নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রমিত

মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল!

রমিত

মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল! ব্যাটা নিয়াজী বলেছিলো, “বাঙালী মার্শাল রেস না”। ২৫শে মার্চের পরপরই যখন লক্ষ লক্ষ তরুণ লুঙ্গি পরে হাটু কাদায় দাঁড়িয়ে অস্র হাতে প্রশিক্ষন নিতে শুরু করল, বাঙালীর এই রাতারাতি মার্শাল রেস হয়ে যাওয়া দেখে পাকিস্তানি শাসক চক্র রিতিমত আহাম্মক বনে যায়। সেই অসম সাহস সেই পর্বত প্রমাণ মনোবল আবার ফিরে আসুক বাংলাদেশের তরুণদের মাঝে। দূর হোক দুর্নীতি, হতাশা, গ্লানি, অমঙ্গল। আর একবার জয় হোক বাংলার অপরাজেয় তারুণ্যের।

রমিত › বিস্তারিত পোস্টঃ

‘ওম মনিপদ্মে হুম’ - পর্ব ১

৩১ শে মে, ২০১৫ দুপুর ১:৫৫

‘ওম মনিপদ্মে হুম’ - পর্ব ১
---------------- ড. রমিত আজাদ



আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগের কথা। ১০৪২ সালে আমাদেরই বাংলাদেশের এক কৃতি সন্তান দুর্গম পর্বতমালা, কঠোর আবহাওয়া, তুষারের শীতলতা, ইত্যাদি সকল প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ক্লান্তিকর দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে পৌঁছালেন হিমালয় দুহিতা তিব্বতে। সাথে সাথে একদল ঘোড়সওয়ার ছুটে এসে তাঁকে অভ্যার্থনা জানালো। সেই ঘোড়সওয়ারদের হাতে তীক্ষ্ণ বর্ষার মাথায় পতপত করে উড়ছে শ্বেত পতাকা, সুরতোলা বাদ্যযন্ত্রে বাজছে স্বাগত বাজনা আর সেই সাথে উচ্চারিত হচ্ছে মহামন্ত্র, 'ওম মনিপদ্মে হুম'। তিব্বতের গু-জে-এর রাজা স্বয়ং গার্ড অব অনার দিয়ে বরণ করেছিলেন বাংলার এই জ্ঞানতাপসকে, নাম তাঁর শ্রীজ্ঞান অতীশ দিপংকর।

আমাদের বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ (বিক্রমপুর) জেলার বজ্রযোগিনী গ্রামে ৯৮০ খ্রীস্টাব্দে জন্ম শ্রীজ্ঞান অতীশ দিপংকরের। বংশ পরিচয়ে তিনি ছিলেন রাজপুত্র। তাঁর রাজপিতার নাম ছিলো কল্যাণশ্রী আর মাতার নাম ছিলো শ্রী পদ্মপ্রভা/প্রভাবতী। রাজা-রাণীর তিন পুত্রের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন তিনি। পিতামাতা তাঁর নাম রেখেছিলেন আদিনাথ চন্দ্রগর্ভ। তাঁর অপর দুই ভাইয়ের নাম ছিল পদ্মগর্ভ ও শ্রীগর্ভ। অতীশ খুব অল্প বয়সে বিয়ে করেন। কথিত আছে তার পাঁচ স্ত্রীর গর্ভে মোট ৯টি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। তবে পুন্যশ্রী নামে একটি পুত্রের নামই শুধু জানা যায়।

প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন মায়ের কাছে। তিন বছর বয়সে সংস্কৃত ভাষায় পড়তে শেখা ও ১০ বছর বয়সে নাগাদ বৌদ্ধ ও অবৌদ্ধ শাস্ত্রের পার্থক্য বুঝতে পারার বিরল প্রতিভা প্রদর্শন করেন তিনি। মহাবৈয়াকরণ বৌদ্ধ পণ্ডিত জেত্রির পরামর্শ অনুযায়ী তিনি নালন্দায় শাস্ত্র শিক্ষা করতে যান। ১২ বছর বয়সে নালন্দার আচার্য বোধিভদ্র তাঁকে শ্রমণরূপে দীক্ষা দেন, এবং তখন থেকে তাঁর নাম হয় দীপংকর। ১২ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত তিনি বোধিভদ্রের গুরুদেব অবধুতিপাদের নিকট সর্বশাস্ত্রে পান্ডিত্য অর্জন করেন। ১৮ থেকে ২১ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি বিক্রমশীলা বিহারের উত্তর দ্বারের দ্বারপন্ডিত নাঙপাদের নিকট তন্ত্র শিক্ষা করেন। এরপর মগধের ওদন্তপুরী বিহারে মহা সাংঘিক আচার্য শীলরক্ষিতের কাছে উপসম্পদা দীক্ষা গ্রহণ করেন। আচার্য শীলরক্ষিতের কাছ থেকে তিনি লাভ করেন শ্রীজ্ঞান উপাধী। ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের জন্য তিনি পশ্চিম ভারতের কৃষ্ণগিরি বিহারে গমন করেন এবং সেখানে প্রখ্যাত পন্ডিত রাহুল গুপ্তের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ শাস্ত্রের আধ্যাত্নিক গুহ্যাবিদ্যায় শিক্ষা গ্রহণ করে ‘গুহ্যজ্ঞানবজ্র’ উপাধিতে ভূষিত হন।
বলা হয়ে থাকে যে তিনি চৌষট্টি ধরনের কলা/বিদ্যা শেখেন (যেমন সঙ্গীতকলা, যুক্তিবিদ্যা)। আরও বলা হয়ে থাকে যে তিনি ১৫০ জন আচার্যের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক খ্যাতিমান ছিলেন ধর্মকীর্তি শ্রী ।
১০১২ খ্রীষ্টাব্দে শ্রীজ্ঞান গিয়েছিলেন সুবর্নদ্বীপে (বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপ) সেখানে ধর্মকীর্তির কাছে মহাযান পন্থার ধর্মীয় দর্শন হিসাবে শিক্ষা নেন। দীর্ঘ ১২ বছর বৌদ্ধ দর্শনশাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ের উপর অধ্যয়ন করে তিনি ফিরে এলেন বাংলায়। বাংলায় তখন চলছিলো শক্তিমান পাল রাজাদের শাসনামল। রাজা ন্যায়পাল শ্রীজ্ঞানকে রাজা ধর্মপাল (৭৭০-৭৭০ খ্রীস্টাব্দ) প্রতিষ্ঠিত 'বিক্রমশীলা’ বিহারের প্রধান আচার্য (অধ্যক্ষ) হিসাবে নিয়োগ দেন। তিনি রাজশাহীর সোমপুর বিহারেরও প্রধান আচার্য ছিলেন।

বাংলায় উদ্ভুত সাংখ্য দর্শনই পৃথিবীর প্রাচীনতম দর্শন বলে অনেকে মনে করেন (বৈদিক দর্শন সাংখ্য দর্শন-এর পূর্বে হলেও তা পূরাণ মিশ্রিত বলে তাকে নির্ভেজাল দর্শন বলা যাবেনা বলে অনেকে মনে করেন।) কপিল মুনি সৃষ্ট সাংখ্য দর্শনের ধারাবাহিকতায়ই উদ্ভুত বৌদ্ধ দর্শন। এই বৌদ্ধ দর্শন বা ধর্ম বাংলার অন্যতম প্রাচীন ধর্ম। আর্য সাম্রাজ্যের বাইরে উদ্ভুত ও অ-বৈদিক দর্শন বলে আর্যরা এই দর্শনের ঘোরতর বিরোধী ছিলো। তাই প্রথমদিকে এই দর্শন বাংলা ও তার আশেপাশেই চর্চিত ও বিকশিত হয়। ধীরে ধীরে তা প্রসার লাভ করে ও দুর্গম হিমালয় পেরিয়ে তিব্বত, চীন, মঙ্গোলিয়া, কোরিয়া, জাপান ইত্যাদি দেশে পৌছে যায়।

বাংলার ভূমিপুত্র শৌর্য্যশালী পাল রাজাদের শাসনামলে বৌদ্ধ দর্শন ব্যাপক রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায়। পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল বাংলার প্রথম গণভোটে নির্বাচিত একজন রাজা ছিলেন। তিনি ও তার উত্তরপুরুষরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। পাল রাজাদের প্রথম রাজধানী বিক্রমপুরে ছিলো বলে ধারনা করা হয়, এবং পরবর্তিতে তা পাটলিপুত্র ও গৌড়ে স্থানান্তর করা হয়। গৌতম বুদ্ধের দেশের শাসক পালরা বৌদ্ধজাহানে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিলো। পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পাল শাসনামলের পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হলেও পাল যুগেই তা রাজ পৃষ্ঠপোষকতায় উন্নয়নের শিখরে পৌছায়। রাজা গোপালের পুত্র ধর্মপাল (শাসনামল ৭৭০ থেকে ৮১০ পর্যন্ত) নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন, ধর্মপাল বিক্রমপুরেও (বর্তমান মুন্সীগঞ্জ) একটি উল্লেখযোগ্য বৌদ্ধ বিহার নির্মান করেন। এছাড়া পালরা নির্মান করেছিলেন জগদ্দল, ওদন্তপুরা, সোমপুরা ও বিক্রমশিলা বিহার (Jagaddala, Odantapura, Somapura, and Vikramashila)

প্রথম পাল রাজা গোপাল নির্মান করেছিলেন ওদন্তপুরা বিহার। রাজা ধর্মপাল ইতিহাসখ্যাত বিক্রমশিলা বিহার (অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়) ও দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম বিহার সোমপুরা (পাহাড়পুর, নওগাঁ, বাংলাদেশ) নির্মান করেন। ধর্মপাল পঞ্চাশটিরও অধিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মান করেছিলেন। ধর্মপাল-এর পুত্র দেবপাল নালন্দার সবচাইতে উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

পাল শাসনামলের উল্লেখযোগ্য দর্শন গ্রন্থ গৌড়পাদ রচিত আগামা শাস্ত্র (Agama Shastra), শ্রীধর ভট্ট রচিত ন্যায়া কুন্ডালি (Nyaya Kundali), ভট্ট ভবদেব রচিত কর্মানুষ্ঠান পদ্ধতি, ইত্যাদি। চিকিৎসা শাস্ত্রের উপর রচিত কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের নাম চক্রপাণি রচিত চিকিৎসা সংগ্রহ, আয়ুর্বেদ দিপিকা, ভানুমতি, শব্দ চন্দ্রিকা এবং দ্রাভিয়া গুনশাস্ত্র; সুরেশ্বর রচিত শব্দ-প্রদীপ, বৃক্ষায়ুরবেদ এবং লোহপদ্ধতি; ভঙ্গসেনা রচিত চিকিৎসা সংগ্রহ, গদধারা বিদ্যা (Gadadhara Vaidya) রচিত শুশ্রুষা; জিমুতভাহানা (Jimutavahana) রচিত দয়াভগ, ভয়াভোহারা মাতৃকা (Vyavohara Matrika) এবং কলাবিবেক (Kalaviveka )। প্রাচীন বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন 'চর্যাপদ;-ও পাল শাসনামলে রচিত। পাল রাজাদের সুদীর্ঘ চারশত বছরের ইতিহাসে ধর্ম, দর্শন, শিক্ষা, সাহিত্য, ললিতকলা, চিকিৎসা, ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্র ছিলো গৌরবান্বিত।
শৌর্যপূর্ণ পাল শাসকরা গুণীদের মর্যাদা দিতে জানতেন। রাজা ধর্মপাল বৌদ্ধ দার্শনিক হরিভদ্রকে তাঁর গুরু মেনেছিলেন। বীরদেব, বজ্রদত্ত সহ অনেক পন্ডিত ব্যক্তিই পাল শাসনামলে বিকশিত হয়েছিলেন। একাদশ শতাব্দীর এমন একজন পন্ডিত ব্যাক্তির নাম অতীশ দিপংকর।

কথিত আছে যে তিব্বতের রাজা লংদর্মা (Langdarma) দীর্ঘ সত্তর বছর বৌদ্ধ ধর্ম/দর্শন-কে অবদমন করে এবং বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের নির্যাতন করে। তারপর গুজ রাজ্যের দ্বিতীয় রাজা ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস'-ওদ , নাগ-ত্শো-লো-ত্সা-বা-ত্শুল-খ্রিম্স-র্গ্যাল-বা সহ কয়েক জন ভিক্ষুর হাতে প্রচুর স্বর্ণ উপঢৌকন দিয়ে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে তিব্বত ভ্রমনের আমন্ত্রন জানালে দীপঙ্কর সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন। এতে নিরাশ না হয়ে ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস'-ওদ সীমান্ত অঞ্চলে সোনা সংগ্রহের জন্য গেলে কারাখানী খানাতের শাসক তাঁকে বন্দী করেন ও প্রচুর সোনা মুক্তিপণ হিসেবে দাবী করেন। ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস'-ওদ তাঁর পুত্র ল্হা-লামা-ব্যাং-ছুব-ওদকে মুক্তিপণ দিতে বারণ করেন এবং ঐ অর্থ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে তিব্বতে আনানোর জন্য ব্যয় করতে বলেন। ল্হা-লামা-ব্যাং-ছুব-ওদ গুজরাজ্যের রাজা হয়ে গুং-থং-পা নামে এক বৌদ্ধ উপাসককে ও আরো কয়েক জন অনুগামীকে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে তিব্বতে আনানোর দায়িত্ব দেন। এরা নেপালের পথে বিক্রমশীলা বিহারে উপস্থিত হন এবং দীপঙ্করের সাথে সাক্ষাৎ করে সমস্ত সোনা নিবেদন করে ভূতপূর্ব রাজা ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস'-ওদের বন্দী হওয়ার কাহিনী ও তাঁর শেষ ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করলে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অভিভূত হন। তাঁরা মহাজ্ঞানী অতীশ দীপংকর-কে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান তিব্বতে এসে ক্ষয়িষ্ণু বৌদ্ধ দর্শনকে পুনর্জাগরিত করতে। আঠারো মাস পরে ১০৪০ খৃস্টাব্দে বিহারের সমস্ত দায়িত্বভার লাঘব করে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তিব্বত যাত্রার জন্য প্রস্তুত হন।

দীপংকর রচিত ' বোধি পথ প্রদীপ' গ্রন্থটি বৌদ্ধধর্ম প্রচারে খুবই সহায়ক ছিলো। এরপর ৬২ বছর বয়স্ক জ্ঞান তাপস দীপংকর সকল পথকষ্ট অগ্রাহ্য করে তিব্বতের পতনোম্মুখ বৌদ্ধ দর্শনকে পুনুরোদ্ধার করার পবিত্র লক্ষ্যে পৌছান গু-জে-তে। আর সেখানে পৌছেই শুনতে পান তাঁরই সমর্থিত মহামন্ত্র 'ওম মনিপদ্মে হুম'।

"বাঙালি অতীশ লঙ্ঘিল গিরি তুষারে ভয়ংকর, জ্বালিল জ্ঞানের দীপ তিব্বতে বাঙালি দীপংকর।" (সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)

হ্যাঁ, কোন কিছুই দমাতে পারেনি ৬২ বছর বয়স্ক শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপংকর-কে, দুর্গম গিরিপথ, তুষারাচ্ছন্ন অয়ন, প্রতিকুল আবহাওয়া, সব বাধা অতিক্রম করে তিনি পৌছেছিলেন হিমালয় রাজ্য তিব্বতে কেবল জ্ঞানের আলো ছড়াতে।

শ্রীজ্ঞান দিপংকর তখন বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আচার্য্য ছিলেন। সেখানে তখন অধ্যয়ন করছিলো প্রায় ৮০০০ ছাত্র। তাদের শিক্ষাদানে নিরত ছিলেন ১০৮ জন অধ্যাপক। বিশিষ্ট এই সকল পন্ডিতদের গুরু ছিলেন মহাজ্ঞানী দিপংকর। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা দেয়া হতো থেরাভেদ, মহাযান বৌদ্ধ দর্শন, বজ্রযান বৌদ্ধ দর্শন, সমাজবিদ্যা, বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, ইত্যাদি। ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান তো বটেই, এমনকি সুদূর চীন, তিব্বত, তুর্কিস্তান থেকেও ছাত্ররা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসতো। এদিকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান চর্চায় তখন ভাটা চলছিলো। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভুত মহাযান ও তান্ত্রিক শিক্ষা পরবর্তিতে বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকশিত হয় এবং বাঙালী পন্ডিতদের মিশনারী কার্যক্রমে তা এশিয়া মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আচার্য্যের গুরু দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে তিব্বত রাজার আমন্ত্রণ শ্রীজ্ঞানকে একরকম সংকটেই ফেলে। কেননা, কেবল বিক্রমশীলাই নয় এই ভুখন্ডের একটি বিশাল সংখ্যক বিহার মূলতঃ উনার অভিভাবকত্বেই চলছিলো। তারপরেও ধম্মের খাতিরে বৃহত্তর উদ্দেশ্যে বৃদ্ধ বয়স, পথকষ্ট ইত্যাদি উপেক্ষা করেও তিনি সেই আমন্ত্রণ গ্রহন করলেন। তবে শর্ত আরোপ করলেন যে, তিব্বতে তিনি কেবল তিন বছর কাটাবেন। তিন বছর তিব্বতীদের সাহায্য করে তিনি আবার ফিরে এসে বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বভার গ্রহন করবেন।

শ্রীজ্ঞান দিপংকরের এই সিদ্ধান্ত শুনে আচার্য্য রত্নাকর শান্তি বলেছিলেন, "দিপংকরের অভাবে ভারতবর্ষ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। বহু বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানের চাবি উনার হাতেই আছে। উনার অনুপস্থিতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো শূণ্য হয়ে যাবে। ............... যদিও আমি চিন্তিত তারপরেও আমি আশীর্বাদ করি দিপংকরের তিব্বত সফর আনন্দময় হবে।"

তিনি বারো জন সহযাত্রী নিয়ে তিব্বত যাত্রা শুরু করেন। তবে নিজভূমি ছাড়বার পূর্বে গৌতম বুদ্ধের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে তিনি প্রথমেই বুদ্ধগয়া গমন করেন ও আরও কিছু তীর্থস্থান দর্শন করেন। তারপর সেখান থেকে নেপালের রাজধানীতে উপস্থিত হন এবং নেপালরাজের আগ্রহে এক বছর সেখানে কাটান। এখান থেকেই তিনি মগধের গৌরবময় পাল রাজবংশের রাজা ন্যায়পাল-কে এক ঐতিহাসিক চিঠি লেখেন, যার নাম 'বিমল রত্ন লেখানামা' ( 'Vimala Ratna Lekhanama' )। এই অতুলনীয় ধ্রুপদী চিঠিতে তিনি রাজাকে কিছু বার্তা প্রেরণ করেছিলেন। সেখানে তিনি লিখেছিলেন যে, রাজাকে সকল অস্তিত্বের প্রতি দয়াশীল হতে হয়, চিন্তা ও কাজে মন্দকে পরিত্যাগ করতে হয়, রাজাকে কার্যে হতে হয় নম্র, বিনয়ী ও প্রেমময়; বোধিচিত্ত (Budhicitta: mind of enlightenment)-এর সাধনা করা এবং ঔদ্ধত ও অহংকার পরিত্যাগ রাজার কর্তব্য। এটিই ছিলো একটি ব্যক্তির অন্তরে ও বাহিরে শান্তি ও সৌম্যের বৌদ্ধ বার্তার সারাংশ। নেপালে অবস্থানকালীন সময়ে তিনি 'চর্যা সংগ্রহ প্রদীপ,' (Carya Samgra Pradipa) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। নেপালরাজ শ্রীজ্ঞান দিপংকরকে জাঁকাল অভ্যার্থনা জানিয়েছিলেন।

পদব্রজে শ্রীজ্ঞান দিপংকরের তিব্বত যাত্রা ছিলো খুব কঠিন। দুর্গম হিমালয়ের তুষারাচ্ছন্ন পর্বতমালা পার হতে গিয়ে তাঁরা ডাকাতের আক্রমণের মুখেও পড়েছিলেন। র্যু টটি ছিলো নেপালের পালপা থেকে মানস সরোবর পর্যন্ত। নেপাল অতিক্রম করে থুঙ বিহারে এলে তাঁর সঙ্গী র্গ্যা-লো-ত্সা-বা-ব্র্ত্সোন-'গ্রুস-সেং-গে (ওয়াইলি: rgya lo tsA ba brtson 'grus seng ge) অসুস্থ হয়ে মারা যান। ১০৪২ খৃস্টাব্দে তিব্বতের পশ্চিম প্রান্তের ডংরী প্রদেশে পৌছন। সেখানে পৌছলে ল্হা-লামা-ব্যাং-ছুব-ওদ এক রাজকীয় সংবর্ধনার আয়োজন করে তাঁকে থোলিং বিহারে নিয়ে যান। এখানে দীপঙ্কর তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বোধিপথপ্রদীপ’ রচনা করেন। ১০৪৪ খৃস্টাব্দে তিনি পুরঙে, ১০৪৭ খৃস্টাব্দে সম-য়ে বৌদ্ধ বিহার ও ১০৫০ খৃস্টাব্দে বে-এ-বাতে উপস্থিত হন।

তিব্বতের প্রধান মন্ত্রী দেশের প্রবেশপথে বিপুল সংখ্যক অনুসারীসহ শ্রীজ্ঞানকে জমকাঁলো অভ্যার্থনা জানান। স্বাগত বক্তব্যে প্রধান মন্ত্রী বলেন, "আপনি সর্বাধিক জ্ঞানী ও সর্বাধিক মেধাবী মহাপন্ডিত। তিব্বতের জনগণের সনির্বন্ধ অনুরোধে আপনি দেবত্ব অবতারে আচার্য্যদের ভূমি থেকে এখানে এসেছেন। এই যুগে আপনিই অবতার বুদ্ধের প্রতিনিধি এবং বৌদ্ধ দর্শনের পরমোৎকর্ষের আদর্শ। আপনার বিশুদ্ধতার গুনে জগতের সকল জীব ও দেবতারা আপনাকে পূজা করে।"
উপস্থিত জনতার মুখে তখন উচ্চারিত হচ্ছিলো মহামন্ত্র, "ওম মনিপদ্মে হুম"!

(উল্লেখ্য যে তিব্বতীরাই শ্রীজ্ঞান দিপংকরকে অতীশ উপাধী দেয় যার অর্থ মহাপন্ডিত (great scholar))।


তিব্বতে অবস্থানকালীন প্রথম বছরটি অতীশ দিপংকরের জন্য ছিলো অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মহাযান বৌদ্ধ দর্শনের প্রকৃত ডকট্রাইনগুলো প্রচার পূর্বক তার ভিত্তি স্থাপনে আত্মনিয়োগ করলেন। উনার প্রথম তিন বছরের কাজগুলোকে নিম্নরূপে সংকলিত করা যায়।

১। পশ্চিম তিব্বতের শাসক কর্তৃক উনাকে জানানো সাদর অভ্যর্থনা এবং উনার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ। বায়ন-চুব-ওদ (Byan chub-od )/বুধিপ্রভা কর্তৃক উনার প্রতি প্রদর্শিত একনিষ্ঠতা।
২। তিব্বতের মহাপন্ডিত ৮৫ বছর বয়স্ক রিন-চেন-বজান-পো (Rin-chen-bzan-po) বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করেন ও রত্নভদ্র নাম গ্রহন করেন।
৩। তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'বোধি-পথ-প্রদীপ', এবং এই গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি গৌতম বুদ্ধের ডকট্রাইন অনুযায়ী মানবের নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন সাধনে সফলকাম হন।

৪। অতীশ দীপংকর পরিচিত হন ব্রোম-স্টোন-পা-রগিয়াল-বাই-বিয়ান-গ্না (Brom-ston-pa-rgyal-bai-byun-gna)-র সাথে, যিনি অতীশের প্রধান তিব্বতী অনুসারীতে পরিণত হন এবং সমগ্র তিব্বত ব্যাপি বৌদ্ধ ধর্মের সংস্কার আন্দোলনে অতীশকে সফলভাবে সহযোগিতা করেন।

তিন বছরের অভূতপূর্ব সাফল্যের পর অতীশ দিপংকর জন্মভূমিতে ফিরে এসে বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য মহাবিহারগুলোর দায়িত্বভার পুণঃগ্রহন করার জন্যে গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেন, কেননা এমনটিই তিনি কথা দিয়েছিলেন তাঁর স্বদেশী শিষ্যদের। কিন্তু তিব্বতে ধম্ম প্রচার করার তাঁর নিবিষ্টচিত্ততার সাথে যুক্ত হয় ফিরে যাবার যাত্রা পথের বাধা। কারণ নেপালে তখন উদ্ভুত হয়েছিলো গুরুতর রাজনৈতিক সমস্যা, ফলে তিব্বত থেকে দেশে ফেরার যে নেপালী রুটটি ব্যবহার করা হতো, তা ব্যবহার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

এই পর্যায়ে অতীশের প্রধান শিষ্য ব্রম তাঁকে প্রণোদিত করেন মধ্য তিব্বত সফর করতে, যেখানে লাসা সহ অনেক নগরীতে অজস্র মঠে হাজার হাজার সন্যাসীরা রয়েছেন অতীশের দীক্ষার অপেক্ষায়। অক্লান্ত ধর্ম প্রচারক অতীশ তৎকালীন তিব্বতে ধর্মের নামে প্রচলিত বিবিধ কুসংস্কার ও বিভিন্ন ভ্রান্ত আচার-যজ্ঞের বিরূদ্ধে সংগ্রাম করতে শুরু করেন, এবং শুভ ও নৈতিক জীবন যাপনের ডকট্রাইন প্রচার করতে থাকেন। অতীশের মোহনীয় ব্যাক্তিত্ব ও যাদুকরী প্রচারনার প্রভাবে পুরো মধ্য তিব্বতে ক্ষয়িষ্ণু বৌদ্ধ দর্শন ও ধর্ম নতুন জীবন ফিরে পায়। তিনি জনগণকে বুদ্ধের নৈতিক শিক্ষা দান করেন ও মহাযান দর্শনের সারগর্ভ অনুধাবন করান। জগৎ-সংসারের অনিত্যতা (anicca) প্রচার করে তিনি এই বোঝান যে তন্ত্রের মূল চর্চা যজ্ঞের মধ্যে নিহিত নাই, বরং তা আছে মনকে ধ্যানে নিমগ্ন করার মধ্যে। তিনি দুঃখভোগের জিঞ্জির থেকে মুক্তির নিমিত্তে নৈতিক শুদ্ধতা এবং ধ্যান-এর গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠা করার উদ্ধেশ্য তন্ত্রের অপকৃষ্ট চর্চার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। উনার রচিত গ্রন্থ 'বোধি-পথ-প্রদীপ' বুদ্ধের শিক্ষাকে বিশদভাবে তুলে ধরেছে, এই শিক্ষা বলে উচ্চ নৈতিক জীবনের কথা, অস্তিত্বের নম্রতা ও বিশুদ্ধতার কথা, বিশ্বজনীন ভালোবাসার কথা, অহিংসা ও সৌহার্দের কথা, এবং বোধিসত্ত্ব (Bodhicitta) অর্জনের জন্য ধ্যানের প্রয়োজনীয়তার কথা। ছিষট্টিটি শ্লোকের এই ছোট্ট গ্রন্থটি অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় বুদ্ধের শিক্ষার মূলনীতিগুলি তুলে ধরেছে। মহাযান দর্শনের অনুসারী অতীশের উত্থান হয়েছিলো সীমাহীন দুঃখভোগের জিঞ্জির থেকে মানজাতির মুক্তির পথপ্রদর্শক হিসাবে। তিব্বতের ধর্মীয় ইতিহাসে তিনিই ছিলেন সবচাইতে বেশি প্রভাববিস্তারকারী মহামানব, যিনি সমগ্র জাতিকে জাগ্রত করে ধম্মের পথে নিয়ে এসেছিলেন।

ডকট্রাইন প্রচার করার সময় তিনি তার শিষ্য ও অনুবাদক ব্রমের সাথে পুরো তিব্বত চষে বেড়ান। বহু গুনে গুনান্বিত, জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় বিচরণকারী একজন সাধু, দার্শনিক ও পন্ডিত অতীশ দীপংকর তিব্বতে মহাযান বৌদ্ধ দর্শন প্রতিষ্ঠা করত ব্যাপক সামাজিক সংস্কার সাধন করেছিলেন। তিনি কুসংস্কারাচ্ছন্ন তৎকালীন তিব্বতীদের পথপ্রদর্শন করে তাদের ভুত-প্রেত ও গুণিনতন্ত্রে বিশ্বাস, হত্যাযজ্ঞ, ব্যভিচার এবং আরো অনেক অসামাজিক কাজের মত অন্ধকার থেকে বের করে আলোয় নিয়ে আসেন। তিনি বুদ্ধের শিক্ষাদানের ভিতর দিয়ে তাদের মধ্যে নতুন মূল্যবোধের সৃষ্টি করেন।
তিব্বতের থোল নামক একটি জায়গায় প্রবল বন্যায় স্থানীয় জনগণ খুব কষ্ট করতো। নানা জ্ঞানে পন্ডিত অতীশ দীপংকর তাঁর প্রকৌশল জ্ঞান কাজে লাগিয়ে সেখানে একটি বাঁধ নির্মান করে বন্যা প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা করেন। খাল খনন করে কৃষিতে সেচের ব্যবস্থা করেন, এবং এর ফলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। তিনি জনস্বার্থে চিকিৎসা শাস্ত্রের উপরও কিছু গ্রন্থ (treatises) রচনা করেন। এভাবে তিব্বতের সমাজে এক নবযুগের সূচনা হয়।

বাংলার সাধুদের মত শ্রীজ্ঞান অতীশ বিস্তৃত প্রত্যন্ত অঞ্চলে গীত ও পদের মাধ্যমে ধর্ম প্রচার করে তিব্বতের মানুষদের হৃদয় জয় করে নেন। অতীশ রচিত পদাবলী 'বজ্রাসনা বজ্রগীতি ( 'Vajrasana Vajragiti' ), 'চর্যাগীতি ( 'Charyagiti' ) এবং বজ্রযোগিনী স্তোত্র ( 'Vajrayogini Stotra' ) তিনি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর প্রিয় জন্মভূমি বাংলার স্মৃতির প্রতি। আধ্যাত্মিক এই গীতিগুলি ছিলো নির্মল বাংলা ভাষায় রচিত। তবে বাংলা রূপগুলো হারিয়ে গিয়েছে শুধু এগুলির তিব্বতী অনুবাদগুলো টিকে আছে তানজুর (Tanjur) নামক গ্রন্থে। এই পদগুলিতে রয়েছে গৌতম বুদ্ধের বাণী। কোপ্পেন (Koppen) নামক একজন জার্মান পন্ডিত ১৮৫৯ সালে প্রকাশ করেন অগণ্য-সংস্কারমুক্ত অতীশ দীপংকরের মহত্বকে, যিনি তাঁর গীত ও পদকে তাঁর দার্শনিক চিন্তাধারার যান হিসাবে ব্যবহার করে তিব্বতের মানুষের নৈতিক উন্নয়ন সাধন করেছিলেন।

অতীশের ধর্মপ্রচার তিব্বতের মানুষদের আবিষ্ট করে এমনভাবে অনুপ্রানিত করেছিলো যে তারা পেয়েছিলো বৌদ্ধ দর্শন থেকে নিঃসৃত নৈতিকতা ও ধর্মের এক নতুন ধারনা। সেক্ট উপদল নির্বিশেষে হাজার হাজার সন্যাসী অতীশের শিক্ষাকে গ্রহন করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে মালভূমির এক সাধারণ রাখালও অতীশের বই সাথে রাখতো। একজন পন্ডিত বলেছেন, "সন্যাসী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, পন্ডিত থেকে শুরু করে সামান্য ব্যাক্তি, এককথায় সকল তিব্বতীর জন্য অতীশ নিয়ে এসেছিলেন নৈতিক বিশুদ্ধতা এবং অপরের জন্য নিস্বার্থ ত্যাগ, পবিত্র জীবন এবং মহাযান শিক্ষার মহান বাণী।" জনতা পেয়েছিলো একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী মহৎকে যার কথা ও কাজে কোন অমিল ছিলনা।

ধর্ম প্রচারের ফাঁকে ফাঁকে তিনি ধ্যেনেও নিমগ্ন হতেন, পাশাপাশি সাহিত্যকর্মও করতেন। তিনি ৭৯টি বই লিখেছেন বলে জানা যায়। তাঁর গ্রন্থগুলোকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে, তন্ত্র (Tantra), প্রাজনাপরমিতা (Prajnaparamita), মাধায়ামিকা (Madhayamika) এবং কমেটারি (cometary)।

শ্রীজ্ঞান অতীশ বাংলাদেশ ও প্রাচীন ভারতের সাথে তিব্বত, চীন ও উত্তর এশিয় দেশগুলোর মধ্যে সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন তৈরী করেন। একজন পন্ডিত বলেছেন যে, বৌদ্ধ ধর্ম যে তিব্বতের রাষ্ট্রীয় ধর্মে পরিণত হয়েছে এর পিছনে অতীশ দীপংকরের অবদান রয়েছে।


অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতের বিভিন্ন অংশে ভ্রমণ করেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। তিনি তিব্বতী বৌদ্ধধর্মে প্রবিষ্ট তান্ত্রিক পন্থার অপসারণের চেষ্টা করে বিশুদ্ধ মহাযান মতবাদের প্রচার করেন। বোধিপথপ্রদীপ রচনাকে ভিত্তি করে তিব্বতে ব্কা'-গ্দাম্স নামে এক ধর্ম সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়।

দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন। তিব্বতের ধর্ম, রাজনীতি, জীবনী, স্তোত্রনামাসহ তাঞ্জুর নামে বিশাল এক শাস্ত্রগ্রন্থ সংকলন করেন। বৌদ্ধ শাস্ত্র, চিকিৎসা বিদ্যা এবং কারিগরি বিদ্যা বিষয়ে তিব্বতী ভাষায় অনেক গ্রন্থ রচনা করেন বলে তিব্বতীরা তাকে অতীশ উপাধীতে ভূষিত করে। অতীশ দীপঙ্কর অনেক সংস্কৃত এবং পালি বই তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ করেন। দীপঙ্করের রচিত গ্রন্থগলির মধ্যে বোধিপথপ্রদীপ, চর্যাসংগ্রহপ্রদীপ, সত্যদ্বয়াবতার, মধ্যমোপদেশ, সংগ্রহগর্ভ, হৃদয়নিশ্চিন্ত, বোধিসত্ত্বমণ্যাবলী, বোধিসত্ত্বকর্মাদিমার্গাবতার, শরণাগতাদেশ, মহযানপথসাধনবর্ণসংগ্রহ, শুভার্থসমুচ্চয়োপদেশ, দশকুশলকর্মোপদেশ, কর্মবিভঙ্গ, সমাধিসম্ভবপরিবর্ত, লোকোত্তরসপ্তকবিধি, গুহ্যক্রিয়াকর্ম, চিত্তোৎপাদসম্বরবিধিকর্ম, শিক্ষাসমুচ্চয় অভিসময় ও বিমলরত্নলেখনা উল্লেখযোগ্য। বিখ্যাত পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং ইতালির বিখ্যাত গবেষক গ্যুসেপ তুচ্চি দীপঙ্করের অনেকগুলো বই আবিস্কার করেন।

তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মে সংস্কারের মতো শ্রমসাধ্য কাজ করতে করতে দীপঙ্করের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে ১০৫৪ খৃস্টাব্দে ৭৩ বছর বয়সে তিব্বতের লাসা নগরের কাছে চে-থঙের দ্রোলমা লাখাং তারা মন্দিরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এভাবে বিদেশের মাটিতে তাঁর শেষ দিনগুলো কাটান বাঙালী জ্ঞানতাপস অতীশ দীপংকর। সেই তিব্বতেই রয়ে যায় তাঁর দেহাবশেষ।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে পরাশক্তি চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন হলে, জিয়া বাংলার সন্তান অতীশ দীপংকরের দেহভস্ম পাওয়ার জন্য চীন সরকারের কাছে অনুরোধ জানান। নতুন এই সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে চীন তা দিতে রাজি হয়। ১৯৭৮ সালের জুন মাসে শিল্পকলা এ্যাকাডেমীর মহাপরিচালক জনাব আসাফ-উদ-দৌলা-র নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল চীন গমন করেন। সেখানে এক রাজকীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ১৬ই জুন তাদের হাতে এই ভস্ম তুলে দেয়া হয়। অবশেষে ২৮শে জুন, ১৯৭৮-এ এই ভস্ম নিয়ে প্রতিনিধি দলটি ঢাকায় আসে। বর্তমানে রাজধানী ঢাকার ধর্মরাজিক বৌদ্ধবিহারে তা সংরক্ষিত আছে।

মহাজ্ঞানী অতীশ দীপংকরের সকল জ্ঞানকর্মের মূল নিহিত রয়েছে একটি মহামন্ত্রে, তা হলো 'ওম মনিপদ্মে হুম'। কি এই মহামন্ত্র? কি তার গুঢ় অর্থ? বাঙালী জ্ঞানতাপসের এই মন্ত্র আজও কেন ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় তিব্বতের আকাশে-বাতাসে? পরবর্তিতে এইসব নিয়ে আলোচনা করবো।


(চলবে)


(ধর্মবিশ্বাসে আমি একজন মুসলমান হলেও আমার প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের আদি ধর্ম বৌদ্ধ দর্শনের প্রতি আমার গভীর আগ্রহ রয়েছে। সময় ও সুযোগ পেলে তা জানার চেষ্টা করি। আশা করি পাঠকরা আমার লেখাটির গঠনমূলক সমালোচনা করবেন। আমার লেখায় কোন তথ্যবিভ্রাট থাকলেও জানাবেন।)

তথ্যসূত্র:
১। ইন্টারনেটে প্রাপ্ত বিভিন্ন আর্টিকেল
২। ইমরান যুবায়ের-এর ব্লগ
৩। http://www.munshigonj.com/Famous/Atis.htm
৪। Click This Link
৫। http://thebuddhisttimes.com
৬। http://wikipedia.org


মন্তব্য ১৩ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১৩) মন্তব্য লিখুন

১| ৩১ শে মে, ২০১৫ বিকাল ৩:১৪

রমিত বলেছেন: লেখাটিকে নির্বাচিত পাতায় স্থান দেয়ার জন্য সামু কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ।

২| ৩১ শে মে, ২০১৫ রাত ৮:১৮

তৌফিক মাসুদ বলেছেন: লেখাটি পড়ে অতীশ দীপংকর সম্পর্কে জানলাম। একজন বিক্রমপুর বাসী হয়ে গর্বিত হলাম।

০১ লা জুন, ২০১৫ রাত ১:২১

রমিত বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে।
বিক্রমপুর বিহার কি দেখেছেন?

৩| ৩১ শে মে, ২০১৫ রাত ১০:০৯

তাপস কুমার দে বলেছেন: ধন্য হলাম অনেক তথ্য জানা গেলো।

০১ লা জুন, ২০১৫ রাত ১:২০

রমিত বলেছেন: আপনাকে ধন্যবাদ।

৪| ০১ লা জুন, ২০১৫ দুপুর ১২:১৩

রাতুলবিডি৪ বলেছেন: তৌফিক মাসুদ বলেছেন: লেখাটি পড়ে অতীশ দীপংকর সম্পর্কে জানলাম

লেখাটিকে নির্বাচিত পাতায় স্থান দেয়ার জন্য সামু কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ।

০১ লা জুন, ২০১৫ দুপুর ২:২৮

রমিত বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

৫| ০১ লা জুন, ২০১৫ বিকাল ৫:৪৮

শতদ্রু একটি নদী... বলেছেন: অসাধারন পোষ্ট।

বৌদ্ধ মনীষীরা ধর্মপ্রচারের জন্য ওইদিকেই বেশি দৌড় দিত কেন? কোন বিশেষ কারন নাকি নিরিবিলি পরিবেশ, সহজ সরল মানুষই আসল ব্যাপার?

০২ রা জুন, ২০১৫ দুপুর ১:০৮

রমিত বলেছেন: বিষয়টি নিয়ে আমি এখনও লেখাপড়া করছি। অনেক গভীর প্রশ্ন করেছেন। অল্প জ্ঞান দিয়ে এর উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। অনেকগুলো প্রশ্ন আমার নিজেরই আছে, ১। আমাদের বাংলা ছিলো আর্য সমাজ/সাম্রাজের বাইরে, এখানেই এই দর্শনটির উদ্ভব ও বিকাশ, কেন? সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে - আর্যদের বৈদিক দর্শন আমরা (আমাদের পূর্বপুরুষরা) পছন্দ করতেন না, তাই হেটেরোডক্স এই দর্শনটির উদ্ভব এখানে হয়েছিলো, যেহেতু তা আমাদের সংস্কৃতি ও চিন্তাধারারই প্রতিফলন ছিলো এই দর্শনে তাই তা এখানে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। উপরন্তু, আর্যদের আগমনের পূর্বে আমাদের এখানে বিশাল সভ্যতা ছিলো। সেই সভ্যতায় প্রচলিত ধর্ম/দর্শনের সাথে আর্য ধর্ম ও দর্শনের অমিল থাকাটাই স্বাভাবিক, যেহেতু তারা বহিরাগত ও বাহুবলে বিজয়ী শক্তি ছিলো। অনেকের ধারনা, বৌদ্ধ দর্শনের মধ্য দিয়ে আমাদের পুরাতন দর্শনটিই আবার জেগে উঠেছিলো। ২। আর্য সমাজের প্রভাবে আমাদের দেশ ঠিক কবে এসেছিলো? সেই প্রভাব কতটুকু শক্তিশালী ছিলো? ৩। বৌদ্ধ মনীষীরা ধর্মচর্চা মূলত বাংলা ও বিহারেই করেছিলেন এর সাক্ষ্য এখনও বহন করছে দেশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক বৈদ্ধ নিদর্শন, উদাহরণ স্বরূপ নালন্দা ও মহাস্থানগড়ের কথা বলা যায়। এই জাতীয় নিদর্শন আরো থাকার কথা পর্যাপ্ত অনুসন্ধান করলে আরও পাওয়া যাবে হয়তো। সম্প্রতি অতীশ দিপংকরের জন্মভূমী বিক্রমপুরেই খননকার্য চালিয়ে একটি বিহার পাওয়া গিয়েছে। ধর্মপ্রচারের জন্য বৌদ্ধ মনীষীরা শুধু তিব্বত না, সুদুর জাপান, তুরস্ক, কাজাখিস্তান, মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত গিয়েছিলেন। হেরমান হেসে রচিত 'সিদ্ধার্থ' উপন্যাসে একটা খুব সুন্দর মন্তব্য পাওয়া যায়, একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু-কে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, "কোথায় যাচ্ছেন ভাই?" উত্তরে ভিক্ষু বললেন, 'আমাদের ভিক্ষুদের নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য নেই, আমরা কোথাও যাইনা, পথে পথেই থাকি। বুদ্ধের বাণী প্রচার করি।"

৬| ০২ রা জুন, ২০১৫ দুপুর ১:১৭

শতদ্রু একটি নদী... বলেছেন: এ ব্যাপারে আমি নিজেও কিছু পড়ছিলাম। নিজের কিছু ধারনা হইছে। কিন্তু প্রাচীন ইতিহাস নিয়া লেখার মতো যোগ্যতা এখনো হয়নাই। তবে খুব সম্ভবত গৌতম বুদ্ধ যেহেতু ওইদিকে প্রথম গিয়েছিলেন, তার অনুসারীরাও সম্ভবত সেই ধারাই অনুসরন করতেন। এছাড়া আরো অনেক আনুসাঙ্গিক কারন তো ছিলই। বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব শুধু বাংলা বিহার না, দক্ষিন ভারতেও ব্যাপকভাবে বিদ্যমান ছিলো।

০২ রা জুন, ২০১৫ দুপুর ২:০৭

রমিত বলেছেন: জ্বী, দক্ষিণ ভারতেও বৌদ্ধ দর্শনের ব্যাপক প্রভাব ছিলো। কারণ ঐ একই, কলিঙ্গ-ও আর্য সাম্রাজ্যের বাইরে ছিলো। ওটাও এই উপমহাদেশের প্রাচীন সভ্যতার অংশ। বহিরাগত আর্যরা প্রথমদিকে মূলত উত্তর ভারতে অবস্থান নিয়েছিলো। অঙ্গ (বিহার), বঙ্গ ও কলিঙ্গ (দক্ষিণ ভারত) আর্য সম্রাজ্যের বহির্ভুত ছিলো। সম্রাট অশোক কলিঙ্গের যুদ্ধের পর মানুষে পরিণত হয়েছিলেন।
আমার পরবর্তিতে এই বিষয়গুলো নিয়ে লিখবো আশা রাখি।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
সাথে থাকবেন।

৭| ১০ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:৩৬

প্রণব দেবনাথ বলেছেন: প্রিয়তে নিলা।।

১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৩০

রমিত বলেছেন: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.