নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাধারণ পরিবহন

চাপা মারাই আমার কাজ

ট্রাক

সমগ্র বাংলাদেশ আজ ৫টন। তার মধ্যে আমি একাই .১ টন।

ট্রাক › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ বিড়াল

১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ১:০৩

১।

‘তোমার ভাবিরে দেখতে গিয়াই প্রেমে পইড়া গেলাম, বুঝলা। বিয়া করার খুব বেশি ইচ্ছা ছিল না। আম্মার অনুরোধে মামা জোর কইরা ধইরা নিয়া গেল মাইয়া দেখাইতে। দেইখাতো আমি কাইত। এই মেয়েরেই বিয়া করুম। কিন্তু মেয়ে পক্ষ আমারে পছন্দ করে নাই। তখন ভালো চাকরিও করতাম না, চেহারাও অতো জাতের না। তাই ওরা না কইরা দিল। কিন্তু আমি তো শ্যাষ। এই মাইয়ারেই আমার বিয়া করন লাগব। সারা দিন তোমার ভাবির চেহারা মনে ভাসে। চান্স পাইলেই তোমার ভাবির বাড়ির সামনে গিয়া খারায় থাকি। এদিকে কাউরে লজ্জায় কইতেও পারি না। তারপরও একদিন মামারে কইয়া ফালাইলাম। মামা আরেকবার চেষ্টা করল কিন্তু কাম হইল না। আমি সব আশা ভরসা বাদ দিয়া আল্লহরে কাইন্দা কইলাম, আল্লাগো আমার ভালোবাসা তো মিথ্যা ছিল না, তো আমারে কেন কান্দাইলা? কয়দিন পর মামা একদিন ফোন দিয়া কয় ভাইগ্না জলদি আয় তর বিয়া। আমিতো পুরাই টাস্কি। দৌরাইয়া যাইয়া শুনি, ঐ মাইয়া মানে তোমার ভাবি নাকি তার বাপেরে কইসে যে বিয়া করলে সে আমারেই করব। আমারে দেইখা নাকি তার মনে হইসে আমার চে বেশি কেউ তারে ভালবাসতে পারব না। তার টাকা বা চেহারা কিছুই লাগব না। শুধু ভালোবাসা লাগব। তাই তার বাপ রাইগা কইসে আইজই তারে বিয়া দিয়া বিদায় করবো। ব্যস ঐদিনই আমাগো বিয়া হইয়া গেল।’

‘সবই ভালোবাসার খেল! ভালোবাসা সত্যি হইলে, সবই সম্ভব বুঝলা মিয়া’

মতিন ভাই, তার এবং তার বৌ, মানে ভাবির কোনো কাহিনী শুনিয়ে তারপর এই কথাটা বলেন সবসময়। রাত্রে ঘুমানোর আগে বিছনায় শুয়ে প্রায় প্রতিদিনই মতিন ভাই আর ভাবির ভালবাসার গল্প শোনে তারেক। মেসের এই রুমটাতে ওরা দুজনেই থাকে। তাই কোন সমস্যা হয় না।

গল্পগুলো শুনে অবশ্য তারেক লজ্জা পায়। লজ্জা, দয়া, মায়া এ ধরণের সব নরম গুণ তারেকের মধ্যে আছে। শুধু আছে না, একটু বেশিই আছে।

লজ্জা পাওয়ার আরেকটা কারণ হল, সে নিজেও প্রেমে পড়েছে। মতিন ভাই তা ধরতে পেরেছেন কিনা কে জানে? ও অবশ্য এখনো কাউকে কিছু বলেনি, কিন্তু ওরও কাউকে বলতে খুব ইচ্ছা করে কিন্তু আবার লজ্জা লাগে খুব। তাই বলা হয় না।

মতিন ভাইয়ের মত হঠাৎ প্রেম বা ওরকম কিছু না। নিশাতের সাথে ওর পরিচয় দুই বছরের উপরে। মাস কয়েক হল ওরা বুঝতে পেরেছে যে একজন অন্যজনকে কতটা ভালবাসে।

ওদের পরিচয়ের শুরুটা অবশ্য একেবারে নাটকীয়, মানে নাটকে যেভাবে হয় আরকি!

তারেক তখন সদ্য ঢাকা এসেছে। অ্যাডমিশন কোচিং করতে। থাকত ফার্মগেট তেজকুনি পাড়া।

বিকেলে প্রায়ই ঘুরতে যাওয়ার জায়গা ছিল তেজগাও রেলওয়ে স্টেশন। সেদিনও রেললাইনের ওপর দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে হাটার চেষ্টা করছিল। কাজটা সহজ না, চোখ ছিল পুরোপুরি লাইনের উপর। হঠাত মাথায় কিসের সাথে যেন গুতো খেয়ে ছিটকে পড়ল পাশে। মাথা ডলতে ডলতে উঠে দাঁড়িয়ে দ্যাখে একটা মেয়ে পড়ে আছে। মেয়েটাও সম্ভবত ওর মত একই কাজ করছিল। সে জন্যই এই সংঘর্ষ। মেয়েটার মাথা পড়েছে লাইনের ওপর, ফলে কেটে গেছে বেশ খানিকটা। রক্তও পড়ছে। দ্রুতই হতবুদ্ধি ভাবটা কাটিয়ে উঠে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেল সে। মেয়েটা নড়ছে না দেখে ভাবল অজ্ঞান হয়ে গেছে কিনা। কিন্তু হাত ধরে টানতে যেতেই মেয়েটা ওর হাত সরিয়ে দিল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমতা আমতা করে তারেক বলল,

‘দেখুন, রক্ত বের হচ্ছে। বন্ধ করা দরকার।’

মেয়েটা তাও কোনো কথা বলছে না দেখে তারেক নিজের হাত বাড়িয়ে দিল, ‘আপনি রেল লাইনের উপর পড়ে আছেন, ট্রেন আসতে পারে। এখান থেকে সরা দরকার।’

ব্যাথা চেপে মেয়েটা বলল, ‘আপনাকে লাগবে না। আপনি সরে যান।’

তারেক বুঝল, অ্যাকসিডেন্টের জন্য মেয়েটা তাকেই দায়ী মনে করছে। অথচ সমান দোষ মেয়েটারও। কিন্তু ও এটা নিয়ে তর্ক করতে গেল না, সরেও গেলো না।

মেয়েটা নিজেই বহু কষ্টে মাথা চেপে ধরে প্লাটফর্মের কোনায় উঠে এলো। মুখের ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে খুব ব্যাথা পেয়েছে। তারেক এগিয়ে গেলো। বলল,

‘আপনার খুব ব্লীডিং হচ্ছে, ওটা বন্ধ করা দরকার।’

মেয়েটা তাও চুপ।

‘আচ্ছা, মানছি যে দোষ আমার কিন্তু রক্ত তো আপনার পড়ছে। ওটাতো বন্ধ করুন।’ বলে নিজের রুমালটা এগিয়ে দেয়।

মেয়েটা কিছু না বললেও রুমালটা নেয়। কাটা জায়গাটা চেপে বসে থাকে। তারেক কি করবে ভেবে পায় না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে এরপর মেয়েটার থেকে একটু দূরে প্লাটফর্মের উপর পা ঝুলিয়ে বসে পড়ে। সেভাবে কিছুক্ষণ থাকার পরও দ্যাখে যে মেয়েটা সেভাবেই বসে আছে। মেয়েটার কষ্ট দেখে ওর নিজের খুব খারাপ লেগে ওঠে। কান্নাও পায় খানিকটা। ওর এই এক দোষ খুব সহজেই কান্না পেয়ে যায়। সেটাকে সামলে আবার এগিয়ে যায়।

‘আপনার বোধহয় খুব ব্যাথা করছে। চলুন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।’

মেয়েটা তাও চুপ। তারেক আবার বলে,

‘দেখুন যা ঘটে গেছে তা একটা অ্যাকসিডেন্ট। এর জন্য শুধু শুধু কষ্ট করছেন। একটা ডাক্তারের কাছে চলুন। অসুধ খেলেই ব্যাথা চলে যাবে।’

এবার মেয়েটা নড়তে চেষ্টা করে। বহু কষ্টে উঠে দাড়ায় কিন্তু সাথে সাথেই ঘুরে পড়ে যায়। তারেক দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ধরে। মেয়েটা ছাড়িয়ে নিতে গেলে তারেক কিছুটা খেপে যায়।

‘দেখুন জেদ অনেক করেছেন, আপনার পরিচিত কেউ নেই বলেই আমি আপনাকে ধরছি। কেউ থাকলে নিশ্চয়ই ধরতাম না। আর অ্যাকসিডেন্টের দায় পুরোটা আমাকে দিচ্ছেন কেনো? আপনি দেখে হাঁটলেতো আর এরকম হত না। খামোখা জেদ করে নিজের বারোটা বাজাচ্ছেন।’

এবার আর মেয়েটা কিছু বলল না। কাছেই একটা ডিসপেনসারি থেকে মাথায় স্টিচ লাগিয়ে দিল তারেক। দোকানদার ব্যাথার ওষুধ দিলে তখনই একটা খাইয়ে দিলো। তারেক মেয়েটাকে বাড়ি পৌছে দিতে চাইছিল কিন্তু মেয়েটা খুব করে না করায় আর কথা বাড়াল না।

ফলে, শুরুটা নাটকের মত হলেও শেষটা আর হলো না। নাম, ধাম ঠিকানা দূরে থাক মেয়েটা একটা ধন্যবাদ পর্‍যন্ত দিল না। তারেক অবশ্য তাতে কিছু মনে করেনি। ঝামেলা এড়ানো গেছে, তাতেই সে খুশি ছিল।



২।

‘বাসর ঘরে তোমার ভাবিরে জিগাইলাম, আমার তো টাকা পয়সা চেহারা সুরত কিছুই নাই। আমারে পছন্দ করলা কেন? এসব কিছু না থাকলেও, প্রথম দিনেই আপনার চোখে আমি ভালোবাসা দেখসিলাম। আমি আবার কইলাম, আমার যে অবস্থা তাতে আয়-উন্নতি কবে হইব, তা তো জানিনা। তোমারে সুখে রাখতে পারুম নাকি তা আল্লাহই জানে। তোমার ভাবি কয় ভালোবাসা দিতে পারবেন তো? আমি কইলাম পারমু। শুইনা হ্যায় কয়, তাইলেই চলবো। আপনে আমারে ভালোবাসেন শুধু এই কারণেই আপনেরেও ভালোবাসছি। ভালোবাসতে আর কিছু লাগব না। আমি কইলাম, বৌ তুমি আমারে যেমনে ভালোবাসছ, আমি কি তোমারে এত ভালোবাসা দিতে পারুম? তোমার ভাবি কইল, ওমা এইডা কী কোণ? আপনে আমারে যেইটুক ভালবাসেন, আমিও আপনেরে সেইটুকই ভালোবাসি। ভালোবাসা হইল দেওয়া নেওয়া। যেইটুক দিবেন সেইটুক ফেরত পাইবেন।’

‘কথা কিন্তু সত্য, ভালোবাসা সত্যি হইলে, সবই সম্ভব বুঝলা মিয়া। এই আমি মতিন মিয়া এতদূর আইসি খালি তোমার ভালবাসার জোরে।’

একটা সলজ্জ হাসি দেওয়া ছাড়া তারেক বেশি কিছু করে না সাধারণত। তবে ইদানীং মতিন ভাইয়ের গল্পের পর তারেক নিজেও মনে মনে নিজের ঘটনাগুলো মনে করার চেষ্টা করে।



নিশাতের সাথে ও’র দ্বিতীয়বার দেখা হয় প্রায় ছয় মাস পর।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ততদিনে তারেক ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। বায়োকেমিস্ট্রিতে। নিশাত মেডিকেলে এসেছিল ও’র এক আত্মীয়কে দেখতে আর তারেক গিয়েছিল অ্যাকসিডেন্ট করা এক রিকশাওয়ালাকে নিয়ে। ওর সামনে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। রিকশার যাত্রী মূহুর্তেই হাওয়া। আশেপাশের কেউও এগিয়ে এলো না। শেষমেশ তারেকই লোকটাকে এখানে নিয়ে এলো। ব্লিডিং হয়ে লোকটার অবস্থা খুব খারাপ তখন। ইমার্জেন্সী রক্ত দরকার। ডাক্তার রক্তের ব্যবস্থা করতে বলেই গায়েব হয়ে গেছে। ও রক্ত পায় কোথায়? তারপরও আশে পাশে জিজ্ঞেস করে সন্ধানীতে গিয়ে খবর নেয়। কিন্তু ওখানেও এই গ্রুপের রক্ত ঐ মূহুর্তে ছিল না। কিভাবে কি করবে ভেবে পায়না তারেক। আগে কখনো এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েনি। ঢাকায় ওর পরিচিত তেমন কেউ নেই। পুরাতন মেসের এক বড় ভাইকে ফোন দেয়। কিন্তু ব্যস্ত থাকায় উনিও আপাতত সাহায্য করতে পারবেন না বলেই জানান। হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভেবে কূল পায় না কি করবে সে? লোকটা কি মরে যাবে? লোকটার নিশ্চয়ই বৌ ছেলে মেয়ে আছে, তাদের কি হবে এই ভেবে মনের অজান্তেই কখন যে ও’র চোখ দিয়ে পানি ঝরা শুরু হয়েছে নিজেও জানে না। হঠাৎ চমক ভাঙ্গে কারো ডাকে।

- এই যে, কেমন আছেন? আমাকে চিনেছেন? কাঁদছেন কেন?

কাঁদার কথা শুনেই ও প্রথম বুঝতে পারে যে ও’র চোখে পানি। দ্রুত চোখ মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে ও। মেয়েটাকে প্রথম দর্শনে চিনতে পারেনি ঠিকমত। অবাক চোখে তাকিয়ে যখন মনে করার চেষ্টা করছে মেয়েটা কে, তখন মেয়েটাই বলে উঠল, জামার হাতা দিয়ে চোখ মুছছেন যে? অ্যাজ রুমাল নেই সাথে?

রুমালের কথা শুনেই সব মনে পড়লো। তারেক মনে মনে কিছুটা লজ্জিত হল। মেয়েটা তাকে মনে রেখেছে অথচ সে রাখেনি।

- কি ব্যাপার কথা বলেন না যে? আমাকে চিনতে পারেন নি?

- হ্যাঁ, পেরেছি।

- তো এমন ক্যবলাকান্তের মত দাঁড়িয়ে আছেন কেন? কাঁদছেন কেন বলুনতো? হাসপাতালে কেউ আছে? কারো কিছু হয়েছে?

মাথা ঝাকায় তারেক।

- কে আছে? অবস্থা খুব খারাপ?

- একটা লোক।

- একটা লোক? কি হয় আপনার?

- কিছু হয় না। রিকশাওয়ালা। অ্যাকসিডেন্ট করেছে। আমি হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। জরুরী রক্ত দরকার কিন্তু পাচ্ছি না।

- লোকজনের সাথে অ্যাকসিডেন্ট করে তাদের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন কাজ নেই আপনার?

- আমার সাথে অ্যাকসিডেন্ট হয়নি তো।

- না হলেও। আপনিই সম্ভবত কুফা। যাই হোক, রক্ত দরকার তো কাঁদছেন কেন? রক্ত জোগাড় করুন। তাহলেই তো হয়।

- চেষ্টা করেছি পাচ্ছি নাতো।

- সন্ধানীতে গিয়েছিলেন?

- হুম

- আপনার বন্ধু বান্ধব কাউকে বলে দেখেছেন?

- আসলে ঢাকায় নতুন আমি, আর ওরকম কেউ হয়নি এখনো। তাই কি করবো ভেবে পাচ্ছি না।

- হুম বুঝলাম। আচ্ছা দেখি আমি কিছু করতে পারি কিনা!

এরপর তারেকের আর কিছু করা লাগলো না। মেয়েটাই কোথায় কোথায় ফোন করে একজন ডোনার জোগাড় করে ফেললো। রক্তের ব্যবস্থা করে, রিকশাওয়ালাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকানোর পর ওরা আবার কথা বলার সুযোগ পেল।

- আপনি কেমন মানুষ বলেন তো? লোকটার এরকম সিরিয়াস কণ্ডিশন আর আপনি দাঁড়ায় দাঁড়ায় কাঁদতেছিলেন? আমি না দেখলে তো লোকটা মরেই যেত!

তারেক কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে থাকে। কিছু বলে না।

- ধূর! ক্যাবলাকান্তের মত দাঁড়ায় থাকা আর মানুষরে ঢুস দেওয়া ছাড়া আর কিছু পারেন না আপনি?

লজ্জা মাখা একটা হাসি দেয় তারেক। তা দেখে মেয়েটা আরও ক্ষেপে যায়।

- দ্যাখেন, ন্যাকামো করবেন না। ছেলেদের ন্যাকামো অসহ্য জিনিস। আমার হাতে আর সময় নেই, আমি আর থাকতে পারব না। লোকটাকে বের করলে ওষুধপাতি কিনে আনতে পারবেন তো? নাকি আবার কান্নাকাটি করবেন?

- না, না, পারব।

- গুড। লোকটার জ্ঞান ফিরলে আপনার কাজ কি হবে বলেন তো?

তারেক মাথা চুলকায় কিন্তু কিছু ভেবে করতে পারে না। আসলেইতো, লোকটার জ্ঞান ফিরলে সে কি করবে? মেয়েটাই মুখ খোলে,

- থাক, মাথার চুল ছিড়তে হবে না। জ্ঞান ফিরলে লোকটার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে ওনার আত্মীয় স্বজনদের খবর দেবেন। ঠিক আছে?

- ঠিক আছে।

- আর শোনেন, আর কোন ঝামেলায় পড়লে প্রয়োজনে আমাকে একটা খবর দিয়েন কিন্তু নো মোর কান্নাকাটি। ওকে?

- আচ্ছা।

- আচ্ছা যে বললেন, কিন্তু খবর দেবেন কিভাবে?

তারেকের আবার মাথা চুলকানি শুরু হয়। হতাশার একটা ভঙ্গি করে মেয়েটা বলে

- মোবাইল নাই আপনার?

- আছে, আছে।

- নাম্বার নিন আমার।

দ্রুত মোবাইল বের করে নাম্বারটা লেখে তারেক।

- মিসকল দিন আমাকে একটা। মেয়েটা বলে।

রিং বাজতেই বলল, হুম এসেছে। আচ্ছা নাম কি আপনার? আশ্চর্‍য ব্যাপার, এতক্ষণ কথা বলছি কিন্তু কেউ কারো নাম জানিনি।

- আমি তারেক।

- আমি নিশাত। ওকে আজ আসি।



৩।

‘তোমার ভাবির জন্য যখন দিওয়ানা আমি, তখন তোমার ভাবির মোবাইল ছিল না। হ্যার বদরাগী বাপ তারে ঘরের বাইরেও বাইরাইতে দিত না। আমিতো যখন তখন হ্যাগো বাড়ীর সামনে গিয়া খারায় থাকি। দোতলায় বাসা, যদি বারান্দায় এট্টু আয়। কিন্তু বাপের জ্বালায় মাইয়া তাও করবার পারে না। কত কতা কইতে মন চায় কেমনে যে কই। শেষমেশ লেকলাম একটা চিডি। চিডিডা যে পরের দিন দিমু সেই তর সইল না। আইজই দিতে হইব। গেলাম হ্যাগো বাড়ীর সামনে। বহুক্ষন খারায় থাকলাম, কিন্তু দেখা নাই।। শেষে আর থাকতে না পাইরা চিডিডারে ইটা দিয়া প্যাচাইয়া মারলাম বারান্দা সই। যেই মারসি ওমনি দেখি হ্যার বাপ বাইরাইতাসে। পিছ হেও আছে। আমি তো লাফ মাইরা রাস্তার পাশে পলাইসি।। এদিকে চিডিডা সোজা ব্যাডার চান্দি বরাবর যাইতাসে, আমি দোয়া কালাম পড়া শুরু করসি। কিন্তু কি কামে ব্যাডা মাথাডা নিচা করসে আর চিডিডা উইড়া সোজা তোমার ভাবির হাতে। সেই চিডি পইরাই নাকি তোমার ভাবি আমার প্রেমে পড়ছিল’

তারেকের অবাক চোখে তাকিয়ে ভ্রূ উচিয়ে মতিন ভাই বলেন, ‘ভালোবাসা সত্যি হইলে, সবই সম্ভব বুঝলা মিয়া’

ইদানীং কালের মত তারেকের আবারো লজ্জা লাগলো।

ভাগ্যিস ওদের মধ্যে মোবাইলেই কথা চালানো যায়। নইলে এত হ্যাপা কে সামলাত?



প্রথম ফোনটা কে করেছিল মনে করার চেষ্টা করে তারেক। যদিও তারেকেরই করার কথা ছিল কিন্তু নিশাতই প্রথম কলটা দেয়। রিকশাওয়ালা ব্যাটার জ্ঞান ফিরেছে কিনা আর তার আত্মীয় স্বজনদের খবর দেয়া হয়েছে কিনা তা জানতে। সবই ঠিকমতই করা হয়েছিল।

তারেক প্রথম নিশাতকে কল দেয় এর দুই সপ্তাহ পর। মিছিমিছি না দরকারেই। ঐ রিকশাওয়ালা সুস্থ হয়ে গেলে তারেকই তাকে বাড়ী পৌঁছে দেয়। অবশ্য তার একটা পা কেটে ফেলতে হয়েছে। কমলাপুর বস্তিতে তার বাসা। সব কিছু ঠিকই ছিল কিন্তু বাড়ী পৌঁছার পর তারেককে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দেয় সে। এখন কিভাবে তার সংসার চালাবে সেই ভাবনায় কান্নাকাটি। তারেক কি বলবে ভেবে পায় না। সে নিজে চলে টিউশনি করে। তারপরও সে দেখবে কিছু করা যায় কিনা, এটা বলে বিদায় নেয়।

বলে তো আসল কিন্তু ঢাকা শহরে খোড়া লোকদের জন্য কি ধরনের কাজ পাওয়া যায় তার জানা নাই। সে সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করতেই তার নিশাতকে ফোন করা।

সব শুনে ও অবশ্য খানিকটা ক্ষেপে গিয়েছিল। বলেছিল, আরে আপনি কি আমাকে সমাজসেবী পাইসেন নাকি? মানুষের সেবা করার এতো শখ তো নিজে করেন। আমারে টানাটানি কেন? আমি এসব ঝামেলার মধ্যে নাই।’ মুখে এটা বললেও, পরেরদিন ও-ই তারেককে ফোন করে দেখা করতে বলে। তারপর দুজনে মিলে একটা এন.জি.ওতে গিয়ে লোকটার বৌএর জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ এর ব্যবস্থা করে দেয়। এভাবে আপাতত চলতে বলে। কিছু কিছু সঞ্চয় করে পরে একটা পান বিড়ির দোকান দিয়ে নিতে বলে, এতে খোড়া হওয়াতেও লোকটার কোন সমস্যা হবে না।

নিশাতের যে কোন সমস্যার সহজ সমাধান বের করার দক্ষতা তারেককে মুগ্ধ করে। সে সমস্যায় পড়লে সব গুলিয়ে যায়, পরিষ্কার চিন্তা করতে পারে না।

এটা শুনে নিশাত বলে, হুম, বিপদে পড়লে আপনি কানতে পারেন ভালই। কিন্তু কানলে লাভ হয়? চিন্তা করে সমাধান বের করতে হয়।

তারেক চুপচাপ সায় দেয় কারণ এটাই সত্য।

এরপর আবার দুই সপ্তাহের বিরতি। এবার ফোন দেয় নিশাত।

- কি ব্যাপার আপনি নতুন কাউরে ঢুস দিয়ে মাথা বা ঠ্যাং ফাটান নাই?

- কি যে বলেন, আমি কি শুধু এসব করে বেড়াই? ওটা তো একটা অ্যাকসিডেন্ট ছিল।

- জ্বি না। আপনি একটা কুফা। তা বহুদিন আপনার কোন খোজ নাই। আমার কথা মনে আছে?

- কি যে বলেন? কেন থাকবে না?

- না, কারো ঠ্যাং ভেঙ্গে সাহায্যের দরকার না হলে তো আবার আমাকে মনে পড়ে না।

- আরে না না, সেরকম কিছু না। মনে তো পড়ে। কিন্তু ফোন করার সাহস করতে পারিনি।

- কেন? আমি কি ডাইনীর মত? আপনাকে খামচি দিয়েছি? আপনিই তো আমার মাথা ফাটিয়েছিলেন।

- না, সেরকম কিছু না। যদি আপনি কিছু মনে করেন। সে জন্য।

- ওরে বাবা, একসাথে ঘোরাঘুরি করে কত কিছু করলাম। এখনো আপনি ভাবছেন আমি কিছু মনে করব?

এভাবেই শুরু কথা বলা। জানা যায় নিশাতও ঢাকা ভার্সিটিতেই পড়ে। এরপর ক্যাম্পাসেও দেখা হয়। ধীরে ধীরে তারেকের জড়তাও কেটে যায়। তারেকের অসম্ভব কোমল মন আর নিশাতের অতিরিক্ত জেদী মেজাজ দুটো বিপরীতমুখী হলেও, বিপরীত মেরুতেইতো আকর্ষণ হয়। নিশাতের জেদ মেটানোর জন্য একজনের দরকার ছিল আর তারেকের প্রয়োজন ছিল এমন একজন যে তার দায়িত্ব নিয়ে তাকে সব সমস্যা থেকে উদ্ধার করবে। ফলে খুব ভালো দুজন বন্ধু হতে তাদের সময় লাগলো না।

ঐ রিকশাওয়ালাটাকে সাহায্য করার পর থেকে মানুষকে সাহায্য করা ওদের একটা নেশা হয়ে গেছিল। নিশাত সাহায্য করার মত অসহায় কাউকে পেলেই তারেককে ফোন দিত,

- তোমার জড়ায় ধরে কান্দার জন্য একটা মানুষ জোগাড় করসি। তাড়াতাড়ি চলে আসো।

তারেকও ছুটে যেত। ধীরে ধীরে ক্লাসের শেষে আড্ডাবাজি, ফুচকা, আইসক্রিম কিংবা ঘোরাঘুরি সবকিছুতেই একজন আরেকজনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেল। এভাবেই একসময় ওরা বুঝতে পারল শুধু এসব নয়, কখন যে ওরা পরস্পরের জীবনেরই অংশ হয়ে গেছে তা ওরা জানে না। শুধু এটা জানে যে, ওদের ভালোবাসা দিয়ে ওরা পৃথিবী জয় করতে পারবে।



৪।

‘বিয়ার পর তোমার ভাবিরে নিয়া ঢাকায় আইসি বেরাইতে। ঘোরাঘুরি করতে করতে গেলাম বসুন্ধরায়। হ্যায় একটা শাড়ি পছন্দ কইরা ফালাইসে দশ হাজার ট্যাকা দাম। তখন মাসে দশ হাজার টাকা কামাইও করি না। পকেটে তখন আছে মাত্র পনেরশ টাকা। কি আর করি! তোমার ভাবি আমার মুখ দেইখা বুইঝা ফালাইসে, তাই মুখে লাগব না কইয়া উইঠা গেল। কিন্তু আমি তো বুঝসি যে তার মন আসলেই খারাপ হইসে। কি আর করি সন্ধ্যায় তারে বাসায় রাইখা নিজেই বাইর হইলাম। নিউ মার্কেটেত্তে পকেটে যা ছিল, সব দিয়া কিনলাম একটা শাড়ি। তোমার ভাবি যে সেই শাড়ি পাইয়া কি খুশি। আমারে কয় ঐ বসুন্ধরার শাড়িটা কিনা দিলেও নাকি এত খুশি হইত না। এরপর তারে দশ হাজার টাকার শাড়িও কিনা দিসি কিন্তু তার নাকি এখনও সেই শাড়িটাই সবচে প্রিয়। এহনও যে কোন অনুষ্ঠানে সে ঐ শাড়িটাই পরে।’

বলতে বলতে মতিন ভাইয়ের চোখ স্বপ্নালু হয়ে ওঠে, যেন সেই শাড়িটা পড়া অবস্থায় ভাবিকে দেখতে পাচ্ছেন। এরপর-ই আসে তার প্রিয় ডায়লগ, ‘ভালবাসা সত্যি হইলে, সবই সম্ভব বুঝলা মিয়া।’

গিফট দেওয়ার কথায় তারেকের মনে পড়ে নিশাত তার জন্মদিনে ও’র কাছে একটা বিড়াল চেয়েছে। ধবধবে সাদা রঙের নীল চোখের একটা বিড়াল।

এই একটা জিনিসের প্রতি নিশাতের অসম্ভব ফ্যাসিনেশন। বিড়াল ও’র অসম্ভব প্রিয়। বাসায় ও’র একটা বিড়াল ছিল। নাম সুজি। বিড়ালটা চব্বিশ ঘণ্টা ও’র সাথে সাথে থাকত। দিনের বড় একটা অংশ কাটত বিড়ালকে খাওয়াতে, গোসল করাতে বা আদর করাতে। পড়তে বসুক, টিভি দেখুক, গল্প করুক বিড়ালটা ও’র সাথে থাকতই। তারেকের সাথে ফোনে যেটুক কথা হত, তারও একটা অংশ জুড়ে থাকত বিড়াল বন্দনা।

- জানো, আমার সুজিটা আজ কি করেছে............

- জানো, সুজি এখন আমার পেটের উপর গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে।

- সুজিকে জড়ায় ধরে ঘুমাচ্ছিলাম এতক্ষণ।

রিলেশন হওয়ার পর তারেক এসব শুনলে দুষ্টুমি করে বলত,

- ইশ! আমি যদি বিড়াল হতাম।

- তাহলে কি হত?

- তাহলে তুমি আমাকে জড়ায় ধরে ঘুমাতে।

- জ্বি না! তা হচ্ছে না। তুমি হচ্ছ একটা পাজি বিড়াল।

- কেন? কি করসি আমি?

- তুমি একটা চোর।

- তাই? তো কি চুরি করসি আমি?

- জানা লাগবে না। তোমাকে হাতের কাছে পেলে পিটুনি দিব, আদর করব না।

কিন্তু মাসখানেক আগে সুজি গাড়িচাপায় মারা যায়। নিশাত তখন ক্লাসে ছিল। বিড়ালের শোকে দুইদিন না খেয় থাকার পর স্বান্তনা দিতে গিয়ে বলে যে, কেদ না, সুজির চে সুন্দর একটা বিড়াল তোমাকে কিনে দেব।

কথাটা খুব পছন্দ হয় নিশাতের। সে ঠিক করে নতুন বিড়াল তারেককেই কিনে দিতে হবে। নাহলে ও আর বিড়াল পুষবে না।

ওরা কাটাবন চষে ফেলে কিন্তু ধবধবে সাদা, নীল চোখের বিড়াল একটাও নেই। কি আর করা! নীল চোখ পাওয়া না গেলেও ধবধবে সাদা একটা বিড়াল পছন্দ করা হয়। দাম চায় আট হাজার টাকা। তারেকের মাথায় হাত। এত টাকা তো তার কাছে নেই। টিউশনি করে সে নিজের খরচ চালায়। সদ্য বেতন পেয়ে পুরোটাই নিয়ে এসেছিল, কিন্তু বিড়ালের দাম তারচেয়েও বেশি। তারেকের মাথা চুলকানি দেখেই নিশাত সব বুঝে নিল। বলল,

- টাকা নেই?

- না মানে, পুরোটা তো নেই, তুমি চিন্তা করো না, আমি কারো কাছ থেকে ম্যানেজ করে কালই নিয়ে আসব।

- না, আমি অন্য কারো টাকায় বিড়াল নিব না। তোমার টাকায়ই কিনে দিতে হবে না।

- অন্যের টাকায় কই? আমিতো ধার করে আবার ফেরত দিয়ে দেব।

- না। লাগবে না। ধার করলে তুমি চলবা কিভাবে?

- আরে না, ম্যানেজ হয়ে যাবে।

- উহু, আগামী মাসের বেতন পেয়ে কিনে দিতে পারবে না?

- তা পারবো। কিন্তু ততদিনে কি এই টাকা হাতে থাকবে?

- থাকবে না কেন? রাখতে হবে। তাছাড়া আগামী মাসে আমার জন্মদিন। তুমি জন্মদিনে আমাকে এটা গিফট দিবা। আরও স্পেশাল হবে।

- আচ্ছ ঠিক আছে।

- হুম, আগামী একমাস খুব সাবধানে খরচ করে চলবা। জন্মদিনে আমি তোমার কাছ থেকে বিড়াল চাইই চাই।

নিশাতের ফ্যাসিনেশনের মনে করে তারেক আর কিছু বলে না। তাছাড়া আসলে ওরও অনেকদিন ধরেই ইচ্ছা ছিল নিশাতকে কিছু দেয়ার। সবসময়ই নিশাতকে ও’র কিছু না কিছু দিতে ইচ্ছা করে। এখন ও’র সবচে প্রিয় জিনিসটা যদি দিতে পারে তাহলেতো আরো ভালো।

এরপর শুরু হল তারেকের দেওয়া বিড়াল নিয়ে নিশাত কি করবে সেই ফিরিস্তি। নিশাতের কাছে এটা যেন বিড়াল না, তারেক নিজেই। বিড়ালকে আদর করা মানে তারেককেই আদর করা, বিড়ালকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানো মানে, তারেককেই জড়িয়ে ধরে ঘুমানো। কোন মহিলা প্রথম বাচ্চা হওয়ার সময় যে রকম উত্তেজিত থাকে, ঠিক সেরকম উত্তেজনা নিয়েই অধীর আগ্রহে নিশাত বিড়ালটার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।



আজ বিড়ালের টাকা পুরোটা জোগাড় হয়েছে। কাটাবন গিয়ে দেখে এসেছে। বিড়ালটা এখনও বিক্রি হয়নি। পরশু জন্মদিন। ঐদিন বিকেলে কিনবে বিড়াল।

সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল, কিন্তু সেদিন রাতে বন্ধু মিজান ফোন দিয়ে কেদে বলল,

- দোস্ত, মা স্ট্রোক করসে।

- কি বলিস, তাই নাকি? কি অবস্থা এখন?

- হাসপাতালে আছে। অজ্ঞান।

- বাড়ী যাবি কখন?

- এখনই কিন্তু দোস্ত হাতে একটা টাকাও নাই।

তারেক জানে, মিজানের বাবা নেই। নিজের ইনকাম দিয়ে নিজেরতো চলতেই হয়, সাথে ও’র বাসার খরচও ওরই চালাতে হয়। তাই বিনা দ্বিধায় জমানো টাকা তুলে দেয় মিজানকে। নিশাতকে বুঝালে বুঝবে নিশ্চয়ই। মিজান টাকাটা দিলেই কিনে দেবে বিড়াল।

রাত বারোটায় উইশ করার পর এই সেই কথা বলে বিড়ালের প্রসঙ্গটা চাপা দিতে চেয়েছিল কিন্তু শেষ রক্ষা হল না, নিশাত নিজেই কথাটা পেড়ে বসল,

- কাল আমরা কখন যাচ্ছি?

- কোথায়?

- আরে বিড়াল কিনতে।

- কালকেই কিনতে হবে বিড়াল? কাল ঘোরাঘুরি করি।

- না, না। কালই লাগবে আমার।

- আরে বোঝনা কেন? বিড়াল কোলে নিয়ে ঘোরাঘুরি করা কি ঠিক হবে?

- সত্যি কথা বলতো কি হইসে? কালকেই বিড়াল কিনব এটা তো সন্ধ্যায় ও আলাপ হল।

- তাতে কি? এখন মনে হচ্ছে পড়ে কেনাই ভাল।

- তারেক, সত্যি কথা বল। টাকার কিছু হইসে? হারায় ফেলস?

- না, টাকা ঠিক আছে।

- তো?

ঘটনা খুলে বলে তারেক। শুনে ক্ষেপে যায় নিশাত।

- তোমার বন্ধুর মা অসুস্থ বুঝলাম কিন্তু তোমাকেই কেন টাকা দিতে হবে? তুমি কি হাতেম তাঈ?

- আরে ইমারজেন্সী তো। তাছাড়া ও এখনো এ মাসের বেতনগুলো পায়নি। এসে দিয়ে দিলেই আমরা বিড়াল কিনব।

- ও! আমাকে দেওয়া কথার কোন দাম নাই না?

- আরে ক্ষেপে যাও কেন? একটা বিড়াল কি মানুষের জীবনের চেয়েও দামি?

- ওসব আমাকে শুনায় লাভ নাই। গত একমাস তুমি মিথ্যা কথা শুনাইস। তুমি আমার সাথে আর কথা বলবা না। বলতে বলতে কেদে দেয় ও।

- নিশাত, বোঝার চেষ্টা করো।

- না, না, না। আমার বিন্দু মাত্র দাম তোমার কাছে নাই। তুমি আমারে আর ফোন দিবা না।

ফোন কেটে দেয় নিশাত। তারেক আরও অনেকবার ডায়াল করে কিন্তু ফোন ধরে না আর। শেষে ফোনটা বন্ধই করে দেয় নিশাত।



খুব খারাপ লেগে ওঠে তারেকের। বুকের বাম পাশটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে নিশাতের আচরণের জন্য না বরং নিশাতের জন্যই ও’র কষ্ট লাগছে। বেচারির কাছে বিড়ালটার একটা অন্য রকম আবেদন ছিল। সব স্বপ্ন ভেস্তে গেল। কষ্টতো পাবেই। সকালেই ঠিক হয়ে যাবে। তারেককে ছাড়া নিশাত, অসম্ভব একটা ব্যাপার।

কিন্তু রাত বাড়তেই কষ্ট বাড়তে থাকে তারেকের। নিশাতে জন্য কষ্ট। মশারির ভেতর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে সে। একটু পর পর এপাশ ওপাশ করছে। বালিশ একবার মাথার তলে, আরেকবার মাথা বালিশের তলে। বার বার মতিন ভাইয়ের কথাটা মনে পড়ছে, ‘ভালবাসা সত্যি হইলে, সবই সম্ভব, বুঝলা মিয়া।’

তা-ই যদি হয় তাহলে এমন হল কেন? নিশাতকে ওর সবচে পছন্দের জিনিসটা দিতে চেয়েছিল। আর কিছুতো না। তাহলে দিতে পারলো না কেন? ও’র আর নিশাতের ভালোবাসা কি তাহলে সত্যি না?

না, তা কি করে হয়? কিন্তু গত মাসখানেক ধরে ওরা যে স্বপ্ন দেখল, তা কেন পূরণ হলো না?

কেন পূরণ হয়নি তাও জানে, জানে যে কয়দিন পরেই নিশাতকে বিড়াল কিনে দিতে পারবে। নিশাতও সকালের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তারপরও ওর কষ্ট বাড়তেই লাগলো।

ইশ! আমার নিশাত কত কষ্ট পাচ্ছে! মনে শুধু এই কথাটাই আসছে বারবার। যেদিন প্রথম বুঝেছিল ভালবাসে, সেদিনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে, নিশাতকে কনদিক কষ্ট দেবে না। ও’র কারণে নিশাত কখনো কাঁদবে না। কিন্তু আজ নিশাত কষ্ট পেয়েছে, কেদেছে শুধু ও’র জন্যেই। ও’র ভালোবাসা সত্যি হলে তো এরকম হওয়ার কথা না।

চোখের পানিতে বালিশ ভিজে গেছে, ঘামে বিছানা। কিন্তু তারেকের অস্থিরতা কমে না। শুধু ভাবে, তার ভালোবাসা তো সত্যি তাহলে সে কেন পারলো না। সৃষ্টিকর্তার উপর খুব অভিমান হয় ও'র। এতো দিন থাকতে আজকেই কেন মিজানের মা অসুস্থ হল?

হঠাৎ ওর অস্থিরতা খুব বেড়ে যায়। শরীর ঘামে ভেজা কিন্তু খুব ঠাণ্ডা । ছটফট করতে করতে হঠাৎ বুকের বাম পাশে গরম কোন কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করে তারেক।

তারেকের ঠিক হৃৎপিণ্ড বরাবর গুটিসুটি মেরে একটা বিড়াল বসে আছে। ধবধবে সাদা বিড়ালটার সমুদ্রের মত নীল চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে তারেকের চোখের জ্যোতি নিভে যায়।



পরিশিষ্ট

সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই তারেকের কথা মনে পড়ে নিশাতের। খুব মন খারাপ হয়ে যায় ও’র। কাল রাতে একটু বেশিই বাজে ব্যবহার করে ফেলেছে। আসলে অনেকদিন ধরে চিন্তা করে রাখা একটা বিষয় হঠাৎ এভাবে ভেস্তে যাওয়ায় নিজেকে সামলাতে পারেনি। তারেক তো ঠিক কাজই করেছে। বিড়ালতো ওরা পরেও কিনতে পারবে। ইশ! কি কষ্টই না পেয়েছে বেচারা! ফোন অন করে দ্যাখে তারেক কোন মেসেজ দেয়নি। অভিমান হয়েছে সাহেবের, মনে মনে ভাবে নিশাত। বাথরুম থেকে ফিরে ফোন দিয়ে অভিমান ভাঙ্গাতে হবে।

বাথরুম সেরে ফেরার পথে নিশাতের মনে হল কে যেন দরজায় নক করল। এত সকালে কে এল ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে দ্যাখে কেউ নেই। ভুল শুনেছে ভেবে দরজা বন্ধ করতে যাবে এমন সময় ‘ম্যাও’ ডাক শুনে চমকে ওঠে।

তাকিয়ে দ্যাখে সারা সকালের শুভ্রতা মেখে একটা বিড়াল দরজার সামনে দাঁড়ানো। অবাক হয়ে হাত বাড়াতেই লাফিয়ে কোলে উঠে গেল। যেন কতদিনের চেনা। বিড়াল কোলে নিশাত আশে পাশে খুঁজে এলো। কেউ নেই। তারেক নিশ্চয়ই ওকে সারপ্রাইজ দিতে কাল নাটক করেছে। এখন দরজার সামনে বিড়াল রেখে পালিয়ে গেছে। ইশ! কি সুন্দর বিড়ালটা।

কী পাজি দেখছ ছেলেটা! মনে মনে ভাবে নিশাত।

ফোন দিয়ে ঝাড়তে হবে। একবার দেখা করে গেলেও তো পারতো।

কিন্তু নিশাতের ফোন আর কখনোই তারেককে খুঁজে পায়নি।

মন্তব্য ২৯ টি রেটিং +৭/-০

মন্তব্য (২৯) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ১:৩৮

কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: আপনি বেশ ভালো লিখেন। পড়তে ভালো লাগে। এই লেখাতে খানিকটা সিনামেটিক একটা ভাব ছিল, আপনার উপস্থাপনার কারনে বিশেষ করে মূল গল্পের মাঝে মাঝে অন্য একজনের ভালোবাসার গল্প সাধারন প্লটটাকে বেশ চমৎকার করেছেন। প্রথম ভালো লাগা জানালাম।

অনেক শুভেচ্ছা রইল আপনার প্রতি। অনুসরনে নিলাম।

১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১২:৩৩

ট্রাক বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ

২| ১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ১:৪৬

অর্থনীতিবিদ বলেছেন: অসাধারণ। শেষে এক দারুন চমক, একই সাথে ট্রাজেডী দিয়ে গল্পটি শেষ করেছেন। এত সাবলীল ভাবে লিখেছেন যে সম্পূর্ণ গল্পটি কোথা দিয়ে শেষ হয়ে গেল টেরই পেলাম না। এমন সুন্দর একটি গল্প উপহার দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১২:৩৭

ট্রাক বলেছেন: আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।

৩| ১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ২:০৯

জুলিয়ান সিদ্দিকী বলেছেন: দুইটা ঘটনা (গল্প) পাশাপাশি চালানোতে খানিকটা বরিং মনে হইতেছিল। কিন্তু ফিনিশিঙে গিয়া বোরিং ভাবটা থাকলো না।

১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১২:৩৯

ট্রাক বলেছেন: যাক, তাহলেতো ভালই।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

৪| ১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ সকাল ৮:৪৬

মামুন রশিদ বলেছেন: দুইটা গল্প সাবলীল ভাবে সমান্তরালে চলেছে । আইডিয়াটা নিঃসন্দেহে চমৎকার । তবে প্রথম অর্থাৎ মতিন ভাইয়ের গল্পটা প্রাণবন্ত হয়েছে । দ্বিতীয় গল্পটা ন্যাকা ন্যাকা আর সিনেমাটিক মনে হয়েছে ।

১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১২:৪৪

ট্রাক বলেছেন: আয় হায়, দ্বিতীয়টাইতো আসল গল্প!!!!!!!!
:|

৫| ১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১:০৪

আহাদিল বলেছেন: গল্পটা ভালো লেগেছে!
সাবলীল লেখা!

পাঠককে ধরে রাখতে পারে এমন লেখা!
তবে এটা ঠিক যে মতিন সাহেবের অংশটা যতখানি সুন্দর হয়েছে দ্বিতীয় অংশখানিতে ততখানি প্রাণ নেই কিন্তু ভালো লেগেছে!

১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ বিকাল ৩:২৪

ট্রাক বলেছেন: ধন্যবাদ
মতিন সাহেবের গল্পটা সাপোর্ট হিসাবে রাখা। অথচ ওটাই দেখি সবার ভাল্লাগতেসে!!!!
B:-/

৬| ১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১:১৪

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: সবমিলিয়ে ভাল লেগেছে।

১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ বিকাল ৩:২৪

ট্রাক বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ

৭| ১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ২:৪৬

সমুদ্র কন্যা বলেছেন: পাশাপাশি দুটো গল্প মিলে বেশ ভাল লেগেছে। শেষটুকুও সুন্দর।

১৪ ই আগস্ট, ২০১৩ বিকাল ৩:২৫

ট্রাক বলেছেন: B-))

৮| ১৭ ই আগস্ট, ২০১৩ সকাল ১১:৫২

তানজিব বলেছেন: +

১৭ ই আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১২:০৭

ট্রাক বলেছেন: :-B

৯| ১৭ ই আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১:২০

আম্মানসুরা বলেছেন: মামুন রশিদ বলেছেন: দুইটা গল্প সাবলীল ভাবে সমান্তরালে চলেছে । আইডিয়াটা নিঃসন্দেহে চমৎকার । তবে প্রথম অর্থাৎ মতিন ভাইয়ের গল্পটা প্রাণবন্ত হয়েছে । দ্বিতীয় গল্পটা ন্যাকা ন্যাকা আর সিনেমাটিক মনে হয়েছে ।

২৩ শে আগস্ট, ২০১৩ সকাল ৯:২০

ট্রাক বলেছেন: কি আর বলব?
সাইড হিরো মতিন মিয়া ই তো দেখি বেশি হিট খাইল!!!!!!!!!
B:-)

১০| ২৩ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ২:১২

ইকরাম বাপ্পী বলেছেন: পরের গল্পটার মতন এই গল্পটাও আমার ভালো লাগল......

২৩ শে আগস্ট, ২০১৩ সকাল ৯:২২

ট্রাক বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে আমার গল্পগুলো পড়ার জন্য।

১১| ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ৮:৫০

অপ্রচলিত বলেছেন: নাহ আপনার প্রত্যেকটা গল্পই এক কথায় অতুলনীয়। চমৎকার লিখেছেন, নিবিষ্ট হয়ে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এমন সুন্দর সব ব্যতিক্রমী গল্প উপহার দেওয়ার জন্য। ভালো থাকবেন লেখক :)

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:০৮

ট্রাক বলেছেন: :-B :) B-) :D
থ্যাঙ্কিউউউউউউউউউউউ

১২| ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ৮:৫২

অপ্রচলিত বলেছেন: হয়তো জেনে খুশি হবেন, আপনার আসল গল্পটিই বেশি ভালো লেগেছে :P

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:০৯

ট্রাক বলেছেন: যাক, একজন পাওয়া গেলো।
:#>

১৩| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১২:১৩

মহামহোপাধ্যায় বলেছেন: আপনার এই গল্পটা কাল রাতে পড়ছিলাম। ভালো লাগল। অনেক ভাল লেখেন আপনি। অনুসরণ করলাম।


ভাল থাকুন। শুভকামনা।

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:১১

ট্রাক বলেছেন: আপনিও ভালো থাকবেন। উৎসাহের জন্য থ্যাঙ্কিউউউউ

১৪| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১২:৪৬

এম হাবিব আহসান বলেছেন: আম্মা পাত্রী খুজতেছে। মতিন ভাইএর শালী আছে কিনা জানা দরকার। :) B-) :D :P

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:১৫

ট্রাক বলেছেন: দাঁড়ান, খোজ নিচ্ছি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.