![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
‘জ্যামে পড়লে মানুষ কেন যে বিরক্ত হয়। আমার কিন্ত ভালই লাগে।’
কথা শুনে রাগে পিত্তি জ্বলে গেল আমার। বক্তা আমার পাশের সীটের ভদ্রলোক। এপ্রিলের প্রচন্ড গরমে ট্রাফিক জ্যামে আটকে আছি। বাসে চড়েছি মিরপুর থেকে যাব মতিঝিলে।এখন আছি ফার্মগেটে।এতটুকু আসতেই প্রায় ৪৫ মিনিট পার হয়ে গেছে। এখানে আটকে আছি মনে হচ্ছে ঘন্টা খানেক। আসলে ৫ মিনিট ও হয়নি। গরমে পুরো শরীর ঘেমে গেছে এবং নানান বিশ্রী জায়গায় চুলকাচ্ছে। কিন্ত চুলকাতে পারছিনা। কারণ এই ব্যাটা ভালোই মোটা। নিজেরটা ছাড়াও আমার সীটেরও খানিকটা দখল করে ফেলেছে।এর মধ্যে এই কথা শুনলে কার ভাল লাগে?
মনে মনে বললাম, ‘ ব্যাটা তোর ভাল লাগে, তুই সারা জীবন জ্যামে বসে থাক, আমি থাকতে পারব না,আমার ভাল লাগেনা।’
কিন্তু মুখে কিছুই না বলে আমি তার দিকে শুধু তাকালাম।
-‘জ্যামের মধ্যেও মজা আছে বুঝলেন!’
‘তোর মজা তুই খা’ মনে মনে বলি।
-‘এই জ্যাম নিয়েই আমার লাইফের সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটেছিল। শুনবেন?’
বলে লোকটা হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকালো। আমি হতাশ ভঙ্গিতে তার দিকে তাকালাম, কোন কথা বললাম না।
-‘আরে শোনেন, ইন্টারেস্টিং কাহিনী।’
লোকটা আমার বিরক্তি সম্পূর্ন উপেক্ষা করে নিজে থেকেই বলতে লাগল-
“চিটাগাং থেকে ঢাকা ফিরতেছি, বুঝলেন। তখন আর সবার মত আমিও জ্যামকে অপছন্দ করি। মীরেরসরাইয়ের কাছে এসেই পড়লাম জ্যামে, বাস আর নড়ে চড়ে না । বসে থাকতে থাকতে পায়ে ঝিঝি লেগে গেছে। বাসওয়ালা মাঝে মাঝে রাস্তা থেকে নামিয়ে পাশের কাচা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এখন তাও বন্ধ। হঠাৎ যেন অনন্ত কাল পরে জ্যাম ছুটলো।কিন্ত মিনিট পাচেক না যেতেই আবার আগের মত অবস্থা। ড্রাইভার আবার বাস রাস্তা থেকে নামিয়ে কাচা রাস্তায় ছোটালো। শুকনো দিন , ভয়ানক ধুলো রাস্তায় । ধুলোর মেঘ পেরোতে পেরোতে বাস হঠাৎ ঘ্যাচাং করে ব্রেক করে থেমে গেল। আর হঠাৎ একটা আইসক্রীমের কাঠি জানালা দিয়ে আমার গায়ে এসে পড়ল। কাঠিতে তখনো আইসক্রীম লেগে আছে। আমার অফ হোয়াইট শার্টে চকলেট বাটিক প্রিন্ট হয়ে গেল। ভয়ানক রেগে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি পাশের বাসের জানালায় আরেকটা মেয়ে, যেন কিছুই করিনি, এমন ভাবে তাকিয়ে আছে।
- এই যে ম্যাডাম, এই?
মেয়েটা ভুরু কুচকে তাকালো শুধু একটু।
- চোখে দেখেন না? ভদ্রতা নাই? আইসক্রীমের কাঠি কোথায় ফেলেছেন?
- একটু অবাক হয়ে মেয়েটা বলল, কেন? রাস্তায়?
- রাস্তায়, এইটা রাস্তা? বলে আমার শার্টটা উচু করে ধরলাম। আমি ভাবলাম হয়তো সরি বলবে, কিন্ত মেয়েটা সমান রেগে আমাকে বলল,
- আমার কি দোষ, আমি রাস্তায় ফেলেছিলাম। আপনার বাস এসে পড়বে তা জানতো কে?
আমি নিস্ফল আক্রোশে এক হাতেই আইসক্রীমের কাঠিটা ভেঙ্গে মুচড়ে বাইরে ফেলে দিলাম। মেয়েটার গালে ঠাস করে একটা চড় মারতে পারলে শান্তি হত। শক্ত একটা চড় যাতে চাপার দু-চারটা দাত নড়ে যায়। তাহলে আর আইসক্রীম খাওয়া লাগতো না। চাপায় চেপে ধরে ব্যথা কমানো লাগতো। মেয়েটা কিভাবে শায়েস্তা করব ভাবছি তখনি আবার জ্যাম ছুটে গেল। পাশের গাড়িটা চলে গেল। আমাদের বেকুব ড্রাইভার গাড়ি রাস্তায় আর উঠাতে পারেনি। তাই আমরা সেখানেই আটকে রইলাম। লোকজন গালাগাল শুরু করল। তাতে আর কি হবে? জ্যাম তো আর ছুটছে না। এরপর গাড়ি একটু এগোয় আর থামে। এভাবে করতে করতে জ্যাম একসময় কমল। মোটামুটি বেশ কিছুদুর বাস ভালোই চলল। কিন্ত কুমিল্লার কাছে এসে আবার ঘ্যাচাং। এবং এবার মিসাইলের মত একটা আমড়ার বিচি আমার দিকে ছুটে এলো। তাকিয়ে দেখি পাশের বাসে, আর সেই মেয়েটিই। এবার আমড়া খেয়ে ছুড়ে মেরেছে। ফুরফুরে বাতাসে মেজাজটা একটু ঠান্ডা হয়েছিল। আবার তাতে আগুন ধরে গেল।জানালা দিয়ে গলা বের করে চিৎকার দিলাম।
- ‘এই মেয়ে এই। চোখের মাথা খাইছ নাকি? একবার আইসক্রীমের কাঠি মারলা, এই বার আমড়া। আমি কি ডাষ্টবিন নাকি?’
আমার চিৎকারে বিন্দুমাত্র না ঘাবড়ে মেয়েটা বলল,
-‘ দ্যাখেন এবারও আমার দোষ ছিল না। দোষ আপনার বাসের। যখনই আমার কিছু কিছু ফেলার হয় তখনই আমার পাশে এসে দাড়ায়। আমারতো মনে হচ্ছে আপনিই আমার ফেলে দেয়া জিনিস নিতে আমার পাশে ঘুরছেন।আর কিছু লাগবে? একটু দাড়ান চিপস আছে। খেয়ে প্যাকেটটা দিচ্ছি।’
-আমার সাথে ইয়ার্কি কর? থাপড়ায়ে দাঁত ফেলে দেব।
-আরে, আমি কি করলাম।
আমি সমস্ত রাগ দিয়ে আমড়ার বিচিটাকে আছাড় দিয়ে, শব্দ করে জানালা বন্ধ করে বসে পড়লাম। আমড়া খওয়া! ঘুষি দিয়ে যদি আমড়া খাওয়া দাতগুলো ফেলে দিতে পারতাম। আবারও মেয়েটাকে বাচিয়ে জ্যাম ছেড়ে গেল।
একটু জিরোয় ফের ছুটে যায়, এভাবে করে করে বাস চলতে লাগল। আমার বাসের পাশে কোন বাস আসলেই জানালা টেনে দেই। যথারীতি নিয়ম মেনে বাস কাঁচপুর ব্রীজের এখানে আবার দাড়িয়ে গেল। ডানে তাকিয়ে দেখি সেই বাসটা। মেয়েটা কোক খাচ্ছে নির্ঘাত বোতলটা ছুড়ে মারবে। আমি দ্রুত জানালাটা টেনে দিলাম।
যা ভেবেছিলাম তাই, মেয়েটা কোক খেয়ে বোতলটা ছুড়ে মারতে গেল। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করল যে পাশে বাস। তাই আস্তে বোতলটা ফিরিয়ে নিল। তারপর আমার দিকে চেয়ে একটা ফিচলে মার্কা হাসি দিল।
- ‘আবার আপনি। বোতলটা নেবেন? ছুড়ে মারব না। এমনিই দেব। নিন।’
বলে বোতলটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল।
আমি আগুন চোখে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলাম।
মেয়েটা শব্দ করে হেসে উঠল। আর আমি দাঁত কিড়মিড় করতে লাগলাম। এদিকে গরম লাগছে কিন্তু জানালা খুলতে পারছি না।
বাসটা কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিলে হাফ ছেড়ে বাচলাম।
বাকি রাস্তা একটাই প্রার্থনা করলাম, যেন আর মেয়েটার সাথে দ্যাখা না হয়।
আল্লাহ কথা শুনলেন, আর মেয়েটার সাথে দ্যাখা হয় নি।”
এতটুক বলে লোকটা একটু থামল। একটা মন্তব্যের আশায় ভ্রু উচিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি তখনো বিরক্ত কারণ বাস তখনো ছাড়েনি। তাই কিছু না বলে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। লোকটা তা না দ্যাখার ভান করে আবার শুরু করল।
“ আরে ভাই, কাহিনীতো শেষ না, কাহিনী মাত্র শুরু---
ঢাকায় আসার সপ্তাখানেক পর কি কাজ এয়ারপোর্ট গেছি। ফিরতে পথে মহাখালীর জ্যামে পড়লাম। ভয়াবহ গরমে জান হাসফাস। বাতাসের আশায় মাথা জানালা দিয়ে বাড়িয়ে আছি। কিন্তু তাতে বাগড়া দিয়ে পাশেই একটা বাস থামল। আমি হতাশ হয়ে মাথা ঘুরিয়ে নিচ্ছি। এমন সময় ডাক শুনলাম-
-‘এই যে, - এই যে’
বাইরে তাকিয়ে দেখি সেদিনকার সেই মেয়েটা। দেখে বিরক্তিটা আরো বাড়ল। অভদ্রতা হবে বলে মাথা ঘুরিয়ে নিলাম না।
- ‘আমাকে চিনেছেন? ওই যে চিটাগাং থেকে আসার পথে আপনাকে কতকিছু দিলাম।’ বলে হেসে দিল মেয়েটা।
এবার আর আমি থাকতে পারলাম না। চোখ ঘুরিয়েই নিলাম।
“হ্যালো.......................................”
আমি অনড়। এমন সময় কন্ট্রাকটর ভাড়া নিতে আসায় ওদিক ব্যস্ত হয়ে গেলাম আর এই ফাকে বাসটা একটু এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর আবার বাসটা পাশে এল। এবার অবশ্য মেয়েটা কিছু বলল না। শুধু মিটি মিটি হাসতে লাগল। এভাবে কিছুদুর যেতেই আবার বাস থামে। পাশের বাসটা আসে। আর মেয়েটার দিকে চোখ গেলেই সে হাসে। যাই বলেন ভাই, মেয়েটার হাসি কিন্তু সুন্দর। তাই হয়তো মনে রাগ হলেও বার বার তাকাচ্ছিলাম। কিছুদুর পর দুই বাস দুই দিকে চলে গেল। ব্যাপারটা ভুলেই গেছিলাম। কিন্তু উপর ওয়ালা ব্যাপারটা অন্যভাবে লিখে রেখেছিল। কয়েকদিন পর আবার দ্যাখা হল মেয়েটার সাথে।
কোথায় বলেনতো? লোকটার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি-”
- ‘ট্রাফিক জ্যামে?’ বলি আমি।
“- একদম ঠিক। এইবার আর পাশের বাসে না। একই বাসে। নিউমার্কেটের সামনে এবার বাস। এবার অবশ্য আমি জানালার পাশে না। ভিতরের দিকে। হঠাৎ এক বয়স্ক মহিলা ঠেলেঠুলে উঠে পড়ল। হাতে কিছু ব্যাগ। ফলে বাসের স্ট্যান্ড ও ধরতে পারছিল না। আমি সিটটা ছেড়ে তাকে জায়গা দিলাম। উঠে একটু পিছনে সরে দাড়ালাম। দেখি সামনের সিটেই সেই মেয়েটা বসা। আমাকে দেখে বলল......
- আপনিতো আসলে ভালো লোক। কিন্তু এত রাগী কেন?
- আমি ভাল লোক আপনাকে কে বলল?
- এই যে, কি সুন্দর মহিলাটাকে বসতে দিলেন। আপনি না দিলে আমাকে উঠে দাড়াতে হতো।
- এতেই আমি ভালো?
- হুম, কিন্তু মনে হচ্ছে খুব রাগী। আচ্ছা, ওই দিন যা হয়েছে তাতো আমার অনিচ্ছাকৃত ছিল।
তার জন্য এখনো রাগ করে থাকতে হয়? আপনার শার্টের আইসক্রীমের দাগ ওঠেনি?
- না তা না, আসলে আমি যখন রেগে থাকি বা বিরক্ত থাকি, তখনই আপনার সাথে আমার দ্যাখা হয়।
- এখন রেগে আছেন কেন?
- এই যে, ট্রাফিক জ্যাম।
- এটাতো প্রতিদিনকার রুটিন। এতোদিনে তো মানিয়ে যাওয়ার কথা।
- আমার ক্ষেত্রে মানায় নি।
বাস তখন চলা শুরু করেছে।
- এইতো বাস ছাড়ল। এখন নিশ্চয়ই একটু ঠান্ডা হবেন।
আমি কিছু না বলে একটু হাসলাম। এমন সময় মেয়েটার মোবাইলে কল এল।
‘এইতো চলে আসছি কাছে। আনছি আনছি।’ এই টাইপের কি কি কথা বলতে বলতে বাস সাইন্সল্যাব চলে এল। মেয়েটা ফোন কেটে দ্রুত উঠে দাড়িয়ে বলল, ‘আমি এখানে নামব আপনি বসেন। আর এত রাগবেন না। কেমন?’
বলে নেমে গেল।
এরপর থেকে কী যে হল ভাই। জ্যামে পড়লেই মেয়েটাকে আমি খুজি। কিন্তু এবার আর দ্যাখা নাই। প্রায় দুইমাস পর আবার তার দ্যাখা পেলাম। নীলক্ষেতের সামনে। যথারীতি আমি জ্যামে বসা। এমন সময় তাকে দেখলাম। আর একটা মেয়ের সাথে নীলক্ষেত ঢুকছে। আমি বসেছি ভিতরের দিকের সীটে। তারপরও পাশের যাত্রীর উপর দিয়ে গিয়ে জানালা দিয়ে ডাকার চেষ্টা করলাম। কি নামে ডাকব ভেবে না পেয়ে ‘এই’ বলেই চিৎকার দিলাম। কিন্তু শুনল না। আমি কি মনে করে বাস থেকে নেমে গেলাম। ওরা যে গলিতে ঢুকেছে সেদিক দিয়েই ঢুকলাম। বহুত খুজে না পেয়ে মেজাজ খিচড়ে বেরিয়ে এলাম। আবার বাসের টিকিট কেটে প্রায় ঘন্টাখানেক রোদ মাথায় লাইনে দাড়িয়ে থেকে তার পরে আবার বাসে উঠতে পারলাম। কিন্তু এবার আর সিট পেলাম না। সেই ভয়াবহ জ্যামে আর গরমে দাড়িয়ে থেকেই মিরপুর ফিরলাম। নিজেকে আমার আস্ত একটা ছাগল মনে হচ্ছিল। আর মেয়েটার চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিলাম। কিন্তু ওই যে বললাম, বিধাতার খেলা। আমি যেই মেয়েটাকে ভুলতে বসেছি, ওমনি আবার তার সাথে দেখা।
যথারিতী ট্রাফিক জ্যামে বাসে বসে আছি। হঠাৎ পেছনে শুনি কন্ট্রাকটরের সাথে এক মেয়ের চেচামেচি।
- ১৮ টাকা মানে, ১৬ টাকার ভাড়া ১৮ টাকা কেন রাখছেন।
- ভাড়া ১৮ ট্যাকাই।
- ১৮ টাকা না? কয় দিন এই রাস্তায় গাড়ি চালান? আমি প্রতিদিন এই রাস্তায় যাই আসি।
কন্ঠটা পরিচিত মনে হতে ঘুরে তাকালাম, দেখি সেই মেয়েটা। মেয়েটাও আমাকে খেয়াল করল। করে আমাকেই নালিশ করল।
- দেখছেন ১৬ টাকার ভাড়া ১৮ টাকা চাইছে। কিছু একটা বলেন।
আমি সাধারনত ভেজালকর যে কোন পরিস্থিতি এড়িয়ে চলি। এধরনের ক্ষেত্রে দুই এক টাকা এমনিই দিয়ে দেই। তাই মিন মিন করে বললাম।
- দুই টাকাই তো। দিয়ে দেন না।
- দুই টাকা মানে। দুই টাকা দুই টাকা করে ভাড়া কত হইছে দেখছেন? ১০ টাকা ছিল ভাড়া, এখন ১৮ টাকা। এই আপনাদের জন্যই ভাড়া বাড়ানোর সাহস পায় এরা। চাইতেই দিয়ে দেন। কিছু বলেন না আর লাফায় লাফায় ভাড়া বাড়ে।
কন্ট্রাকটর ততক্ষনে সরে গেছে। আমিও আত্মপক্ষ সমর্থন করতে যেতেই রাগটা পড়ল আমার উপর।
- ‘শুধু যেখানে সেখানে রাগ করতে পারেন। যারা দোষ করেনা তাদেও উপর ঠিকই রাগ ঝাড়তে পারেন। অথচ যেখানে দরকার সেখানে বিড়ালের মত মিউ করেন।’
আমি আর কিছু না বলে চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করলাম।
কিছুক্ষণ পর সাহস সঞ্চয় করে যেই কিছু একটা বলতে যাব অমনি বাস সাইন্সল্যাব চলে এল মেয়েটাও নেমে গেল।
এবারও কিছু জানা হলনা। কিন্তু এবার আমি জানতাম যে মেয়েটার সাথে আবার আমার দেখা হবে এবং এই ট্রাফিক জ্যামেই।”
বলে লোকটা থামল, কারণ কন্ট্রাকটর ভাড়া নিতে এসেছে। দুজনই ভাড়া দিলাম। ভাড়া দিয়ে লোকটার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। কারণ গল্পটা ভালই লাগছে । লোকটা মিটিমিট হাসল আমার দিকে তাকিয়ে, যেন জানতো যে এমনই হবে। লোকটা গল্পটা যদি বন্ধ করে দেয় এই ভয়ে আমি একটু হাসার চেষ্টা করলাম। যাই হোক লোকটা আমাকে হতাশ করল না। আবার বলা শুরু করল।
“দেখা হল, এবার বেশ দ্রুতই। মতিঝিলে অফিস শেষে বাসে উঠে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি টিকিটের লাইনে সে। লাইনটা আস্তে আস্তে বাসে ঢুকছে। ভয়ে ছিলাম, শেষ পর্যন্ত উঠতে পারবে কিনা। শেষ পর্যন্ত পারল। ভীড় ঠেলে আমার কাছে এসেই দাড়াল। আমি ডাক দিলাম।
- এই যে এই............
মেয়েটা তাকাল। কিছু বলল না। কিন্তু আমার দিকে এগিয়ে এল।
কাছে আসতেই আমি সিট ছেড়ে দিতে চাইলাম। কিন্তু মেয়েটা না করল।
- থাক থাক আমি বুড়ি না।
আমি হেসে দিলাম। বললাম,
- এর আগে আমি রাগ করেছিলাম, এইবার আপনি। কাটাকাটি।
মেয়েটাও হাসল। বলল,
- ঠিক আছে, কিন্তু সীট ছাড়তে হবে না। দাড়িয়ে আমার অভ্যাস আছে।
- ভালকথা আপনার নামটা আমি জানি না।
- নাম দিয়ে কি করবেন। হুম?
- কিছু না, আপনার সাথে এতবার দ্যাখা হল, তাই জানতে ইচ্ছা হল।
- হুমম, আমি শান্তা।
- নাম শুনে তো মনে হয় শান্ত একটা মেয়ে, কিন্তু আপনিতো মোটেও শান্ত না।
-সে কথা সবাই বলে। বাদ দেন, আপনার নাম কি?
আমি নাম বললাম। তারপর আর কি বলব ভেবে ভেবে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু মেয়েটাই কথা শুরু করল। নানা কথায় জানতে পারলাম। যে থাকে সাইন্সল্যাবে থাকে। মতিঝিলে চাকরি করে। বাড়ি চট্রগ্রাম। চাকরি করাটা অবশ্য ফ্যামিলি পছন্দ করে না। কিন্তু সে মনে করে যে এত পড়াশোনা করেও যদি কিছু না করেও ঘরে বসে থাকি , তাহলে আর পড়াশোনার কি দরকার ছিল। তার অফিসের ঠিকানাটা জেনে নিলাম। আমার অফিসের কাছেই। কথা বলতে বলতে সাইন্সল্যাব চলে এল বাস। এই প্রথম কোন দিন আমার জ্যাম শেষ হয়ে যাওয়ায় খারাপ লাগল।
পরেরদিন অফিস শেষ করে দ্রুত তড়িঘড়ি বাস কাউন্টারে চলে এলাম। যদি তার দেখা পাওয়া যায়। দুই ঘন্টা অপেক্ষা করলাম সেই রোদের মধ্যে, কিন্তু তার দ্যাখা নেই। মনে মনে নিজেকে বকছি, কেন গতকাল অফিস ছুটির টাইমটা জেনে রাখলাম না। শেষে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে বাসায় ফিরলাম।
বাসায় ফিরে হাজার বার শপথ করার পরও পরদিন আবার আগে আগে বাস কাউন্টারে চলে এলাম। আজকে ভাগ্য সুপ্রসন্ন। দেখি সে আসছে। আমি ডাকব ডাকব করতেই সে-ই আমাকে দেখে ফেলল।
- কি খবর, ভালো আছেন?
- হ্যা, আপনি ভালো?
- হুম, কি বাসে উঠবেন?
- হ্যা আপনার অফিস শেষ?
- হুম,
-প্রতিদিন এই টাইমেই ছুটি হয়?
-হ্যা,
-তাহলে কালকে কোথায় ছিলেন?
-কেন? কালকেও আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন নাকি?
আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। এমন সময় বাস এসে গেল।
-টিকিট করেছেন?
আমি মাথা নাড়ালাম।
-আরো বাস চলে আসছে তো?
আমি দৌড়ে কাউন্টারে গিয়ে দুটো টিকিট কাটলাম। ঘুরে দেখি সেও আমার পেছনে। বললাম, টিকিট আপনার টাও কাটছি।
-সেকী, কেন?
-আসেনতো, আরেকদিন আপনি আমারটা কেটে দিয়েন।
সেদিনও গল্পে গল্পে সময় পার হয়ে গেল। আগের দিন নাকি একটা বাজে আগে আগে অফিস থেকে ছুটি নিতে হয়েছিল। তাই আগেই চলে গিয়াছিল। পরের দিন বেরুতে লেট হয়ে গেল। কিন্তু দেখি সে-ই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। দ্যাখা হতেই হাতের দুটো টিকিট দেখিয়ে বলল,
- ‘সেই অপেক্ষা করে আছি,দুটো বাস চলে গেছে।’ আমি কাধ ঝাকালাম।
এরপর থেকে ব্যাপারটা রুটিন হয়ে গেল। যে আগে কাউন্টারে আগে সে টিকিট কেটে অপেক্ষা করে। তারপর একসাথে বাসায়। বিরুক্তিকর জ্যাম এখন আমার সবচে প্রিয় জিনিস। প্রদিদিন কামনা করি, জ্যামটা যেন আরো লম্বা হয়। আস্তে আস্তে কী যেন কি হয়ে গেল। সারাদিনের সমস্ত আগ্রহ ঘিরে থাকে ওই জ্যামটুকু। বাড়িতে ফিরেও অস্থির লাগতে লাগল। তখনও তার সাথে কথা বলতে মন চাইত। অবাক হয়ে ভাবতাম, কত কী অর্থহীন কথা যে আমরা বলতাম। তারপরও কথা শেষ হতো না। আরো বাকী রইত। কিন্তু এতদিনের পরও কখনো সাহস করে ফোন নাম্বার চাইতে পারিনি। ফলে ছুটির দিনগুলো, আগে যার জন্য আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, সেগুলো ক্রমেই অসহ্য হয়ে উঠল। বুঝলাম আমি তাকে ভালবেসে ফেলেছি। কিন্তু তাকে বলার ক্ষমতা ছিলনা, বললে যদি রাগ করে, যদি আমার সাথে আর বাসে না চড়ে। আমার সম্পর্কে তার অনূভুতিটাওতো আমার জানা নেই।
তখন বর্ষাকাল।
ছাতা না নিয়ে বের হওয়ায় হঠাৎ বৃষ্টিতে একদিন খুব ভিজলাম। পরদিন ভয়ানক ঠান্ডা লেগে গেল। চোখ টোখ লাল হয়ে আর কাশতে কাশতে একাকার। টানা সাতদিন হাসপাতালে। এর মধ্যেও শুধু তার কথাই মনে পড়ত।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে পরের দিনই অফিসে ছুটলাম। বাসার সবাই নিষেধ করেছিল। কিন্তু আরো অফিস কামাই হবে বলে ম্যানেজ করে এসেছি।
আর অফিসে অসুস্থতার কথা বলে আগেই ছুটি নিয়ে কাউন্টারে চলে আসলাম।
অপেক্ষা সহ্য হচ্ছিলনা। এদিকে আবার বুক টিপ টিপ করছিল।
হঠাৎ দেখি সে আসছে, কেমন চিন্তিত চেহারা। কাছে আসতেই ডাক দিলাম।
ঝাকি দিয়ে সে আমার দিকে তাকাল, তারপরই পুরো মুখোভঙ্গি বদলে গেল। মুহুর্তেই মুখ রাগে লাল হয়ে গেল। আমার দিকে ঝামটা মেরে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল।
আমি আবার ডাকলাম। কিন্তু শুনল না। টিকিট কেটে ঘুরে তাকাতেই দেখি চোখে পানি। সামনে দাড়াতেই চেচিয়ে উঠল।
- ‘সরেন সরেন সামনে থেকে’
আমি অনড়।
- কি সরেন না কেন?”
“আমিও যাব আপনার সাথে”
“আমার কারো সাথে যাওয়া লাগবে না। আমি একাই যেতে পারি।”
আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে থাকি।
অস্ফুটে বলি, “টিকিট কাটছি তো”
- ‘এতই যখন দরদ, কই ছিলেন গত সাতদিন? হ্যাঁ? গত সাতটা দিন দুই ঘন্টা আমি কাউন্টারে অপেক্ষা করতাম। আমি যে আপনার জন্য অপেক্ষা করব, আপনি তা জানতেন, জানতেন না?’
আমি মাথা নিচু করে বলি, হুম।”
- ‘তাহলে? আমার সাথে যেতে না হয় ভাল লাগতেছে না। তো সেটা জানালেই হতো। তাহলে আমার আর টেনশনও করা লাগে না। অপেক্ষাও করা লাগে না।’
- ‘অসুস্থ ছিলাম’
- ‘খুব ভাল, কিন্তু খবর দিতে কি সমস্যা ছিল? অজ্ঞান ছিলেন সাতদিন?’
- ‘কিভাবে দেব, আপনার নাম্বারটা তো আমি জানি না।’
- ‘কেন জানেন না? এতদিনের পরিচয়, আর আমার নাম্বার ওনার কাছে নেই।’
আমি বলতে চাইলাম যে, আমার টাও তো তোমার কাছে নেই। কিন্তু তখনই বাস চলে এল। ও বাস ধরতে ছুটল। আমি পিছনে যেতেই ঘুরে দাড়িয়ে বলল।
- খবরদার আপনি এই বাসে আসবেন না। আপনি উঠলে আমি নেমে যাব।
আমি আর কি করি দাড়িয়ে রইলাম। বাস চলে যেতেই তাকিয়ে দেখি চারপাশের লোকজন আমাকে দেখছে।
বাসায় গিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, কালকেই তাকে মনের কথাটা বলবো। যা আছে কপালে। রাত আর কাটে না। পরদিন সকালেই চলে এলাম সাইন্সল্যাব বাস কাউন্টারগুলোর সামনে।
হাতে একটা গোলাপ।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। দেখি সে আসছে।
হঠাৎ সামনে এসে দাড়ালাম। আমাকে দেখে হতচাকিত হয়ে গেল। কাপা গলায় বলল,
- ‘আপনি?’
আমি কিছু না বলে গোলাপটা বাড়িয়ে ধরলাম।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘এই গোলাপটার মানে কি?’
- ‘আমি জানি না।’
- ‘তাহলে আমাকে দিচ্ছেন কেন?’
- ‘তাও জানি না।’
- ‘না জানলে আমি নেব কেন?’
- ‘আমি দিচ্ছি তাই। আপনি এটা নিলে হয়তো একটা মানে হবে। না নিলে আর হবে না।’
নীচের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর হাত বাড়িয়ে গোলাপটপ নিল। তারপর বলল,
- ‘ফুলটা আমি নিলাম, এর মানে এখন আমাকে বলেন।’
আমি চুপ করে রইলাম।
- ‘আমার বাস চলে এসেছে, অর্থটা আমাকে বিকেলে জানাবেন।’
বলে চলে গেল।
এখন আমি পড়ে গেলাম বিপদে, কী জবাব দেব এখন, অফিসে সময় কাটল না। চলে এলাম কাউন্টারে। অবশেষে সে এল।
- ‘কি অর্থ বের হয়েছে? বলেন।’
আমি চুপ।
- ‘কি হল?’
- ‘অর্থ বের করতে পারিনি।’
- ‘আপনি একটা ইডিয়েট।’ বলে টিকিট কাটতে গেল, আমি ডাকলাম যে টিকিট কাটা হয়ে গেছে।
শুনে ঘুরে এসে বলল, ‘দেখি আপনার ফোনটা।’
ফোনটা দিলাম। একটা নাম্বার লিখে, ফোনটা হাতে ধরিয়ে দিল।
-‘আমি বললাম কার নাম্বার?’
- ‘জানি না।’
এমন সময় বাস এল। সে বাসে উঠতে চলে গেল। আমিও বাসে উঠলাম। কিন্তু দুজন বসলাম দুই জায়গায়, সারা রাস্তা একটা কথাও হলো না।
বাসায় ফিরে কি করব বুঝতেছিনা। একবার ফোনটা হাতে নেই, আবার রেখে দেই। শেষে ১২ টার দিকে দিলাম কল।
- ‘আস সালামু আলাইকুম। কে?’
- ‘আমি।’
ওপাশে নীরবতা ........অনেকক্ষন পর।
- ‘বলেন, চুপ করে আছেন কেন?’
- ‘কি বলব?’
- ‘আশ্চর্য, ফোন করছেন আপনি। আর কি বলবেন জানেন না?’
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, ‘ভাল আছ তুমি?’
- ‘এটা কোনো প্রশ্ন হল, এত গাধা কেন তুমি?’
ওর তুমি ডাক কানে মধু বর্ষন করল। বললাম,’সঙ্গদোষে।
- ‘মানে?’
- ‘আগে মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি ছিল, কিন্তু গত কয়েকমাসে একজনের সাথে থাকতে থাকতে সব কমে গেছে।’
- ‘কি? এই কথা, যাও, আর আমার সাথে থাকা লাগবে না।’
আমি হেসে দিলাম, ব্যাপারটা এত সহজে হয়ে যাবে ভাবিনি। পরদিন থেকে আমার রুটিনে চেঞ্জ এল। এখন প্রতিদিন সাইন্সল্যাবে অপেক্ষা করি। একসাথে যাই আর আসি। বিশ্বাস করবেন না ভাই, এই বাস-ই ছিল আমাদের ডেটিং প্লেস, আর ট্রাফিক জ্যাম ছিল সবচে প্রিয় সময়। দুজসেরই অফিস আছে। ফলে এর বাইরে সময় বের করা সম্ভব ছিল না।”
- ‘কেন ছুটির দিনে কি করতেন আপনারা, তখন তো বেড়াতে যেতে পারতেন।’ বহুক্ষণ পর আচমকা বলি আমি।
“- আরে বলবেন না ভাই, তার চেষ্টা কি আর করিনি। কিন্তু উপর ওয়ালা আমাদের ভাগ্যে এই খেলাটাই খেলছিলেন যে আর সম্ভব হয়নি। অনেকবার প্ল্যান করেছি কিন্তু প্রতিবারই কিছু না কিছু হয়েছে। একবার আমার অসুখ হয় তো আরেকবার ওদের বাসায় মেহমান আসে। একবার ও গেলো কিন্তু জ্যামে আটকে আমি গিয়ে পৌছাতেই পারলাম না। একবার মা অসুস্থ হয়ে পড়ল। এরকম হতে লাগ্ল প্রতিবার। বুঝলাম যে জ্যাম বাদে আর আমাদের একসাথে হওয়া সম্ভব না। মেনেও নিয়েছিলাম ব্যাপারটা। ভালই চলছিল সব। আহ! কি সেই দিনগুলো।”
-‘আপনি প্রেম করেছেন?’ আচমকা প্রশ্ন করেন আমাকে।”
আমি মাথা নাড়ি।
“-ধুর তাহলে বুঝবেন না।” বলে তিনি চুপ করে যান।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তারপর কি? আপনাদের প্রেম কি পরিনতিতে পৌছেছিল, নাকি ট্রাজেডি?
“-ট্রাজেডিয়াস হতে হতেও হয় নি। ওই যে জ্যাম। জ্যামই বাচিয়েছে। ভালই চলছিল আমাদের। কিন্তু এর মধ্যে ভিলেন হয়ে এল যথারীতি নায়িকার বাবা। তিনি মেয়ের বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন। এদিকে ও নিয়মিত তাড়া দেয় বাসায় বলে ফেলার জন্য। কিন্তু আমার সাহস হয় না। শেষে ও ঘোষনা করল, আমরা নিজেরাই বিয়ে করব। যুক্তি হিসাবে বলল, প্রেম করার কথা হয়তো আমি বলতে পারছি না। কিন্তু বিয়ে হয়ে গেলেই হয়তো বলতে পারব। আমি আমতা আমতা করে রাজী হলাম।
দুই দিন ডেট ঠিক হল, কিন্তু আমি ভয়ের চোটে যাইনি। কাজী অফিস পর্যন্ত গিয়ে পালিয়ে চলে এসেছি। তিন নাম্বারের বার ও বলল এবার ও ব্যাগ হাতে বেরুবে। আমি সাথে গেলে আমার সাথে আমার বাসায় যাবে। নাহয় সোজা চট্রগ্রামের বাসে উঠবে। ওর বাবা বলেছেন। এবার যদি ও না যায়, তাহলে নিজে নিয়ে যাবেন।
আমি আর কি করি, এবার তো যেতেই হবে। যা আছে কপালে ভেবে বের হলাম। কিন্তু এইবার জ্যাম আমাকে ফেলল বিপদে। পুরো তিনঘন্টা জ্যামে আটকে যখন কাজী অফিসে গেলাম, গিয়ে দেখি ও নেই। এতক্ষণ রাস্তায় এই সেই বলে ফোনে সালাম দিয়েছি। কিন্তু এখন ফোনও ধরছে না। অফিসের লোককে জিজ্ঞাসা করে জানলাম এই মাত্র একটা মেয়ে কতক্ষণ বসে থেকে চলে গেল। আমি দৌড়ে বের হলাম, ফোন দিচ্ছি কিন্তু ধরছে না। বোধহয় ভেবেছে এবারও আমি ফাকি দিয়েছি। আমি দৌড়ে কাছের বাস কাউন্টারের দিকে গেলাম। গিয়ে দেখি ও একটা বাসে উঠছে, পিছন থেকে ডাকলাম কিন্তু শোনেনি। আমি কাছে যাওয়ার আগেই বাস ছেড়ে দিল। সায়েদাবাদের বাস। চট্রগ্রাম চলে যাচ্ছে। মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছা হল। কাউন্টারে এখন আর বাসও নেই। সিএনজি বা আর কিছুও নেই। যাক একটা লোকাল বাস এল। দৌড়ে উঠলাম, কিন্তু কিছুদূর গিয়েই পড়লাম জ্যামে। বহু দিনের প্রিয় জ্যামের চৌদ্দগুষ্টি সহ গালাগাল শুরু করলাম। আর থাকতে পারলাম না। বাস থেকে নেমে দৌড়ে শুরু করলাম। হাটছি, দৌড়াচ্ছি আর ওই বাসটাকে খুজছি। বাসের পিছনে একটা ডলফিন আঁকা। হাটতে হাটতে কখন কাদতে কাদতে শুরু করেছি নিজেও জানি না। কাদছি আর মনে মনে দোয়া করছি। “ইয়া আল্লাহ এই জ্যামটাকে চিরস্থায়ী করে দাও। জীবনে আর কিছু চাই না। শুধু একবার ওর কাছে পৌছাতে দাও। মাঝে মাঝে একটু যখন জ্যাম ছাড়ে, আর আমার হৃদপিন্ডটা বন্ধ হয়ে আসতে চায়। বিশ্বাস করেন আর না করেন, আমি হেটে কমলাপুর পর্যন্ত চলে গেলাম, কিন্তু তার দেখা নাই। ফোন ধরছে না। আমার আর হাটার শক্তি ছিল না। কি করব বুঝতে না পেরে রাস্তার ধারে দাড়িয়ে কাদতে লাগলাম। শব্দ হচ্ছিল না, শুধু চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। এমন সময় সামনে একটা বাস এসে দাড়াল। মনে হল বাসটার জানালায় শান্তা। চোখ ঝাপসা থাকায় বুঝা যাচ্ছিলনা। চোখ মুছে ভাল করে দেখি আসলেই ও। আমি ব্যাকুল হয়ে ডাক দিলাম। ও চোখ তুলে তাকাল, দেখি ওর চোখেও পানি। ও কি একটা বলতে চাইল। কিন্তু বাসটা সাথে সাথে ছেড়ে দিল।
আমি দাড়িয়ে রইলাম। বাসটা ধরার মানসিক বা শারীরিক শক্তি কোনটাই আমার ছিল না।
কিন্তু বাসটা একটু গিয়েই থেমে পড়ল। দেখি শান্তা নামছে। আমি আবার কাদতে শুরু করলাম। এবার আনন্দের কান্না। কাছে এসে একটা ঘুষি দিয়ে বলল, ‘গাধা। আসতে এতক্ষণ লাগল। বাস জ্যামে পড়ে, আর আমি ভাবি তোমার দ্যাখা পাব। আর উনি এখানে দাড়িয়ে কান্নাকাটি করতেছে।’
খুব ইচ্ছে করছিল ওকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু আমি দাড়িয়েই রইলাম।
- ‘কি? এখানে দাড়িয়েই থাকবে?’
- ‘চলো যাই।’
- ‘কোথায়?’
- ‘কাজী অফিসে। এবার হেটে হেটে যাব।‘
- ‘যাব তার আগে আইসক্রিম কিনে দাও।’
- ‘এই শীতকালে কেউ আইসক্রীম খায়?’
- ‘খাব না, তোমার গায়ে মারব।’
আমি কথা না বাড়িয়ে আইসক্রীম কিনলাম। আর ও সত্যি সত্যি অইসক্রীমটা হাত দিয়ে চটকে আমার গায়ে ছুড়ে দিয়ে, সোজা হাটতে লাগল।
আমি দৌড়ে গিয়ে ওর হাত ধরলাম। ও আমার হাতটা আরো জোরে জড়িয়ে ধরল।”
বলে লোকটা ছখ বন্ধ করে ঝিম মেরে কিছুক্ষণ থেকে বলল, ‘এখন বলেন, জ্যামকে আমি পছন্দ করব কি করব না?’
বলে লোকটা আমার দিকে তাকাল। আমার চেহারার মুগ্ধতা লক্ষ করে সেই রহস্যময় মিটি মিটি হাসতে লাগল।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বিয়ে করে বাসায় ম্যানেজ করলেন কিভাবে?’
- ‘সেটাতো আরেক বিরাট কাহিনী। আজকে আর টাইম হবে না। বাস গুলিস্তান চলে আসছে, আমি নামব। আরেকদিন যদি দ্যাখা হয়, তবে বলব।’
বলে লোকটি নেমে গেল।”
লোকটার গল্পের ফাকে কখন এদ্দুর চলে এসেছি খেয়াল করিনি। গল্পের গল্পে সময়টা ভালই গেল। এখন আর জ্যাম এতটা বিরক্ত লাগছে না।
বাস গুলিস্তান থেকে ছেড়ে, আর একটু গিয়ে জ্যামে পড়ল। হঠাৎ পাশে একটা বাস এসে দাড়াল। আমি আগ্রহ নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। কিন্তু ভাগ্যে শিকে ছিড়ল না। দেখি এক মহিলা বমি করছে।
আমি শিউরে মুখ ফিরিয়ে নিলাম।
২| ০৮ ই জুন, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৫৪
ট্রাক বলেছেন: ধন্যবাদ
৩| ০৮ ই জুন, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:২৫
খেয়া ঘাট বলেছেন: ট্রাফিক জ্যাম নিয়ে এতো সুন্দর একটা গল্প লিখলেন। অপূর্ব। শেষটা অনেক সুন্দর হয়েছে।
০৯ ই জুন, ২০১৩ দুপুর ১২:১২
ট্রাক বলেছেন:
৪| ০৮ ই জুন, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৩১
বোকামন বলেছেন:
গল্পের গল্পে সময়টা ভালই গেল।
০৯ ই জুন, ২০১৩ দুপুর ১২:১২
ট্রাক বলেছেন:
৫| ০৮ ই জুন, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৪৯
রাতজাগাপাখি বলেছেন: গল্পটা সুন্দর। আপনাদের সবার জন্য শুভ কামনা। কিন্তু, আমার ভাই ট্রাফিক জ্যাম সহ্য হয়না। কোন নায়কের সাথে আমার এভাবে দেখা হবার চান্স নেই বলেই বোধ হয়, তবে একদন সহ্য করতে পারিনা আমি।
০৯ ই জুন, ২০১৩ দুপুর ১২:১৩
ট্রাক বলেছেন: দেখা হবার পর থেকে সহ্য হবে আশা করি
৬| ০৮ ই জুন, ২০১৩ রাত ৮:১০
সাদা মনের মানুষ বলেছেন: চমৎকার গল্প, গল্পের শেষাংটা যেন আরো বেশী চমৎকার ++++
০৯ ই জুন, ২০১৩ দুপুর ১২:১৪
ট্রাক বলেছেন: শেষ্টা আমার ও খুব পছন্দ
৭| ০৮ ই জুন, ২০১৩ রাত ৮:১৯
বাদশা নামদার বলেছেন: ইদানিং ব্লগে আবার ভাল ভাল লিখা আসতেছে ।ভাল লাগল।
০৯ ই জুন, ২০১৩ দুপুর ১২:১৫
ট্রাক বলেছেন:
৮| ০৮ ই জুন, ২০১৩ রাত ৯:৪৪
হাসান বৈদ্য বলেছেন: দারুণ
০৯ ই জুন, ২০১৩ দুপুর ১২:১৫
ট্রাক বলেছেন:
৯| ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:৪৪
অপ্রচলিত বলেছেন: খুবই চমৎকার। আপনার প্রত্যেকটি গল্পের মানই খুব ভালো। এমন অনন্যসাধারণ একটি কাহিনী উপহার দেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:১৬
ট্রাক বলেছেন: আমার লেখাগুলো কষ্ট করে পড়ার জন্য আপনার প্রতিও অনেক কৃতজ্ঞতা।
১০| ৩১ শে মার্চ, ২০১৪ রাত ৯:১৬
মহামহোপাধ্যায় বলেছেন: দারুণ !! দারুণ অনেক ভালো লাগলো। আপনি অনেক ভালো লিখেন।
৩০ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১০:৩০
ট্রাক বলেছেন: আপনিতো সব গল্পই পড়ে ফেলেছেন। সাথে থাকার জন্যে ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১|
০৮ ই জুন, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৩৯
মুদ্দাকির বলেছেন: দারুন,