নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

pramanik99

আমার স্কুল জীবনের স্মৃতিগুলো বার বার মনে পড়ে। ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেই দিনগুলোতে।

প্রামানিক

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

প্রামানিক › বিস্তারিত পোস্টঃ

একাত্তরে যজ্ঞেশ্বর বুড়োর করুণ কাহিনী (দ্বিতীয় পর্ব)

২৭ শে জুন, ২০২৪ রাত ৯:১৩


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

রাস্তার পাশে দুইজন বসে আছি, এমন সময় পশ্চিম দিক থেকে ধানের ক্ষেতের ভিতর দিয়ে দেখি তিন চারজন লোক হাতে ধারালো ছুরি নিয়ে আমাদের দিকেই ছুটে আসতেছে। এই দৃশ্য দেখেই বুড়ো আমার এক হাত ধরে বলল, দাদারে ওরা ছুরি নিয়ে আইসপা নাইকছে ক্যা?

তাদের ছুরি নিয়ে দৌড়ে আসতে দেখে আমিও ভয়ে পড়ে গেলাম। নাজানি এরা কোন বিপদ ঘটায়। বুড়োকে মারার পাশাপাশি যদি আমাকেও মেরে ফেলে করার কিছুই থাকবে না। দেশে কোন প্রশাসন নাই। বিচার চাওয়ার জায়গাও নাই। থানায় বিচার চাইতে যাওয়া মানেই নিজের কল্লা নিজে পাক সেনাদের ছুরির তলে দেয়া। আমরা যে রাস্তায় যাচ্ছিলাম সে রাস্তার পশ্চিম পাশেই বারো মাইসা নদী। একসময় খুব খড়¯্রােতা ছিল বর্তমানে মরে গেছে। লোকগুলো বারোমাইসা নদীতে নেমে দৌড়ে পার হচ্ছে। আর দুই তিন মিনিট পরেই তারা আমাদের কাছে এসে পৌঁছবে। ভয়ের চোটে আমি বুড়োকে ফেলেই রাস্তার পূর্বপাশে সামসুল মৌলভী সাহেবের বাড়ির দিকে দৌড়ালাম। সামসুল মৌলভীর বাবা বাড়ির সামনেই দাঁড়ানো ছিলেন। আমার দৌড়ানো দেখে সামসুল মৌলভীর বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, দৌড়াও কেন বাবা, কি হোচে তোমার? আমি বললাম জ্যাঠো, তিন চারজন লোক পশ্চিম দিক থাকি ছুড়ি হাতোত করি দৌড়ে আইসপার নাইগছে, আমি ভয়োত পরি আপনার বাড়িত দৌড়ি আচ্চি। মৌলভীর বাবা বলল, চলোতো দেখি কেটা ছুরি নিয়ে আইসে। আমাকে সাথে নিয়ে মৌলভীর বাবা রাস্তায় এসে দেখে যজ্ঞেশ^র বুড়ো রাস্তার কিনারে ঘাসের উপর চোখ বন্ধ করে উপর হয়ে শুয়ে আছে কিন্তু আমাদের সামনে একটি মাঝ বয়সি লোক দু’টি গরু নিয়ে যাচ্ছিল তারা তাকে ধরে বসেছে। লোকটির হাত থেকে গরু দু’টি ছিনিয়ে নিয়ে লোকটির গলায় ছুরি ধরে আছে। লোকটি চোখ বন্ধ করে দুই চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছে। সে ধরেই নিয়েছে বিনা করণে গলায় যখন ছুরি ধরেছে তখন এদের হাত থেকে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কম একটু নড়াচড়া করলেই হয়তো ফ্যাছ করে গলা কেটে দু’ভাগ করে দিবে। লোকটির গলায় ধারালো ছুরি ধরা দেখে আমিও ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। জীবনে কখনও মানুষ খুন করতে দেখি নাই। যদি চোখের সামনে একজন জীবন্ত মানুষকে গলা কেটে হত্যা করে তখন এই দৃশ্য সহ্য করতে পারবো কিনা জানি না। সামসুল মৌলভীর বাবা বয়স্ক লোক হওয়ার পরেও দেখলাম অনেক সাহসী লোক। এই দৃশ্য দেখে সামসুল মৌলভীর বাবা তাড়াতড়ি এগিয়ে গেলেন। কাছে গিয়ে ছুরিওয়ালাদের ধমক দিয়ে বললেন, এই ছুরি নামা, নামা ছুরি। এই লোকের গলাত ছুরি ধরছিস কিসোক? ছুরি ধরা লোকটি বলল, চাচা আপনে সরি যান, এরঘোরে ছাড়া যাবে না। এরা গরু ছাগল নিয়ে ভারত পালাবার নাইগছে ওদিকে আর্মি আসি হামার ঘর বাড়ি আগুন দিয়া পুড়ি দিবা নাইগছে। এরঘোরে কারণে হামরা বিপদে পড়ি গেছি।

সামসুল মৌলভীর বাবা গর্জে উঠলেন, তোরঘোরে ঘর-বাড়ি পুড়ি দেয় না কি করে সেটা তোরা ঠেকাবু, তোরা এই লোকটাক আটকাছিস কিসোক, এই লোক কি তোরঘোরে ঘরোত আগুন দিয়া আইচ্চে? ্পাসে আরেকজন ছুরিওয়ালা ছুরি নেড়ে নেড়ে বলল, এরঘোরে ছাড়ি দিলে হামার গাঁওয়ের একটা মানুষও বাঁইচপা নয়। তামানগুলাক আর্মিরা মারি ফ্যালাবে। মৌলভীর বাবা বললেন, তোরঘোরে মারি ফেলায় না পুড়ি দেয় সেটা তোরা সামাল দিবু, আরেক ঝোনের গরু কাড়ি নিয়া যায়া আর্মি ঠেকাবু। তোরা মোক পাগল পাছিস, তোরঘোরে মতলব হামি বুঝি নাই। মাস্তানি করলে তোরঘোরে গাঁওত যায়া কর, হামার গাঁওত মাস্তানি করবু তো ভুড়ি ফাটে ফ্যালামো।
সামসুল মৌলভীর বাবার সাথে ছুরিওয়ালাদের উচ্চ বাক বিতন্ডা শুরু হওয়ায় ইসমাইল ডাক্তার কিছুটা দূরে ছিলেন তিনিও এগিয়ে আসলেন, সুলতান নামের এক কিশোর এগিয়ে আসলেন। মারদাঙ্গা হাকডাক শুনে ঐ গ্রামের আরো কয়েকজন এগিয়ে আসলেন। লোক সংখ্যা বাড়তে থাকায় ছুরিওয়ালারা একটু দমে গেল। ইসমাইল ডাক্তার এসেই বলল, এই গরু ছাড়, যার গরু তার হাতোত দে, নাহলে কিন্ত কাল্লা কাটি নদীত ভাসি দেমো। এটা হামার গাঁও, তোরঘোরে গাঁও নয়। বিপদে পড়ি ওরঘোরে গরু ওরা নিয়া যাবার নাইগছে তোরঘরে জ¦লে কিসোক। সন্ত্রাসী করার জায়গা পাইস নাই। সন্ত্রাসী করলে নিজের গাঁওত যায়া কর হামার গাঁওত সন্ত্রাসী করবু তো ভুড়ি ফাটে ফ্যালামো। ছুরিওয়ালারা কি যেন বলতে যাচ্ছিল ইসমাইল ডাক্তারসহ কয়েকজন একসাথে চিল্লিয়ে গালি দিয়ে বলল, আরে---চু-- আগে গরুর দড়ি ছাড়, যার গরু তার হাতোত তুলি দে, তা না হলে তোরঘোরে চারটাকেই পাট ক্ষ্যাতোত পুঁতি থোমো। দ্যাশোত বিচার না থাকায় তোরা যেমন মাইনষের গরু ছিনি নিবার আইচ্চিস সেইঙ্কা হামরাও তোঘোরে পুঁতি থুলে কিচ্চুই কইরবার পাবু না। এবার ভালোই ভালোই গরু ছাড়।

ইসমাইল ডাক্তার, সামছুল মৌলভীর বাবা, এবং আরো অনেকে এসে প্রতিবাদ করায় ছুরিওয়ালা লোকগুলো বুঝতে পারল এখানে বেশি জোরাজুরি করলে উল্টো মার খেতে হবে। এখানকার লোকজন স্বার্থপর জুলুমবাজ নয়। তারা বিপদে পড়া মানুষদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভুতিশীল। উপস্থিত লোকজনের মারমুখি প্রতিবাদে তাদের উদ্দেশ্য সফল না হওয়ায় নিজেদের হাতে নেয়া গরুর দড়ি গরুওয়ালার হাতে দিতে বাধ্য হলো। তারা এলাকার লোকজনের ভয়ে আর কোন বাক বিত-া না করে সোজা পশ্চিম দিকে দৌড়ে বারো মাইসা নদী পার হয়ে চলে গেল। গরু ছেড়ে দিয়ে লোকগুলো যখন পশ্চিম দিকে পালিয়ে যায় তখন লোকটার চেহারা দিকে তাকিয়ে দেখি প্রাণহীন মরা কাঠ যেমন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে তেমনিভাবে লোকটি দাঁড়িয়ে আছে। অনড় অবস্থায় দুই চোখের পানি দিয়ে বুক ভেসে যাচ্ছে। নিজের হাতের গরু সন্ত্রাসীরা কেড়ে নিলেও সামান্যতম প্রতিবাদ করে নাই, করার সাহসও পায় নাই। প্রতিবাদ করার আগেই গলায় ছুরি ধরেছে। মৃত্যুর ভয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে।

গরুর দড়িগুলো ছুরিওয়ালারা লোকটির হাতে তুলে দেয়ার কিছুক্ষণ পরে কাঠ হয়ে যাওয়া লোকটি একটু নড়ে চড়ে দাঁড়ালো। চোখ খুলে সামছুল মৌলভীর বাবাকে সামনে দেখেই পা জড়িয়ে ধরে হু হু করে কান্না করতে লাগল। মৌলভীর বাবা তাকে টেনে তুলে দাঁড় করালে লোকটি কেঁদে কেঁদে বলল, ভাই, হামার বাচ্চাগুলা কাল থেকে না খাওয়া, হাতোত একটা পয়সা নাই। মনে কচ্ছিলাম গরুদু’কনা চরোত নিয়ে বিক্রি করি একটু চাল ডাল কিনি বাচ্চাগুলাক খাওয়ামো, সেই গরু তারা হাত থাকি কারি নিয়া গলায় ছুরি ধইরলো। আপনারা না থাকলে ওরা গরুও নিতো সাথে হামাকেও মারি ফেলতো। আপনাদের ঋণ আমি জীবনেও শোধ দিবার পাবার নই। সামছুল মৌলভীর বাবা ছিলেন উপস্থিত লোকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক লোক। লোকটির মাথায় হাত দিয়ে বললেন, আপনি নির্ভয়ে যান। এই এলাকায় কেউ আর আপনাক ধইরবা নয়।

আমার দেখা এই ঘটনায় আমি সামসুল মৌলভীর বাবাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দিব তা আজও ভাষা খুঁজে পাই না। ইসমাইল ডাক্তারসহ উপস্থিত লোকগুলোর সহযোগীতা ভুলে যাওয়ার মতো নয়। যুদ্ধের সময় বেশির ভাগ মানুষই মানুষের প্রতি সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। ভালো লোকগুলোর দ্বারা মানুষের ক্ষতি তো হয়ই নাই বরঞ্চ তারা বিভিন্ন ভাবে বিপদগ্রস্ত অসহায় মানুষদের সহযোগীতা করেছে। না খাওয়া মানুষদের জন্য যতটা পেরেছে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। এর মাঝেই হাতে গোনা কিছু স্বার্থপর অমানুষদের কারণে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেসব মানুষদের ধিক্কার জানানো ছাড়া আর কিছু করার নাই।

সামছুল মৌলভী ছিলেন ফুলছড়ি হাই ্স্কুলের শিক্ষক। তার বাবা দেখতে মৌলানার মতো হলেও মৌলানা ছিলেন না তবে ভালো নামাজি ছিলেন এবং সবসময় মৌলানার পোষাক পরে থাকতেন। মৌলভীদের গণহারে রাজাকার বললেও এই মৌলভী এবং মৌলভী সাহেবের বাবাকে সেই তোকমা দেয়ার সুযোগ নাই। সেই সময় ফুলছড়ি এলাকার যারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল তাদের বেশির ভাগই ছিল তারই ছাত্র। প্রত্যেকটা ছাত্রকেই তিনি নিজের সন্তানের মতো দেখতেন। তার ভুলের কারণে ছাত্ররা বিপদে পড়–ক এটা তিনি কখনই চান নাই। যেহেতু তিনি আলেম পাস ছিলেন ভালো উর্দু জানতেন। উর্দু জানার কারণে যতটা পেরেছেন অনেকের উপকার করেছেন, নিজে কারো ক্ষতি করেন নাই এবং কারো ক্ষতি হতেও দেন নাই। যতোটা পেরেছেন হিন্দু মুসলিম উভয় ধর্মের মানুষের সহযোগীতা করেছেন।
গরু ছিনিয়ে নিতে আসা দস্যু প্রকৃতির লোকগুলো চলে যাওয়ার পর লোকটি গামছা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে গরু নিয়ে রওনা দিলে আমি আবার যজ্ঞেশ^র বুড়োর কাছে ফিরে আসি। এসে দেখি বুড়োকে যেখানে যে অবস্থায় রেখে গিয়েছিলাম সেখানে সেই অবস্থায় উপর হয়ে শুয়ে আছে। এতো কিছু ঘটনা ঘটে গেলেও বুড়ো এক চুলও নড়াচড়া করে নাই। মনে হয় মৃত্যুর ভয়ে চোখ পর্যন্ত খুলে তাকায় নাই।
আমি কাছে এসে ডাক দিয়ে বললাম, ও দাদা, উঠেক, ছুরিওয়ালারা চলি গেইছে। কয়েকবার ডাকার পরে মনে হলো বুড়োর সম্বিত ফিরে এলো। আস্তে আস্তে মাথা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দাদা আইচ্চিস?
বলালাম. হ দাদা আইচ্চি
ছুরিওয়ালারা আছে না চলি গেইছে?
বললাম, চলি গেইছে
কোন দিকে গেইছে?
পশ্চিম দিকে
ওইগলা কেটা রে?
জানিনা দাদা
চিনিস নাই?
না
তাদেরকে আসলেই চিনি নাই। তারা হয়তো উত্তর পশ্চিমের কোন এক গ্রাম থেকে এসেছিল।
অস্ত্রধারীরা চলে গেছে এমন কথা শুনে বুড়ো এবার শোয়া থেকে উঠে বসল। আমার এক হাতে বালতি আরেক কাঁধে বুড়োর ঝোলা। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, দাদা উঠেক, তাড়াতাড়ি নদী পার হওয়া নাইগবে, নাহলে আবার কোন বিপদ আসি পড়ে কওয়া যায় না। বিপদের কথা বলায় বুড়ো তড়িঘড়ি লাঠি ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
দুইজনে আবার রওনা দিলাম। জটলা হওয়া উপস্থিত লোকগুলো বুড়োকে দেখে অনেকেই বলে উঠল, এই ব্যুাড়া এতক্ষণ কোনটে আছিল রে। হামারঘোরে চোকোত পরল না ক্যামা।
বললাম, ছুরিওয়ালা গুলাক আইসতে দেখি রাস্তায় উপ্পুর হয়া শুতি আছিল।
কোন্ঠে শুতি আছিল বাহে, হামরা কেউ দেখলাম না।
দেখপেন ক্যাং করি, ব’ুড়া তো সোজা হয়া আছিল না। উপর হয়া শুতি মাটির সাতে মিশি আছিল সেই জন্যে কেউ চোকোত দেখেন নাই।

সামছুল মৌলানার বাড়ি থেকে নদী খুব একটা দূর নয়। পূর্বদিকে কয়েকশত গজ হবে। তিন চার বার বিশ্রম নিয়ে নিয়ে বুড়োসহ নদীর ঘাটে পৌঁছিলাম। নদীর পাড়ে এসেও পড়লাম বিপদে। বৈশাখ মাস হওয়ায় নদীতে পানি বেড়ে এক গলা সমান হয়েছে। আমি হেঁটে নদী পার হতে পারলেও বুড়ো পার হতে পারছে না। আমি যখন এক বুক পানিতে নামবো তখন বুড়ো কুঁজো হওয়ার কারণে নাক মুখসহ পুরো পানির নিচে তলিয়ে যাবে। বুড়ো যে সাঁতার দিবে সে শক্তিও তার গায়ে নাই। আমি তাকে উঁচু করে ধরে পার করাবো সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। এক হাতে ভাতের বালতি অন্য হাতে বুড়োর চিড়া মুড়ির ঝোলা। এই অবস্থায় কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। আশে পাশে কোন লোকজনও নাই যে তাদের সহযোগীতা নিব। খান সেনাদের ভয়ে কেউ খেয়া নৌকাও চালু করে নাই যে নৌকা দিয়ে পার হবো।
নদী পার হওয়া নিয়ে বিপদেই পড়ে গেলাম। বুড়োকে ফেলেও যেতে পারছি না আবার বুড়োর কারণে নদীও পার হতে পারছি না। এদিক ওদিক নৌঁকা খুঁজতে লাগলাম, কিন্তু কোথাও নৌকা পেলাম না। নদীর পারে বুড়োকে বসিয়ে রেখে উত্তরে গিয়ে নৌকা খুঁজতে লাগলাম। সেখানেও কোন নৌকা পেলাম না। আরো উত্তরে নৌকা খুঁজতে গিয়ে দেখি নদীর ছোট একটা ঘোনের ভিতর আমার বড় ফুফুর বড় ছেলে বাহার ভাই তার নিজস্ব ডিঙি নৌকা নিয়ে বসে আছে। নদীর খাড়া কাছারের নিচে ছোট বাঁক হওয়ায় দূরে থেকে চোখে পড়ে না। সম্ভাবত পশ্চিম পাড়ে কোন কাজে এসেছিল। আমি নৌকার কাছে যেতেই বাহার ভাই আমাকে দেখে বলল, কিরে চরে যাবি?
বললাম, যাবো।
উঠেক, নৌকায় উঠ।
বললাম, আমি তো একা না ভাই, সাথে কান্তির দাদা আছে।
বাহার ভাই বলল, ওরা সব তো চরে এই বুইড়া আবার বাদ পড়ল কেমনে?
বললাম, ওরা যার যার মতো চরে পালায়ে আসলেও বুড়াকে সাথে আনে নাই। বাড়িতে বুড়া একলা একলা একদিন একরাত থাকার পরে আমাদের বাড়ি আইসা আশ্রয় নিছে।
ভাই বলল, বুইড়া কই আছে নিয়ে আয়।
নদীর পার এ্যাবড়োথেবড়ো হওয়ায় বুড়ো হাঁটতে পারছিল না। অনেকটা ধরে ধরেই নৌকার কাছে ৃনিয়ে আসলাম। নৌকার কাছে আনলেও নৌকায় উঠতে পারছিল না। পাঁজাকোলা করেই তাকে নৌকায় উঠাতে হলো। বাহার ভাই দেরি করলেন না, নৌকায় উঠার সাথে সাথেই নদী পার করে দিলেন। নদী যখন পার হলাম তখন অনেক বেলা হয়েছে। নদী পার হওয়ার পরে আরো আধা মাইল বালুচর হাঁটতে হবে।

নদী পার হওয়ার পর বালু চর হেঁটে বুড়ো কিছুদূর গিয়ে আবার বসে পড়ল। নদীর ওপারে শক্ত মাটিতে হেঁটে এসেছে তাতেই একশ’ গজ পর পর বসেছে আর এখন তো বালুর চর। বালুচরে হাঁটতে গেলে পা পিছন দিকে যায়। শক্ত মটির চেয়ে বালুর ভিতর হাঁটতে শক্তিও বেশি লাগে। ওপারে যেমন তেমন এপারে এসে বুড়োকে নিয়ে আরো সমস্যায় পড়ে গেলাম। আমি চিন্তা করলাম এই বুড়োকে এভাবে সাথে নিয়ে গেলে বেলা পার হয়ে যাবে। ততক্ষণে আমার মেজ মামাসহ ভাইবোনগুলো না খেয়ে কষ্ট করবে। ভাতগুলো আগে পৌঁছে দিয়ে তারপর না হয় এসে বুড়োকে ধরে ধরে নিয়ে যাবো। সেই চিন্তা করে বুড়োকে বললাম দাদা, তুই এত্তি এ্যানা বোসেক, মুই দৌড় দিয়া ভাতের বালতি আর তোর ঝোলাটা থুইয়া আইসম। এ্যাগলা নিয়া মুই হাইটপার পাবার নাইকচম না।
কথা শুনে বুড়ো তাড়াতাড়ি বলল, না না, তুই মোক থুইয়া যাইস না, সাতোত করি নিয়া যা। বললাম, এ্যাগলা থুইয়া আইসম তাহলে তোক ধরি ধরি নিয়া যাবার পামো। এখন তো বোচকাবুচকি নিয়া মুইও হাইটপার পাবা নাইকচম না তোকও ধইরবার পাবা নাইকচম না।
বুড়ো আমার মুখের দিকে অসহায়ের মতো করুণ চোখে তাকিয়ে বলল, দাদা তুই আইসপু তো? মোক বালু চরোত ফ্যালে থুইয়া যাবু না তো?

বললাম, না না দাদা, তুই চিন্তা করিস না, এতো কষ্ট করি নদী পার করি আনি এ্যাটে তোক ফ্যালে থুইয়া যামো এটা ভাবলু ক্যাংকা করি। নদী পার হছি যখন তখন আর চিন্তু নাই। বিপদ কাটি গেছে এখন আস্তে ধীরে গেলেই চলবে। দাদা তুই ভয় করিস না, মুই দৌড় দিয়া যামো আর আইসমো।

আমি বুড়োকে বসিয়ে রেখে চলে যাওয়ায় বুড়ো অসহায়ের মতো আমার চলার পথে তাকিয়ে ছিল। আমি পিছন ফিরে তার মায়াভরা চাহনি দেখার পরে সামনে যেতে বিবেকে বাঁধছিল, কিন্তু তারপরেও বুড়োকে রেখেই যেতে হয়েছিল। আমি অনেকটা দৌড়ে দৌড়েই প্রায় ফুফুর বাড়ি গিয়ে পৌঁছলাম। গিয়ে দেখি সত্যিই ভাইবোনগুলো না খেয়ে আছে। আমার যাওয়ার দেরি দেখে মেজ মামাসহ তিন ভাইবোন রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। এক দিকে ক্ষুধার্ত অন্য দিকে আমাদের কোন বিপদ হলো কিনা এই শঙ্কায় আছে। আমাকে দৌড়ে আসতে দেখেই যেন তারা প্রাণ ফিরে পেল। ফুফুর বাড়ির উঠানে যেতেই বড় বোন ভাতের বালতি হাতে তুলে নিল। আমি ঘরে ঢুকে বুড়োর পোটলা চোকির উপর রেখে বাড়ির সামনে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি আট দশ জন গোল হয়ে বসে কি যেন আলোচনা করছে। সম্ভাবত বর্তমান পরিস্থিতি নিয়েই আলোচনা করছে। তারা বাড়ি ফিরে যাবে না ভারত চলে যাবে এইরকমই কিছু একটা আলোচনা করতেছিল। কাছে গিয়ে দেখি ঐ দলের মধ্যে কান্তি দা এবং তার বাবা শান্তি সরকারও বসে আছেন। আমি কান্তি দার কাছে গিয়ে বললাম, দাদা, তোমারঘোরে ব্যুাড়াক সাথে নিয়ে আইচ্চি। এ কথা শুনে কান্তি দা লাভ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল, বলল, কোনটেরে?
বললাম নদীর বাতাত বসে থুইয়া আইচ্চি।
এই পারোত না ঐ পারোত?
বললাম, এই পারোত।
এই পারের কোন সমানতে থুইয়া আইচ্চিস?
বললাম, এই সোজা পশ্চিম দিকে নদীর পারোত বসে থুইয়া আইচ্চি।
কথা শুনে কান্তি দার বাবা তাড়াতাড়ি বলল, নরেন কোটেরে, তাড়াতাড়ি কান্তির সাথে যাতো, বাপোক আগে নিয়া আয়। বাবার কথায় কান্তি দা আর নরেন পশ্চিম দিকে দৌড়ালো। তারা যাওয়ার কারণে আমি আর নদীর পারে গেলাম না। কিছুক্ষণ পরে কান্তি দা আর নরেন বুড়োকে দুই পাশে দুইজন ধরে ধরে নিয়ে আসল। বুড়ো হাঁটতে পারছিল না তারা অনেকটা পাঁজাকোলা করেই নিয়ে আসল।

ছবিঃ ইন্টারনেট

মন্তব্য ১৪ টি রেটিং +৬/-০

মন্তব্য (১৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে জুন, ২০২৪ রাত ১১:১৬

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: আহ.... মুক্তিযুদ্ধের সেই কঠিন সময়ের গল্প, হৃদয়স্পর্শী। যুদ্ধ দেখি নাই, কিন্তু সেসময়কার ঘটনা শুনলে মনোজগত কেমন আদ্র হয়ে যায়।

২৮ শে জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫২

প্রামানিক বলেছেন: আপনি কেমন আছেন ভাই? আপনাদের ব্লগে দেখলে মনটা ভালো হয়ে যায় আবার ব্লগে ফিরতে মন চায়। ধন্যবাদ আপনাকে

২| ২৭ শে জুন, ২০২৪ রাত ১১:৩০

মনিরা সুলতানা বলেছেন: কঠিন সময়ের গল্প।

২৮ শে জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৩

প্রামানিক বলেছেন: তখন বাঙালিদের জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘুরতে হতো। ধন্যবাদ আপনাকে

৩| ২৮ শে জুন, ২০২৪ রাত ১:৪২

কামাল১৮ বলেছেন: যুদ্ধ করেছি এবং অনেক কিছু দেখেছি।জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড দেখুন।অনেক মর্মস্পর্শী দৃশ্য আছে তাতে।যেটা বাস্তবের দৃশ্য।

২৮ শে জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৪

প্রামানিক বলেছেন: স্টপ জেনোসাইড দেখেছি, জেনোসাইডের মতো অনেক ঘটনা আমার চোখের সামনেই ঘটেছে। মূল্যবান মন্তব্যর জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ

৪| ২৮ শে জুন, ২০২৪ ভোর ৪:২৮

শ্রাবণধারা বলেছেন: ভালো লাগলো এটা জেনে যে পরিশেষে যজ্ঞেশ্বর দাদু ব হুকষ্ট করে (এবং আপনাকেও কষ্ট) দিয়ে চরে তার সন্তানদের কাছে পৌছুঁতে পেরেছিলেন।

পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল পথ যেন শেষই হচ্ছিলো না, আমার দুপাও যেন চরের বালিতে আটকা পরে ভারি হয়ে যাচ্ছিল।

২৮ শে জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৬

প্রামানিক বলেছেন: বুড়ো কমপক্ষে আশি পঁচাশি বছরের বৃদ্ধ ছিল। তাকে চরে নিতে গিয়ে আমাকে সত্যিই অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। ধন্যবাদ আপনাকে। অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল।

৫| ২৮ শে জুন, ২০২৪ ভোর ৫:১৭

আহমেদ জী এস বলেছেন: প্রামানিক,





একটা কঠির সময়ের বাস্তব চিত্র। সে সময়কালে সকল ধর্মাবলম্বীরা যেমন একসাথে মিলেমিশে থাকতো, এক অন্যের দুঃখ কষ্টে এগিয়ে আসতো, সেসব এখন রূপকথার মতো মনে হয়!

২৮ শে জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৮

প্রামানিক বলেছেন: আপনি ঠিক বলেছেন গুরু। তখন হিন্দু মুসলমানের মধ্যে এতো তফাৎ ছিল না। উভয় ধর্মের লোকজন মিলেমিশে মানুষের উপকার করেছে। মন্তব্য করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ গুরু।

৬| ২৮ শে জুন, ২০২৪ রাত ১০:২৫

রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: দুটো পর্ব একসাথে পড়লাম। বাস্তব কাহিনী যেন রূপকথাকেও ছাড়িয়ে গেছে। কী যে ভয়াবহ দিন গেছে।

২৯ শে জুন, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

প্রামানিক বলেছেন: তখনকার কথা মনে হলে এখনো গা শিউরে উঠে

৭| ২৯ শে জুন, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫

সাড়ে চুয়াত্তর বলেছেন: চমৎকার বর্ণনা। আঞ্চলিক ভাষাও ভালো লেগেছে।

৮| ২৯ শে জুন, ২০২৪ রাত ৮:২৪

গেঁয়ো ভূত বলেছেন: মুক্তিযুদ্ধচলাকালীন কঠিন বাস্তবতার অসাধারণ শিল্পনৈপুণ্য বর্ণনা বেশ ভাল হয়েছে!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.