![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এ বছর বন্য প্রাণী সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য 'বন্য প্রাণী সংরক্ষণে বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক-২০১০' পেয়েছেন বিশিষ্ট প্রাণিবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস কাজী জাকের হোসেন। অধ্যাপক হোসেনের জন্ম ১৯৩১ সালে কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে ১৯৫০ সালে তিনি স্নাতক এবং লাহোর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৩ সালেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রফেসর বায়ারসনের অধীন এমফিল ডিগ্রি নেন। তিনি ১৯৯০ সালের জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউনেপ) 'গ্লোবাল ৫০০ রোল অব অনার লরিয়েট' পদক, ১৯৯২ সালের বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ পদক 'স্বাধীনতা দিবস স্বর্ণপদক', ১৯৯৬ সালে 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ক্রেস্ট', ১৯৯৭ সালে জুলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের 'রজতজয়ন্তী স্বর্ণপদক', ১৯৯৩ সালে 'ইউজিসি রিসার্চ গাইড অ্যাওয়ার্ড', ২০০৫ সালে প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পদকসহ আরো অনেক পুরস্কার বা স্বীকৃতি লাভ করেন। বাংলাদেশে বন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণের বিভিন্ন দিক নিয়ে কালের কণ্ঠের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফরহাদ মাহমুদ
কালের কণ্ঠ : প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে আপনার সুদীর্ঘ কর্মজীবনের প্রায় পুরোটা বাংলাদেশের বন্য প্রাণী চর্চায় কেটেছে। বাংলাদেশে বন্য প্রাণীদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
কাজী জাকের হোসেন : আপনার অভিধানে বিশেষণের কমতি নেই দেখছি! তবুও বন্ধু মনে করেন, সেটাই আমার বড় প্রাপ্তি। বহুদিন থেকে আপনাকে দেখে আসছি। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণে আপনার চেয়েও বড় কাউকে আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। আপনার অবদান পত্রিকার প্রচারণায় আসে না, আপনিও বোধ হয় তা চান না। আসলে আপনি নিজেও একজন প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক কি না! যা হোক, আমার সঙ্গে আপনি একমত নাও হতে পারেন। বর্তমান অবস্থায় আমি মোটেও খুশি নই। তবে সার্বিক বিবেচনায় বলতে হয়, আমাদের বন্য প্রাণীদের অবস্থা আগের মতো না হলেও এখন মোটামুটি ভালো আছে। বাংলাদেশের অবস্থানকে ভৌগোলিকভাবে বলা হয় subtropical বা উষ্ণ-নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডল। বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ উষ্ণ মণ্ডলে এবং দুই-তৃতীয়াংশ নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে। সে জন্য আমরা সৌভাগ্যবান। এত ছোট দেশ হয়েও আমাদের দেশে এত উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতি আছে, যা বিস্ময়কর। আমাদের পরিবেশে যেমন উদ্ভিদবৈচিত্র্য আছে, তেমন প্রাণিবৈচিত্র্যও আছে। প্রাণীরা উদ্ভিদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। সে কারণে আমাদের মতো দেশের জীববৈচিত্র্য অত্যন্ত লক্ষণীয়। সংক্ষেপে বলব, কিছু প্রাণী এবং সম্ভবত কিছু উদ্ভিদ প্রজাতিও বোধগম্য কারণেই এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তার পরও ৫০ বছর আগে যেসব প্রাণী প্রজাতি আমাদের দেশে ছিল তাদের প্রায় সবই এখনো আছে। তবে এ কথাও সত্য, বোধগম্য কারণে তাদের বিস্তৃতি ও সংখ্যা আগের তুলনায় এখন অনেক কমে গেছে। আমার বিবেচনায় বিভিন্ন কারণে আমাদের গভীর পার্বত্যাঞ্চল এবং হাওর-বাঁওড়ের প্রাণীরাই ব্যাপক হারে কমে গেছে। খোলা বন(open forest) এবং খোলামেলা (open country) এলাকার প্রাণীরা এখনো ভালোই আছে বলা যায়। তবে ঠিক এখন আমরা যেভাবে কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছি, তাতে মনে হয় আগামী ৫০ বছরে ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে যাবে, অর্থাৎ অনেক প্রাণী প্রজাতি বিলীন হয়ে যাবে।
কালের কণ্ঠ : আমাদের দেশে নিকট অতীতে ছিল, এখন নেই_এমন বন্য প্রাণীর প্রজাতির সংখ্যা কত হবে? সেসব সম্পর্কে আপনার স্মৃতি থেকে কিছু বলবেন কি?
কাজী জাকের হোসেন : ১২৫ বছর আগেও মধুপুর জঙ্গলে হাতি ছিল বলে রেকর্ড আছে। এখন তা বিশ্বাস হবে কি? সম্ভবত ১৯৬৩ সালে কক্সবাজার এলাকায় এবং সিলেটে হাতি ধরার খেদা বসানো হয়েছিল। সিলেটে হাতি ছিল, তা সবাই জানতাম। সে বার খেদায় কোনো হাতি ধরা পড়েনি। তবে কক্সবাজার এলাকায় কিছু ধরা পড়েছিল। বিবিসির তৈরি হাতির খেদার একটি ডকুমেন্টারি আগে দেখেছিলাম এবং হতবাক হয়েছিলাম। কক্সবাজারে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ফিল্ড ওয়ার্কে গিয়েছিলাম। শোনার সঙ্গে সঙ্গে তারা খেদা দেখতে চাইল। ওখানকার বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সব সময় আমাদের বন্ধু ছিলেন এবং সব রকম সহায়তা দিতেন। তখনকার ইপিআর থেকে ট্রাক নিয়ে এবং নিজেরা পেট্রলের দাম দিয়ে খেদার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অনেক কিছু ছেলেমেয়েদের দেখাতে পেরেছিলাম। বলা বাহুল্য, ওটাই ছিল বাংলাদেশের শেষ খেদা। বন্য হাতি অবশ্য এখনো ধরা হয়, তবে ভিন্ন পন্থায়। গত শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে ঢাকা, কুমিল্লা ও অন্যান্য জায়গায় ডোরা বাঘ দু-একটা মারা যেত বলে রেকর্ড আছে। তবে গত শতাব্দীর চলি্লশের দশক থেকে মাঝেমধ্যে মধুপুর জঙ্গলের মতো জায়গায় চিতাবাঘ ছাড়া সুন্দরবন এলাকার বাইরে কোথাও ডোরা বাঘ শিকার হয়েছিল বলে আমার জানা নেই। আকাশে মেঘের গর্জন শুরু হলে শিল্পী যেমন উন্মাদের মতো সেতারে মেঘমাল্লার সুর উঠাতেন, তেমনি সুন্দরবন, মধুপুর, ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ সর্বত্র ময়ূর পেখম মেলে নেচে বেড়াত। ভাবতে কষ্ট হয়, ১০০ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা বনজঙ্গলে গণ্ডার আর ময়ূর দেখতেন, এখন আমরা বইতে এদের ছবি দেখি। এখন আমরা বাঘ-হাতি দেখছি, তবে আমরা এখনো যেভাবে চলছি তাতে মনে হয় ৫০ বছর পরে আমাদের ছেলেমেয়েরাও বইতেই শুধু বাঘ আর হাতির ছবি দেখবে!
কালের কণ্ঠ : মনে করা হয়, আবাসযোগ্যতা অর্থাৎ বন্য প্রাণীদের থাকা ও খাদ্য সংগ্রহের মতো অবস্থা কমে যাওয়াই বন্য প্রাণীদের প্রজাতি ও সংখ্যা হ্রাসের প্রধান কারণ। এর কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বনাঞ্চলের পরিমাণ কমে যাওয়া। কিন্তু এখনো বাংলাদেশে সরকারের মালিকানাধীন বেশ কিছু সংরক্ষিত বনাঞ্চল আছে। সেগুলোয় বন্য প্রাণীদের আবাসযোগ্যতার অবস্থা কী?
কাজী জাকের হোসেন : আপনার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। আরো অনেক কারণ আছে, তবে এগুলোই প্রধান। আমি আরেকটি বিষয় যোগ করব। কোনো এলাকাকে 'সংরক্ষিত' এলাকা ঘোষণা করলেই কোনো লাভ হবে না। ব্যক্তিমালিকানাধীন এলাকাকেও সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা যায়। আইনের প্রয়োগ না হলে কোনো লাভ হবে না। আমি যা বলতে যাচ্ছি, তা আপনি নিজেও জানেন। আগেই বলেছি, পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে প্রাণীরা উদ্ভিদের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। এক প্রজাতির গাছকে কেন্দ্র করে পিঁপড়া-পতঙ্গ থেকে স্তন্যপায়ী পর্যন্ত বহু প্রজাতির প্রাণী বাস করে। আবার পরিবেশের গুণ ও মানের ওপর নির্ভর করে অনন্তকাল ধরে সেই উদ্ভিদই একটি স্থানে জন্মায়, যারা সেখানে জন্মাতে সক্ষম। ঠিক সেসব উদ্ভিদের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল প্রাণীরা সেই জায়গায় আসে এবং সহ-বিবর্তন (co-evolution) ও সহযোগিতায় (adaptation) বাস করে। প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো উদ্ভিদ কেটে ফেলে দিলে সংশ্লিষ্ট প্রাণীরা বাঁচবে কেমন করে? আমাদের বর্তমান প্লান্টেশন পদ্ধতিতে এক জায়গার সব গাছ কেটে নির্মূল করে সেখানে শুধু এক প্রজাতির গাছ লাগানো হচ্ছে_এটাই বর্তমান বনায়নের নিয়ম। সে গাছ যদি দেশি হয়, তবে তার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রাণীগুলো সেখানে দেখা যাবে। আর বিদেশি গাছ হলে আমাদের কোনো প্রাণীই সেখানে দেখা যাবে না। প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো লতা থেকে গাছ পর্যন্ত উদ্ভিদের কারণে যে প্রাকৃতিক বন গড়ে ওঠে, তার সঙ্গে বনায়ন করা কৃত্রিম বনের কোনো তুলনাই হয় না। আমাদের প্রাণীরা মেহগনি গাছ চেনে না, কীটপতঙ্গ খাবে কী, ওরা না থাকলে পাখিরা খাবে কী? দক্ষিণ আমেরিকার মেহগনি ও অস্ট্রেলিয়ার ইউক্যালিপটাস গাছ তো সেসব দেশের প্রাণীদের জন্য। সেসব প্রাণী তো এ দেশে আনা হয়নি। গ্রামে কিছু আদি গাছপালা এখনো আছে, তাই সেই প্রাণীরাও আছে। ব্যক্তিমালিকানার বনাঞ্চল যদি আদি বনাঞ্চল হিসেবে থাকে, তাহলে কাজ হবে। তা না হলে লাভ নেই।
কালের কণ্ঠ : পঞ্চাশের দশকেও ভাওয়াল, মধুপুর, বৃহত্তর সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে কমবেশি বাঘ দেখা যেত। এখন সুন্দরবন ছাড়া আর কোথাও বাঘের অস্তিত্ব নেই। সেখানেও দ্রুত সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী?
কাজী জাকের হোসেন : এ সম্পর্কে আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আমি আগেই যা বলেছি, তা বন বিভাগের রেকর্ড থেকেই বলেছি। তবে একটা কথা, মাঝেমধ্যে আমাদের মফস্বলের সাংবাদিকরা 'বাঘ' ধরা বা মারা যাওয়ার সংবাদ দেন। আমরা সরেজমিন বেশ কয়েক জায়গায় পরীক্ষা করে দেখেছি সেগুলো বনবিড়াল, গেছো বিড়াল, মেছো বিড়াল বা বড়জোর চিতাবাঘ। আমরা কিন্তু এদেরও অনেকে 'মেছোবাঘ', 'গেছোবাঘ' ইত্যাদি বলে থাকি।
কালের কণ্ঠ : গ্রামীণ বনজঙ্গলে বেশ কিছু বন্য প্রাণী ছিল। যেমন শিয়াল, খাটাশ, বনবিড়াল, শজারু ইত্যাদি। এগুলো দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। এগুলো যেহেতু খাবারের জন্য মানুষের কিছু ক্ষতি করে, তাই মানুষ সুযোগ পেলেই এদের মেরে ফেলে। এসব বন্য প্রাণী রক্ষায় কী করা যেতে পারে?
কাজী জাকের হোসেন : এ ব্যাপারটার দিকে আপনার দৃষ্টি পড়েছে দেখে আমি বেশ খুশি হয়েছি। কয়েক মাসে এ বিষয়টি নিয়ে আমি তিন-চারটি নিবন্ধ বিভিন্ন পত্রিকায় লিখেছি। যেসব প্রাণীর নাম উল্লেখ করেছেন, এরা গ্রামাঞ্চলের জঙ্গলে বেশ ছিল, কিন্তু এখন তেমন দেখা যায় না। কারণ তো আপনিই উল্লেখ করেছেন। ছোটবেলায় যাদের বাড়ির পাশের জঙ্গল দিয়ে চলতে ভয় পেতাম, সেখানে এখন বাড়িঘর বানানো হয়েছে। জঙ্গল নেই। আবার বিশাল ফসলের মাঠের মাঝেমধ্যে এখন প্রচুর বাড়িঘর হয়ে গেছে। ফলে খোলা মাঠের সৌন্দর্য হারিয়ে গেছে। অবশ্য এসব বাড়ির চারপাশে জঙ্গল-গাছপালা দেখা যায়। আগেই বলেছি, প্রাকৃতিকভাবে দেশি গাছের অস্তিত্ব না থাকলে তাকে প্রাকৃতিক বনজঙ্গল বলা যাবে না এবং সে কারণে আমাদের দেশি প্রাণীরাও থাকবে না। কিছু বনজঙ্গল হয় তো আছে, কিন্তু সেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশ নেই। ফলে আমাদের বন্য প্রাণীরাও নেই। এ কথাটা সবারই বোঝা উচিত। কিছু জায়গা প্রকৃতির ওপর ছেড়ে দিলে সেখানে স্থানীয় উদ্ভিদ জন্মাবে, পরে এদের মধ্যে 'Ecological succession' হবে এবং পরম্পরায় প্রাকৃতিক গাছপালা জন্মাবে। এর সঙ্গে অবস্থান করবে দেশি প্রাণী, অর্থাৎ সেটিই হবে প্রাকৃতিক পরিবেশ। বিনা পয়সায় পাওয়া মেহগনি, অ্যাকাশিয়া, ইউক্যালিপটাস, মিনজিরি ইত্যাদি বিদেশি গাছ বাড়ির চারপাশে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চারপাশে, রাস্তার দুই ধারে, এমনকি ধানক্ষেতের আইলে লাগিয়ে তাকে বনায়ন বললে কোনো লাভ হবে না। আমাদের কীটপতঙ্গ এতে খাদ্য পায় না, পাখিরা কীটপতঙ্গ বা ফুলের মধু পায় না। এসব প্রাণী কৃত্রিম পরিবেশে থাকবে কেমন করে? গ্রামের মানুষ এটা যে বোঝে না তা নয়, তবে আমাদের বড় বড় পণ্ডিত বা নেতা-কর্তাব্যক্তিরা ঘটা করে আনুষ্ঠানিকভাবে এসব বিদেশি গাছ বিতরণ করে থাকেন। আধাশিক্ষিত মানুষ তো আমাদের বুদ্ধির ওপরই বেশি নির্ভর করে।
কালের কণ্ঠ : অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, যখন কোনো বনকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করা হয় তখনই বনের অবস্থার দ্রুত অবনতি হয়। বন্য প্রাণীরা তাদের আবাসযোগ্যতা হারায়। আপনি কি মনে করেন, সরকারের বর্তমান বন বিভাগের আওতায় বন্য প্রাণী সংরক্ষণের কাজটি যথাযথভাবে করা সম্ভব, নাকি এর জন্য আলাদা বন্য প্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ থাকা প্রয়োজন? এ ছাড়া সরকার বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন সংশোধন করে নতুন করে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন করতে যাচ্ছে। যেসব সংশোধনী আনা হচ্ছে সে সম্পর্কেও নানাবিধ সমালোচনা আছে। অতীতে যে আইন ছিল, বাংলাদেশে তার বাস্তবায়ন কতটুকু ছিল বলে আপনি মনে করেন?
কাজী জাকের হোসেন : দুটি প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর আপনিও ভালো করে জানেন, তা আমারও জানা আছে। এ দুটো প্রশ্নের আলোচনা-সমালোচনা না করে সংক্ষেপে ভবিষ্যতের আশায় আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণের জন্য কী করা উচিত এবং সম্ভব, সে সম্পর্কে কয়েকটি বক্তব্য রাখব। সব কয়টির সঙ্গে আপনি এক মত নাও হতে পারেন। তবে আমি আমার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কথাগুলো বলব। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন মহাদেশের বেশ কিছু সংরক্ষিত এলাকা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
ক. কেউ আলো, বাতাস, পানি, তাপ, মাটি ইত্যাদির সংমিশ্রণে একটি জায়গায় যে পরিবেশ শুরু থেকেই সৃষ্টি হয়েছে, সেটি সে জায়গার প্রাকৃতিক অজৈব পরিবেশ। খ. অজৈব পরিবেশের গুণাগুণের ভিত্তিতে সেখানে প্রথম যে উদ্ভিদ জন্মায়, সেগুলোই সেখানকার প্রাকৃতিক উদ্ভিদ (Pioneer plant)। গ. ওইসব উদ্ভিদকে কেন্দ্র করে যেসব প্রাণী টিকে থাকতে পারে, তারাই সেখানে আসে। এ উদ্ভিদ ও প্রাণীই হচ্ছে ওই স্থানের প্রাকৃতিক পরিবেশ। ঘ. এর মধ্যে আবার প্রাকৃতিকভাবেই ওই স্থানের অজৈব পরিবেশে একের পর এক পরিবর্তন দেখা দেয় (Ecological succession) । নতুন উদ্ভিদ দেখা দিলে ঠিক তাদের ওপর নির্ভরশীল নতুন প্রাণী সেখানে দেখা দেয়। পৃথিবীর সর্বত্র তা হচ্ছে। Pioneer plant-এর পর সেখানে দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ পরিবর্তন আসে। শেষে আসে চূড়ান্ত অবস্থা। এরপর আর পরিবর্তন হয় না। {যদি হয় তবে তাকে বলে পরিবেশগত অবক্ষয় (Ecological degradation) । অজৈব কোনো উপাদানে বিরূপ অবস্থা দেখা দিলে এ অবক্ষয় দেখা দেয়। যেমন ফারাক্কার কারণে সুন্দরবন এলাকার বিভিন্ন স্থানে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে। ফলে অনেক গাছ মরে যাচ্ছে বা মারা যাবে এবং তাদের সম্পৃক্ত প্রাণী ও কীটপতঙ্গ থেকে স্তন্যপায়ী প্রাণীরাও বিলীন হয়ে যাবে। এটাই নিয়ম}। ঙ. আগেই বলেছি, বিদেশি বা দেশি হোক, মাত্র একটি প্রজাতি একটি প্লটে লাগানোর মাধ্যমে সৃজন করা কৃত্রিম বন (plantation forest plan) সম্পূর্ণভাবে কৃত্রিম পরিবেশ হয়ে গেছে বহু আগে থেকে। ছায়ার কারণে বনের মাটিতে আলো লাগে না, তাই তেমন কোনো আগাছা জন্মায় না, তাই উদ্ভিদভোজীরা সেখানে থাকে না। হরিণ খাবে কী অথবা বনকলার গাছ নেই বলে বনের ভেতর হাতিরা খাবার পায় না। আসল প্রাকৃতিক বনে লতা থেকে বৃক্ষ পর্যন্ত বহু প্রজাতির গাছ থাকে, জলাভূমিতে প্রচুর জলজ উদ্ভিদ থাকে। খাবারের অভাবে সিলেট থেকে হাতি বিদায় নিয়েছে, এখন চট্টগ্রাম এলাকার অবশিষ্ট কয়েক ডজন হাতিও খাদ্যাভাবে এবং মানুষের অত্যাচারে বিদায় নেবে সহসাই। চ. অভয়ারণ্যকে (sanctuary) তার সংজ্ঞা অনুযায়ী অবশ্য অবশ্যই মানববসতিহীন প্রাকৃতিক বন হতে হবে। আমাদের অভয়ারণ্যগুলো মোটেও তা নয়। শোনা যায়, বন বিভাগ কথায় কথায় 'অভয়ারণ্য' ঘোষণা করে। উদ্দেশ্য মহৎ, তা ঠিক। আমাদের ছোট দেশ, তাই যত কম অভয়ারণ্য হয় তত ভালো। তবে সঠিক অর্থে তা হতে হবে। অভয়ারণ্যে মানুষ ও বন্য প্রাণীরা কখনো একসঙ্গে থাকতে পারবে না। পরিণামে শেষ পর্যন্ত প্রাণীদের বিদায় নিতে হবে। অভয়ারণ্যে পাহারাদার ও গবেষকরা ছাড়া আর কেউ প্রবেশ করতে পারবেন না। সঠিক ব্যবস্থা করলে প্রাণীর ক্ষতি না করে দর্শনার্থী প্রবেশের ব্যবস্থা করা যায়। ছ. বর্তমানে সুন্দরবন ছাড়া বলতে গেলে কিছু মাত্র প্রাকৃতিক পরিবেশ কেবল গ্রামেই আছে। গ্রামের সবাই এটা বোঝে। গ্রামের মানুষ সবাই মিলে যদি তাদের গ্রামের সামান্য কিছু অংশে কেবল স্থানীয় গাছের জঙ্গল জন্মাতে দেয়, অর্থাৎ কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ না করে, তবে কয়েক বছরেই সেটি আগের মতো প্রাকৃতিক পরিবেশ জোগাবে এবং আগের মতো পরিচিত গ্রাম্য এলাকার বন্য প্রাণী দেখতে পাওয়ার সুযোগ হবে। বন বিভাগ যদি তাদের বনগুলোয় প্রাকৃতিকভাবে গাছ, লতাপাতা জন্মাতে এবং বড় হতে দেয়, তবে দেখতে পাবেন অনেক বন্যপ্রাণী সেখানে ফিরে এসেছে।
সরকার 'বন্য প্রাণী সংরক্ষণ' বন বিভাগের দায়িত্বে অর্পণ করেছে। বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারি চাকরি করেন। কাজেই তাঁদের যা করতে বলা হয় তাঁরা তা করতে বাধ্য। আমি তাঁদের কোনো দোষ দেখি না। কিন্তু আজকের বন সংরক্ষণ যেমন অত্যন্ত উঁচুমানের টেকনিক্যাল বিষয়, বন্য প্রাণী সংরক্ষণও তেমনি বা তার চেয়েও উঁচুমানের টেকনিক্যাল বিষয়। তবে আমি ধন্যবাদ দেব ওই কর্মকর্তাদের, কারণ তাঁরা দৃষ্টি রেখেছেন বলেই বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন এখনো বলবত আছে। এখন সময় এসেছে 'বন্য প্রাণী ও সংরক্ষিত এলাকা নিয়ে একটি পৃথক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করার'। আমার মতে, এটি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীনেই থাকতে পারে, তবে সম্পূর্ণ পৃথক একটি বিভাগ হিসেবে_সে কথাটা আপনিও বলেছেন। আমার বিশ্বাস, বন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজেও এটা ভালো বোঝেন। আর সে জন্যই সম্প্রতি তাঁরা বন্য প্রাণী ও সংরক্ষিত এলাকার জন্য পৃথক সার্কেল প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমি এ জন্য তাঁদের সাধুবাদ দিই। ছোট্ট একটি কথা বলব, আজকের বন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হয়তো জানেন না, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন তৈরির জন্য যে কমিটি পাকিস্তান আমলে হয়েছিল, আমিও তার সদস্য ছিলাম। আরো কিছু কথা আছে সেটি বলব না। তবে এ মুহূর্তে আমি একজন 'মহামান্যবর'-এর প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানাব। তিনি হচ্ছেন বাংলাদেশে একসময়ের মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।
আরেকটি কথা। আমাদের সাংবাদিক মহলসহ দেশের সাধারণ মানুষ বন্য প্রাণী সংরক্ষণ সম্পর্কে এখন বেশ সজাগ। এ মুহূর্তে আমাদের 'বন্য প্রাণী ও সংরক্ষিত এলাকা সংরক্ষণ' বিভাগকে উন্নত দেশের যেকোনো অনুরূপ এলাকার মতো অত্যন্ত দক্ষভাবে পরিচালনা করার মতো শক্তি প্রচুর হয়েছে এবং আরো হচ্ছে। তবে আমাদের ভয় কিসের?
©somewhere in net ltd.