নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার দুনিয়ায় আপনি আমন্ত্রিত

রাজন আল মাসুদ

খুঁজে ফিরি স্বপ্নগুলো............

রাজন আল মাসুদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমেরিকার পথে পথে ৬

০৯ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ১১:১৩

এবার যাচ্ছি ওয়ালনাট গ্রোভে| মিনেসোটা স্টেটের মধ্যেই ঝিরি ঝিরি বয়ে যাওয়া প্লাম ক্রীক নদীর পাশে ছোট্ট একটা সিটি| "লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরি" বইটার কথা মনে আছে? এখানে মাটির কুটিরে থাকতেন তার বিশ্বখ্যাত লেখিকা লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডার !!!!! বইয়ে কিন্তু লেখা ছিল এই শহরের কথা| ওয়ালনাট গ্রোভে দেখতে যাচ্ছি লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডারের স্মৃতি বিজড়িত মিউজিয়াম|

মিউজিয়ামটা সেই সময়, সেই আমলের শহর, জীবন-যাত্রার ছোট্ট একটি মডেল| স্কুল, চার্চ, গ্র্যান্ড মা'স কিচেন, বাচ্চাদের খেলার ঘর, বার্ন, পোস্ট অফিস, প্রেস, টেলিফোন বুথ, ঘোড়ার গাড়ির ওয়াগন সবই ছোট আকারে আছে এখানে| স্পেশাল যে জিনিসগুলি এখানে আছে তা হল: লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডারের এবং তার মেয়ে রোজের ব্যবহার করা কুইল্ট (লেপ), লরা যে চার্চে যেতেন সেই চার্চের সেই সময়ের বাইবেল, পারিবারিক দূর্লভ ছবি, চিঠি আর লরার লেখার চেয়ার-টেবিল| বোনাস হিসাবে সাথে আছে গিফট শপ, মাটির কুটির, লিটল হাউজ অন দ্য প্রেইরি টিভি সিরিজে ব্যবহৃত নানান জিনিস, ১৮৭০ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ২৫০+ কেল্টন ডলের কালেকশন আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার নানান স্মারক| যুদ্ধে ব্যবহৃত হেলমেট আর ইউনিফর্ম পরে ছবি ও তোলা যায়|

মিউজিয়ামের উল্টো পাশেই আছে তালা বন্ধ আন্ডার রিনোভেশন এক বাড়ি| এই বাড়িটি তৈরী করেছিলেন লরা'র বাবা| কাঠের তৈরি বাড়িটাতে ঠাণ্ডার প্রকোপ কমানোর জন্য খবরের কাগজ সাঁটানো হয়েছিল, এবং ১৮৯০ সালের সেই খবরের কাগজের কিছু কাগজ এখনো লেগে আছে| মেরামত শেষ হলে এই কাঠের বাড়ীটি ভবিষ্যতে মিউজিয়ামের অংশ হিসেবেই প্রদর্শিত হবে|

আমাদের ইচ্ছা ছিল লরা যেখানে মাটির কুটিরে থাকতেন সেই জায়গায় যাওয়ার| সেই কুটির টিকে না থাকলেও জায়গাটা দেখা| কিন্তু প্লাম ক্রীকে বোন হয়ে রাস্তা তলিয়ে থাকায় তা আর সম্ভব হল না| ম্যাপে বাংলাদেশের নামের উপরে পিন সেটে আমাদের আসার প্রমান রেখে মিউজিয়ামকে বিদায় জানালাম|

এর মধ্যে পেট বেশ হুংকার শুরু করায় পেট পুঁজো করে রওয়ানা দিলাম ডি স্মেট শহরের দিকে| এই শহরটা বেশি দূরে না হলেও পরেছে সাউথ ডাকোটা স্টেটের সীমানায়| ইঙ্গলস হোমস্টেড, প্রেইরীর মাঝে অবস্থিত ছিমছাম স্নিগ্ধ একটা র‍্যাঞ্চ, যেখানে ৬ বছর বাস করেছিলেন লরার পরিবার, রয়েছে এখানেই| এখানে ক্যাম্পিং করে থাকার আর টাকা দিয়ে প্রেইরিতে কামলা খাটার সুযোগ রয়েছে !!!!! এই শহরের স্কুলে ছাত্রী আর শিক্ষিকা দুইই ছিলেন লরা| এই শহরেরই শেষ প্রান্তে এক কবরস্থানে লরা'র বাবা-মা, তিন বোনের আর প্রথম সন্তানের কবর| লরা ঘুমিয়ে আছেন মিসৌরি'র ম্যান্সফিল্ড সিমেট্রিতে| প্রেইরির পাশে এই ছোট শহরের সিমেট্রিতে সন্ধ্যাবেলায় গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে থাকার সময় চোখের সামনে সূর্য যখন শেষ আলো ছড়াচ্ছিল তখন একাকিত্বের প্রেমে নতুন করে পরতে হয়| একই সাথে এক জীবনে এতো খাটাখাটনি, দৌড়াদৌড়ি অর্থহীন মনে হয়| একদিন তো মরেই যাব !!!!! তারচেয়ে জীবনের বাকি সময়টা আপনজনদের সাথে কাটানোই তো ভাল| সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামা পর্যন্ত সেই সিমেট্রিতে সবাই সময় কাটালাম| সবাই চুপচাপ এমনকি আমুদে অপু ভাই ও| কেমন যেন উদাস সবাই| ক্যাম্পিং সাইটে জায়গা না পাওয়ায় কাছের মারডো শহরে রাত কাটিয়ে দিলাম|

সকালে নিত্যদিনকার হুড়োহুড়ি শেষে যখন গাড়ি ছাড়লো তখন ঘড়ির কাঁটা ১১ টা ছুঁই ছুঁই করছে| যাচ্ছি ব্যাডল্যান্ডস ন্যাশনাল পার্কে| ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে গাড়ি চলছে তো চলছেই প্রেইরি পেরিয়ে| সেবার ওয়েস্টার্ন গল্পের সেই প্রেইরি, রুক্ষ প্রেইরি, ঘাসে ঢাকা প্রেইরি, মাইলের পর মাইল শুন্যতায় ধু ধু করা প্রেইরি, র‍্যাঞ্চারদের প্রেইরি, কাউবয়দের প্রেইরি, বুনো ঘোড়াদের প্রেইরি, ভালোবাসার প্রেইরি......গাড়ি করে প্রেইরি দিয়ে যাওয়ার সময় মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল| এই প্রেইরি তো পাড়ি দেয়ার কথা ছিল স্ট্যালিয়ন ঘোড়ার পিঠে, কাউবয় হ্যাট আর সিক্স শ্যুটার হোলস্টারে নিয়ে| মিনারেল ওয়াটারের বদলে পানি খাওয়ার কথা ছিল ছোট্ট কোন ওয়াটার হোলে| তীব্র ভালবাসার জায়গাগুলোতে না যাওয়াই হয়ত ভাল| স্বপ্নটা বাস্তবের সাথে মিলানো যে বড় কঠিন|

যেতে যেতে হটাৎ চোখে পড়ল "র‍্যাঞ্চ স্টোর প্রেইরি ডগ টাউন" নামে ছোট একটা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দোকান| তবে আসল আকর্ষণ হচ্ছে পাশেই অগণিত প্রেইরি ডগের আবাস| দোকান থেকে কিনে তাদের বাদাম খাওয়ানো যায় কাছ থেকেই তবে নিজের আস্তানার প্রতি রক্ষণশীল এই প্রাণীর গর্তে হাত/পা দিলে কিন্তু তারা ছেড়ে কথা কয় না| ঘোড়ায় চলাচলের যুগে প্রচুর ঘোড়া এদের গর্তে পা দিয়ে পা ভেঙে অথবা কামড় খেয়ে আহত হত| এই জন্য কাউবয়দের দু চোখের বিষ ছিল এরা| আমি ভাবতাম প্রেইরি ডগ বোধহয় প্রেইরির হিংস্র কোন কুকুর| ওমা এরা দেখি কাঠবিড়ালীর মত একটা আদুরে প্রাণী| দুপুরের খাবার দোকানের পাশের পিকনিক এরিয়াতে খেয়ে নিয়ে আবার চার চাকার যানে দৌড়ানো শুরু| শেষ না হওয়া পথের পাশে অনেকক্ষন পরে চোখে পড়ল বিশাল এক লাইফ সাইজ ধাতব কৰ্ম| এক মানুষের কংকাল গলায় দড়ি লাগিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ডাইনোসরের এক কংকালকে| জিনিসটা বেশ ইন্টারেষ্টিং লাগায় থামান হল গাড়ি| এভাবেই অনেকটা কাকতালীয় ভাবেই ঢুকলাম "১৮৮০" শহরে| ১৯ শতকের আদলে সাজান এই শহরটা আসলে ট্যুরিস্ট টাউন| দর্শনার্থীরা যেন সেই বুনো পশ্চিমের স্বাদ এখনো উপভোগ করতে পারে তাই রেস্টুরেন্ট, স্যালুন, ব্যাংক, শেরিফের অফিস একইভাবে রাখা| সেই আমলের ট্রেন ও আছে চড়ার জন্য| হাতে সময় কম তাই শুধু সামনে থেকে দেখেই চলে আসতে হল|

দুপুরের পরে যখন ব্যাডল্যান্ডস ন্যাশনাল পার্কে ঢুকলাম, সে এক দুনিয়াছাড়া জায়গা| সবুজ প্রান্তরের মাঝে হটাৎ স্তরে স্তরে মাটি আর পাথরের ফর্মেশন এখানকার ল্যান্ডস্কেপকে দিয়েছে আলাদা এক মোহনীয়তা| আলোর পরিবর্তনের সাথে সাথে এরাও লাল রঙের নানা রূপ ধারণ করে| কর্কশ, রুক্ষ এই ভূমিতে কিছুই জন্মায় না| পাথরের সাথে মিশে আছে অতিকায় ডাইনোসরদের ফসিল আর নিরন্তর অপেক্ষায় থাকা র‍্যাটলস্নেক| এজন্যই হয়তো এই জায়গার নাম ব্যাডল্যান্ডস, যার সৌন্দর্য উপভোগ করতে নিজের মাঝে থাকতে হয় কাউবয়দের রুক্ষতা| আউট ল হলে তো কথাই নেই|

হাঁটাহাঁটি করে বেশ ক্লান্ত হয়ে যাওয়ায় গাড়ি ছোটালাম ওয়াল ড্রাগ নামক এক সুপারস্টোরে যেখানে কফি পাওয়া যায় মাত্র ৫ পয়সায়| কাঙ্খিত কফি খুঁজে না পেলেও আরেক গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া গেল| বুনো পশ্চিমের অস্ত্রের রেপ্লিকা, পোষাক, বুট, হ্যাট, হোলস্টার, হান্টিং নাইফ, বাউয়ি নাইফ, ন্যাটিভ আমেরিকানদের হাতে তৈরী ভাস্কর্য, ওষুধ, পাহাড়ে পাওয়া অদ্ভুত সব পাথর থরে থরে সাজানো| স্টাফড বন্য প্রাণীদের মিউজিয়াম ও আছে স্বল্প পরিসরে| আসল প্রাণীর সাথে মাথায় শিং জুড়ে কাল্পনিক প্রাণীও রাখা আছে মানুষকে বোকা বানানোর জন্য|

বিকাল হয়ে যাওয়ায় তীব্র গতিতে গাড়ি ছোটালাম কাস্টার স্টেট পার্কের নিডল হাইওয়ের নিডল আই পয়েন্টের দিকে| নিডল হাইওয়ে ধরে বিশাল সব পাথরের বোল্ডারের মাঝে সুঁইয়ের চোখের মত একটা টানেল, সেখান দিয়ে কোনমতে একটি গাড়ী যেতে পারে| সূর্যাস্তের সময় পাথরের কোনায় কোনায় যখন আলো টিকরে পরে তখন আশেপাশের পরিবেশ এক অপার্থিব রূপ ধারণ করে| রাত নামার পরে আবার ক্যাম্পিং সাইট খোঁজার ধান্ধা এবং বলাই বাহুল্য যে আবারো বিফল| আমেরিকায় সামারে প্রচুর মানুষ ঘোরাঘুরি আর ক্যাম্পিং করে, তাই আগে থেকে ক্যাম্পিং সাইটে বুকিং দিয়ে না রাখলে জায়গা পাওয়া বেশ মুশকিল| যেহেতু আমাদের প্রতিদিনের প্ল্যান প্রতিদিন হচ্ছে তাই আগে থেকে বুকিং দেয়াও সম্ভব হচ্ছে না| আবারো মোটেলের শরণাপন্ন রাতের আশ্রয়ের জন্য| সাউথ ডাকোটার রাজধানী র‍্যাপিড সিটিতে মিললো ঠাঁই|

সকালে যাত্রা শুরু মাউন্ট রাশমোরের উদ্দেশ্যে| আমেরিকার চার বিখ্যাত রাষ্ট্রপতি- জর্জ ওয়াশিংটন, টমাস জেফারসন, থিওডর রুজভেল্ট এবং আব্রাহাম লিংকনের মুখের ভাস্কর্য পাহাড় কেটে বানানো হয়েছে ৬০ ফুট উঁচুতে| দারুন এই স্থাপনার কাজ শুরু হয় ১৯২৭ সালে আর শেষ হয় ১৯৪১ সালে| তিনটি প্রজম্ম শ্রম দিয়েছে এর পিছনে| হাইকিং করে একেবারে কাছে যাওয়া গেলেও হোঁৎকা মোটা শরীর তো আর তাতে সায় দেয় না তাই ভিজিটর সেন্টার থেকেই সাধারণ সবার সাথে নিচ থেকে দেখে, অতি আবশ্যক সেলফি তুলে সূর্যের তীব্র রোদের হাত থেকে গাড়ির এসির মধ্যে ঢুকে পালিয়ে বাঁচলাম|

পরবর্তী গন্তব্য মন্টানা| আমার আমেরিকার জীবন শুরু হয়েছিল যেখান থেকে|































মন্তব্য ৮ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ০৯ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ১১:৪৩

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেছেন:
ভালো মন্দ মিলিয়ে আমেরিকা এক অসাধারণ দেশ।

১২ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ২:২৪

রাজন আল মাসুদ বলেছেন: একদম সত্যি ভাই :)

২| ১০ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ১:৫০

ভ্রমরের ডানা বলেছেন:
ভিনদেশ ভাল লাগল!

১২ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ২:২৪

রাজন আল মাসুদ বলেছেন: ভাল লেগেছে জেনে আমারও ভাল লাগল :)

৩| ১০ ই আগস্ট, ২০১৮ সকাল ৭:৩৪

চাঙ্কু বলেছেন: আম্রিকা বজ্জাত দেশ। দেখতে দেখতে শেষ হয় না!

১২ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ২:২৬

রাজন আল মাসুদ বলেছেন: হা হা হা, আসলেই|

৪| ১০ ই আগস্ট, ২০১৮ দুপুর ২:০২

রাজীব নুর বলেছেন: চমৎকার।

১২ ই আগস্ট, ২০১৮ রাত ২:২৬

রাজন আল মাসুদ বলেছেন: ধন্যবাদ :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.