নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত,
মূলধারা বাংলাদেশ নামের একখানি ট্যবলয়েড পত্রিকার অনলাইনে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথকে সাম্প্রদায়িক অপবাদ দিয়া সলিমুল্লা খান মহোদয়ের লেখাটা পুরা পড়িলাম না। তাহার প্রধান কারন তিনি তাহার এই সন্দর্ভে কী বুঝাইতে চাহিলেন তাহা কিয়ত পরিমান পাঠ করিলে মনযোগী পাঠকের বোধোদয় হইবে যে, খান সাহেব রবীদ্রনাথের গোসটি উদ্ধারে ব্রত পালন করিবার নিমিত্তে আমাদের মতো গাধা গরুদের জ্ঞান বিলাইতেছেন । আহমদ ছফার এক কালের চেলা তথা স্বাধীন বাংলাদেশের দুষ্ট চক্র জাসদের ঝান্ডা ধারীরা এই পরিনামই বরণ করেন । ইংরেজরা যদি দেশ ছাড়িয়া না যাইত তাহা হইলে এই জ্ঞানী প্রবর তাহাদের কে বিদেশী বলিতেন না। চলিয়া যাওয়াই তাহাদের কাল হইল। আর যাহারা ইহার পূর্বে ভারত বর্ষ আক্রমন বা 'জয়' করিয়া বাড়ী, ভিটি,পুকুরপার, বাঁশঝাড়, বৃক্ষাদি রোপণে ছেদনে,জিয়ানে ভোগ দখল পূর্বক জোর করিয়া তাহাদের মৌরসি পাট্টা বানাইয়া নিল, তাহাদের কে বিদেশী বলাতে খান মহোদয় রবীন্দ্রনাথের উপর ক্ষুদ্ধ হইলেন । ক্ষুদ্ধ হইবার আরও কারন আছে, যাহা খান সাহেব ব্যক্ত করিলেন না , কিন্তু তাহার সাম্প্রদায়িক মন কিছুতেই যে প্রবোধ মানিলেন না তাহাই এই লেখাতে ফুটাইয়া তুলিলেন। নচেৎ, এই অধমের ক্ষুদ্র জ্ঞানে কখনো জানি নাই, রবীন্দ্রনাথ আপন সমা্লচনায় পিছপা ছিলেন কিনা ও যাহা তাহার মনে ধরিত না, তাহা স্বগীয় হইলেও তিনি তাহা গ্রহন করিতেন কীনা । ইহা আমাদের খান সাহেবরা এই জনমে অধিগত করিতে পারিবেন না। রবীন্দ্রনাথ মহাশয়ের প্রবন্ধ গুলি পাঠ করিলে বা শ্রবন করিলে গেরামের চাষা ভুষা ও বুঝিতে পারিবেন তিনি যাহা মন্দ তাহাকে মন্দ বলিতে পিছপা থাকিতেন না । আর যাহা উত্তম তাহা উত্তম বলিতে পিছপা থাকিতেন না। খান সাহেব তাহার জীবনে, কোন অন্যায় অত্যাচারে বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া কোন রাজ শক্তির ভিত নাড়িয়া দিয়াছেন কিনা নাকি টক শোতে শুধু অধিগত জ্ঞান বিতরন করিয়া মানুষের সম্মুখে ইংরেজদের নাইট উপাধি রাস্তার ধুলায় ফেলিয়া দিবার সেই মানুষটা কে বেইজ্জত করিবার বাসনা পোষণ করিলেন কেন তাহা এই মূর্খ বাঙ্গালীর অনধিগম্য নহে। বলি হারি , রবী বাবুর সাথে তুলনা । এহ বাহ্য ।
খান সাহেব কি শান্তি নিকেতন ভ্রমন করিয়াছেন? সেখানে কি কোন হিন্দু দেব দেবীর পুজা আরচা প্রতিমা দেখিয়াছেন ? চালাক মানুষ বলিতে হইবে, তাই ব্রাম্ম দের উপর ও চাপাতি চালাইলেন। যেহেতু তাহার লক্ষ্য বস্তু রবীন্দ্রনাথ।
তিনি একটি মহাভুল পরিবেশন করিয়া পাঠক দের সাথে প্রতারনা করিলেন, আর তাহা হইল - রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধ(বুদ্ধদেব??) কে হিন্দুর অবতার বানাইলেন । ইহা তিনি কোথায় পাইয়াছেন মহাজ্ঞানী কমলাকান্ত ??বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধ গয়ায় যাইয়া যে লিখাখানি লিখিয়াছিলেন তাহা কি তিনি পড়িয়াছেন । নাহ, ইহা পড়িবার কোন প্রয়োজন খান সাহেবের রহিয়াছে কীনা বিবেচ্য ।তবে একজন ক্ষুদ্র পাঠক হিসাবে খান সাহেব কে চ্যালেঞ্জ ছুড়িয়া দিলাম তিনি প্রমান করুন, রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধ কে অবতার বানাইতে সচেষ্ট ছিলেন। কম পড়াশুনা করিয়া অধিক পরিমানে লিখিতে চাওয়া বড় ভয়াবহ। তাহাও আবার রবীদ্রনাথে কে লইয়া?? আমি যদি তাহাকে বলিতে চাহি রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ব্রাম্ম কোনটাই ছিলেন না, তিনি কি আমার কথার ভুল প্রমান করিতে পারিবেন ? আমি যদি বলি তিনি শুধু বৌদ্ধ ধর্মেই মুগ্ধ ছিলেন তাহা তিনি ভুল প্রমান করিতে পারিবেন ? তাহা হইলে তাহার এহেন উদ্দেশ্য মুলক রচনাখানি অর্থহীন হইয়া যাইবে । তাহা ভুল প্রমান করিতে হইলে রবী বাবুর সমগ্র রচনা তাহাকে পড়িতে হইবে, এমন কি তাহার গীতবিতান, গীতাঞ্জলী, নৃত্য নাঠ্য তাহাকে গাইতে বা শুনিতে হইবে । একবার বলিবেন ইউরোপীয়রা রেসিস্ট(তাই ফ্রাঞ্জ ফানো কেই কথায় কথায় তুলিয়া আনেন), আর একবার বলিবেন রবীন্দ্রনাথ সাম্প্রদায়িক। আর পাঠক দের গাধা গরু ভাবিবেন এমন জ্ঞানা ভিমান পরিত্যাজ্য । মহোদয়ের মনোবাঞ্ছা হয়তো গভীরে আর তাহা হইল এমন সাম্প্রদায়িক মানুষ টির রচিত গান কী করিয়া তাহাদের নিজ হস্তে স্বাধীন কৃত দেশটির জাতীয় সঙ্গীত হইতে পারে ??
১৯ শে এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল ৪:৩২
পি কে বড়ুয়া বলেছেন: ধন্যবাদ, আপনার মতামতের জন্যে । তবে আপনি যে কী জিনিস - সেটা বুঝতে কাল বিলম্ব হল না এই অধমের। খারাপ জ্ঞানীর চেয়ে ভালো মূর্খ অনেক বেশি বিপদজনক - সেই বোধে একজন অকাট মূর্খের সাথে বাতচিত করা থেকে বিরত থাকলাম। আবার ধন্যবাদ। যদি আরেন আপনার বক বকানীর স্বপক্ষে একটি মাত্র প্রমান দেন যা সত্য , যে আপনি নিজে লেখা পড়া করে এই বাক বাকুম, বাক বাকুম করছেন।
২| ১৯ শে এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল ৪:৫৭
খন্দকার আঃ মোমিন বলেছেন: জ্ঞান মানুষ কে ভালো করে , সেই জ্ঞানীই যদি খারাপ হয় তা হলে জ্ঞান মাপার জন্য ন্যানো মিটার এর দরকার নাই , আমিন এর হাতের ছেইন কাপ্পাই কাপি , ঘুমানোদের কে ডাকিয়া যাগানো যায় ভেংছি কাটা ঘুমন্তদের কে বল্লম দিয়া গুতাইলেও জাগানো সম্ভব নয় , দুনিয়ার এক মাত্র জ্ঞানী হওয়ার দাবি করার সময় মনে হয় অতী নিকটে আপনার , তালিয়া বাজাইতে থাকুন , হউত পেতে ও পারেন এই তক্মাটা । ধন্যবাদ
রবির পাইজলামি প্রকাশ করে নাই দেখে রবি পাজিল নয় ,এ ধারনা ভুল বংগভঙ্গের দিকেই খেয়াল করে দেখুন ৭১ রক্ত গঙ্গার জন্য রবি তাঁর ভুল এড়াতে পারেন না ।
১৯ শে এপ্রিল, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:০৯
পি কে বড়ুয়া বলেছেন: সান্ধ্য ভাষা ছাড়িয়া একটু খোলসা করুন । এই অধম সহজ কথায় বুঝে । যেভাবে গম গম করে শব্দের দোররা ঘুরাচ্ছেন, এহেহ বাংলা বুঝার তো সাধ্য নাই। 'পাজিল' রবি র পাঠে কাপ্পাই কাপ্পি নাই তো ? রবি কি বঙ্গ ভঙ্গ চাইছিলেন নাকি চান নি ? আপনার কথায় কিচ্ছু বুঝা গেল না। ৭১ এর সাথে রবির কি সম্পর্ক । আসল গো্সসা কোথায় মহাশয়ের ??
১৯ শে এপ্রিল, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৩২
পি কে বড়ুয়া বলেছেন: পুনরায় ঃ যদি সত্যি ই শোভন বিতর্ক করতে চান , তাহলে আসুন মূল কথায় আসি। অজথাবাক্য থেকে বিরত থেকে আসুন কাপ্পাই, তালিয়া আর আমাকে নিয়ে গবেষনা না করে, 'পাজিল' রবিকে নিয়ে শুরু করি। মাঝখান থেকে টুপ করে একটা ঢিল মেরে দিয়ে - না হল আপনার উওকার, না হল আমার শেখা।
৩| ১৯ শে এপ্রিল, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫৪
খন্দকার আঃ মোমিন বলেছেন: ধন্যবাধ , আপনারা রবির কাগজ কলম নিয়াই মেতেছিলেন দেখেন নি তার হাকিকত , আমি শুধু একটি বিষয় ই আপনার থেকে জানতে চাছি যে বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা কালিন রবির ভুমিকা কি ছিল ? তিনি কি তা সমরথন করেছেন নাকি তার বিরোধিতা করেছেন ?
আপনি আমার কাছে জানতে চেয়েছেন যে ৭১ এর সাথে তার ভুমিকা কি ছিল ?
প্রথমেই বলি ভারত উপ মহাদেশে সর্ব প্রথম বাঙলা আসাম সহ আর ও কিছু যায়গা নিয়ে যখন বঙ্গ নামে ব্রিটিশ থেকে স্বায়ত্ত শাসন পায় ১৯০৬ সালে যেটা পরবরতিতে বাংলাদেশকে সরাসরি ব্রিটিশ থেকে স্বাধীনতা দিতে সহায়তা করত ,সে বংগ ভংগ কে বাতিল করার জন্য পশ্চিম বংগ থেকে যে বিরোধিতা করা হয় তার ইন্দন দাতা এই রবি ঠাকুর ই ।
যার ফলা ফল হয় ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান নাম নিতে বাদ্ধ হয় ,আর ও আগিয়ে ১৯৭১
১৯ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৮:৩৫
পি কে বড়ুয়া বলেছেন: প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলি - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষতার বিরুদ্ধে রবি দারিয়েছিলেন সেটা একটা ডাহা অপপ্রচার এবং সরবইব সংঘটিত মিত্যা প্রচারনা ।তা যদি হতো তাহলে, আপনি ই আমাকে বলেন, আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্টা হবার পর যে অনুষ্টান হয়, তাতে রবি কি করে বিশেষ অথিতি হিসাবে আমন্ত্রিত হন ?? প্লিজ চেক করে জানাবেন । তারর বলি, এক্মাত্র স্যার আশুতোষ মুখারজী ই ইংরেজদের কাছে এর বিরুধীতা করেছিলেন। তাঁর প্রধান কারন বাংল পূর্ব বঙ্গ বিদ্ধেষ নয়, তাঁর কারন ইংরেজদের থোক বরাদ্ধ কল্কালা ইউনি থেকে কমে যাবে এবং সেখান থেকে শিক্ষক ছাটাই করতে হবে সেই ই কারনে । আপনি অনলাইন এ চেক করে দেখেন ঢাকা বিস্ববিদ্যালয় এস্টাব্লিশ্মেন্ট কমিটিতে কারা কারা ছিলেঙ্কয়জন এ এলাকার আর কয়জন ঐ এলাকার, কয়জন হিন্দু আর কয়জন মুসলমান। তাঁর রবি র কোন সম্পর্ক নেই ।সো পাবেন চেক করলে । প্লিজ খারাপ প্রচারনা কারীদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হবেন না কারন সত্য কে এরান যাবে না ।মুসলমান রা বিশ্ববিদ্যালয় চান নি,কারন তাদের প্রয়োজন ছিল প্রাইমারী এবং উচ্চ বিদ্যালয়।জেহেতু প্রান্তিক মুসলমান রা শিক্ষায় পিছিয়ে ছিলেন। তাই তাদের ভয় ছিল বিশ্ববিদ্যালয় হলে তাদের সেই বরাদ্ধ কমে যাবে ।সেই বাস্তুতার প্রতি রবীন্দ্রনাথের সায় ছিল। কারন তিনি বাংলাদেশের গরীব প্রজাদের সাথে দীর্ঘ জীবন কাটিয়েছেন, তাদের জন্য রাস্তা করছেন, বিদ্যালয় করেছেন, নিজের ছেলে বিদেশে পাঠিয়েছেন তাদের আদুনিক চাষাবাদ শিক্ষা দেবার জন্যে । এসব তাঁর লেখায় আছে।কনটাই বানানো নয় । আমরা ব্যাপক ভাবে না জেনে , একজনের একটা মাত্র উক্তি দিয়ে ব্বহ্রান্ত হই। কেউ কেউ তা থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে ফায়দা তোলে। কেউ প্রমান করতে পারবে না রবি এদেশে জন্মে, এদেশে থেকে, এ দেশের সাথে বিরুপ আচরন করেছেন। তিনি এচ্যেছিলেন প্রান্তিক ক্রিষকের সন্তান রা স্কুলে পড়ার ব্যাপক সুযোগ যেন পান। সেই সুত্রে ইন্রেজদের সাথে তাঁর বাদানুবাদ হয় তা এখন ইতিহাস। লেখা দীর্ঘ হয়ে গেল, আরও বলার ছিল ।
১৯ শে এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৯:১৩
পি কে বড়ুয়া বলেছেন: ধন্য বাদ দ্বিতীয় গুরুত্ব পূর্ণ প্রশ্নের জন্যে । বঙ্গ ভঙ্গ আন্দোলনের ইতিবাচক দিক
চলমান এই আন্দোলনের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেয়েছেন– এবারই প্রথম রাজনীতিকরা দুটো বিষয়কে সকলের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন–
১. বিশ্ববিদ্যালয় বিলের মাধ্যমে ইংরেজরা এদেশের উচ্চশিক্ষা, স্বাধীন শিক্ষার মূলোচ্ছেদ করতে চায়।
২. বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করে বাঙালিজাতিকে দুর্বল করতে চায়।
১৯০৪ সালের ১৬ জুন বঙ্গদর্শনে দীনেশচন্দ্র সেনের সাহিত্য প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ফলে বিলিতি সভ্যতার মোহ কেটে গিয়ে আমাদের দেশ যথানিয়মে আমাদের হৃদয়কে পাইতেছে। ইহাই পরম লাভ। ধনলাভের চেয়ে ইহা অল্প নহে।বেঙ্গলী পত্রিকার ৩ আগস্ট সংখ্যায় একটি খবরে জানা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ স্টার থিয়েটারে বিকেল পাঁচটায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধ সভায় সভাপতিত্ব করবেন। সেখানে বিপিনচন্দ্র পাল বক্তব্য রাখবেন। বিষয় আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধিকার। রবিজীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল জানাচ্ছেন– রবীন্দ্রনাথ অনুপস্থিত ছিলেন সভায়। এই সভায় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন পরিচালনার জন্য যে স্ট্যান্ডিং কমিটি হয় তাতে যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, ঠাকুরবাড়ির জামাই স্বর্ণকুমারীর স্বামী জানকীনাথ ঘোষাল, মেজো দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভাতিজা গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে রাখা হয়নি। তিনি এই আন্দোলন থেকে প্রত্যক্ষভাবে একটু সরেই ছিলেন। বয়কট আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর চিন্তার স্বতন্ত্রতা প্রকাশ পেয়েছিল ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’ ভাষণে। প্রবন্ধটি পাঠ করেছিলেন টাউন হলে ২৫ আগস্ট। এই ভাষণে রবীন্দ্রনাথ কার্জনের বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব ও বাঙ্গালীদের বিলেতি দ্রব্য বয়কট আন্দোলনকে ক্ষতির দিক থেকে দেখেননি। তিনি দেখেছেন লাভের দিক থেকে। একই সঙ্গে তিনি ইংরেজ উপনিবেশকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেন।এই দিনগুলোতে এই উত্তাল সময়ে বাউল সুরে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন আমার সোনার বাংলা গানটি। গানটি কোলকাতায় মানুষের মুখে মুখে গীত হচ্ছে। আন্দোলনের প্রাণশক্তি হিসেবে কাজ করছে।
১ সেপ্টেম্বর সিমলা থেকে ঘোষণা করা হয়—১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হবে। ঘোষণাটি আসার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনের গতি আরও বেড়ে যায়। ৩ রা সেপ্টেম্বর বিকেল সাড়ে চারটেয় ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় কলেজ স্কোয়ারে। প্রায় চার হাজার ছাত্র খালি পায়ে পতাকা হাতে সমাবেশে যোগদান করে। তারা উদাত্ত কণ্ঠে আমার সোনার বাংলা গানটি গাইতে গাইতে শহর প্রদক্ষিণ করে। ঘোষণা করা হয়– যদি ১৬ অক্টোবর সতি সত্যি বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয় তবে সেদিনটিতে সারা দেশে পাদুকা বর্জন ও চাদর বর্জন করার মধ্যে দিয়ে ৩দিনের শোক দিবসের কর্মসূচি পালন করা হবে।তিনি প্রস্তাব রাখেন –১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর তারিখ থেকে ব্রিটিশ সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ওই আইন কার্যকর হলে সেদিন কোন বাড়িতে রান্নাবান্না হবে না। বাঙালি জনসাধারণ অরন্ধন পালন করে উপোষ থাকবে। বাঙালির ঐক্য বজায় রাখার জন্য দেশজুড়ে হবে রাখিবন্ধন উৎসবরাখিবন্ধন উপলক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ রাখি-সঙ্গীত ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ূ, বাংলার ফল—পূণ্য হউক, পূণ্য হউক’ রচনা করেন। ৭ আগস্ট বাগবাজারে রায় পশুপতিনাথ বসুর সুরম্য প্রাসাদপ্রাঙ্গণে বিজয়া সম্মিলনী অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ আমন্ত্রিত হন। বিজয়া সম্মিলনী মূলত হিন্দুদের অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথ লক্ষ করেছেন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সব প্রতীকই হিন্দুদের প্রতীক থেকে গ্রহণ করা হচ্ছে। এসব প্রতীকের সাম্প্রদায়িক চরিত্র আছে। বঙ্গদেশ কেবল হিন্দুদের নয়—হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান—সকল মানুষেরই দেশ। এতকাল সকল মানুষ এক সঙ্গেই আছে। বঙ্গদেশটি ভাঙলে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান—সকল মানুষের বঙ্গদেশই ভাঙবে। কেবল হিন্দুর বঙ্গদেশ ভাঙবে না। বঙ্গভঙ্গ রদ করতে হলে সকল মানুষের অংশগ্রহণ চাই। এমন আন্দোলন চাই যেখানে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষই অন্তর থেকে অংশ নিতে পারে। রবীন্দ্রনাথ তাই স্পষ্টত ভেবেছেন– বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের এই হিন্দু প্রতীকগুলো মুসলমানদের কাছে টানার বদলে আরও দূরে সরাবে। সুতরাং তিনি এই বিজয় সম্মিলনীতে হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের সম্ভাষণ করার আহ্বান করেন। তিনি লিখেছেন–হে বন্ধুগণ, আজ আমাদের বিজয়া-সম্মিলনের দিনে হৃদয়কে একবার আমাদের এই বাংলাদেশের সর্বত্র প্রেরণ করো। উত্তরে হিমাচলের পাদমূল হইতে দক্ষিণে তরঙ্গমুখর সমুদ্রকূল পর্যন্ত, নদীজালজড়িত পূর্বসীমান্ত হইতে শৈলমালাবন্ধুর পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত চিত্তকে প্রসারিত করো। যে চাষি চাষ করিয়া এতক্ষণে ঘরে ফিরিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, যে রাখাল ধেনুদলকে গোষ্ঠগৃহে এতক্ষণ ফিরাইয়া আনিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, শঙ্খমুখরিত দেবালয়ে যে পূজার্থী আগত হইয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো, অস্তসূর্যের দিকে মুখ ফিরাইয়া যে মুসলমান নমাজ পড়িয়া উঠিয়াছে তাহাকে সম্ভাষণ করো।
আরেকটি প্রবন্ধ ‘বঙ্গবিচ্ছেদে’ লিখেছেন, এই ব্যবচ্ছেদের ফলে দেশবাসীর অন্নবস্ত্র, বাসস্থানের বিশেষ ক্ষতি না হইলেও ইহাতে আমাদের একমাত্র যথার্থ অনিষ্ট এই যে, সমস্ত বাংলা দেশ এক শাসনাধীনে থাকিলে বাঙালির অন্তঃকরণে যে একটা ঐক্যের অনুভূতি জাগ্রত থাকে, নানাকারণে বাঙালির একত্রে মিলিবার যে বহুতর উপলক্ষ ঘটে, তাহা নষ্ট হইলে আমরা ভিতরে ভিতরে যে বল-লাভের পথে চলিতেছিলাম, তাহাতে বাধা পড়িবে। তবে এই বঙ্গবিচ্ছেদ নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে–তাতে রবীন্দ্রনাথ মনে করছেন পার্টিশন আমাদের ক্ষতি করবে না। সকলের মধ্যে একটা প্রাণশক্তি সৃষ্টি করেছে। ফলে দুই বঙ্গ ভাগ হলেও বাঙালির কিছু ক্ষতি হবে না। কারণ এই প্রাণশক্তি পার্টিশনের উপর জয়ী হবে—এই আশা থাকবে। মিলনে-বিরহে, আনন্দ-বেদনায়, সুখে-দুঃখে, সুবিধা-অসুবিধ বাঙালি ঐক্য অনুভব করবে।
বৃটিশ পার্লামেন্টে ১৯০৫ সালের ৪ জুলাই বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব গ্রহণ করায় আবেদন-নিবেদনের রাজনীতি ত্যাগ করে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেওয়া হয় ৭ আগস্ট টাউন হলের একটি সভায়। প্রত্যেক জেলার বিপুল সংখ্যক প্রতিনিধি, ছাত্র-জনতা এ সভায় উপস্থিত ছিল। সেখানে নরেন্দ্রনাথ সেন বিলেতি-বর্জন বা বয়কট প্রস্তাব ঘোষণা করেন। বয়কট ঘোষণার পর বৃহত্তর বঙ্গের সর্বত্র শত শত সভায় বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের বিরোধিতা ও বিলেতি বর্জনের শপথ গৃহীত হয়। বহু তরুণ ছাত্র দোকানে দোকানে পিকেটিং করে। দূর গ্রামে মাথায় করে দেশীয় দ্রব্যাদি বিক্রয় করতে থাকে। বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবে ভারতের ইংরেজ বনিকরাও কিছু অসুবিধা আশঙ্কা করে প্রথমে প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেছিল। বয়কট ঘোষণা হওয়ার হওয়ার পরে তারা প্রস্তাবটির পক্ষে চলে যায়। দেশি কাপড়ের তুলনায় বিলেতি কাপড়ের দাম কম ছিল। বিলেতি কাপড়ের দাম বেড়ে যাওয়ায় গরীব মানুষের অসুবিধা হয়ে যায়। কোথাও কোথাও বিলেতি দ্রব্য বিক্রিতে জোর জবরদস্তি করা হয়। এরই কারণে ফরিদপুর ২৬ আগস্ট ফরিদপুরে ছোটো খাটো দাঙ্গার ঘটনাও ঘটে।
রবীন্দ্রনাথ ঘরে বাইরে উপন্যাসে এইরকম একটা ঘটনা লিখেছেন। সেখানে শিক্ষিত প্রজাহিতৈষী জমিদার নিখিলেশের কাছে এক গ্রামীণ খুদে কাপড় ব্যবসায়ীকে নিয়ে এসেছেন মাস্টার মশায়। তার নাম পঞ্চু। ঘরে বাইরে থেকে পড়া যাক–
মাস্টারমশায় পঞ্চুকে আমার কাছে নিয়ে এসে উপস্থিত। ব্যাপার কী?
ওদের জমিদার হরিশ কুণ্ডু পঞ্চুকে এক-শো টাকা জরিমানা করেছে।
কেন, ওর অপরাধ কী?
ও বিলিতি কাপড় বেচেছে। ও জমিদারকে গিয়ে হাতে পায়ে ধরে বললে, পরের কাছে ধার-করা টাকায় কাপড় কখানা কিনেছে, এইগুলো বিক্রি হয়ে গেলেই ও এমন কাজ আর কখনো করবে না। জমিদার বললে, সে হচ্ছে না, আমার সামনে কাপড়গুলো পুড়িয়ে ফেল্, তবে ছাড়া পাবি। ও থাকতে না পেরে হঠাৎ বলে ফেললে, আমার তো সে সামর্থ্য নেই, আমি গরিব ; আপনার যথেষ্ট আছে, আপনি দাম দিয়ে কিনে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলুন। শুনে জমিদার লাল হয়ে উঠে বললে, হারামজাদা, কথা কইতে শিখেছ বটে— লাগাও জুতি। এই বলে এক চোট অপমান তো হয়েই গেল, তার পরে এক-শ টাকা জরিমানা।
সেনাপতি লর্ড কিচেনের সঙ্গে কার্জনের মতভেদ হওয়ায় কার্জন পদত্যাগ করেন। তার স্থলে লর্ড মিন্টোর নিয়োগ হয়। মিন্টো তখন ছিলেন কানাডায়। তার আসতে দেরী হওয়ার সুযোগ নিয়ে কার্জন সিমলা থেকে ঘোষণা জারি করে বসেন, ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী হবে। নবগঠিত প্রদেশ আসাম ও পূর্ব বাংলার লেফটেনান্ট গভর্নর নিযুক্ত হলেন কার্জনের চেয়েও পাষণ্ড শাসক ব্যামফিল্ড ফুলার। অ্যান্ড্রু ফ্রেজার পুনর্গঠিত বাংলা প্রদেশের লেফটেনান্ট গভর্নর থাকেন।
বঙ্গভঙ্গের এই খবরগুলো সে সময়কার পত্রপত্রিকাগুলো কালো বর্ডার দিয়ে প্রকাশ করছিল। শোকচিহ্ণের প্রতীক হিসাবে এই কালো বর্ডার দিয়ে খবর প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন সম্পাদকগণ। বাঙালিদের মধ্যে আত্মীয় স্বজনের মৃত্যুতেও কালো পেড়ে কাগজ বা কালো খাম ব্যবহারের চল হচ্ছিল। এটা বিদেশী প্রথা। শোকের দেশী চিহ্ণ হল সাদা—শ্বেত শুভ্র। প্রাচীনকাল থেকে এই সাদা রং বাঙালির শোককে শুভ্রতার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করছে। রবীন্দ্রনাথ শোকচিহ্ণ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে পত্রিকার সম্পাদকদের প্রতি অনুরোধ করেছিলেন সাদা শুভ্রতায় ফিরে আসতে। তিনি লিখেছিলেন, এই (কালো) চিহ্ণ ব্যবহার করে কলঙ্ক বাড়িও না। আমাদের শোক আজি শুভ্র হউক, সংযত হউক, নিরাভরণ হউক—কঠোর ব্রত দ্বারা তাহা আপনাকে সফল করুক, অনাবশ্যক অনুকরণের দ্বারা তাহা দেশে বিদেশে আপনার কৃষ্ণাশ্রুরেখাকে হাস্য করিয়া না তুলুক।
শোকচিহ্ণের মতো করতালি দেওয়ার প্রথাকেও বিদেশী বলে বাতিলের প্রস্তাব করেন কবি। তিনি করতালি প্রবন্ধে লিখেছেন, এরূপ উৎকট উপায়ে মান্য ব্যক্তিকে সম্মান করা হয় না, কারণ, সম্মান করিবার উপায় কখনোই অসংযত হইতে পারে না। আমাদের দেশে করতালি চিরকাল অপমানের উদ্দেশ্যই ব্যবহার করা হইয়াছে-বস্তুত তাহাই সঙ্গত—কারণ, অসংযমের দ্বারাই অপমান করা যায়। তাই চিৎকার-রব দুয়ো বা সশব্দে করতালি দেওযা অপমানের উপায়। অপরপক্ষে যিনি আমাদের সম্মানের যোগ্য, তাঁহার কাছে আমরা আত্মসম্বরণ করিয়া থাকি। কবি মান্য ব্যক্তিকে সাধু সাধু বলার প্রস্তাব করেন।
উৎসাহ উদ্দীপনার আতিসাহ্যে জনপ্রিয় লোককে ঘাড়ে তুলে নেওয়া হয়। আবার কখনো টেনে নেয় ভক্তবৃন্দ—এই প্রথাকেও অপমানজনক বিদেশী অনুকরণ বলে বর্ণনা করেছেন তিনি।
সে সময়ে কোলকাতার অনেকগুলো থিয়েটার ছিল। তাদের নাম ছিল ইংরেজিতে—স্টার, ক্লাসিক, গ্রান্ড, য়ুনিক। এগুলোর মালিক কিন্তু বাঙালি। থিয়েটারগুলোর ইংরেজি নামের বদলে বাংলা নাম রাখতে এই মালিকদের প্রতি কবি অনুরোধ করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, বর্তমানে এমন একটি সুযোগ উপস্থিত হইয়াছে যখন এই নাট্যাশালাগুলির পক্ষে বিলাতি নাম বিলেতি পোষাকের মত ছাড়িয়া ফেলাটা লোকের চক্ষে আকস্মিক ও অপ্রাসাঙ্গিক বলিয়া ঠেকিবে না। বরঞ্চ তাহা আমাদের দেশের বর্তমান হৃদয় ভাবের সহিত মিশ খাইয়া আমাদের স্বদেশ প্রেমের আনন্দোচ্ছ্বাসে নূতন তরঙ্গ তুলিবে।
তাঁর ইচ্ছে জেগেছিল স্বদেশী ভাবধারা জনগনের মধ্যে প্রচারের জন্য স্বদেশী ভিক্ষুসম্প্রদায় গড়ে উঠুক। তিনি লিখেছেন—যে সকল ভিক্ষুক নাম গান করিয়া দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা সংগ্রহ করে—তাহারা যাহা পায় তাহার চেয়ে অনেক বেশি দেয়—তাহারা দেশের চিত্ত আকাশ হইতে প্রত্যহ কলুষ মোচন করিয়া, তাহাকে মধুময় করিয়া তুলিতেছে। কর্ম্মের ঘোরতর আন্দোলনের মধ্যেও তাহারা জীবনের চরম লক্ষ্যকে স্মরণ করাইয়া সংসারের কত আবর্জনা দূর করিতেছে তাহার হিসাব লওয়া শক্ত। এই রূপে যে সম্প্রদায় স্বার্থনিরত লোকদিগকে প্রত্যহ স্বদেশী কর্তব্য স্মরণ করাইয়া বেড়াইবেন—স্বদেশের স্বরূপকে অন্যমনস্কের মনে জাগ্রত করিয়া রাখিবেন, স্বদেশের প্রতি প্রেমকে প্রত্যহ সুরে তানে দেশের পথে ঘাটে উদ্বোধিত করিয়া তুলিবেন তাহারা এই মহৎ কর্তব্য সাধনের দ্বারা যদি জীবিকা সম্বন্ধে নিশ্চিত হইতে পরেন তবে তাহাতে লজ্জার বিষয় নাই।
স্বদেশী আন্দোলনের আদর্শে কোলকাতায় দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে এই রকম বৈতালিক গোষ্ঠী গঠিত হয়েছিল। তারা রাস্তায় রাস্তায় গান গাইতেন। তখন পানওয়ালা বিড়িওয়ালা পর্যন্ত টাকা পয়সা দিত। সংগৃহীত এই চাঁদা জাতীয় অর্থভাণ্ডারে জমা দেওয়া হত।
উদ্বোধন নামে প্রবন্ধে কবি নারীদের উদ্দেশ্যে লেখেন, তোমরা—যাহারা আজ বিশ্ববঙ্গের বেদনায় ব্যথা পাইয়াছ, চক্ষু বিশ্ববঙ্গের মিলনাবেগে গৌরব অনুভব করিতেছ, তোমরা আজ সকলে প্রস্তুত হইয়া এস,–তোমাদের দুটি চক্ষু হইতে বিদেশী হাটের মোহাঞ্জন আজ চোখের জলে একেবারে ধুইয়া মুছিয়া এস—যে বিদেশের অলঙ্কার তোমাদের অঙ্গকে সোনার শৃঙ্খলে আপাদমস্তক বন্দি করিয়া রাখিয়াছে, তাহা আজ খণ্ড খণ্ড করিয়া ভাঙিয়া এস, আজ তোমাদের যে সজ্জা তাহার প্রীতির সজ্জা হউক, মঙ্গলের সজ্জা হউক, তাহাতে বিদেশের রেশম-পশম-লেস-ফিতার জাল-জালিয়াতি অপেক্ষা তোমাদিগকে অনেক বেশি মানাইবে।
রবীন্দ্রনাথ ১৭ সেপ্টেম্বর সাবিত্রী লাইব্রেরীর সভায় রাখীবন্ধনের প্রস্তাব রেখেছিলেন। জনসাধারণ উৎসাহের সঙ্গে রাখীবন্ধন কর্মসূচিটি গ্রহণ করে। বেঙ্গলী পত্রিকায় রাখী সংক্রান্ত ব্যবস্থা নামে একটি ঘোষণা ছাপা হয়েছিল—
দিন। এই বৎসর ৩০ শে আশ্বিন ১৬ অক্টোবর
আগামী বৎসর হইতে আশ্বিনের সংক্রান্তি।
ক্ষণ। সূর্য্যোদয় হইতে রাত্রির প্রথম প্রহর পর্যন্ত।
নিয়ম। উক্ত সময়ে সংযম পালন।
উপকরণ। হরিদ্রাবর্ণের তিন সুতার রাখী।
মন্ত্র। ভাই ভাই এক ঠাঁই, ভেদ নাই ভেদ নাই।
অনুষ্ঠান। উচ্চ নিচ হিন্দু মুসলমান, খৃস্টান বিচার না করিয়া ইচ্ছামত বাঙ্গালী মাত্রেই হাতে রাখী বাঁধা, অনুপস্থিত ব্যক্তিকে সঙ্গে মন্ত্রটি লিখিয়া ডাকে অথবা লোকের হাতে রাখী পাঠাইলেও চলিবে।
১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়। সেদিন কোলকাতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালিত হয়। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, ৩০ শে আশ্বিন প্রভাতে রবীন্দ্রনাথকে পুরোভাগে রাখিয়া বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি ও আপামর জনসাধারণ এক বিরাট শোভাযাত্রা করিয়া গঙ্গাতীরে সমবেত হইল। গঙ্গাস্নান করিয়া পরস্পরের হস্তে রাখী বন্ধন করিল। রবীন্দ্রনাথ সজনীকান্ত দাশকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সামনে যাকে পেতাম, তারই হাতে বাঁধতাম রাখি। সরকারী পুলিস এবং কনস্টেবলদেরও বাদ দিতাম না। মনে পড়ে, একজন কনস্টেবল হাত জোড় করে বলেছিল, মাফ করবেন হুজুর, আমি মুসলমান।
দুপুর সাড়ে তিনটার সময় ২৯৪ আপার সার্কুলার রোডে ফেডারেশন হল ভিত্তি প্রস্তর অনুষ্ঠানে প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোক উপস্থিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ সে অনুষ্ঠানের ঘোষণাপত্রটির বঙ্গানুবাদ পাঠ করেছিলেন। সভার শেষে সেই বিশাল জনতা পায়ে হেটে সার্কলার রোড ধরে বাগবাজারে চলে যায়। ঐ মিছিলে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন। মিছিলে সহস্র কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ রচিত স্বদেশী সঙ্গীত গীত হচ্ছিল।
এর আগে ১২ অক্টোবরে ময়মনসিংহের মহারাজার বাড়িতে একটি সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল—১৬ আক্টোবর জাতীয় অর্থভাণ্ডার গড়ে তোলা হবে। সে টাকা দিয়ে একটি তুলার কারখানা গড়ে তোলা হবে। জনসাধারণকে অনুরোধ করা হবে তারা যেন অন্তত এক দিনের আয় এই ভাণ্ডারে দান করেন। ১৬ অক্টোবর পশুপতিনাথ বসুর বাড়ির আঙিনায় অনুষ্ঠিত সভায় অর্থসংগ্রহ সভায় উপস্থিত মতে প্রায় তিরিশ হাজার টাকা সংগৃহীত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন ১০০ টাকা।
বঙ্গবঙ্গ কার্যকর হওয়ার দিন ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রথম পর্যায় শেষ হয়। এই প্রথম পর্যায়ের প্রদান ৩টি কার্যকরী পদক্ষেপ ছিল।
১) বিলেতি ভোগ্যপণ্য বয়কট।
২) স্বদেশী শিল্পের সংগঠন ও প্রচার এবং এই উপলক্ষ্যে জাতীয় অর্থভাণ্ডার স্থাপন।
৩) মিছিল, বক্তৃতা ও লেখালেখি।
প্রশান্তকুমার পাল জানাচ্ছেন, এই পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথ ৫টি সভায় যোগ দিয়েছেন, ২টি সভায় লিখিত ভাষণ পাঠ করেছেন। ১টিতে সভাপতিত্ব ও মৌখিক ভাষণ দিয়েছেন। একটিতে ঘোষণাপত্রের বঙ্গানুবাদ পাঠ করেছেন। একটি সভায় শুধু উপস্থিত ছিলেন। এই হিসেব থেকে বোঝা যায় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে রবীন্দ্রনাথের অংশগ্রহণ ছিল অন্যদের চেয়ে কম। তবে ভাণ্ডার ও বঙ্গদর্শন পত্রিকায় এ বিষয়ে তাঁর লেখালেখির পরিমাণ মোটেই কম নয়। এইসব লেখালেখির মাধ্যমে তিনি কয়েকটি বিষয়ের উপর সুস্পষ্টভাবে জোর দিয়েছেন—
১) বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি রক্ষা।
২) ভিতর থেকে ঐক্য গড়ে তোলা গেলে সে ঐক্য বাইরে কোনো শক্তি ভাঙতে পারে না।
৩) ইংরেজদের উপর রাগ করে নয়—দেশকে ভালোবেসে দেশীয় শিল্পজাত দ্রব্যাদি ব্যবহার করা দরকার।
৪) দেশীয় শিল্পোদ্যোগকে গড়ে তোলার জন্য কিছু বিলেতি ভোগ্যবস্তু থেকে নিজেদের বঞ্চিত করতে হবে। এই ত্যাগের মধ্যেকার ইতাবাচক বা ভাবগত দিকটিকেই জোর দিয়েছেন।
৫) সহজ পরিচিত সুরের মাধ্যমে রচিত গানগুলো মাধ্যমে দেশজননীর একটি সৌন্দর্য্যময়ী কল্পমূর্তি রচনা করেছেন। এ-গানগুলোর মাধ্যমে তিনি বাঙালির আত্মশক্তিকে জাগিয়েছেন। এবং একটি জনসম্প্রদায়কে একটি জাতি হিসাবে পরিণত করার চেষ্টা কবি রবীন্দ্রনাথ করেছেন।
৬) বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে সকল ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের জন্য মিলনের স্রোতধারায় নিতে চেষ্টা করেছেন।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রকৃতি
বঙ্গভঙ্গ থেকে কয়েকটি ধারায় আন্দোলন শুরু হয় বঙ্গে। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা এবং তা কার্যকর করার পর বাংলায় সশস্ত্র আন্দোলন বিকাশ লাভ করে। ১৯০৬ সালে কংগ্রেসের পূর্ণ অধিবেশনে ‘স্বরাজ’ শব্দ গৃহীত হয়। স্বরাজ বলতে কংগ্রেসের নরমপন্থীরা বুঝলো ঔপনিবেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন, চরমপন্থীরা বুঝলো স্বাধীনতা। এর থেকে উৎপত্তি হলো বিদেশী পণ্য বর্জন প্রসঙ্গ। চরমপন্থীরা চাইলো সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সর্বাঙ্গীণ বয়কট। এই পুরো আন্দোলনটিকেই স্বদেশী আন্দোলন হিসাবে চিহ্ণিত করা হয়।
ইতিহাসবিদ সুমিত সরকার দেখিয়েছেন, স্বদেশী আন্দোলন তিনটি ধারায় প্রবাহিত হয়েছিল সে সময়। প্রথমধারাকে বলা যায় গঠনমূলক স্বদেশী। ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ এ ধরনের গঠনমূলক কাজের কথা বিশদ করেছিলেন। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, আত্মশক্তির উদ্বোধন। দ্বিতীয়ধারা বয়কটকে প্রাধান্য দিয়েছিল। তৃতীয়ধারায় ছিল চরমপন্থীরা। তাদের কাছে স্বদেশী আন্দোলন এবং বয়কট গৌণ হয়ে যায়। মুখ্য হয়ে ওঠে স্বরাজ। এ নিয়ে কংগ্রেসে তুমুল বিতর্কও হয়। এরই মধ্যে স্বদেশী আন্দোলনের পক্ষে জনমত সংগঠনের জন্য জেলায় জেলায় সমিতি গড়ে ওঠে। গৃহীত নীতি কার্যকর করার জন্য তৈরি করা হয় জাতীয় স্বেচ্ছাসেবীদল। বরিশালে ‘স্বদেশ বান্ধব’, ময়মনসিংহে ‘সুহৃদ’ ও ‘সাধনা’, ফরিদপুরে ‘ব্রতী’ আর সবচেয়ে বিখ্যাত ঢাকার ‘অনুশীলন’ সমিতি। জেলা সমিতির অধীনে অনেক শাখাও স্থাপিত হয়।কলকাতায় গড়ে ওঠে ‘যুগান্তর’ নামে আরেক সংগঠন।এই দলের নেতা অরবিন্দ ঘোষ। সহোদর বারীন ঘোষ তার সহযোগী। এরা অস্ত্র হিসেবে বোমা ব্যবহার চালু করেন।
বঙ্গবঙ্গ আন্দোলনে ছাত্রসমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। ছাত্রদের এই আন্দোলনটা কঠোর হাতে দমনের চেষ্টা করে বৃটিশরাজ। ২২ অক্টোবর দি স্টেটসম্যান পত্রিকার সরকার একটি সার্কুলার জারি করে সকলপ্রকার স্কুল-কলেজের ছাত্রদের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা হয় এবং নানাবিধ শাস্তির বিধান করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ভয় দেখানো হয় যদি কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখা যায় তাহলে তার সরকারী সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া হবে। সরকারের এই ঘোষণায় কোলকাতায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যারিস্টার আবদুল রসুলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় জাতীয় বিশ্বিবিদ্যালয় গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তাবটি রবীন্দ্রনাথ আগে থেকেই দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন—শিক্ষাকে সরকারী আওতামুক্ত রাখতে হবে। তাহলে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর ইচ্ছে মত ছড়ি ঘোরাতে পারবে না। দেশের মানুষ সমাজের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে পারবে—তাদের জন্য কোন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা দরকার। কবিকল্পনা বলে রাজনীতিকরা রবীন্দ্রনাথের এই প্রস্তাবে কখনই কর্ণপাত করেননি।
১৯০৫ সালের ২৭ অক্টোবর পটলডাঙায় সহস্র ছাত্রের উপস্থিতিতে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে রবীন্দ্রনাথ সভাপতিত্ব করেন। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রস্তাব সকলের সামনে বিষদভাবে আবার তুলে ধরেন। সে সভায় সিটি কলেজের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র শচীন্দ্রনাথ বসু সরকারী সার্কুলারটি প্রত্যাখ্যান করেন। বলেন, আমরা কোলকাতার ছাত্রবৃন্দ সম্মিলিত হইয়া প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করিতেছি যে, যদি গভর্নমেন্টের বিশ্ববিদ্যালয় আমাদিগকে পরিত্যাগ করিতেও হয় তাহাও স্বীকার করি, তথাপি স্বদেশ সেবারূপ যে মহাব্রত আমরা গ্রহণ করিয়াছি তাহা কখনো পরিত্যাগ করিব না।
সে সভায় রবীন্দ্রনাথ বলেন, আমাদের সমাজ যদি নিজেদের বিদ্যাদানের ভার নিজে গ্রহণ না করে, তবে এক দিন ঠকিতে হইবে। আজকার এই অবমাননা যে নূতন তাহা নহে, অনেকদিন হইতেই ইহার সূত্র আরম্ভ হইয়াছে। আমাদের উচ্চ শিক্ষার উপর গভর্নমেন্টের অনুকূল দৃষ্টি নাই; সুতরাং গভর্নমেন্ট যদি এই পরোয়ানা প্রত্যাহারও করেন, তবুও আমরা তাহাদের হাতে শিক্ষার ভার সমর্পণ করিয়া শান্ত থাকিতে পরিব না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা আমাদের অন্তকরণকে অস্থি মজ্জায় একেবারে দাসত্বে অভিভূত করিয়া ফেলিয়াছে। তাই আমাদের নিজেদের শিক্ষার ভার নিজেদের হাতে রাখিতে হইবে।
২৯ অক্টোবর বাংলার ভগিনীদের জাতীয় ধনভাণ্ডারে দান করার আহ্বান করে আবেদন প্রচার করা হয়। আবেদনপত্রটিতে স্বাক্ষর করেন—শ্রী শিশিরকুমার ঘোষ, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দমোহন বসু, জগদিন্দ্রনাথ রায়, নলিনীবিহারী সরকার, মতিলাল ঘোষ, ভূপেন্দ্রনাথ বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সূর্যকান্ত আচার্যচৌধুরী, নবাব আবদুল সোভান চৌধুরী, কুমার সতীশচন্দ্র সিংহ ও গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ব্যধি ও প্রতিকার
২৬ অক্টোবর মল্লিকবাজার ট্রাম ডিপোর কাছে ব্যারিস্টার আবদুল রসুলের সভাপতিত্বে স্বদেশী সভায় যোগদান করেন রবীন্দ্রনাথ। সভাটিতে প্রধানত মুসলমানদের উপস্থিতিই ছিল প্রধান। সেদিনের রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যটি ব্যধি ও প্রতিকার প্রবন্ধে ছাপা হয়েছিল। এখানে তিনি মূলত হিন্দু-মুসলমান বিরোধের পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে কথা বলেছিলেন। তিনি বলেন, আজ আমরা সকলেই এই কথা বলিয়া আক্ষেপ করিতেছি যে, ইংরেজ মুসলমানদিগকে গোপনে হিন্দুর বিরুদ্ধে উত্তজিত করিয়া দিয়াছে। কথাটা যদি সত্যিই হয় তবে ইংরেজদের উপর রাগ করিব কেন? দেশের মধ্যে যতগুলো সুযোগ আছে তাহা নিজের দিকে টানিবে না, এই ইংরেজকে এতোবড়ো নির্বোধ বলিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিব এমন কি কারণ ঘটিয়াছে।
মুসলমানকে যে হিন্দুর বিরুদ্ধে লাগান যাইতে পারে এই তথ্যটাই ভাবিয়া দেখিবার বিষয়, কে লাগাইল সেটা গুরুতর বিষয় নয়। শনি তো ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না। অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই সাবধান হইতে হইবে। আমাদের মধ্যে যেখানে পাপ আছে সেখানে জোর করিবেই—আজ যদি না করে তো কাল করিবে, এক শত্রু যদি না করে তো অন্য শত্রু করিবে—এতএব শত্রুকে দোষ না দিয়া পাপকেই ধিক্কার দিতে হইবে।
তিনি বলেন, মিথ্যা কথা বলিবার কোনো প্রয়োজন নাই। এবার আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে হিন্দু-মুসলমানের মাঝে একটা বিরোধ আছে। আমরা যে কেবল স্বতন্ত্র তাহা নহে। আমরা বিরুদ্ধ।
এরপর তিনি এই ভেদব্যাধির কারণটি বর্ণনা করছেন–
আমরা বহুশত বৎসর পাশে পাশে বসিয়া এক ক্ষেত্রের ফল, এক সূর্যের আলোক ভোগ করিয়া আসিয়াছি, আমরা এক ভাষায় কথা কই, আমরা একই সুখদুঃখে মানুষ, তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ, যাহা ধর্মবিহীত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই। আমাদের মধ্যে সুদীর্ঘকাল ধরিয়া এমন-একটি পাপ আমরা পোষণ করিয়াছি, একত্রে মিলিয়াও আমরা বিচ্ছেদকে ঠেকাইতে পারি নাই। এ পাপকে ঈশ্বর কোনোমতেই ক্ষমা করিতে পারেন না।
পূর্ববঙ্গে জমিদারী পরিচালনা করতে যখন এসেছিলেন তখন প্রথম দিনেই তিনি দেখেছিলেন ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী অনুসারে আলাদা আলাদা বসার স্থান। সেই দিনই এই ব্যবস্থার উচ্ছেদ করেছিলেন তার জমিদারী থেকে। সে অভিজ্ঞতার আলোকে কবি বলেন–
আমরা জানি, বাংলাদেশের অনেক স্থানে এক ফরাশে হিন্দু-মুসলমান বসে না—ঘরে মুসলমান আসিলে জাজিমের এক অংশ তুলিয়া দেওয়া হয়। হুঁকার জল ফেলিয়া দেওয়া হয়।
এক করিবার বেলায় বলিয়া থাকি, কী করা যায়, শাস্ত্র তো মানিতে হইবে। অথচ শাস্ত্রে হিন্দু-মুসলমান সম্বন্ধে পরস্পরকে এমন করিয়া ঘৃণা করিবার বিধান তো দেখি না। যদি-বা শাস্ত্রের সেই বিধানই হয়—তবে সে শাস্ত্র লইয়া স্বদেশ-স্বজাতি-স্বরাজের প্রতিষ্ঠা কোনোদিন হইবে না। মানুষকে ঘৃণা করা যে ধর্মের নিয়ম, প্রতিবেশীর হাতে জল খাইলে যাহাদের পরকাল নষ্ট হয়, পরকে অপমান করিয়া যাহাদিগকে জাতিরক্ষা করিতে হইবে, পরের হাতে চিরদিন অপমানিত না হইয়া তাহাদের গতি নাই। তাহারা যাহাদিগকে ম্লেচ্ছ বলিয়া অবজ্ঞা করিতেছে সেই ম্লেচ্ছের অবজ্ঞা তাহাদের সহ্য করিতেই হইবে।
তিনি এই সময়ের হিন্দু নেতৃবৃন্দের ভেদাশ্রিত আন্তকরণ দেখে ব্যাথিত হয়েছিলেন। এ কারণে তিনি দেখেছিলেন, এভাবে চলতে থাকলে এই ভেদের বীজটি একদিন বিষবৃক্ষে পরিণত হবে। বিচ্ছেদটি চূড়ান্ত হবে হৃদয়ে, দেশবিচ্ছেদে, সংস্কৃতি বিচ্ছেদে, মনুষ্যত্ব বিচ্ছেদে। ভয়ঙ্করভাবে নিপীড়িতরা পীড়কদের উপর প্রতিশোধ নেবে। কবি বলেন, একদিন মানুষকে মানুষ বলিয়া গণ্য করা যাহাদের অভ্যাস নহে, পরস্পরের অধিকার যাহারা সূক্ষাতিসূক্ষভাবে সীমাবদ্ধ রাখিবার কাজে ব্যাপৃত—যাহারা সামান্য স্খলনেই আপনার লোককেই ত্যাগ করিতেই জানে, পরকে গ্রহণ করিতে জানে না—সাধারণ মানুষের প্রতি সামান্য শিষ্টতার নমস্কারেও যাহাদের বাধা আছে—মানুষের সংসর্গ নানা আকারে বাঁচাইয়া চলিতে যাহাদিগকে সর্বদা সতর্ক থাকিতে হয়—মনুষ্যত্ব হিসাবে তাহাদিগকে দুর্বল হইতেই হইবে। যাহারা নিজেকেই নিজে খণ্ডিত করিয়া রাখিয়াছে, ঐক্যনীতি অপেক্ষা ভেদবুদ্ধি যাহাদের বেশি দৈন্য অপমান ও অধীনতার হাত হইতে তাহারা কোনোদিন নিষ্কৃতি পাইবে না।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের আরও কিছু ত্রুটির কথাটাও তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ। বয়কট ও স্বরাজ মন্ত্র গ্রহণের মধ্যে দিয়ে ধরা পড়েছে এই আন্দোলনের প্রধান শত্রু ইংরেজের চেয়ে নিজেরাই নিজেদের ভেদ সম্পর্কটাই বড় শত্রু। বাইরের ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নেমে দেখা গেল নিজেদের মধ্যেই একটা যুদ্ধ লেগে আছে। এই আত্মকলহ বজায় রেখে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা অসম্ভব।
তিনি বলেন, আজ আমাদের ইংরেজী পড়া শহরের লোক যখন নিরক্ষর গ্রামের লোকের কাছে গিয়া বলে ‘আমরা উভয়ে ভাই’—তখন এই কথাটার মানে সে বেচারা কিছুতেই বুঝিতে পারে না। যাহাদিগকে আমরা ‘চাষা বেটা’বলিয়া জানি, যাহাদের সুখদুঃখের মূল্য আমাদের কাছে অতি সামান্য, যাহাদের অবস্থা জানিতে হইলে আমাদিগকে গবর্ণমেন্টের প্রকাশিত তথ্যতালিকা পড়িতে হয়, সুদিনে-দুর্দিনে আমরা যাহাদের ছায়া মাড়াই না, আজ হঠাৎ ইংরেজের প্রতি আস্পর্দ্দা প্রকাশ করিবার বেলায় তাহাদের নিকট ভাই-সম্পর্কের পরিচয় দিয়া তাহাদিগকে চড়া দামে জিনিস কিনিতে ও গুর্খার গুতা খাইতে আহ্বান করিলে আমাদের উদ্দেশ্যের প্রতি সন্দেহ জন্মিবার কথা। সন্দেহ জন্মিয়াও ছিল। কোনো বিখ্যাত স্বদেশী প্রচারকের নিকট শুনিয়াছি যে, পূর্ববঙ্গে মুসলমান শ্রোতারা তাঁহাদের বক্তৃতা শুনিয়া পরস্পর বলাবলি করিয়াছে যে, বাবুরা বোধ করি বিপদে ঠেকিয়াছে। এই বাবুদের উদ্দেশ্যসাধনের জন্য সাধারণ মানুষের কাছে যাওয়া, কিছু সুবিধার জন্য ঐক্যের কথা বলা এবং ঐক্যের আগ্রহে হৃদয়ের যোগ না থাকায় এই বয়কট বা স্বরাজের আন্দোলনটা সাধারণ মানুষের কাছে অর্থহীন হয়ে উঠেছে বলে রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন।
এই রকম একটি পরিস্থিতিতে বিদেশী রাজা চলিয়া গেলেই দেশ যে আমাদের স্বদেশ হয়ে উঠবে এটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। দেশের লোককেই দেশের সকল মানুষের অন্ন-বস্ত্র-সুখস্বাস্থ্য-শিক্ষাদীক্ষা দানে সর্বপ্রধান সহায় হতে হবে। দুঃখে বিপদে দেশের মানুষই সকল মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িতে হবে—কেবল সুবিধায় নয়। অসুবিধায়ও। অসুবিধায়ও ভাই বলে তাঁর কাছে যেতে হবে। তবেই স্বরাজ সম্ভব। অন্য কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে কবি বলেন।
কবির এই চিন্তাটা ছিল প্রচলিত রাজনীতিকদের চেয়ে ভিন্ন। শুধু ভিন্ন বলাটা সঙ্গত হয় না—বলা উচিৎ একেবারে তাঁদের বিপরীত চিন্তার প্রকাশ। নেতারা যখন বঙ্গবঙ্গ আন্দোলনকে তাঁদের সাময়িক সুবিধার কর্মনীতি হিসেবে গ্রহণ করছে—সেখানে একটা সুদূর প্রসারী চিন্তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তাকে উপস্থান করেছেন, উল্টো পথে হাঁটছেন।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় : ছাত্রসমাজ প্রস্তুত–দোদুল্যমান রাজনীতিক
২৭ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথ কোলকাতায় ফিরে আসেন। সেখানে ফিল্ড এন্ড একাডেমী ভবনে সদস্য ও ছাত্রদের সান্ধ্যসম্মিলনে সভাপতিত্ব করেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, বঙ্গবঙ্গ ব্যাপারটি সর্বজনীন বলেই ছাত্ররা যোগদান করবে—এটা খুব স্বাভাবিক। নেতাদের ত্যাগ স্বীকার যথেষ্ট নয় বলে অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের পাঁজনের শক্তিকে সংহত করা গেলে নেতারাও যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত হবেন। জাতীয় ধনভাণ্ডারের ইংরেজি নাম NATIONAL FUND না রেখে বঙ্গভাণ্ডার রাখার প্রস্তাব করেন এই সভায়। তাঁর মতে স্বদেশী কলকারখানা গড়ে তোলা গেলে স্বদেশী দ্রব্যের যোগান বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া আমাদের শিক্ষাকে স্বাধীন করার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যায়লয প্রতিষ্ঠার সময় এসেছে। গভর্নমেন্টের সম্মন ও চাকরীর মায়া ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে ছাত্রদের পরামর্শ দেন। যদি ছাত্ররা প্রস্তুত থাকে এই ত্যাগ স্বীকারে তাহলে নেতারা বাধ্য হবে তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে।
৫ নভেম্বর বিকেলে ডন সোসাইটিতে দুহাজার ছাত্রের উপস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, বাংলাদেশে আজ নবজীবনের সূত্রপাত হয়েছে। বিদেশী বর্জন ও স্বাধীন স্বদেশী শিক্ষার দ্বিমুখী সংকল্পকে আশ্রয় করে চলেছে বাংলা। প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় শুরুতেই জীবিকোপার্জনের ব্যবস্থা, অভিভাবকদের মতগঠন, ইঞ্জিয়ারিং ডাক্তারি ভূবিদ্যা ইত্যাদি বিষয় চালু করা না গেলে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ইংরেজের বিশ্বিদ্য
©somewhere in net ltd.
১| ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:০৬
খন্দকার আঃ মোমিন বলেছেন: এক জন ঘোর সাম্প্রদায়ীক বেক্তিকে সাম্প্রদায়িক বলাটা আসলে ই বে মানান , এটা আসলে অর্জিত জিনিশ আবার অরজন করার চেষ্টা করার নামান্তর , আসলে ভারত যখন ইংরেজরা লুটিয়া পুটিয়া খাইতেছিল রবি তখন ইংরেজদের কে চাটিয়া চুটিয়া জমিদারী করিতেছিল , খাদ্যাভাবে জরা জিরন মানুষ গল তখন রবির হাতে ঘামের গন্ধ মিশ্রিত ফসল গুলা তুলে দিচ্ছিল , রবি সে গুলা দিয়া রাতের আলো খরিদ করিতেন ,বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়া রবির নাটক তো সবার ই জানা , যেই বাংলার স্বাধীনতার সুত্র বঙ্গভঙ্গ নিয়ে রবির দাফাদাফি দুনিয়া বাসির অজানা নয় , ফলাফল ৭১ এ আবার মুজিব এর সংরাম এর অগনিত প্রান আমাদের কে কোরবানি করিতে হইল , তাই জোড়া ঠাকুরের এই গোঁড়া ঠাকুর কে নিয়া কিছু বলা আসলেই ইমানের জন্য ক্ষতি কারক হইতে পারে ভাবিয়া সকল কে ই মুখে ছুইঙ্গাম নিয়া বেলুন ফুলানো উচিৎ ।