নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

রেজা ঘটক

ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।

রেজা ঘটক › বিস্তারিত পোস্টঃ

জীবনের প্রথম ভোট কেমন ছিল!!!

১৪ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:০৫

১৯৮৫ সাল। আমি তখন ক্লাশ টেন-এ পড়ি। অর্থ্যাৎ নিউ টেন। পরের বছর ১৯৮৬ সালে আমাদের এসএসসি পরীক্ষা হয়। তখন ক্ষমতায় ছিলেন স্বৈরাচার জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সংক্ষেপে হুমু এরশাদ। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। ২১ মার্চ ১৯৮৫ সাল। আমরা সকালে স্কুলে গিয়ে শুনি, আজকে স্কুল ছুটি। কারণ আজ 'হ্যা' 'না' ভোট। মুখে মুখে সবাই বলতে লাগলো গণভোট। আমরা তখন 'হ্যা' বা 'না' বা 'গণভোট' এসব কিছু বুঝি না। স্কুল ছুটি। অতএব আমাদের তো অনেক স্ফূর্তি।

আমরা স্কুল থেকে উত্তর পাড়া হয়ে ফিরছিলাম। উদ্দেশ্য উত্তর পাড়ার প্রাইমারি স্কুল মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলবো। স্কুল মাঠে এসে আমরা দুই দলে ভাগ হয়ে খেলা শুরু করবো, ঠিক সেই মুহূর্তে ওই স্কুলের হেডমাস্টার সেকেন্দার সাহেব, যিনি সম্পর্কে আমাদের মামা হন, আমাদের দল ভাগাভাগির মাঝখানে এসে বললেন, তোরা কী করবি এখন? আমরা বললাম যে ফুটবল খেলবো।

সেকেন্দার মাস্টার বললেন, তোরা খেলতে পারবি কিন্তু তার আগে আমার একটু কাজ করে দে। আমরা জানতে চাইলাম কী কাজ? জবাবে সেকেন্দার মাস্টার বললেন, তোরা সবাই ভোট দিবি। আয় আমার সাথে। ভোট দেবার পর তোরা খেলিস। খেলা শেষে তোদের আমি গরম জিলিপি খাওয়াবো।

আমরা সবাই মহাখুশিতে সেকেন্দার মাস্টারের পেছন পেছন স্কুলের বারান্দায় গেলাম। সেখানে কয়েকজন আনসার লম্বা বাঁশের লাঠি নিয়ে কোণায় কোণায় বসে আছেন। আমাদের দেখে তারা মিটমিট করে হাসলেন। কারণ তারা সবাই আমাদের পরিচিত। আমাদের গ্রামেরই মানুষ। আজকে ভোট। তাই লুঙির উপর খাকি ফুলহাতা জামা গায়ে দিয়ে আনসার সেজেছেন। তাদের গলায় বাঁশি ঝোলানো আর হাতে ইয়া মোটা লম্বা বাঁশের লাঠি। ভাবসাব-ই অন্যরকম। আমাদের দেখে তারা অনেকটা দারোগা দারোগা ভাব নিয়ে একটু তাকালেন।

সেকেন্দার মাস্টার আমাদের তিন জন করে কয়েকটি দলে ভাগ করলেন। একজন ব্যালোট পেপারে সিল মারবো, একজন ব্যালোট পেপার ভাঁজ করবো। আর একজন ব্যালোট পেপার বাক্সে ঢুকাবো। সেকেন্দার মাস্টার বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে কোথায় সিল মারতে হবে। এই সিল মারাই নাকি ভোট!

আমরা সবাই তখন সিল মারতে চাইলাম। আমাদের কেওয়াজকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিলেন সেকেন্দার মাস্টার। বললেন, তোরা সবাই সিল মারতে পারবি। সিরিয়াল করে সবাই মারবি। একশো সিল মারার পর সিরিয়াল ঘুরবে। নে তোরা শুরু কর? আরেকটা কথা। এই যে দ্যাখ, ব্যালোট পেপার। এখানে 'হ্যা' আর 'না' আছে। তোরা যে জিনিসটা ফলো করবি তা হলো, ১৫/২০টা 'হ্যা' সিল মারার ফাঁকে ফাঁকে ২/১টা 'না' সিল মারবি। নে শুরু কর?

আমরা সেকেন্দার মাস্টারের নির্দেশ পেয়ে মহানন্দে ভোট দেওয়া শুরু করলাম। জীবনের প্রথম ভোট বলে কথা! আর যত তাড়াতাড়ি ভোট দেওয়া শেষ হবে, তত তাড়াতাড়ি আমরা ফুটবল খেলতে পারব। আর গরম জিলিপি খাওয়ার ব্যাপার তো আছেই।

আমরা কিছুক্ষণ পরপর দায়িত্ব বদল করে ভোট দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভোটের বাক্সো ভরে গেলে সেকেন্দার মাস্টার খালি নতুন ভোটের বাক্সো এগিয়ে দিচ্ছিলেন। আর সিগারেট ধরিয়ে সুখ টান দিতে দিতে আমাদের কড়িৎকর্মা ভোট দেওয়া নজরদারি করতে লাগলেন।
প্রায় সবগুলো ভোটের বাক্সো ভরাট হবার মতো অবস্থা হয়ে গেলে সেকেন্দার মাস্টার বললেন, যা তোরা এবার খেলতে যা। ভোট দেওয়া শেষ। আর আনসার সেজে বসে থাকা আঊয়াল কাকাকে বললেন, যা বাজার থেকে ওদের জন্য জিলিপি নিয়ে আয়।

তারপর আমরা খেলায় ডুবে গেছি। কিছুক্ষন পর স্কুল মাঠে এক নয়া বিপত্তি। আমাদের হেডস্যারের বাবাকে দেখলাম খুব মেজাজ খারাপ করে গালাগালি করতে করতে আমাদের খেলার মাঝখান দিয়ে যাচ্ছেন। হেডস্যারের বাবাকে আমরা দাদু ডাকি। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, দাদু কী হইছে? দাদু কইলেন, মুই মণীন্দ্র'র বাবা। হেয়া চৌদ্দ গ্রামের সবাই জানে। মোর ভোট অন্য মাইনষে দেয় কেমনে? অ্যা?

তাইতো? দাদু'র ভোট অন্য কেউ দেবে কেমনে? আসলে দাদু'র ভোট তো আমরা দলবেধে আগেই দিয়া দিছি। আসল ঘটনা হইলো, আজকে ভোট শুনে দাদু স্নান করে সুন্দর সেজে গুজে ভোট দিতে আসছেন। সেকেন্দার মাস্টার ওই সময় গেছিলেন বাথরুমে। দাদু'র নাম জিজ্ঞেস করে অন্য এক মাস্টার, যিনি অন্য স্কুলের, ভোটের কারণে এই স্কুলে আজ ডিউটি পড়ছে। সেই মাস্টার তো দাদুকে চেনে না। সে লিস্ট চেক করে দাদুকে কইছে, আপনার ভোট দেওয়া শেষ। তাই শুনেই দাদু ক্ষেপেছেন!

দাদু ছিলেন মরিচ ভিটায় কাজে। মানুষের মুখে ভোটের কথা শুনে দাদু ভোট দিতে এসেছেন। এসে শোনেন তার ভোট দেওয়া শেষ। এইটা কী মগের মুল্লুক? দাদু আর কিছুতেই মানতে পারছেন না। ব্যাপক গালাগালি করছেন।

দাদু'র ভোট তো আসলে আমরা দিয়ে ফেলেছি। দাদু'র গালি তাই আমাদের গায়েও লাগতেছে। আমাদের একজন দৌড়ে গিয়ে সেকেন্দার মাস্টারকে ডেকে আনলো। সেকেন্দার মাস্টার দাদুকে বললেন, আসেন কাকা, আপনি ভোট দেবেন। ওই মাস্টার ভুল লিস্ট দেইখা আপনারে ভুল কইছে। আসেন কাকা, আপনি ভোট দেবেন।

সেকেন্দার মাস্টার একটা ব্যালোট পেপার আর সিল দাদু'র দিকে এগিয়ে দিলেন। দাদু ব্যালোট পেপার আর সিল হাতে নিয়ে বললেন, ভুত কোই? সেকেন্দার মাস্টার দেখিয়ে দিলেন, ওইদিকে ভুত! আমরা সবাই তাজ্জব বনে গেলাম! আমরা ভোট দেবার সময় তো ভুত দেখি নাই। খেয়াল করলাম স্কুলের ক্লাশরুমের এক কোনায় হোগলা দিয়ে একটু বেড়া দেওয়া। দাদু সেই বেড়ার আড়ালে গিয়ে ভোট দিলেন। ভাঁজ করা ব্যালোট পেপার বেঞ্চে রাখা বাক্সে রাখলেন। আর বেঞ্চের উপর সিল রেখে দিলেন।

ততক্ষণে আউয়াল জিলিপি নিয়ে সেখানে হাজির। সেকেন্দার মাস্টার সবাইকে প্রথমে দুই পিস করে দিতে বললেন। দুই পিস জিলিপি খাওয়ার পর আরো জিলিপি থেকে যাওয়ায় আবারো এক পিস করে আমাদের দিলেন। দাদুও জিলিপি খেয়ে খুশিতে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন।

সেকেন্দার মাস্টার বললেন, তোরা এখন সবাই বাড়ি যা। খেয়ে দেয়ে আবার সবাই চারটার মধ্যে আসবি। তখন তোদের আবার আমি জিলিপি খাওয়াবো।

আমরা কী আর সেকেন্দার মাস্টারের নির্দেশ অমান্য করতে পারি! এমনিতে আমাদের সম্পর্কে মামা হন। নির্দেশ না মানলে নিশ্চিত মা'র কাছে এসে নিলিশ করবেন। আমরা বাড়িতে চলে আসলাম। চারটার আগেই আবার সবাই স্কুল মাঠে হাজির হলাম। ঠিক চারটা বাজার পর স্কুল মাঠে কয়েকটা হোগলা বিছানো হলো। সকল মাস্টাররা সেখানে গোল হয়ে বসলেন। আমরাও বসলাম।

সেকেন্দার মাস্টার নির্দেশ দিলেন, তোরা ব্যালোট পেপার খুলে 'হ্যা' ভোট একদিকে রাখবি, আর না ভোট একদিকে রাখবি। সূর্য ডোবার অনেক আগেই আমাদের ভোট গণণা শেষ হলো। সেকেন্দার মাস্টার ঘোষণা দিলেন এই কেন্দ্রে 'হ্যা' ভোট পড়েছে দুই হাজার একশো সত্তরটি। আর না ভোট পড়েছে দুইশো বারোটি। ব্যালোট পেপারগুলো আবার তারা বাক্সে ভরতি করে হোগলা গুছিয়ে ভোট শেষ করলেন। ততক্ষণে আউয়াল আবার জিলিপি নিয়ে হাজির। আমরা জিলিপি খাওয়া শেষ করে আবার ফুটবল খেলতে লাগলাম। আর বুঝলাম একেই বলে ভোট! আহা!

১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ যে গণভোট করেছিলেন, রেডিও'র খবরে তখন বলা হয়েছিল, সারাদেশে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। কোথাও কোনো গোলোযোগের খবর পাওয়া যায়নি। সারা দেশের মোট ২২ হাজার ৯৮৪টি ভোটকেন্দ্রে শতকরা ৬৫ ভাগ ভোট পড়েছে। ভোটারদের ৫৬% 'হ্যা' ভোট দিয়েছে। যার পরিমাণ প্রায় ১৮.২ মিলিয়ন। আর ৫% না ভোট পড়েছে, যার পরিমাণ প্রায় ১ মিলিয়ন।

'হ্যা' ভোট জয়যুক্ত হওয়ায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নাকি গণরায় পেয়েছেন। পড়ুন হাহাহা অট্টহাসি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় থাকার জন্য হুমু এরশাদ তখন দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। আবার পড়ুন হাহাহা অট্টহাসি।
ওটা ছিল আমার প্রথম ভোট দেবার অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতা এখন অনেক পেকেছে। কিন্তু বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে কতটা পরিবর্তন হয়েছে তা কেবল খোদা মালুম। আবার পড়ুন হাহাহা অট্ট হাসি।
-------------------------
১৪ নভেম্বর ২০১৮

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:১৪

ঋণাত্মক শূণ্য বলেছেন: আঙ্কেল, হুম, আঙ্কেলই হবেন, কারণ ঐ বছর ঐ ভোটেরও ৬মাস পরে আমার জন্ম! আপনার স্মৃতি শক্তি দেখে অবাক আমি! ক্যামনে কি?

২| ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:২৪

আর্কিওপটেরিক্স বলেছেন: :D :D :D

৩| ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:৩৯

জুনায়েদ বি রাহমান বলেছেন: হা হা হা... এখন ত এরশাদ সাহেব সাধু হইয়া গেছেন।

৪| ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:৪৫

অপু দ্যা গ্রেট বলেছেন:



আমি আমার প্রথম ভোট বাবা কে দিয়েছি । চেয়ারম্যান নির্বাচনে ।

মজার ব্যাপার তিনি দ্বিতীয় হয়েছেন ।

৫| ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:৫৫

পাঠকের প্রতিক্রিয়া ! বলেছেন: সব গুজব। কাক্কু বড় ভালো মানুষ...:D



৬| ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:৫৮

মাহমুদুর রহমান বলেছেন: অত্যন্ত মজাদার একটা ঘটনা শেয়ার করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।প্রিশু নিবেন।

৭| ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:২০

ব্লগার_প্রান্ত বলেছেন: ভাই, মেইল পাইছেন? B-)

৮| ১৫ ই নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ৮:১৯

রাজীব নুর বলেছেন: হা হা হা---

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.