![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রফিক ঠিক ঘাটের উল্টো দিকের তাল গাছটার নিচে দাঁড়ালো। পুকুরটা খুব বেশি বড় না। বাচ্চারা খুব সহজে ঢিল ছুড়ে এপার ওপার করে। রোদ তখনো তেতে ওঠেনি। বাতাসের ধাক্কায় তালপাতারা সশব্দে কেঁপে ওঠে। রফিকের সচেতন দৃষ্টি চারপাশ ঘুরে বারবার ঘাটে যায়। আবার আহত হয়ে ফিরে আসে। এই ভর দুপুরে হঠাৎ তার চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে। গত রাতে বেশ ধকল গেছে। একটুও ঘুম হয়নি। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে একটা ঘুম দিতে হবে। হঠাৎ জলের আলোড়নে সচকিত হয়ে হয়ে রফিক ঘাটে দৃষ্টি ফেলে। রিনা জলে শব্দ তুলে থালা-বাসন ধোয়ার কাজ করছে। রফিকের চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। রিনার ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি। হাতে কাঁচের চুড়ি বাজে। সে চুড়ির মৃদু শব্দ রফিকের কান ছুঁয়ে মনে প্রবল আলোড়ন তোলে। আড়ষ্টতা ভেঙে রফিক পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে পারে না। তারপর তার আধো আধো ছেঁড়া ছেঁড়া দৃষ্টিপথ ধরে সশব্দে হেসে দ্রুত পায়ে অদৃশ্য হয়ে যায় রিনা। এবার তার প্রস্থান পথের শূন্যতায় পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে রফিক। এতক্ষণ সে যেন কি এক ভালোলাগার আচ্ছন্নতায় নিমগ্ন ছিলো। এখন সে অনুভূতির ছেদ পড়েছে। তার মনটা একটু আর্দ্র হয়ে উঠলো। মেয়েটি কি আরেকটু থাকতে পারলো না। কিংবা সেও কি একটু নিবিড়ভাবে দেখতে পারতো না তাকে? তৃষিত মনের এমন প্রশ্নাকুল ভাবনার গা বেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে তার। বুকভরা অপূর্ণতা নিয়েই রফিক বাড়ির পথ ধরে।
দুই
রাতের বুক থেকে ঘন আঁধার ক্রমেই ক্ষয়ে যেতে থাকে। বাঁশঝাড়ের আবছা আলোয় পাখির কিচিরমিচির শব্দে ডেন আলো স্পষ্ট হতে থাকে। খোপের কুঠুরিতে কি বুঝে মোরগগুলো ডেকে উঠছে বারবার। প্রকৃতিতে একটা মৃদু বাতাসের আস্তরণ। আরো একটা প্রভাতের পূর্বাভাস। এরই মধ্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে রিনা। কিন্তু রশিদ মৃধার সমস্ত বাড়ি তখনো ঘুমে মগ্ন। এতো এতো শ্রম তবু মেয়েটির গায়ে একটা সুন্দর কাপড় উঠে না। স্বপ্ন ভাঙন পথে সে হেঁটে চলে নিরন্তর। রিনার কর্মচাঞ্চল্যে ধোঁয়াটে থালায় সকালের প্রথম আলো ঝিলিক খেলে, ঘরদোর উঠোনে ছড়িয়ে পড়ে ঝকঝকে পবিত্রতা, টেবিলে শোভিত হয় উষ্ণ রুটি। ধীরে ধীরে আলোর প্লাবনে জেগে ওঠে ঝলমলে পৃথিবী। হঠাৎ রিনার কানে নুরু সিকদারের বিস্ফারিত কণ্ঠস্বর। মাঝে দশ-বারো কাঠা জমি। তারপর ছোট্ট একটা কচুরিপানা ঠাঁসা ডোবার পরই নুরু সিকদারের বাড়ি। ও বাড়ির উচ্চস্বর সতর্কভাবে কান পাতলে এ বাড়ি থেকে শোনা যায়। কিন্তু কাজের চাপে রিনার ওভাবে মনোযোগ দেয়া হয় না। মনে প্রচ্ছন্ন কৌতূহল খচখচ করে। টিউবয়েলের পানি আনতে গেলে কে যেন তার কৌতূহল নিবৃতির পথ ধরে বলে ওঠে- জানিস রিনু, নুরুল কাকার ঘরে চুরি হইছে। এইডা মনে হয় রফিক্যার কাম। চাচা ওরে যা গালাগালি করতাছে। রিনা কান পাতে। নুরুল সিকদারের উচ্চ কণ্ঠ-রফিক শুয়োরের...কুত্তার...আমার সর্বনাশ করছে। তোর এবার রক্ষা নাই। আচমকা রিনা তার মনোযোগ সরিয়ে নেয়।
সে কিছু শুনতে চায় না। তবুও অপ্রত্যাশিতভাবে কথাটা তার আশেপাশে অনুরণিত হয়। সে কানে হাত দিয়ে বসে পড়ে। পানি নিয়ে ফেরার কথাও ভুলে যায়।
তিন
সূর্য যেন প্রচ- আক্রোশে নিজেকে মেলে ধরছে। রোদে গা পাতা যায় না। রফিক খানিক হেঁটেই ঘেমে নেয়ে ওঠে সেই পুকুর পাড়ের গাছটির নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। অপর পাড়ের মাঠ জুড়ে খাঁ খাঁ শূন্যতা। শিগগিরই সে শূন্যতায় ঐশ্বর্যের রানী হয়ে ধরা দিলো মেয়েটি। কিন্তু আজ ঠোঁটের রেখায় কোন হাসি নেই। কিংবা আড়চোখে একবার তাকালোও না। রফিক মনোযোগ দিয়ে দেখতে চায় তার চোখেমুখে লেপ্টে থাকা বিষণœতা। সে অচেনা মানুষের মতো চলে যায়। রফিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তালগাছটায় ঠেস দিয়ে বসে পড়ে। চারপাশে ছায়াময় শীতল শীতল প্রশান্তি। রফিকের বুকটা খচখচ করে। পুকুরের জলে কয়েকটা হাঁস ডানা ঝাপটায়। খানিক দূরে ছোট্ট পেয়ারা গাছটায় বসে আছে একটা মাছরাঙা। পুকুর জলে তার গভীর দৃষ্টি। আর সুনীল আকাশের অচেনা পাখিদের ওড়াওড়ির পানে চেয়ে রফিকের রাতজাগা দৃষ্টি বুঁজে আসে। তারপর একান্ত ভাবনার বাঁক বদলে ভেসে যেতে থাকে।
হঠাৎ পানির ঝাপটায় আচমকা তাতে ছেদ পড়ে। রিনা সামনে দাঁড়িয়ে। তার পানে এক ঝলক তাকিয়ে রফিক আবার উদাসী দৃষ্টি মেলে সেই দূর আকাশের বুকে সেঁটে থাকা অচেনা পাখিদের পানে
‘এই সব ছাইড়া দিতে পারেন না।’
রফিকের উদাসী দৃষ্টি আর আকাশে থাকে না। তা এখন লাজুক হয়ে সামনের ঘাসের চাদরে ফিরেছে।
‘আপনি দিনের আলোতে জাইগা উঠেন।’
রফিক পুড়তে থাকে। এখানে এলেই যে সে পোড়ে। আজ তার আরো একটু শাসন নিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু বলতে পারে না। তার কথা হয়ে ওঠে দু’চোখের অবারিত জল।
রিনা হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠে।
‘জানেন কাইল না স্বপ্নে দেহি...’
শেষ করে না। রফিক কিছুটা সামলে নিয়ে মাথা উঠায়। রিনার ঠোঁটের নিচে এক ছোপ রক্ত। উদ্বিগ্ন রফিক।
‘কি হয়েছে ঠোঁটে’
‘পানি আনতে দেরি....’ আর বলে না রিনা।
রফিক অস্বস্তিতে মাথা এদিক ওদিক করে।
‘তোমারে আমার কইরা হেরপর আমি তোমার হমু।’
‘মানে.. তোমারে বিয়া কইরা তারপর তোমার মনের মতো হমু।’
রিনা লজ্জা পাওয়ার বদলে হেসে ফেলে।
‘জানো বিয়া করতে কি লাগে?’
‘হ জানি।’
‘কও তো কি?’
‘যহন আনমু তখন দেখবা।’
‘সত্য কতা।’
‘সত্য।’
‘এইবার ঈদেই তোমারে..’
দু’জোড়া চোখ আলোকিত হয়ে উঠে। কিন্তু কোথাও যেন এক চিলতে আঁধার থেকে যায়। দু’জনের কেউ তা দেখে না।
চার
কৃষ্ণপক্ষের দশমী তিথির গভীর রাত। গ্রামটা একটা অন্ধকারের পি- হয়ে পড়ে আছে। ঘরের পাশে গোয়ালে গরু জাবর কেটে চলে। রফিকের চোখে ঘুম নেই। সে উঠে বসে। অন্ধকারে পাটখড়ির বেড়ার মাথায় ঝুলানো জামাটি হাতড়ায়। দ্রুত তা গায়ে চাপিয়ে অন্ধকারের পি-ে পা রাখে। ঘন ঘন পদক্ষেপে প্রশস্ত রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে থাকে গোপালদি বাজারের পানে। তার কোনদিকে খেয়াল নেই। কেবল একান্ত ভাবনায় ভেতরটা কিঞ্চিৎ দুলে উঠে। বাতাসে শীতের আমেজ তবু সে ঘেমে উঠছে। অনতিদূরে কুকুরের উদ্দেশ্যহীন ডাকেও আমূল কেঁপে ওঠে সে। রফিক নিজেকে আজ মেলাতে পারেনা। সে বাজারের ইলিয়াস কসমেটিকসের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। কোন মানুষ্য শব্দ নেই। অপরিচিত সব নিশাচর পোকারা অবিরাম ডেকে যাচ্ছে। একটি পাখি বাজারের মাঝের বিশাল বটগাছটিতে সশব্দে ডানা ঝাপটে উঠে। রফিক উদাসীনতার খোলস ছেড়ে চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখে। তারপর এক পা দু’পা এগিয়ে নিপুণ হাতের জাদুতে দোকানের ভেতর ঢোকে। টাকা, দামি কসমেটিকস ফেলে ছোট্ট টর্চের মৃদু আলোয় সে আজ খুঁজে চলে অন্য কিছু। তার শরীরে উত্তেজনা টগবগ করে। সে উত্তেজনায় ঠাঁসা মন নিয়ে বেরুতে চায় দোকানের গাঢ় অন্ধকার থেকে। কিন্তু অবচেতনেই ছোট্ট একটি শব্দ রাতের নীরবতা ভেঙে প্রকান্ডভাবে ছড়িয়ে পড়লো। মুহূর্তে চারপাশে কোলাহল জেগে ওঠে। এ সম্মিলিত কোলাহলের মধ্যেই রফিকের চেতনা লুপ্ত হয়ে যায়।
পাঁচ
পাখির কলকাকলীতে, শিশিরের শব্দে পৃথিবীর বুকে উজ্জ্বল ভোর নামে। গোপালদি বাজারটা আজ এই সকালেও সরগরম। বাজারের চত্বরে পড়ে আছে একটা নিথর দেহ। তবু কেউ একজন পা দিয়ে তার নিস্তেজ শরীরটাকে ঝাঁকি দেয়। মুখটা ঘুরে যায়। কারো চিনতে ভুল হয় না। রফিকের মুখ। ‘রফিক চোরা’র মুখ। সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। আবার ঝাঁকি দেয়। পকেট থেকে ছোট্ট একটা কাগজের পুটলি গড়িয়ে পড়ে। কেউ সেটা তুলে খুলতেই বেরিয়ে পড়ে সুন্দর একটা নাকফুল। নাকফুলটি সকালের প্রথম আলোয় চিকচিক করে উঠে।
রানা মুহম্ম্দ মাসুদ
২| ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ৮:১৭
অর্থনীতিবিদ বলেছেন: রফিকের আর বিয়ে করা হলো না। চুরি করে আসলে সবসময় সফল হওয়া যায় না। তাছাড়া ভালবাসার ক্ষেত্রে সততা রক্ষা করাটা জরুরী। রফিক নাকফুলটা চুরি না করে যদি গায়ে খেটে পরিশ্রম করা অর্থ দিয়ে কিনত তাহলে সেটার বরকত পাওয়া যেত। কিন্তু চুরি করতে গিয়ে বেঘোরে নিজের জীবনটাই খোয়াল।
©somewhere in net ltd.
১|
১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ৮:০২
রাতুল_শাহ বলেছেন: সুন্দর গল্প।
সমাপ্তিটা ভাল লাগছে।
বিয়ে করতে নাকফুল লাগে।