নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নিজের সম্পর্কে বলার আসলে কিছু নেই। বিপণি বিতানের কোন সিদ্ধহস্ত বিক্রায়কও আমি নই। হঠাৎ হঠাৎ কিছু শব্দ মনের মাঝে টুপটাপ করে ঝরে পড়ে। তাই লিখি এখানে।

আসাদুজ্জামান পাভেল

নিজের সম্পর্কে বলার মতো আসলে তেমন কিছু নেই।

আসাদুজ্জামান পাভেল › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ হাইফেন ( পর্ব- চার)

০৬ ই জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫৯

৪.

লাক্ষনৌ তাদের খাবারের জন্য বিখ্যাত।
একটা বিতর্ক কিন্তু রয়েই যায়। কাদের খাওয়া বেশি মজাদার? পেট ভরে গেলেও মন ঠিক ভরে না! সেটা কি হায়দারাবাদি শাহী খাবার নাকি লাক্ষনৌ-এর নবাবি খানা? নবাব-শাহীর সে বিবাদের আজো কোন সুরাহা হয় নি যদিও। তবে লাক্ষনৌ-এর কাবাব যে আসলেই লা-জবাব, খাবারের টেবিলে হরেক রকমের আয়োজন দেখেই তা মনে হয়। তারই সুঘ্রাণ চারপাশে হামলে পড়েছে।

আয়োজনটা এমন যে, দু- পক্ষই কিছু না কিছু রান্না করে আনবে। এমনিতে অ্যামেরিকান খাবার তো থাকছেই। কারণ নাহিয়া আর ধীমানের বেশ কিছু এ দেশীয় বন্ধবান্ধবও থাকছে। ওরা কাছের একটা কটেজেই উঠেছে। যখন জেনেছে ডি-এন (ধীমান-নাহিয়ার নামের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ)ওদের পরিবারের লোকজন নিয়ে হোয়াইট ওয়াটার রাফটিং করবে, ওরাও জুটে গেছে। দল বেঁধে ওয়াটার রাফটিং-এর মজাই আলাদা। সকালে উঠেই ওসবের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল ওরা। সে বন্দোবস্ত যে এতো ব্যাপক তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। এয়ার পাম্প ব্যাগ, সেইফটি রোপ, ওয়েট সুট, সাঁতারের পোশাক, রোদ চশমা, সান-স্ক্রিন, ডাইভ-শু, ক্যাপ, লাইফ জ্যাকেট, পানি নিরোধক কন্টেইনার, সেইফটি পিন, শুকনো খাবার,-কী নেই? প্রত্যেকের কাঁধে তাই একটি করে বেশ বড় সাইজের ব্যাগ। যখন দল বেঁধে বেরোচ্ছিল, দেখে মনে হয় যেন কোন অভিযাত্রীর দল। মোট দুটো দলে ভাগ হয়ে রাফটিং-এ নেমেছে ওরা। একটিতে ধীমান আরেকটিতে নাহিয়া রয়েছে। বাতাসে ফুলানো হালকা নৌকাগুলোই আসলে রাফটস। খরস্রোতা পানিতে এগুলো দিয়েই ভেসে বেড়াতে হয়।

রাফটিং শেষে আজ ওদের বন্ধুদের সবার দাওয়াত এখানে। ওদের জন্য তো আমাদের ওদিককার খাবার ঠিক যুতসই হবে না। যদিও ধী ফিরোজকে বলেছে, দেখো ওরা আমাদের খাবারই বেশি খাবে। যেকোনো নতুন কিছু ট্রাই করতে অ্যামেরিকানদের জুড়ি নাই। আর আম্মুর হাতের গরুর মাংশ খেলে তো পাগল হয়ে যাবে। হা হা হা।
খাবারের ফর্দ দেখে ফিরোজ একটু অবাকই হয়। শিক কাবাব, বটি কাবাব, রুমালি রোটি, কোর্মা, কালিয়া, দাম বিরিয়ানি-সবই নাকি ওদের ঐতিহ্যবাহী খাবার! ‘দাম বিরিয়ানি’ যে আসলে আমাদের কাচ্চি বিরিয়ানি- সেটাও মোটামুটি বোঝা যায়। সব খাবারই ধীর তাপে দম দিয়ে রান্না করা নাকি ওদের আবিষ্কার! এতো যে আমরা এইসব খাবার নিয়ে উদযাপন করি, সবই তাহলে ধার করা। অন্যের রান্না ঘরের ভেসে আসা সুঘ্রানে আমরা আমাদের টেবিল সাজাই। আশ্চর্য।
সামান্য কিছু পদের রান্না করার কথা থাকলেও নবাবি খাবারের ঠেলায় টেবিলে জায়গাই হয় না। দীপ্তিও বেশ কিছু পদ রান্না করেছে। সে রেঁধেছে ইলিশ পোলাও, ইলিশের ঝাল-কারি, ইলিশের দো-পেয়াজা, ঝরঝরে সাদা পোলাও, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, মুরগির রোস্ট, ভাত, লইট্টা শুঁটকি, কচুর লতি আর চট্টগ্রামের বিখ্যাত মেজবানীর টকটকে লাল গরুর মাংশ। শুঁটকি দীপ্তি দেশ থেকেই নিয়ে এসেছিলো। আর সব এখান থেকেই বাজার করা। এখানে সবই পাওয়া যায়। ধী আর ওর মা র‍্য-লেতে গিয়ে বাজার করে নিয়ে এসেছে। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল ওদের ননদ-ভাবীর তৈরি করা মিষ্টি। দীপ্তির আর তার ভাবী আনিকা বেশ কিছু পদের দুর্দান্ত মিষ্টি বানিয়েছে। এ জিনিসে নবাবরা ধারে কাছেও আসতে পারে নি। তাই ডেসার্ট অংশে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলো- ফিরোজ ভাবে।

গত পরশু সন্ধ্যায় গ্রেজুয়েশন পার্টিটা ‘টপ অফ দ্য হিল’ নামের একটি রেস্টুরেন্টে করেছে ওরা। রেস্তোরাঁটি আসলে ছাদের মতো জায়গায়, একপাশে খোলা। মে মাসের ঝিরিঝিরি বাতাসে মনটা ভরে যায়। বেশ পরিপাটি, সব কিছুই নিয়মে বাঁধা। আগে থেকেই সবকিছু নির্ধারিত। নির্ধারিত খাবার, নির্ধারিত বসার জায়গা। খাবার আগে ছোটখাটো বক্তৃতা।

ফিরোজ দেখেছে ওদের দলে একজন বেশ বয়স্ক মতন লোক যুক্ত হয়েছেন। হাই-হ্যালো ছাড়া তেমন কোন কথা হয়নি সেদিন। অশীতিপরের চেহারা দেখে মনে হয়, বেশ ক্লান্ত। জেট-ল্যাগ বেশ ভালো ভুগাচ্ছে, বোঝা যায়। উনি নাহিয়ার বাবার ছোটো চাচা।
আজ খেতে খেতে ধী’র বন্ধুদের কথা শুনছিল ফিরোজ। খানিক আগেই ওরা ফিরেছে। এখন সবাই পাশের টেবিলে একসাথে বসে হাপুশ হুপুশ খাচ্ছে। নাহিয়া বেশ মজা করে ওদের বলছে, দেখো, ডি অনেক ভাগ্যবান। আর আমার কপালে নিষেধাজ্ঞা।
- কি রকম?কি রকম!
- এই যেমন ডি যেখান থেকে এসেছে তার প্রথম তিনটা অক্ষর লক্ষ্য করো। বি-এ-এন। মানে ব্যান।এর অর্থ তো তা-ই, নাকি? আর আমি যেখান থেকে এসেছি তার প্রথম অক্ষরগুলো লক্ষ্য করো, এল ইউ সি কে, লাক। পুরোটা হল লাক-নাও! তার মানে কি দাঁড়ায়?হি হি হি।
এখানে এসে ধীমান বলে, ওয়েল, মাইন ইজ অ্যা কান্ট্রি, এন্ড ইয়োরস ইজ অ্যা সিটি। নট অ্যা গুড কম্পারিজন অ্যাট অল, মাই ডিয়ার।
- ঐ হল, ক্রিকেট খেলায় আমি তো তোমাদের ঐ নামটাই দেখি সবসময়।
- না, এক হল না, নাহিয়া। বাংলাদেশ একটা দেশ আর লাক্ষনৌ একটা শহর। এক হয় কি করে!
- হেই, হোয়াই সো সিরিয়াস। আই অ্যাম জাস্ট মেসিং উইথ ইউ। আমি আগেও দেখেছি দেশের কথা আসলেই তুমি কেমন যেন শক্ত হয়ে যাও।

যখন ডেসার্ট নিচ্ছে, ফিরোজের মনে হল আজ অনেক বেশি খেয়ে ফেলেছে সে। স্পেশালি, দীপ্তির হাতের শুঁটকি আর গরুর মাংশ। অনেকদিন পর অমনটা রাঁধলো ও। যদিও এ বিষয়ে তার একটা মতামত আছে। শুঁটকি আর গরুর মাংশ একই বেলায় খাওয়া ঠিক নয়। বেশি খাওয়া হয়ে যায়। এই আজ যেমন হল। কিন্তু মিষ্টির পর্বটা তো আর বাদ দেওয়া যায় না। ডেসার্টের প্লেট নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেই বৃদ্ধের কাছে গিয়ে বসে সে। সামান্য গল্প গুজব করার জন্য। ভদ্রলোক বেশ ভালো ইংরেজি বলেন। যদিও কথার ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে উর্দু বা হিন্দি এসে যায়। ফিরোজ তবু ঠিকই বুঝে নেয়।
- আঙ্কেল, আসতে আপনার দেরি হল কেন? রাস্তায় অসুবিধা হয়েছে কিছু?
- আর বল না বাবা। আমাদের নামেই যত ফ্যাসাদ।
- কি রকম?
- এই যেমন আমার নামের মধ্যে ‘ইবনে’ আছে। তো হয়ে গেলো লাফড়া। ভিসা দেবার আগে মেলা হুজ্জুত। আমার বায়োমেট্রিক না কি যেন ছাই করতে পাঠালো। তাতেই বহুত সময় লেগে গেলো। তাতেও কি শেষ হল? আসার সময় নিউইয়র্কেও আরেক ঝামেলা। ভেঞ্চতগুলো প্রায় সারাদিন বসিয়ে রেখেছে আমাকে। বসে থাকতে থাকতে আমার পাছা ব্যথা হয়ে গেছে। ইন্ডিয়ার কারো সাথে কিন্তু এমনটা করে না। যত নকশা কেবল আমাদের সাথেই।
- কেন আপনিও তো ওখানকারই মানুষ, তাই না?
- আমি ওখানকার হব কেন? আমি তো করাচির মানুষ। ভালো কথা, আপনার বিবি কিন্তু দারুণ গুলাব-জাম বানায়, একদাম বেহতেরিন!
ফিরোজ দেখে ভদ্রলোক প্রথম কালোজাম মিষ্টিটি শেষ করে দ্বিতীয়টি খাওয়ার জন্য সেখানে চামচ ডুবিয়েছেন। আর তারটি অর্ধেক খাওয়া। বাকিটুকু খাওয়ার আগে সে কিছুটা কম্পিত গলায় জানতে চায়, করাচির মানুষ মানে? আপনারা না লাক্ষনৌ-এর বাসিন্দা?
উত্তরে বৃদ্ধ যা বললেন তা শোনার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। সেটা মোটামুটি এই রকম, সালিম শরাফের তিন পুত্র এবং চার কন্যা। মেয়েদের সবাই করাচিতেই থাকেন। সালিম শরাফ পাকিস্তান সরকারের পুলিশ বিভাগে কাজ করতেন। তাঁর তিন ছেলের মাঝে ইনি, নাদিম ইবেনে শরাফ, সর্ব কনিষ্ঠ। ছেলেদের কেউই ঠিক চাকরিতে যায় নি। আর দুই ভাই এজাজ ইবনে শরাফ মেঝ (নাহিয়ার দাদা) এবং হাফিজ ইবনে শরাফ ( নাহিয়ার বাবার বড় চাচা) লাক্ষনৌ-তে তাঁদের নিজেদের ব্যবসা শুরু করেন। সে কারবার বেশ ভালো জমে উঠলে গণ্ডগোল শুরু হয়। দেশ ভাগ হয়ে যায়। সেসময়ে ওরা তাই ওখানেই রয়ে যান। আর পাকিস্তান ফেরেননি। নাদিম তখন অনেক ছোটো।
যদিও ভাইয়েরা ওখানেই পাকাপাকি কিন্তু ওদের সম্পর্ক-বিয়ে ইত্যাদি কিন্তু এদেশের সাথে আজো যুক্ত। তাদের কেউই ভারতীয় কাউকে বিয়ে করেন নি। ধীমান এবং নাহিয়াও সে অর্থে একই বলয়ে। বাংলাদেশ তো আসলে একই মুলুক, যেন আজও দুই ভাই।
ঠিক এই ধরণের কথা স্বাধীনতার পরপর ভুট্টোও বলেছিলেন। ওটা নাকি তখনো পাকিস্তানেরই অংশ। কদিন পরই আবার এক হয়ে যাবে। অথচ সাড়ে চার দশক পর সে দেশেরই কারো মুখে একই কথা প্রতিধ্বনিত হল! তবে কি কিছুই বদলায় না?

ফিরোজ শোনে নাদিম শরাফ বলে চলছেন, একটা কথা জানেন? নাইন্টিন ফিফটিজ-এ আমার বাবার পোস্টিং কিন্তু ঢাকায় ছিল। সে সময়ের পুলিশ বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি ছিলেন তিনি। ফিফটি থ্রি-তে করাচি ফিরে আসেন । তার ঠিক দু’ বছর পর তিনি পুলিশের কাজে ইস্তফা দেন। শেষের দিকে তাঁকে আমি বেশ চুপচাপ থাকতে দেখতাম।প্রায়ই একা বন্ধ ঘরে বসে থাকতেন। কিয়া বাত হেইন, আপকা গুলাব জাম আভিতাক খাতাম নেহি হুয়া?
ফিরোজ সংক্ষিপ্ত উত্তরে বলে, এক্সকিউজ মি। আই উইল বি ব্যাক শর্টলি।

একটা খোলা জায়গায় বেশ কিছু কাঠের টেবিল পাতা। তারই পাশে খাবার রান্না কিম্বা গরম করার জন্য বারনার রয়েছে। এদিকটায় খোলা, নীচে পরিষ্কার পানির লেক। মে মাসের অপরাহ্ণের চমৎকার বাতাসে চারপাশ জুড়িয়ে যাচ্ছে। খাবার টেবিলে সবাই বেশ জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। সবাইকেই বেশ আনন্দিত এবং সুখি বলে মনে হয়। কেবল ফিরোজের মনেই ঝড় বয়ে যায়।
সত্যিই যদি তিনি তখন ঢাকায় পুলিশে ছিলেন তবে তো বাহান্নতেও ছিলেন। ফেব্রুয়ারিতে যে গুলি ছোড়া হয়েছিলো তাতে কি তবে তিনিও সামিল ছিলেন? তারই অগ্নিকণা কি এতোটা কাল ওদের পরিবার বয়ে যাচ্ছে? সে নিদারুণ ক্ষত তো আজো আছে। শেষ হয়ে যায়নি তো। কেন সালিম শরাফ চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন? শেষ বয়সে কেনই বা বিমর্ষ থাকতেন তিনি? সে কি অনুশোচনা থেকে? ফিরোজ আর ভাবতে পারে না। হাতের কাগজের বাটিতে তখনো তার আধ খাওয়া কালোজামটি পড়ে আছে। তার আর খাওয়া হয় না ।

***

দীপ্তি আর ফিরোজ বসে আছে ওদের বারান্দায়।
কটেজের প্রত্যেকটি ঘরের লাগোয়া একটি করে ছোটো বারান্দা রয়েছে। এখানে বসে লেকের প্রায় পুরোটা দেখা যায়, তাই ওদের বারান্দাটা একটু স্পেশাল। দীপ্তি দেখেছে, সামান্য দূরে গিয়ে লেকটা ঘন গাছের আড়ালে বাঁক নিয়েছে। ওপাশের কিছুই ঠিক মতো দেখা যায় না।
নওরোজ খানিক আগেই চলে গেছে। আজই ওর ছুটি শেষ। বিকেলের ফ্লাইটে তাই চলে গেছে। বলে গেছে হাতে ছুটি থাকলে যেন ওরা ঘুরে যায়।

দুপুরের খাবারের পর প্রায় সবাই যে যার ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে। ফিরোজ সেই কখন থেকেই বারান্দায় বসে আছে। দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস তার নেই। সে অভ্যাস দীপ্তিরও নেই। তবু বিছানায় এই সময়টা গড়াগড়ি করতে ভালো লাগে। তারপর একসময় বাইরে আসে সে। দেখে ফিরোজ একটা বই পড়ছে। আসার পর থেকেই দেখছে ‘ইন দ্য লাইট অফ হোয়াট উই নো’-বইটি সে মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। লেখক জিয়া হায়দার রহমান নামের কে একজন যেন। নাম দেখে তো বাঙালি বলেই মনে হয়। এতো বড় ইংরেজি বই লিখে বসে আছে! অপাঙ্গে সে দেখে নেয় ফিরোজ এখন একশ’ আটানব্বই পাতায় আছে।বারান্দার রেলিঙে এসে দাঁড়ায় সে। দেখে, দূরে বেশ নীচে ধীমান আর নাহিয়া। হাতে হাত ধরে লেকটার পাশ ঘেঁষে হাঁটছে। ওরা দুজনেই দুই ফিতার চপ্পল পরা। শর্টসের সাথে ধী পরেছে ফকফকে সাদা ফিনফিনে শার্ট। বুকের বোতাম বেশ কিছু দূর পর্যন্ত খোলা। বাতাসে সে জামা ফুলেফুলে ওঠে। নাহিয়ার হালকা কমলা রঙের পাতলা শেমিজ হাঁটুর উপর পর্যন্ত। দূর থেকে ওর পরিষ্কার পা দেখা যায়। দেখলে ঈর্ষা হয়। কী সুন্দর মসৃণ আর লম্বাটে পা জোড়া ওর! ধী কি যেন বলল আর অমনি নাহিয়া হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। একবার একটা পাথর পার হবার সময় প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো। ধীমান ঝট করে ওকে ধরে ফেলে। দীপ্তি দেখে, ওরা যেন থেমে কি কথা বলে কিছুক্ষণ। তারপর দেখে ধীমান দ্রুত ওর গায়ের শার্টটা খুলে ফেলেছে। এখন সে শুধু শর্টস পরে আছে। ওর আদুর সুঠাম শরীরের পেশীগুলো এখান থেকেও স্পষ্ট। সেদিকে তাকিয়ে দীপ্তির মাঝে মাঝে বিভ্রান্তি জাগে, ও কি সত্যিই তার ছেলে? কেমন তড়তড় করে বড় হয়ে গেলো!

এবার নাহিয়ার পালা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে এদিক সেদিক তাকায়। ওরা যেন অস্বস্তিতে না পড়ে, তাই দীপ্তি একটু আড়ালে চলে আসে। দেখে, নাহিয়াও তার গায়ের পাতলা শেমিজটা খুলে ফেলেছে। বিকেলের সূর্যের তির্যক কমলা আলো ওর শরীরে ঠিকরে পড়ে। তবে তা মুহূর্তের জন্যই। ঝপাৎ করে সে লাফিয়ে পড়ে পানিতে। যেন উদ্বেলিত সোনালি কোন মাছ এইমাত্র পানিতে ঝাঁপ দিলো। প্রায় সাথে সাথেই ধী-ও টারজানের মতো ডাইভ দেয়। ওদের কোন বন্ধুবান্ধবকে পাশে দেখা যায় নি। শুধুই ওরা দুজন। দীপ্তি দেখে সাঁতরাতে সাঁতরাতে ওরা আরও দূরে চলে যাচ্ছে। তারপর একসময় বাঁকের ওপাশে চলে যায়। ওদের আর দেখা যায় না।

একটু পিছিয়ে এসে আড় চোখে দেখে ফিরোজ এখনো একই পাতায় স্থির। তারমানে, সে মোটেই পড়ছে না। খুব ভালো করে তাকিয়ে দেখে সেও রেলিঙের ফাঁকে ওদের অপস্রিয়মাণ পথের দিকে তাকিয়ে আছে। কোথাও একটি নাম না জানা পাখি ডাকছে। ঘুঘুর ডাকের মতো সে আওয়াজ চারপাশকে আরও বেশি নিথর করে দেয়। পাশে বসতে বসতে কি যেন ভেবে সে একটা হাত ফিরোজের কাঁধে রাখে। ওর দিকে ফিরে ফিরোজ যেন নিজের মনেই ফিশফিশ করে বলে, ‘আমাদের হাইফেনটা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে’।

(শেষ)


আগের পর্ব গুলো পড়তেঃ

১। পর্ব- ১ঃ Click This Link
২। পর্ব- ২ঃ Click This Link
৩। পর্ব-৩ঃ Click This Link

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই জুন, ২০১৬ রাত ১১:২৬

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: কি সুন্দর ভাবে বলেছেন! এই জিনিসটার মুখোমুখি হয়েছি অনেক বার। অনেক বার দেখেছি বিদেশের মাটিতে বড় হওয়া তৃতীয় প্রজন্ম জড়িয়ে গেছে পাকিস্তানি কারও সাথে; তারা নিজেরা কিছু জানে না ইতিহাসের অবস্থান নিয়ে- কিন্তু তাঁদের বাবা-মা আমরা যারা বাংলাদেশি আছি তাঁদের পক্ষে এটা কল্পনা করাও সম্ভব হয় না, স্বাভাবিকভাবেই। সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্ব। বিভেদ। বাচ্চাগুলো একসময় পরিবার থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে ঝামেলা থেকে বাঁচতে চায়; কিন্তু রক্ত একবার যখন জানান দিয়ে ফেলে তাঁর জায়গার কথা- তখন কিছুতেই কিছু হয় না। টেকে না সে সম্পর্ক।

বিদেশে যারা সেটল হয়েছেন/হচ্ছেন/হবেন- আমি মনে করি তাঁদের উচিত বাচ্চাকে ইতিহাস নিয়ে টনটনে জ্ঞান দিয়ে রাখা।

২| ০৭ ই জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৩১

আসাদুজ্জামান পাভেল বলেছেন: আপনাকে ধন্যবাদ প্রফেসর শঙ্কু।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.