউলি গাছটার যত্ন নিতে,গাছে পানি দিতে ভোলে না। নিজে না পারলে বাবুকে বলে। আর কাউকে দিতে দেয়না। কাউলে ফুল তুলতেও দেয়না।
হঠাৎ কেন জানি আর থাকতে পারেনা রাহেলা। রোদ ওঠার অপেক্ষাটুকু আর সহ্য হয় না ওর। বাবুর নিষেধ সত্ত্বেও রোদ ওঠার আগেই জানালা খুলে দেয়।ঘন সাদা কুয়াশায় ঢেকে আছে চারপাশটা। কিছুই ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাশ ঢুকতে থাকে জানালা দিয়ে। লেপটা দিয়ে আরও ভালো করে নিজেকে মুড়িয়ে নেয় রাহেলা। শিউলি গাছটার দিকে তাকায়। কিছু দেখতে পায় না কুয়াশার জন্য। শুধু গন্ধ পেয়ে বুঝতে পারে গাছটার চারপাশে এখন ফুল ছড়িয়ে আছে অনেক। আরও ভালো করে তাকায়। হঠাৎ যেন আবছা আবছা একটা ছায়া বুঝা যায়। সাদা পাঞ্জাবি আর সাদা চাদরে জড়ানো একটা মূর্তি যেন ঘন কুয়াশার মাঝে দাড়িয়ে আছে। শুধু হাতের কাছে একটু খানি আগুনের শিখা জ্বলতে দেখা যায়। বাবু জানেনা মা ওকে দেখছে। বাবুর সিগারেটের ধোওয়া টুকু ঘন কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। অনেক বছরের পুরনো একটা স্মৃতি রাহেলার মনে যেন বিদ্যুতের মত খেলা করে যায়। বাবুকে কোলে নিয়ে জানালায় বসে আছে রাহেলা।ভীষণ কুয়াশার মধ্যে শিউলি গাছটার নিচে দাড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে জামান।
বাবুর দিকে খেয়াল করে তাকায় রাহেলা। হঠাৎ করেই যেন আবিষ্কার করে যে অপেক্ষায় ও এত গুলো বছর ধরে জানালা দিয়ে শিউলি গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে সে অপেক্ষা আজ ফুরিয়েছে। রাহেলার খুব ইচ্ছে করতে থাকে বাবুকে ডেকে বলে, বাবু,তুই এমন করে রোজ সকালে গাছটার নিচে এসে দাড়িয়ে থাকিস।
দুপুরঃ ১২.৩৭
০৩.০৭.২০১৩
২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:০৬
পসর কুমার ভৌমিক বলেছেন: ধন্যবাদ
২| ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:০৯
চেনা মুখ, অচেনা ছায়া বলেছেন: আপনার গল্প লেখার হাত ভালো। সামনে এমন ভালো লেখা আরো পাবো আশা করছি।
২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:০৬
পসর কুমার ভৌমিক বলেছেন: ধন্যবাদ
৩| ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:৩৩
কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:
ভালো সামনে আপনার আরও গল্প পাবো আশা করি।
©somewhere in net ltd.
১|
১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১২:৪৬
২য় জীবনানন্দ বলেছেন: আপনার লেখা দারুণ লাগল। আরও লিখবেন