নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শুণ্যতার নিচে পিয়ানো শুনি...

রাজসোহান

প্রিয় অন্ধকার, আমার পুরোনো বন্ধু তুমি...

রাজসোহান › বিস্তারিত পোস্টঃ

বই আলোচনাঃ আমার গল্প

২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ৯:৪৯



আত্মজীবনীঃ আমার গল্প
লেখকঃ ফরিদ কবির
প্রকাশকঃ আগামী


একদিন কবি ফরিদ কবির শুরু করলেন তাঁর নিজের জীবনের গল্প!

গল্পের শুরুটা ছিলো তাঁর বাবাকে নিয়ে। এ যেন এক জীবনের ভেতর অন্য আগের জীবনের গল্প। সেই গল্পে সে কী সাসপেন্স! যেনো চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে গেলো ট্রেন থেকে অচেনা স্টেশনে নেমে ২/৩ দিনের না খেতে পারা সেই ১০ বছরের বালকের ছোট্ট দেহে। প্রচণ্ড ক্ষুধায় কাতর, চোখে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, স্বজনহীন এই বিশাল ঢাকা শহরে সে যে একা!

আমরা ছোটোবেলায় প্রতি শুক্রবারে বিটিভিতে কিছুকিছু বাংলা সিনেমায় দেখতাম এরকম কোন দৃশ্য। কিন্তু সিনেমাগুলোর ভাবনা আসে কোত্থেকে? বাস্তব জীবন থেকেইতো! কবি ফরিদ কবিরের বাবা সাদুল্লাহ সেই বাস্তবতাকে তীব্র যন্ত্রণায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে বড় হয়েছেন। আর কবি তার চমৎকার লেখনী দিয়ে সেই বালক সাদুল্লাহর কষ্টময় দিনের অনুভূতি আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। সিনেমা নয় নিরেট বাস্তব!

ফরিদ কবিরের ট্রেন কবিতা কি তাঁর বাবার ঘটনা থেকেই লিখেছিলেন?

'ট্রেন আমাদের নামিয়ে দিয়ে গেল
মাঝপথে, অচেনা স্টেশনে

মানুষ যেখানে যেতে চায় সেটাই কি গন্তব্য?
নাকি, তারা যেখানে নামে?
নাকি, গন্তব্যই খুঁজে নেয় তার নিজস্ব মানুষ!

বিহ্বল স্টেশনে নেমে আমরাও ভাবি—
এখানেই কি নামতে চেয়েছি
নাকি, ট্রেনই নামিয়ে দিয়ে গেছে আমাদের
…. …. এই ঘন কুয়াশারাত্রিতে!'

আমার গল্প আসলে অনেকগুলো গল্প। যে গল্পের শুরু ছিলো কবির পিতাকে দিয়ে শেষও হয় পিতাকে দিয়ে। কিন্তু বড় একটা সময় কেটে গেছে সমান্তরালে পিতার জীবন, নিজের জীবন। তাদের জীবনের চড়াই উৎরাই যেনো থ্রিলার সিনেমার রোলার কোষ্টারকেও হার মানিয়েছে।

স্কুল বালক ফরিদ কবিরের জবান দিয়ে আমরা শুনি পুরান ঢাকায় সাত সকালে কলপারে দুই নারীর কলহ আর অকথ্য গালিগালাজ কিংবা দিনের পর দিন মার খেয়েও টেলিভিশনের প্রতি ফরিদ কবিরের অদম্য উৎসাহ! ফরিদ কবিরের অসংখ্য এই গল্প উপন্যাসে শিকড় ছড়িয়ে হয়েছে এক মহীরুহ।

গল্পের শুরু এবং শেষে পিতাকে টেনে ফরিদ কবির যদিও পাঠককে বোঝাতে চান এটি তাঁর পিতার গল্প, কিন্তু ভেতরের পুরো বিস্তারটুকুতে ফরিদ কবির নিজে প্রবলভাবে বিদ্যমান। পিতা সাদুল্লাহ আগের দিনের ঘটনা পরেরদিনই ভুলে যেতো, ফরিদ কবিরকেও একই স্বীকারোক্তি করতে দেখি। যেনো মেলাতে চেয়েছেন পিতার সাথে তাঁর কী কী মিল! আমার গল্প এগিয়েছে ফরিদ কবিরের বেড়ে ওঠার সাথে, আমার গল্পের সাথে বিস্তার ছড়িয়েছে ঢাকা শহরের ডালপালা! ফরিদ কবিরের চোখ আমাদের যে ঢাকাকে দেখিয়েছে সেই ঢাকাকে আমাদের যুগের ছেলেমেয়েরা দেখেনি বা দেখিনি!

মুক্তিযুদ্ধের নরকাগ্নির সময়কালেও পুরান ঢাকার দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক গতিময়তা ফরিদ কবিরের চোখ দিয়ে আমরা দেখতে পাই। যেমন মে মাসেই সারাদেশে যুদ্ধের মধ্যে হুমায়ুন মামার বিয়ের উৎসব! আরও জানতে পারি ৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে কীভাবে হাজারে হাজারে মানুষ ঢাকা ছেড়ে পালাচ্ছিলো অজানা আশঙ্কায়। জীবন্ত দৃশ্যাবলীর মতো ফরিদ কবির ঢিবঢিব বুকে লিখেছেন লঞ্চঘাটে মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে রাজাকারদের মারছেন। মানুষ হত্যার দৃশ্য তাঁর চোখে ওটাই প্রথম, ভয় না পেয়ে উপায় কী!

ফরিদ কবিরের বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের সূচনা পাচ্ছি নিজের সরল স্বীকারোক্তিতে যখন তিনি হয়ে গেলেন বইয়ের পোকা। বইয়ের আগে ফরিদ কবিরের সবচেয়ে আনন্দের বিষয় ছিলো টেলিভিশন! মার খেয়েও তাকে টেলিভিশন দেখানো থেকে সরানো যায়নি।

রিয়ার সাথে চিঠি চালাচালি ফরিদ কবিরকে কবির হওয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছিলো, নিজেও সম্ভবত তাইই চাইছিলেন। কিন্তু তাঁর জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়েছেন। লেখার আগে তিনি হয়েছেন প্রথম পাঠক। ভাষাজ্ঞান, শব্দশৈলী নির্মাণ সম্পর্কিত জ্ঞানলাভের জন্য এদেশের প্রধান কবিদের সাহচর্য, পাশাপাশি পশ্চিম বাংলার কবিদের সাথে মেলামেশায় করেছেন সাহিত্য আড্ডা, দিয়েছেন কবিতার জন্য ভ্রমণ। আর এভাবে জ্ঞান কুড়িয়ে কুড়িয়ে একসময় তিনি কবি শামসুর রাহমানের বাসায় তার বন্ধু জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর সঙ্গে নিজ কাব্যগ্রন্থ নিয়ে ছন্দ এবং মাত্রাজ্ঞানের যে বাহাস দেখিয়েছেন তাতে শুধু বিষ্ময় প্রকাশ করাই চলে।

জেনেছি কবিদের কোন দল হতে পারে না। কবি ঈশ্বরের মতই একা, সার্বভৌম!

আরও জানতে পারি শহীদুল জহিরের সাথে সুন্দর ও ছোট্ট একটি সাক্ষাৎপর্ব। যেখানে কীর্তিমান জহিরকে আক্ষেপের সাথে বলতে শুনি, "প্লিজ জানাবেন বই পড়ে কেমন লাগলো। বই নিয়ে কেউ কিছুই জানায় না।" সেই বই ফরিদ কবিরের কাছে ধরা দিয়েছিলো যেন মার্কেজের কোন উপন্যাস!

আশি আর নব্বই দশক পুরোটা সময়েই ফরিদ কবিরকে বেড়ে উঠতে দেখি কোলকাতা এবং ঢাকা জুড়ে বিভিন্ন সাহিত্যিকদের সাথে আড্ডায়, তাদের বাসায় রাত্রিযাপনে। আমার মনে হয়েছে কোলকাতা কিংবা ঢাকায় এমন কোন কবি বা সাহিত্যিক বাকী ছিলেন না যার সাথে ফরিদ কবিরের পরিচয় হয় নি, আড্ডা হয় নি! আমরা বুঝতে পারি ফরিদ কবিরের মতো এতো সৌভাগ্য আমাদের কোনদিন হবে না। সেই অতুলনীয় জেনারেশনকে শুধুই হিংসা। ধীরে ধীরে কীভাবে বাংলা সাহিত্য কোলকাতা থেকে সরে ঢাকামুখী হয়ে গেলো তার বেশ বড়সর একটা জার্নি আছে বইতে। আছে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আধাঘন্টার ছোট্ট একটি সাক্ষাৎপর্ব। সেই সাক্ষাতে সত্যজিৎ অনেকটা কৈফিয়ত দেয়ার মতোই জানিয়েছিলেন তিনি কবিতা খুব বেশি পড়েন না!

বইয়ের অনেকগুলো অধ্যায়ের মধ্যে হুমায়ুন আজাদের সাথে খুনসুটির অধ্যায়টা খুবই মজার। হুমায়ুন আজাদের মতো মহীরূহের সাথে এরকম চটুল এবং কথার পিঠে কথা বলে খোঁচা মারা অম্ল মধুর সম্পর্ক থাকাটা গর্বের বিষয়ই বৈকী!

সাংবাদিকতায় অফিস পলিটিক্সের অজানা অধ্যায় পড়ে অবাক হয়েছি। জেনেছি আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ সৃষ্টি এবং পতনের ঐতিহাসিক তথ্য । বাংলাদেশের মিডিয়ার গোড়াপত্তনের সময়ের যেসব ঘটনা কানাঘুষা আকারে চালু ছিলো ফরিদ কবির সাহসের সঙ্গে এসব তুলে ধরেছেন। জেনেছি মতিউর রহমানের উত্থান। একটা লোক কীভাবে সামান্য গুটি চালিয়ে পুরো একটি স্বপ্নকে দুমড়ে দিতে পারেন তা এই জীবনি না হলে জানতেই পারতাম না! ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে সমাজে চলাফেরা করা ব্যক্তিরা স্বার্থের জন্য কতো খারাপ হতে পারে সেসব কিছুই লুকাননি ফরিদ কবির।

বাংলা সাহিত্যে ফরিদ কবির একজন স্টাবলিশড কবি, সেই সাথে ফরিদ কবির একজন সাহসী মানুষ। আমার গল্পের মতো সাহসী আত্মজীবনি বাংলা সাহিত্যে কতোগুলো আছে আমার জানা নেই। আত্মজীবনি মানেই যেখানে নিজেকে পুত পবিত্র করে দেখানোর চেষ্টা, সেখানে ফরিদ কবির খোলামেলা লিখেছেন তার প্রেম নিয়ে, লিখেছেন যৌনতা নিয়ে, লিখেছেন পতিতালয় গমন নিয়েও!

কিন্তু এইসব নিয়ে খোলামেলা লেখায় আসলে ফরিদ কবিরের সাহসীকতা ঠিক প্রকাশ পায় না। বিপুল দেনা মাথায় নিয়ে জীবনের কঠিনতম সময়ে তিনি সাংসারিক দায় দায়িত্ব এড়িয়ে জীবন থেকে পালিয়ে যাননি, বরং মুখোমুখি হয়ে কঠিনকে জয় করেছেন। এখানেই ফরিদ কবির সত্যিকার সাহস দেখিয়েছেন। এবং সেই সাহসিকতাকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। বর্তমান বাজারে মোটিভেশনাল বই দেদারসে বিক্রি হচ্ছে অথচ তারা সত্যিকারের মোটিভেশন যদি কেউ চায় তাহলে তার জন্য ফরিদ কবির তার অবারিত জীবনের ঘটনা তুলে দিয়েছেন আমাদের হাতেই। আমাদের বুঝে নিতে হবে কোনটা মনি মুক্তা আর কোনটা গার্বেজ।

শেষ করছি নিজের ব্যক্তিগত সুন্দর একটি অভিজ্ঞতা দিয়ে। ফরিদ কবিরের সাথে আমার একবারই আলাপ হয়েছে। আলাপে তিনি খুবই সপ্রতিভ ছিলেন, যাকে বলা যায় একেবারে My Dear টাইপ মানুষ। মনেই হয়নি প্রথমবার তার মতো একজন লেখকের সাথে কথা বলছি। অনেক অভিজ্ঞতার আলাপ সাক্ষাতেই শুনেছি, যেগুলো হয়তো বইয়ের পরবর্তী সংস্করণে আসবে।

স্বাধীনতা উত্তর অস্থির সময়কে কবিতার নিজস্ব ক্যানভাস দিয়ে ফরিদ কবির যেভাবে ধরেছেন, তাতে বাংলা কবিতায় তাঁর অবদানকে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। বরং পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের শক্তিমান কবিদের মধ্য থেকেও আশি নব্বই দশকে ফরিদ কবির খুব সাধাসিধেভাবে কবিতায় কম কথার মধ্যে নিজের শক্তিমত্তাকে প্রকাশ করেছেন। এমন একজন জীবন্ত শক্তিমান কবি ও লেখকের সাথে সামান্য সময়ের আলাপ অন্যতম সুখস্মৃতি হয়েই থাকবে আমার কাছে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ১০:৩৭

রাজীব নুর বলেছেন: বইয়ের প্রচ্ছদের ছবিটা দেন।

২| ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ১১:১৫

নেওয়াজ আলি বলেছেন: লেখা পড়ে মন পুলকিত হলো।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.