নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

স্যাকারুলাল

বস্তুত বিদ্যা শিক্ষার ডিগ্রী আছে কিন্তু জ্ঞানের কোন ডিগ্রী নেই, জ্ঞান ডিগ্রীহীন এবং সীমাহীন।

স্যাকারুলাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

[প্রবন্ধ] ইংরেজ শাসনে বাংলার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার ধ্বংস সাধন -রাহমান চৌধুরী

১৮ ই এপ্রিল, ২০১২ রাত ১১:৪১

বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে নানারকম পরিকল্পনা নিয়েছে। সম্প্রতি জানা গেল, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি অমর্ত্য সেন তাঁর নোবেল পুরস্কারের অর্থ এসব অঞ্চলের প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি ও গবেষণার প্রশ্নে ব্যয় করছেন। ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন অবিভক্ত বাংলা বিহারের ঐতিহ্যবাহী প্রাথমিক শিক্ষার বহুল ক্ষতি সাধন করে। ইংরেজদের ক্ষমতা ত্যাগের পর সাতচল্লিশ সাল থেকে দু হাজার সাল পর্যন্ত এসব অঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতি ঘটেছে খুবই সামান্য। বিহার ছিল এ ব্যাপারে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া। গত দশ বছরে ভারতে প্রাথমিক শিক্ষা বেশ কিছুটা সাফল্য লাভ করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে একই ধরনের আশাব্যঞ্জক কথা বলা যায়। কিন্তু ইংরেজ শাসনের আগে বিহারসহ অবিভক্ত বাংলার প্রত্যেক গ্রামে ন্যূনতম একটি করে পাঠশালা ছিল। ধনী গরিব এবং প্রত্যেক বর্ণের শিশুরাই সেখানে পড়াশুনা করার সুযোগ লাভ করত। কীভাবে সে ব্যবস্থা ইংরেজ শাসনে ভেঙে পড়ল তার একটি চিত্র দেবার জন্য এই নিবন্ধ রচনা। বর্তমান নিবন্ধটি ইংরেজ শাসনের পূর্ব থেকে বাংলদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত বর্তমান নিবন্ধকারের একটি দীর্ঘ গবেষণার খুবই সংক্ষিপ্ত রূপ।

ব্রিটিশরা বাংলা তথা ভারতের শাসন ক্ষমতা দখল করার পর উনিশ শতকের মাঝামাঝি এসে বাংলার ঐতিহ্যবাহী প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার স্থলে ভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করে। বাংলার শাসন ক্ষমতা দখলের পর বহু বহু বছর পর্যন্ত ইংরেজরা এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। সত্যিকার অর্থে ব্রিটিশ সরকারের জনগণের শিক্ষা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। ব্রিটিশরা এদেশ দখল করেছিল মুনাফা লাভের জন্য, সাধারণ জনগণের ভাগ্য পাল্টাবার জন্য নয়। বাংলা থেকে রাজস্ব হিসেবে তারা যে বিপুল অর্থ লাভ করত শিক্ষা বা জনকল্যাণে তা ব্যয় করার কোনো উদ্দেশ্য বা কর্মসূচী তাদের ছিল না। ব্রিটিশরা ক্ষমতা গ্রহণ করার পর খ্রিষ্টান মিশনারি বা পাদ্রীরা এদেশে আসতে শুরু করে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য। ধর্ম প্রচারের স্বার্থেই তারা বাংলার জনগণের মধ্যে ইংরেজি ভাষার প্রসার চেয়েছিল। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছাড়া সর্বস্তরে ইংরেজি ভাষার প্রসার সম্ভব নয় বলেই বাংলার ঐতিহ্যবাহী প্রাথমিক শিক্ষা বা জনশিক্ষার পাশাপাশি পাদ্রীরা মিশনারি বিদ্যালয়গুলো গড়ে তুলতে শুরু করে। মিশনারিদের এই বিদ্যালয় গড়ে তোলার ব্যাপার তেমন কোনো আপত্তি ওঠে না বা বাধার সৃষ্টি করা হয় না। প্রথমত ইংরেজরা শাসক, ফলে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল না। পাশাপাশি বহুজনই নিজেদের ভাগ্য পাল্টাবার জন্য ইংরেজি শিখতে চাচ্ছিলেন। বিশেষ করে বাংলার হিন্দু সম্প্রদায় এ ব্যাপারে খুবই অগ্রণী ছিলেন।

বাংলার শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করবার পূর্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন বঙ্গদেশে বাণিজ্য আরম্ভ করে-ঠিক তখনি অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে কিংবা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি লাভ করার জন্য কাজ চালাবার মতো ইংরেজি বলতে শিখেছিলেন। এদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষ পঞ্চানন ঠাকুর উল্লেখযোগ্য। তিনি ছিলেন কর্মতৎপর ও উপায় সন্ধানী মানুষ-জাতপাতের বালাই তাঁর ছিল না। গোরা সাহেবদের রসদ জোগানো এবং ফাইফরমাশ খাটা ছিল তাঁর কাজ। খ্রিষ্টান ফিরিঙ্গীদের মুখে তাঁর ঠাকুর নামটা বিকৃতভাবে ‘টেগোর’ হয়ে গিয়েছিল। পঞ্চাননের উপর গোরা সাহেবদের নেকনজর থাকায় তিনি তাঁর দুই পুত্রকেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে শাসালো চাকরি জুটিয়ে দেন। বিশেষ করে পঞ্চানন ঠাকুরের পুত্র জয়রাম ইংরেজদের নানা কাজ কারবার তদারকি, ঠিকাদারি ও দালালিতে নিযুক্ত থেকে বেশ টাকা-পয়সা বানান। ইংরেজরা তখনো বাংলা দখল করেনি। জয়রামের সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ফোর্ট উইলিয়াম নির্মাণে হাত দেয়। ধর্মাধর্ম নিয়ে যাঁরা তখন খুঁতখুঁতে ছিলেন না, সুযোগ-সুবিধা সন্ধানে যাঁরা তৎপর ছিলেন, তাঁদের পক্ষে সে সময়ে রোজগারের নানারকম নতুন পথ খোলা ছিল। জয়রামের দুই পুত্র নীলমণি ও দর্পনারায়ণ পিতার সুবাদে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হন-ঠিক সেই সময় বাংলার শাসনভার ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণে আসে। সতেরশ পঁয়ষট্টি সালে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা লাভ করে ক্লাইভের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি-সেবছরই নীলমণি উড়িষ্যার সেরেস্তাদার নিযুক্ত হন। নীলমণিই পরবর্তীকালে জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের পত্তন করেন। নীলমণিরই নাতি হলেন বাংলার বিখ্যাত দ্বারকানাথ ঠাকুর। দ্বারকানাথের নাতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

বাংলার শাসনভার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাবার পর সতেরশ চুয়াত্তর সালে কলকাতায় ‘সুপ্রিম কোর্ট’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বঙ্গদেশে ইংরেজি শিক্ষার অর্থকরী শক্তি বেড়ে যায়। সে কারণে ইংরেজি শিক্ষার তখনো কোনো মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান না থাকলেও আঠারশ শতকের শেষে এবং উনিশ শতকের প্রথম দিকে বেশ কিছু বাঙালি ইংরেজি শেখার চেষ্টা করে মোটামুটি কৃতকার্য হন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের অনুসৃত নীতি অনুসারে এদেশের ধর্ম-সমাজ-শিক্ষার ব্যাপারে প্রথম দিকে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করেনি। বাংলার ধর্ম-সংস্কৃতি বা শিক্ষা ব্যবস্থা তাদের শাসনব্যবস্থার জন্য কোনো প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং তা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাাংলার সুযোগসন্ধানী বা সুবিধাভোগী মানুষের জন্য। কারণ ইংরেজদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে হলে, তাদের কাছাকাছি যেতে হলে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি অনুসরণ করা দরকার। সেজন্য উনিশ শতকের শুরু থেকেই কলকাতার সম্ভ্রান্ত ও ধনী বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে ইংরেজি শেখার বিশেষ আগ্রহ দেখা যায়। এই আগ্রহ থেকেই আঠারশ সতেরো সালে কলকাতায় ‘হিন্দু কলেজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় ‘কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি’। কলকাতা বুক সোসাইটির উদ্যোগে পরবর্তী বছরে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘কলকাতা স্কুল সোসাইটি। হিন্দু কলেজ ও কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি বঙ্গদেশে ইংরেজি শিক্ষা প্রসারে বিরাট ভূমিকা পালন করে। কলকাতা স্কুল সোসাইটির কাজ ছিল জনশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলির সংস্কার সাধন করে ছাত্রদের উচ্চতরে ইংরেজি শিক্ষা লাভের জন্য প্রস্তুত করে দেয়া। স্কুল সোসাইটি পরিচালিত আদর্শ বিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি শিখে ছেলেরা হিন্দু কলেজে ভর্তি হতো। পটল ডাঙায় সোসাইটির একটি ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই ইংরেজি স্কুলে পড়ার সুযোগকে ছাত্ররা পরম সৌভাগ্য বলে মনে করত। বাংলাদেশে ইংরেজি শিক্ষা প্রসারে তথা বাংলার নবজাগরণে হিন্দু কলেজ যে ভূমিকা রেখেছিল আর কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্বারা তা হয়নি। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল সম্ভ্রান্ত হিন্দু সন্তানদের জন্য ভারতীয় ও ইংরেজি ভাষা শিক্ষা এবং এশিয়া-ইউরোপের সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যবস্থা করা। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বঙ্গদেশে ইংরেজি স্কুলের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে।

রামমোহন ইংরেজি বা পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে ছিলেন। আঠারশ বাইশ সালে তিনি নিজে ‘এ্যাংলো হিন্দু স্কুল’ নামে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। আঠারশ তেইশ সালে ‘জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন’ গঠিত হলো এবং কোম্পানি শিক্ষা খাতের টাকা ও শিক্ষা ব্যবস্থার দায়িত্ব এই প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দিল। প্রতিষ্ঠানটি বঙ্গদেশে প্রাচ্যবিদ্যা প্রসারে মনোযোগী হলে নদীয়া ও কলকাতায় পরবর্তী বছর সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলো। রামমোহন কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ছিলেন। ইংরেজ শাসকদের কাছে তিনি প্রতিবাদ জানিয়ে একটি পত্রও লিখেছিলেন। পত্রটির সারমর্ম ছিল যে, সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার দ্বারা দেশের ছাত্ররা কিছুই শিখবে না। সুপ্রাচীনকাল থেকে যে ব্যাকরণ, ন্যায়শাস্ত্র, দর্শন মীমাংসা এবং বেদাবদান্তের পঠন-পাঠন ভারতবর্ষে প্রচলিত আছে, তা নিয়েই প্রস্তাবিত সংস্কৃত কলেজের ছাত্ররা বারো বছর অতিবাহিত করবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে শিক্ষা পাশ্চাত্যে যুগান্তর এনেছে তার সঙ্গে তুলনা করলে সংস্কৃত শিক্ষা সহজেই অসার বলে প্রতীয়মান হবে। ইংরেজ সরকার যদি ভারতবাসীকে অজ্ঞানের অন্ধকারে রাখতে চায়, তবে সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করলে সে উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ সাধিত হবে। পত্রের উপসংহারে রামমোহন লিখলেন, সরকারের যখন লক্ষ্য এদেশবাসীর উন্নতি সাধনÑতখন গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, শারীরবিদ্যা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে এক উদার উন্নত শিক্ষার ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। রামমোহনের প্রস্তাবে সরকার কর্ণপাত না করলেও দেখা গেল, শিক্ষার সেই আদর্শ বঙ্গদেশে জনসাধারণের মধ্যে ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করেছিল। পাশ্চাত্যের এই বিজ্ঞাসমনস্ক শিক্ষা কিন্তু অনুবাদ করে বাংলা ভাষায় চালু করা যেন। ইউরোপে নবজাগরণের পর মাতৃভাষায় সর্বত্র শিক্ষা আরম্ভ হয়, সকলেই গ্রিক, ল্যাটিন ও অন্যান্য ভাষার জ্ঞানবিজ্ঞান নিজ ভাষায় অনুবাদ করে নেয়। নবজাগরণকে ঘিরে মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ থেকে ইউরোপের অগ্রগতি আরম্ভ হয়েছিল। কিন্তু বাংলার নতুন সুবিধাভোগী ও সুযোগসন্ধানীরা মাতৃভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষাকেই শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতে চাইলেন।

পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু না করে সংস্কৃত শিক্ষা বজায় রাখে বলে সুধাকর নামে একটি বাংলা পত্রিকাও ইংরেজ সরকারের সমালোচনা করে। সুধাকর প্রকাশিত একটি সুদীর্ঘ প্রবন্ধে বলা হয়, বিস্তীর্ণরূপে বিদ্যাপ্রচারের জন্য সমাচারপত্র সম্পাদকরা যতই লেখেন না কেন, সরকার তাতে কর্ণপাত করে না। নিজেরা যে বিদ্যায় খরচ করা উচিত মনে করে তাই করে থাকে কিন্তু ঐ শিক্ষার দ্বারা ভারতবর্ষের সর্বসাধারণ মানুষের কী উপকার হবে বলা যায় না। সংস্কৃত বিদ্যালয়ে সরকার খরচ করে বটে তাতে সর্বসাধারণের বিশেষ উপকার হয় না। যে বিদ্যা শিক্ষায় লোকের মনের অন্ধকার দূর হয়ে রাজ্যশাসনে নৈপুণ্য জন্মায় দয়ালু রাজার উচিত সেই বিদ্যা চালু করা। দেখা যাচ্ছে, ইংরেজি শিক্ষা তথা পাশ্চাত্য বিদ্যা শেখার জন্য সম্ভ্রান্ত দেশবাসীর আগ্রহ ছিল প্রবল বরং ইংরেজ শাসকরা তার স্বীকৃতি দিচ্ছিল না। সুবিধাপ্রাপ্ত বঙ্গবাসীর চাপের মুখে জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন আঠারশ চব্বিশ সালে কলকাতা মাদ্রাসায় ইংরেজি ক্লাস চালু করে এবং আঠারশ সাতাশ সালে কলকাতা সংস্কৃত কলেজে ইংরেজি ক্লাস জুড়ে দেয়। শহরের সুবিধাভোগী জনসাধারণের প্রবল আগ্রহ সত্ত্বেও ক্রমাগত প্রাচ্যবিদ্যা প্রসারে সহায়তা করায় একদিন পাবলিক ইন্সট্রাকশন কমিটিতে ভাঙন ধরল। আঠারশ একত্রিশ সালে পর্ষদের দশজন সদস্যর মধ্যে পাঁচজন ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে, বাকি পাঁচজন প্রাচ্য শিক্ষার পক্ষে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির দ্বারা কাজকর্ম পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। দুপক্ষের কেউ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্যে সমন্বয় সাধনের কথা না ভেবে নিজ নিজ অবস্থানে দৃঢ় রইল।

ব্যাপারটি লক্ষ্য করার মতো, ইংরেজ শাসকরা কিন্তু পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার বা আমদানি চায়নিÑসেটা চেয়েছিল ভারতীয় আলোকপ্রাপ্ত ও সুবিধাপ্রাপ্তরাই। চাপের মুখেই ইংরেজ শাসকরা এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে বাধ্য হয় এবং উনিশশ পঁয়ত্রিশ সালে এ ব্যাপারে একটি চূড়ান্ত মত পাওয়া যায়। উনিশশ চৌত্রিশ সালে মেকলে ভারতবর্ষে এলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন-এর সভাপতি নিযুক্ত হলেন। সকল সদস্যের বক্তব্য শুনে তিনি খুব জোরের সঙ্গে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের পক্ষে মত দিলেন। উনিশশ পঁচিশ সালের সাতই মার্চ স্বয়ং লর্ড বেন্টিঙ্ক মেকলের প্রস্তাবের পক্ষে সরকারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন। সিদ্ধান্তের মর্ম ছিল যে, ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসারে এরপর থেকে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানকে, শিক্ষানীতি হিসাবে গ্রহণ করা হলো এবং শিক্ষার জন্য নির্দিষ্ট টাকা সে উদ্দেশ্যেই ব্যয় করা হবে। শিক্ষা বলতে এখানে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বোঝানো হয়েছে। ঠিক এভাবেই সরকারি উদ্যোগে ইংরেজি শিক্ষা এদেশে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো। ইংরেজি শিক্ষার পক্ষে মেকলের সুদীর্ঘ মন্তব্য ইতিহাসের একটি প্রসিদ্ধ দলিল হয়ে আছে। তিনি তার বক্তব্যে বলেছিলেন, ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও সাহিত্য শিক্ষার প্রবর্তন করলে ভারতবর্ষে একটা নতুন শ্রেণীর উদ্ভব হবে যারা জন্মসূত্রে এবং চেহারায় ভারতীয় থাকবে কিন্তু যাদের রুচি, মতবাদ, নীতিজ্ঞান, বুদ্ধি-শুদ্ধি সবই হবে ইংরেজদের মতো এবং যাদের শিক্ষা চুইয়ে জনসাধারণের উপর পড়বে।’

খুব চমৎকারভাবেই মেকলে বুঝতে পেরেছিলেন, ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের শিক্ষা যারা লাভ করবে তারা হবে ইংরেজ শাসকদের অনুলিপি, বশংবদ এবং সমাজের সাধারণ মানুষের উপরও তাদের শিক্ষার প্রভাব পড়বে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও ইংরেজদের সম্পর্কে নমনীয়তা প্রদর্শন এবং প্রশংসার মনোভাব তৈরি হবে। মেকলে ভুল বলেননি, বাস্তবে ঘটেছিলও তাই। তবুও একথা ভাবা ঠিক নয় যে, মেকলেই এদেশে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচলন করেন। পাশ্চাত্য শিক্ষার ক্ষেত্র রচনা করে রেখেছিলেন রামমোহন রায়, ডেভিড হেয়ার এবং পাশ্চাত্যের মিশনারিগণÑ বাংলার আলোকপ্রাপ্ত মানুষের সমর্থনেই। বঙ্গদেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের উপর বর্তমান রচনায় দীর্ঘ আলোকপাত করার উদ্দেশ্য ঠিক এর ভালমন্দ মূল্যায়ন করা নয়। এই শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন করার ফলে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার হাল কী হয়েছিল তার একটি চিত্র লাভ। বাংলার বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা বা অবক্ষয়ের সঙ্গে ঐ শিক্ষানীতির কোনো যোগসূত্র রয়েছে কিনা বা তার প্রভাবে ভালোমন্দ কী ঘটেছে সেটা বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা। প্রাথমিক শিক্ষার বর্তমান চরিত্রটি বোঝবার জন্যই উপরের দীর্ঘ আলোচনার সূত্রপাত। বঙ্গদেশে ইংরেজি শিক্ষাপ্রণালি চালু করা বা তার পূর্বে বঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষার চেহারাটা কী ছিল সেটা একটু দেখা যাক। খুব বেশি দূর যাওয়া সম্ভব না হলেও আঠারশ বিশ ত্রিশ সালের পূর্বের বাংলার প্রাথমিক শিক্ষার একটি চিত্র এবং কাঠামো স্পষ্টই পাওয়া যাবে এবং ইংরেজদের দেখা চোখেই।

বিভিন্ন তথ্যে দেখা যাচ্ছে, উনিশ শতকের প্রথম দিকেও এদেশে পাঠশালার শিক্ষাই ছিল শিক্ষার ভিত্তি। বঙ্গদেশে তখন পাঠশালার অভাব ছিল না। আঠারশ তিন সালে ওয়ার্ড লিখছেন, ‘বঙ্গদেশের প্রায় সব গ্রামেই লেখাপড়া এবং অঙ্ক শেখানোর জন্য বিদ্যালয় ছিল।’ খড়-ছাওয়া মাটির ঘরে অথবা ছায়াযুক্ত গাছের তলায় এইসব পাঠশালা বসত এবং দরিদ্র, জনগণের শিক্ষার বাস্তব প্রয়োজন এই পাঠশালা বহুকাল ধরে মিটিয়ে আসছিল। এই পাঠশালা শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে বাড়িতে কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসী মহাভারত এবং মধ্যযুগীয় নানা কাব্য পাঠের প্রচলন ছিল। পাশাপাশি যাত্রা, কথকতা, কবিগান, রামায়ণ গান, পদাবলী কীর্তন প্রভৃতি গ্রামে গ্রামে অনুষ্ঠিত হতো। বাঙালির এই সংস্কৃতির ধারা মুসলমান আমলে এবং ইংরেজি শিক্ষার গোড়ার দিকেও অব্যাহত গতিতে প্রবাহিত ছিল। সমসাময়িক পাঠশালা শিক্ষার সঙ্গে লোকশিক্ষা যুক্ত হয়ে জনগণকে একটা সাধারণ শিক্ষা দিতে সমর্থ হয়েছিল।

ভারতের বড়লাট লর্ড ময়রা আঠারশ পনেরো সালের দোসরা অক্টোবর একটি মন্তব্য লিপিতে উল্লেখ করেন, দেশীয় পাঠশালার শিক্ষকগণ ছেলেদের লেখাপড়া ও অঙ্ক কষা শেখান। এঁরা যে সামান্য বেতন নেন গ্রামের কারো পক্ষেই তা দেয়া কঠিন নয় এবং ছাত্রদের যেটুকু বিদ্যা শেখান তা গ্রামের জমিদারির সেরেস্তার কাজ, হিসাব রক্ষকের কাজ এবং দোকানদারির কাজের পক্ষে যথেষ্ট। দেখা যাচ্ছে বঙ্গদেশের তৎকালীন প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাও ছিল যথেষ্ট বাস্তবমুখী। শিক্ষা শুধু ছাত্রদের জ্ঞানার্জনের জন্যই দেয়া হতো না, ব্যবহারিক কাজের জন্য ছাত্রকে প্রস্তুত করা হতো। জমিদারের সেরেস্তার পদ খুব ছোটখাটো ব্যাপার ছিল না। বঙ্গদেশের গ্রামের পাঠশালায় সে শিক্ষাও লাভ করা যেত। লর্ড ময়রা দেশীয় পাঠশালাগুলোর উপযোগিতা উপলব্ধি করেছিলেন এবং এগুলোর উন্নতি ও প্রসারের জন্য সরকারের অর্থ ব্যয় করা উচিত একথাও বলেছিলেন। কিন্তু লর্ড ময়বার কথার গুরুত্ব অনেকেই বোঝেননি। বিশেষ করে মিশনারির পাদ্রীরা লর্ড ময়রার কথা অগ্রাহ্য করে কলকাতা ও অন্যান্য অঞ্চলে নিজেদের শিক্ষা প্রসারের জন্য উদ্যোগী হলেন। তারা কোথাও ব্যক্তিগত, কোথাও বা সমষ্টিগতভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে শিক্ষাদানের কাজ শুরু করেছিলেন। পাদ্রী উইলিয়াম কেরী ছিলেন এ বিষয়ে অগ্রণী। তিনি মালদা জেলার মদনাবাটিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন তারপর আঠারশ সালে শ্রীরামপুর চলে আসেন। এখানে জোশুয়া মার্শম্যান ও উইলিয়াম ওয়ার্ড নামে আরো দুজন পাদ্রী তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। এঁরা বহু বিদ্যালয় স্থাপন করেন। আঠারশ সতের সালের মধ্যেই শ্রীরামপুরের চারদিকে কমপক্ষে পঁয়তাল্লিশটি বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। সবশুদ্ধ দু’হাজার ছাত্র এইসব পাঠশালায় পড়ত।

লর্ড বেন্টিঙ্ক যখন ইংরেজি ভাষায় পাশ্চাত্য শিক্ষা চালু করেন ঠিক সেই সময়ে পাদ্রী উইলিয়াম অ্যাডাম বঙ্গদেশে বাস করছিলেন। ব্যাপটিস্ট মিশনের পাদ্রী হয়েই তিনি কলকাতায় এসেছিলেন। পরে পাদ্রীদের সংস্রব ছেড়ে তিনি সাংবাদিকতায় মন দেন। তিনি এদেশবাসীর শিক্ষা সম্পর্কে যথেষ্ট চিন্তা করতেন। আঠারশ পঁয়ত্রিশ সালের দোসরা জানুয়ারি অ্যাডাম এদেশের বেসরকারি শিক্ষা সম্পর্কে অনুসন্ধান করবেন বলে লর্ড বেন্টিঙ্কের কাছে লিখিত প্রস্তাব দেন। লর্ড বেন্টিঙ্ক তাঁর প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং তাঁকে শিক্ষা সংক্রান্ত প্রতিবেদন দেবার জন্য কমিশনার নিযুক্ত করেন। অ্যাডাম আঠারশ পঁয়ত্রিশ সালের পহেলা জুলাই, ২০ ডিসেম্বর এবং আঠারশ আটত্রিশ সালের ২৮ এপ্রিল তিন খণ্ডে সরকারের কাছে তার প্রতিবেদন জমা দেন। মূলত প্রতিবেদন জমা দেয়া এবং বেন্টিঙ্কের কাছে প্রস্তাব পাঠানোর বহু আগে থেকেই বঙ্গদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে অ্যাডাম সমীক্ষা চালাচ্ছিলেন। পরবর্তীতে সেই সমীক্ষার ফলাফলই প্রতিবেদন আকারে জমা দেয়া হয়। অ্যাডামের দেয়া শিক্ষা সংক্রান্ত তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আঠারশ বিশ থেকে ত্রিশ সাল পর্যন্ত বঙ্গদেশের শিক্ষার একটি চমৎকার প্রতিবেদন পাওয়া অ্যাডামের সমীক্ষা কার্যক্রম থেকে। সমীক্ষায় দেখা যায়, বঙ্গদেশ ও বিহারে তিন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল-পাঠশালা, মাদ্রাসা ও গুরুগৃহ বা গুরুকুল। সারা ভারতবর্ষেরই চিত্র এটা। এই তিন ধরনের প্রতিষ্ঠান ছিল ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাক্রমের প্রধান দিক-বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দা বিহারেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কয়েক হাজার বছর আগে। উল্লিখিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষাপ্রণালি ভারতের ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে সুসম্পর্কিত ছিল। বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতির বা বিদ্যালয়ের সঙ্গে ওই সকল পাঠশালা, মাদ্রাসা বা গুরুকুলের বিরাট পার্থক্য ছিল। সমাজে ঐ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুবই প্রভাব ফেলত।

খ্বুই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে উইলিয়াম অ্যাডাম-এর শিক্ষা সমীক্ষায় জানা যায়- তিনি বাংলা ও বিহারের গ্রামে এক লক্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেখেছিলেন আঠারশ ত্রিশ সালে। গভর্নর টমাস মুনরোর মতে লোক তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেছেন, প্রত্যেক গ্রামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। উইলিয়াম অ্যাডামের হিসাব মতো প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একত্রিশ-বত্রিশ জন ছাত্র ছিল। ঠিক এই সময়কালে ইংল্যান্ডের সাধারণ শিশুদের শিক্ষা দানের জন্য খুব কম বিদ্যালয় ছিল। যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল তার মধ্যে আবার বেশির ভাগ ছিল সেকালে ধরনের ব্যাকরণ শিক্ষার বিদ্যালয়। ভারত তথা বঙ্গদেশ সম্পর্কে ইংরেজদের দিক থেকে শিক্ষা সমীক্ষাটি চালানো হয়েছিল ব্যাপক পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে। উইলিয়াম অ্যাডামের প্রতিবেদনে শিক্ষার প্রকৃতি ও তার ইতিহাস বা পশ্চাৎপট নিয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছিল। সেই সমীক্ষা এবং পরিসংখ্যান দ্বারা এটা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়েছিল যে, বঙ্গদেশের জনশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কোনোক্রমেই ইংল্যান্ডের থেকে নিচুমানের ছিল না বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তুলনামূলকভাবে তা ছিল উচ্চমানের। বঙ্গদেশের শিক্ষা প্রণালি ছিল বিস্তৃত ও ব্যাপক এবং পাঠ্যসূচি বা বিষয়বস্তু ছিল ইংল্যান্ডের তুলনায় অনেক বেশি সমৃদ্ধ। শুধু এক জায়গায় ভারত ইংল্যান্ডের থেকে পিছিয়ে ছিল, তা হলো নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে। বলতে গেলে নারী শিক্ষার প্রচলনই ছিল না বঙ্গদেশে। নারী শিক্ষা যা ছিল তা না বলার মতোই।

উইলিয়াম অ্যাডামের প্রতিবেদনের বাইরে অন্য এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, মালাবারে সাতাশ শতাংশ মুসলিম নারী বিদ্যালয়ে যেত এবং চুয়ান্ন শতাংশ শূদ্র বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করত। বহুক্ষেত্রে দেখা গেছে ব্রাহ্মণদের চেয়ে শূদ্রদের সংখ্যা বিদ্যালয়ে বেশি। যা প্রমাণ করে শুধু ব্রাহ্মণরা নয়, সকল বর্ণের লোকরাই পাঠশালায় পড়াশুনার সুযোগ পেতো। ইংরেজ গবেষকের দেয়া এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সর্বস্তরের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল যেখানে এক লক্ষ পঁচাত্তর হাজার ঊননব্বই জন, সেখানে ব্রাহ্মণ ছিল বিয়াল্লিশ হাজার পাঁচশ দুইজন। সেই একই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বৈশ্য ছাত্রের সংখ্যা ছিল উনিশ হাজার ছয়শ উনসত্তর জন, আর শূদ্র ছিল পঁচাশি হাজার চারশ জন। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শূদ্ররা হচ্ছে মোট ছাত্রের শতকরা আটচল্লিশ ভাগ আর ব্রাহ্মণরা হচ্ছে শতকরা চব্বিশ ভাগ। ঠিক এরকম একটি চিত্র পাওয়া যায় অ্যাডামের একটি সমীক্ষা থেকে। তিনি বাংলা-বিহারের পাঁচটি জেলার সমীক্ষার ফল দেখান। সেই সমীক্ষায় দেখা যায়, সর্বমোট হিন্দু ছাত্র বাইশ হাজার নয়শ সাতান্ন জন, তার মধ্যে ব্রাহ্মণ শতকরা পঁচিশ শতাংশÑপাঁচ হাজার সাতশ চুয়াল্লিশ জন। কায়স্থ শতকরা বারো জন। পঁচানব্বইটি বিভিন্ন নিম্ন সম্প্রদায় থেকে বাকিরা এসেছেÑযার মধ্যে বিশ জন মুচি, ছিষট্টি জন চণ্ডাল এবং চুরাশি জন ডোমও ছিল। শিক্ষকদের বেলায়ও এই কথা সত্যÑব্রাহ্মণ শিক্ষক কম ছিল। সর্বমোট দু’হাজার দুশ একষট্টি জন শিক্ষকের মধ্যে মাত্র দুশ আটজন ছিল ব্রাহ্মণ, শিক্ষকদের মধ্যে ছয় জন চণ্ডাল ও পাঁচ জন গোয়ালাও ছিল। ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা অবশ্য হিন্দু মুসলমানদের জন্য আলাদা রকম ছিল ধর্ম ও সাংস্কৃতিক কারণে। কিন্তু কোনো বিরোধ ছিল না। লর্ড মুনরোর পর্যবেক্ষণে পাঁচ থেকে দশ বছরের শিশুদের এক-তৃতীয়াংশ বা এক-চতুর্থাংশ বাড়িতে বসেও লেখাপড়া করত। মুনরো লিখেছেন, অনেক দরিদ্র আছে যারা কখনো বিদ্যালয়ে যায়নি কিন্তু পড়তে পারে।

প্রাথমিক শিক্ষার সময়কে উইলিয়াম অ্যাডাম চারভাগে ভাগ করেছেন। প্রথম স্তরে দশদিন যখন ছাত্ররা অক্ষর চিনতে শিখত। তারপর দ্বিতীয় স্তরে আড়াই থেকে চার বছর সে তালপত্রে লেখার চর্চা করত এবং পড়তে শিখত, সেই সঙ্গে কড়ি গুনত বাক্য গঠন শিখত পরের বা তৃতীয় স্তরে গণিত সম্পর্কে ভালো ধারণা লাভ করত এবং দৈনন্দিন কাজকর্ম করা বা পেশার জন্য দক্ষতা লাভ করতÑপ্রতিবেদন বা চিঠিপত্র লেখা ইত্যাদি বিষয়ে যাতে কর্মে নিযুক্ত হতে পারে। চতুর্থ বা চূড়ান্ত স্তরে দু’বছর তারা রামায়ণ, মনসামঙ্গল পড়তে হতো। ঠিক এই সময়ে ছাত্রদের তালপত্রের পরিবর্তে কাগজে লেখার অধিকার জন্মাত। সব বিদ্যালয়ে রামায়ণ, মহাভারত ও ভগবত পড়ানো হতো।

উইলিয়াম অ্যাডাম তার শেষ প্রতিবেদনে বলেছিলেন, দেশে উচ্চতম থেকে নিম্নতম পর্যন্ত যেসব দেশীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলোকে অবলম্বন করে এদেশবাসীদের জন্য শিক্ষা প্রবর্তন করাই হবে সবচেয়ে সোজা, নিরাপদ, জনপ্রিয়, স্বল্প ব্যয় সাপেক্ষ এবং কার্যকর। তিনি বলেন, সরকারের এই প্রচেষ্টার সঙ্গে দেশবাসীর প্রচেষ্টাও আদায় করতে হবে। মুনরো, এলফিনস্টোন, অ্যাডামÑএঁরা দেশীয় পাঠশালাকে ভিত্তি করেই সরকারি প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে সরকারকে বার বার বলেছিলেন কিন্তু সরকার সে কথায় কর্ণপাত করেনি। সরকার তখন নিম্ন পরিস্রাবণ নীতির কল্পিত মহিমায় আচ্ছন্ন। নিম্ন পরিস্রাবণ বলতে বোঝায়, উচ্চতর শিক্ষাকে গুরুত্ব দিলেই তা চুঁইয়ে চুঁইয়ে নিম্নে নামবে। কিন্তু শিক্ষা প্রণালি কখনোই কোথাও উপর থেকে নিচের দিকে নামে নাÑনিচ থেকেই পরিকল্পনামাফিক উচ্চস্তরে যায় বা ধাবিত হয়। কিন্তু ইংরেজদের নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা উচ্চস্তরকে ঘিরেই আরম্ভ হলোÑমাধ্যমিক শিক্ষাকে যতটা গুরুত্ব দেয়া হলো প্রাথমিক শিক্ষাকে তা দেয়া হলো না। বরং অবহেলা করা হলো। শুধু ইংরেজদের এ ব্যাপারে দায়ী করলে হবে না, বঙ্গের বা কলকাতার আলোকপ্রাপ্তরা চাইছিল উচ্চস্তরের পাশ্চাত্য শিক্ষাÑযা তাদের সন্তানদের চাকরি পেতে বা উচ্চপদ পেতে সাহায্য করবে। সারাদেশের দীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী প্রাথমিক শিক্ষার বিরুদ্ধেও তারা দাঁড়ালেন। কিন্তু বিকল্প হিসাবে গ্রামের সাধারণ মানুষের শিক্ষা লাভের সুযোগ নিয়ে মাথা ঘামালেন না।

নিম্ন পরিস্রাবণ শিক্ষাগতির সমালোচনা করে বঙ্কিম বলেছেন, কথাটির তাৎপর্য এই যে, কেবল উচ্চশ্রেণীর লোকেরা সুশিক্ষিত হলে নিম্ন শ্রেণীর লোকদের পৃথক শিক্ষার দেবার প্রয়োজন নেই, তারা সংস্পর্শে এসেই বিদ্বান হয়ে উঠবে। বিদ্যা জল বা দুগ্ধ নয় যে উপরে ঢাললে নিচে চোষণ করে নিবে। তিনি ইংরেজি শিক্ষার ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, বিদ্বানের ভাষা মূর্খে বুঝিতে পারে না, তাহলে সংসর্গের ফল পাবে কী করে? ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের ফলে বঙ্গেেদশের লোকশিক্ষার সকল সনাতন আয়োজন কীভাবে ধীরে ধীরে লুপ্ত হচ্ছিল এবং দেশের অধিকাংশ জনগণ কীভাবে নিজেদের শিল্প-সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অসহায়বোধ করছিল বঙ্কিম তার সকরুণ চিত্র এঁকেছেন তার ‘লোকশিক্ষা’ প্রবন্ধে। বঙ্কিমের ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধেও সেই চিত্র পাওয়া যায়। ইংরেজি শিক্ষার প্রসার কীভাবে প্রাথমিক শিক্ষাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে সেটাও দেখা যাবে বিভিন্ন সময়ের পরিসংখ্যানে। খুব ঠাণ্ডা মাথায় মেকলে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন করে ভারতবাসীকে তার সকল ধরনের অতীত ঐতিহ্য থেকে ছিন্ন করতে জ্ঞাতসারেই চেষ্টা করেছিলেন। বঙ্কিমের লেখায় সেই সত্যটাই পরিস্ফুটিত হয়।

সবকিছুই আবর্তিত হচ্ছিল তখন কলকাতা এবং কলকাতার আশপাশকে ঘিরে। পুরানো সমাজকে ভাঙার প্রচেষ্টাও চলছিল সীমাবদ্ধ গণ্ডীর মধ্যে। দ্বারকানাথ ঘরের বাইরে এসে পুরানো নিয়ম ভাঙছেন, কিন্তু ঘরের ভিতরে অর্থাৎ অন্দরমহলে তার স্ত্রী সকল পূজা অর্চনা কুসংস্কার রক্ষা করছেন। নতুন সমাজ ব্যবস্থা উন্মেষের এ এক ক্রান্তিকাল। পুরনো গ্রাম ব্যবস্থা তখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নতুন আইনে বন্দী। মুনাফা তার প্রধান শর্ত। মুনাফার বাইরে এক পা ফেলতে নারাজ নতুন ইংরেজ শাসকরা। বঙ্গদেশের প্রচলিত প্রাথমিক পাঠশালা শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে মুনাফার কোনো সম্পর্ক ছিল না। স্থানীয় জমিদাররা এর দেখভাল ও রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। নবাব, মহারাজা বা মুঘল সরকারকে দেয় কর থেকেই এই অর্থের জোগান হতো। কিন্তু ইংরেজদের শাসনে সে নিয়ম পাল্টে গেল। সকল পুরানো সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ল, সামাজিক পুরনো বন্ধনগুলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ধাক্কায় সরে যেতে থাকল। পুরনো জমিদাররা যে-সকল সামাজিক বন্ধনকে বছরের পর বছর ধরেÑশত শত বছর ধরে টিকিয়ে রাখছিলেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে নতুন জমিদাররা সে ব্যবস্থা আর টিকিয়ে রাখতে চাইলেন না। কারণ নতুন ভূমি ব্যবস্থায় ইংরেজদের কাছে রাজস্ব আদায় একমাত্র লক্ষ্য, প্রজাপালন নয়। নতুন জমিদারদের ক্ষেত্রেও ঠিক একইভাবে মুনাফা প্রধান ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালÑপ্রজাপালন নয়। ফলে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার পুরনো বন্ধন বা কাঠামো যে ভেঙে পড়বে এটাই তো স্বাভাবিক। হলোও তাই। গ্রামে গ্রামে যে-সব পাঠশালা, মাদ্রাসা বা টোল ছিল তা উঠে যেতে লাগল নানান কারণে।

মনে রাখতে হবে বাংলা ও বিহারের প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে মুঘল শাসনামলে। বিশেষ করে বাংলার শাসক হোসেন শাহর আমলে। সিরাজ-উদ-দৌলার পতন এদেশের গতানুগতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে এক রাজার প্রস্থান ও অন্য রাজার আগমনই নির্দেশ করেনি, এতে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের প্রায় হাজার বছরের অতীত সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জীবন পদ্ধতির একটা পরিবর্তন সূচিত হয়। দীর্ঘদিনের আধিপত্য হারিয়ে মুসলমানরা এসময়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে, যা তাদের শিক্ষাব্যবস্থাকেও নিদারুণ ক্ষতিগ্রস্ত করে। বাংলার শাসন ক্ষমতা মুসলিমদের হাতে থাকাকালীন তারা সামরিক বাহিনীতে, রাজস্ব সংগ্রহের কাজে, বিচার ও শাসন বিভাগের চাকরিতে এবং আইন ব্যবসায় বিপুল প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। বস্তুত এগুলিই ছিল বাংলার উচ্চ ও মধ্যবিত্ত মুসলমানদের প্রধান অবলম্বন এবং তাদের সাহায্যের উপরেই শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি নির্ভর করত। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে মুসলমান অবস্থাপন্নদের সার্বিক অবনতি ঘটে। মুসলিম জমিদারদের পতন, লাখেরাজ জমির উপর কর আরোপ ইত্যাদির কারণে শিক্ষার অগ্রযাত্রা বাধাপ্রাপ্ত হয়। লাখেরাজ জমির মধ্যে ‘আয়মা’ ও ‘মদদ-ই-মাশ’-এর সম্পত্তির আয় থেকে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক বা পণ্ডিত ব্যক্তিদের ব্যয় নির্বাহ করা হতো। এ ছাড়াও বিভিন্নভাবে লাখেরাজ ভোগকারী ব্যক্তিগণ শিক্ষাক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসনভার গ্রহণের সময় দেশের এক-চতুর্থাংশ ভূমি করমুক্ত তালুক হিসেবে পেয়েছিল। এগুলোর আয় থেকে বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নির্বাহ করা হতো। প্রতিটি গ্রামপ্রধান নিজেদের সন্তান-সন্ততির শিক্ষার জন্য মক্তব মাদ্রাসা পরিচালনা করতেন। দরিদ্র পাড়া-প্রতিবেশীর সন্তানরাও সেসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভের সুযোগ পেতো। কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসনভার গ্রহণের পর নিষ্কর জমির প্রতি তাদের দৃষ্টি পড়ে। লাখেরাজ জমির দলিলপত্র পরীক্ষা নিরীক্ষার অজুহাতে এবং আরো নানা কৌশলে তারা লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। ফলে শিক্ষার জন্য অর্থ বরাদ্দ বন্ধ হয়ে যায়। আর এভাবেই দীর্ঘদিনের প্রচলিত প্রাথমিক শিক্ষা লাভের হাত থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হতে শুরু করে।

পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের কিছুদিন পরই বাংলায় দ্বৈতশাসন শুরু হলো। রাজস্ব তোলার ক্ষমতা রইল ইংরেজদের হাতে, নবাবের হাতে রইল রাজ্যের শাসনভার। টাকা খরচ করবার ক্ষমতা নেই অথচ তিনি শাসক। সত্যিকারভাবে মাত্র বারো লাখ টাকা বার্ষিক ভাতা দিয়ে নবাবকে ইংরেজদের পুতুল সরকার বানানো হলো। ফলে রাজ্য শাসনে নবাবের টাকা খরচের কোনো সুযোগ থাকল না। ফলে কোনো সিদ্ধান্ত দেবার সুযোগও হারালেন। রাজ্যের সব ব্যাপারে নবাবের নিষ্ক্রিয় থাকা ছাড়া গত্যন্তর রইল না। ইংরেজরা দেশ শাসনের জন্য কলকাতার কিছু মানুষকে খুশি রাখার কথাই ভাবল। হিন্দু-মুসলিম প্রশ্নটা সামনে এনে শাসক হিসেবে ইংরেজদের হিন্দু সম্ভ্রান্তদের কাছে বহু বেশি গ্রহণযোগ্য করল। সিরাজ-উদ-দৌলার বহু আগে থেকেই একদল বাঙালি বণিক ইংরেজদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলেছিল নিজেদের স্বার্থে। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষদের দু-একজন ছিলেন সেই দলে, কিন্তু তাঁরা ব্য

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.