নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

রেজা ঘটক

ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।

রেজা ঘটক › বিস্তারিত পোস্টঃ

\'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা\' শহীদুল জহির টু সৈয়দ জামিল!

১৭ ই মার্চ, ২০১৯ ভোর ৫:১৫

গতকাল ১৬ মার্চ ২০১৯ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি'র জাতীয় নাট্যশালায় দেখলাম নাট্য সংগঠন স্পর্ধা'র নতুন প্রযোজনা ' ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’। শক্তিমান কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহিরের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ অবলম্বনে একই নামে নাটকটি মঞ্চে এনেছে নাট্য সংগঠন স্পর্ধা।

বাংলাদেশের থিয়েটারের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র সৈয়দ জামিল আহমেদ। এর আগে তিনি 'বিষাদ সিন্ধু', 'বেহুলার ভাসান'-এর মত মঞ্চনাটক নির্দেশনা দিয়ে থিয়েটার অঙ্গনে সুনাম কুড়িয়েছেন। সর্বশেষ ২০১৭ সালে ঈদের সময় টানা ১০ দিন ‘রিজওয়ান’ নাটকটি মঞ্চায়ন করে ঢাকার নাট্যাঙ্গনে সৈয়দ জামিল রীতিমতো ঝড় তুলেছিলেন। ঢাকার নাট্যাঙ্গনে তাই সৈয়দ জামিলের কাজ মানে নতুন কিছু।

সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ ও আকতারুজ্জামান ইলিয়াসের পর সবচেয়ে শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহিরের জাদুবাস্তবতায় মোড়া একাত্তরের প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা' নিয়ে এবার তিনি নির্মাণ করলেন একই নামের মঞ্চনাটক। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত শহীদুল জহিরের ৪৮ পৃষ্ঠার এই ক্ষুদ্র উপন্যাসটি মূলত দুইটি সময়কে ইন্ডিকেট করে।

যেখানে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ঠিক ১৪ বছর পর ১৯৮৫ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার এক অসহায় ভিক্টিমের মধ্যে নতুন করেই আবার একটা ভীতিকর অসহনীয় পরিবেশ তৈরি হয়। সমাজ ও বাস্তবতা মিলিয়ে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সেই ভীতি'র কারণেই সে পুরাতন বসতভিটা ছেড়ে এমন একটি নতুন বাড়ি খুঁজতে থাকেন, যেখানে সে নিজের অতীত পরিচয় গোপন রেখেই বাঁচতে চায়। এক কুখ্যাত রাজাকারপুত্র হরতাল শেষে সবাইকে ধন্যবাদ দেবার কারণে উপন্যাসের মুখ্য চরিত্রটি অমন ভীতিকর তীব্র তাড়নাবোধে আক্রান্ত হয়। উপন্যাসে ফ্ল্যাশব্যাকে লেখক শহীদুল জহির সেই তাড়নার কথা আমাদের কাছে স্পষ্ট করেন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ শাসন বিরোধী আন্দোলনের সময় তখন আওয়ামী লীগের সাথে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী জামায়াত শিবিরের যুগপথ আন্দোলন হয়েছিল। সেই আন্দোলনের সময় কুখ্যাত রাজাকার পুত্র আন্দোলনে ডাকা হরতালের জন্য জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। শক্তিমান কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহির হয়তো সে কারণেই উপন্যাসে একটি কঠিন ঘটনার অবতারণা করেন। রাজনীতিতে চিরদিনের শত্রু বা চিরদিনের বন্ধু বলে কিছু নাই।

কারণ শহীদুল জহিরের উপন্যাস প্রকাশের প্রায় ১০ বছর পর ১৯৯৬ সালে সেই স্বৈরাচার শাসক এরশাদের সমর্থন নিয়েই আওয়ামী লীগ ঐক্যমত্যের সরকার গঠন করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই ১৯৮৭ সালের পরের ঘটনা শহীদুল জহিরের উপন্যাসে ছিল না। কিন্তু তিনি একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের ভিক্টিম আবদুল মজিদের মধ্যে সেই ভীতি'র তাড়নাকেই উসকে দিয়েছিলেন। জাতীয় রাজনৈতিক সংকটের প্রভাব কীভাবে একজন ভিক্টিমের অন্তরে তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারে, তারই আখ্যান মূলত 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা' উপন্যাস।

স্বাধীনতার ঠিক ২০ বছরের মধ্যে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী জামায়াত শিবির বিএনপি'র সাথে যৌথভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আরোহন করেছিল। জামায়াত শিবিরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার সেই সম্ভাবনাই শহীদুল জহির দেখিয়েছিলেন একাত্তরের ভিক্টিম মজিদের ভীতির প্রতীকি কারণের মাধ্যমে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ১৪ বছর পর পুরান ঢাকার লক্ষীবাজারের শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেনের যুব্ক আবদুল মজিদ একদিন দেখতে পায় পুলিশ ক্লাবের কাছে মাইক্রোফোন হাতে একাত্তরের কুখ্যাত রাজারকার বদু মাওলানার পুত্র আবুল খায়ের হরতালের জন্য জনগণকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন। একাত্তরে বালক বয়সে মজিদ দেখেছিল লক্ষীবাজার এলাকায় প্রথম যেদিন পাকস্তানি মিলিটারি আসে, তখন একদিনে সাত জন মানুষ মারা গিয়েছিল। তিন জন মহিলা তাদের হাতে ধর্ষিত হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের শেষপর্যায়ে ডিসেম্বর মাসে যখন দেশ শত্রুমুক্ত হবার দ্বারপ্রান্তে তখন মজিদের বোন মোমেনাকে বদু মাওলানার রাজাকার গং তুলে নিয়ে যায়। পরে মোমেনার লাশ পাওয়া যায় রায়েরবাজারের পশ্চিমে বুড়িগঙ্গার তীরে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বদু মাওলানা পালিয়ে যায়। কিন্তু ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার পর এলাকায় আবার বদু মাওলানাকে সেই পুরানা আলখেল্লা গায়ে দেখা যায়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় লক্ষীবাজারের স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের নেতা ছিলেন আজিজ পাঠান, একাত্তরে বদু মাওলানার নেতৃত্বে যার বাড়ি লুট হয়েছিল, তিনি এলাকায় আবার বদু মাওলানাকে দেখে বলেন, আমার নেতা যেহেতু বদু মাওলানারে মাফ করছে, আমার নিজের কোনো প্রতিহিংসা নাই। রাজনীতিতে চিরদিনের বন্ধু অথবা চিরদিনের শত্রু বলে কিছু নাই। কাজেই অতীত ভুলে যাওয়া ছাড়া আর কীইবা করার আছে মানুষের।

অন্যদিকে ১৯৮৬ সালের শুরুর দিকে আবদুল মজিদ যখন নিজের নবজাতক কন্যাসন্তানের মুখ দেখে তার নাম রাখে মোমেনা। তখন একদিন রাস্তায় বদু মাওলানার সাথে দেখা হলে মজিদকে থামিয়ে তিনি বলেন, বোনের নামে মেয়ের নাম রাখছো, বোনেরে ভুলো নাই। একথা শুনে মজিদের মনে হতে থাকে একাত্তরের নয় মাসের ঘটনার কথা মজিদরা যেমন ভোলে নাই তেমনি বদু মাওলানারা আবারো ক্ষমতায় যাওয়ার নতুন সিঁড়ি খুঁজতেছে। এই অবস্থার মধ্যে বদু মাওলানাকে এড়াতে মজিদ এলাকা ছেড়ে অন্য মহল্লায় বাসা নেবার সিদ্ধান্ত নেয়।

শহীদুল জহিরের উপন্যাসের কাহিনী থেকে এবার সৈয়দ জামিলের নাটকে আসা যাক। ন্যারেটিভ নাটকে সৈয়দ জামিল শহীদুল জহিরের গদ্যভঙ্গিটা অনুসরণ করেছেন। ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ উপন্যাসে শহীদুল জহির মুক্তিযুদ্ধপূর্ব, মুক্তিযুদ্ধকালীন ও পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতার এক উত্তরাধুনিক সংকট উপস্থাপন করেছেন। সৈয়দ জামিল সেটি পুরোপুরি অনুসরণ করেছেন। নানান দৃশ্য ও ঘটনার সমন্বয়ে তিনি যে ক্যানভাস গড়ে তুলেছেন তা এককথায় অনবদ্য। কিন্তু শহীদুল জহিরের ভাষায় যে জাদুকরী প্রভাব, সেই রসের কোথায় যেন একটা ঘাটতি এই নাটকে স্পষ্ট।

'রিজওয়ান' নাটকে সৈয়দ জামিল যে ক্যারিশমা দেখিয়েছিলেন, এবার 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা'য় সেই ক্যারিশমার কিছু কিছু লক্ষণ দৃশ্যমান হলেও শহীদুল জহিরকে পুরোপুরি অ্যাডাপ্ট করতে কোথায় যেন কিছুটা ব্যর্থ হয়েছেন। নাটকের জন্য আলাদাভাবে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর না বানিয়ে নির্বাচিত সংগীত দিয়ে একধরনের দায় সেরেছেন। নীলাভ আলোতে এক্ত্তরের ভয়াবহতা আনার চেষ্টা করলেও সৈয়দ জামিল আলো দিয়ে যে জাদু দেখাতে জানেন, তার পুরোটা এই নাটকে অনুপস্থিত।

বারবার সেট পরিবর্তন করে দর্শকদের ভেতরে মনোটোনাস একটা ব্যাপার ঘটিয়ে অনায়াস কিস্তি মাতের প্রচেষ্টাকে ততোটা যৌক্তিক মনে হয়নি। বরং পুরো মঞ্চের প্রতি ইঞ্চি জায়গা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সৈয়দ জামিল যে দক্ষতার ধারাবাহিকতা রেখেছেন, সেটা দেখে দর্শক হয়তো হাততালি দেবেন। কিন্তু 'রিজওয়ান' যে স্তরের ঝড় তুলেছিল, এবার সেই ঝড়ের বাতাস যেন কিছুটা দুর্বল মনে হয়েছে।

দুই ঘণ্টা দীর্ঘ নাটকে আর্টিস্টদের যে পরিমাণ পরিশ্রম ও কষ্ট করতে হয়েছে, একই দিনে দুই ঘণ্টার ব্যবধানে দ্বিতীয় মঞ্চায়ন দেখার ফলে হয়ত কুশীলবদের গতি ও কায়িক শ্রম প্রথম ঘণ্টার চেয়ে দ্বিতীয় ঘণ্টায় তুলনামূলক স্লথগতি ও দুর্বল মনে হয়েছে। কিন্তু একাত্তরের প্রেক্ষাপটে যে ক্যানভাস সৈয়দ জামিল মঞ্চে দেখালেন, তা এই সময়ের যে কোনো মঞ্চনাটকের তুলনায় বরং ভিন্ন আঙ্গিক, প্রেক্ষিত ও উপস্থাপনায় অন্যদের থেকে অনেক এগিয়ে থাকবে।

অভিনয়ে মোমেনা চরিত্রে মহসিনা আক্তার ও বদু মাওলানা চরিত্রে শরীফ সিরাজের অভিনয় বরং মুগ্ধ হবার মতো। এই নাটকের সবচেয়ে শক্তিশালী জায়গাটি বিভিন্ন এপিসোডে ভিন্ন ভিন্ন কম্পোজিশান। কখনো ত্রিভুজ, কখনো আড়াআড়ি, কখনো বৃত্ত, কখনো কৌণিক, কখনো সমান্তরাল, কখনো ক্রোস, কখনো আনুভূমিক কম্পোজিশানগুলো শহীদুল জহিরের জাদুবাস্তবতাময় ভাষাভঙ্গির সাথে দারুণ সঙ্গতিপূর্ণ।

নাটকটি ভালো লাগলেও পুরোপুরি শহীদুল জহিরকে যেমন পাওয়া যায়নি তেমনি সৈয়দ জামিলের ট্রাম্পকার্ডের নানান কৌশলেও কিছুটা দাপটহীন লেগেছে। যেটা 'রিজওয়ান'-এ ছিল এককথায় অনন্য। নাটকে কস্টিউম নির্বাচনে রাজাকার পুত্রের বিশাল মূর্তিরূপে মঞ্চে প্রবেশ, তার বিশাল কালো হাতের ইশারার মাধ্যমে নির্দেশক সৈয়দ জামিল হয়তো রাজাকারদের জঘন্য ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড আর ষড়যন্ত্রের জালবিস্তারে পারদর্শীতার প্রতীক হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। যা দর্শকের হৃদয়ে নতুন করে ভীতি জাগানোর মত একটা ব্যাপার।

সৈয়দ জামিলের এই নাটকটিতে ২০০২ সালে সেলিম আল দীনের নির্দেশনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রযোজনা, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ নাটকের একটি আত্মহত্যা দৃশ্যের বারবার চক্রাকারে ফিরে আসার মতো মজিদের চটির ফিতা ছেড়ার দৃশ্য ফিরে ফিরে আসে। যা আমাদেরকে নাট্যাশ্চার্য সেলিম আল দিনের কৌশলকে নতুন করে সৈয়দ জামিল স্মরণ করিয়ে দিলেন।

শহীদুল জহিরের উপন্যাস 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা' নিয়ে নির্মিত সৈয়দ জামিলের নাটকটি ১৪ মার্চ শুরু হয়েছে, চলবে একটানা ২০ মার্চ পর্যন্ত। নাটকটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৮তম বর্ষপূতি উপলক্ষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে উৎসর্গ করা হয়েছে। জয়তু বাংলা থিয়েটার। জয়তু সৈয়দ জামিল।

----------------
১৭ মার্চ ২০১৯

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই মার্চ, ২০১৯ সকাল ১১:২১

আকতার আর হোসাইন বলেছেন: ভাল পোস্ট।

২| ১৭ ই মার্চ, ২০১৯ দুপুর ১২:৪২

রাজীব নুর বলেছেন: পড়লাম।

৩| ১৭ ই মার্চ, ২০১৯ বিকাল ৪:১৮

মাহমুদুর রহমান বলেছেন: অসাধারন!!!

হিংসা প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করে একটি নতুন বাংলাদেশ দেখার অপেক্ষায় ১৭ কোটি জনগন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.