নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

রেজা ঘটক

ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।

রেজা ঘটক › বিস্তারিত পোস্টঃ

অষ্টরসের সমাহার \'রসপুরাণ\'!

০২ রা মে, ২০১৯ রাত ১২:১৭

দীর্ঘদিন পর একটি সুন্দর মঞ্চায়ন দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটমণ্ডলে। 'রসপুরাণ' নাটকটি মূলত অষ্টরসের মিশ্রণ। প্রাচীন ভারতের দুটি মহাকাব্য 'মহাভারত' ও 'রামায়ণ' এবং অন্যান্য ধ্রুপদী নাটকের নির্বাচিত অংশকে একটি অদৃশ্য সুতায় গেঁথেছেন নাট্যকার ড. আহমেদুল কবীর। মাত্র আটটি এপিসোড মিলে এই নাটক 'রসপুরাণ'।

'রসপুরাণ' নাটকের আটটি এপিসোড নিয়ে লেখার মত সময় এখন পাব না। অভিমন্যু বধ এপিসোডটি একটু বর্ণনা করা যাক-

মহাভারতের একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র হলো অভিমন্যু। পঞ্চপাণ্ডবের এক পাণ্ডব অর্জুন আর কৃষ্ণের বোন সুভদ্রার পুত্র হলেন অভিমন্যু। তাঁর অন্য পরিচয় মৎস্য রাজকন্যা উত্তরার স্বামী। কৃষ্ণের ভাগ্নে। বীর্যে তিনি তাঁর পিতা অর্জুন ও পিতামহ ইন্দ্রের সমতুল্য। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিবসে মাত্র ষোলো বছর বয়সে অভিমন্যু মৃত্যুবরণ করেন।

অর্জুনের বারো বছরের ব্রহ্মচর্য ও বনবাস সম্পূর্ণ হওয়ার পর সুভদ্রার গর্ভে অভিমন্যুর জন্ম হয়। মাতা সুভদ্রার গর্ভে থাকতেই তাঁর শিক্ষা শুরু হয়েছিল। গর্ভাবস্থায় সুভদ্রা অর্জুনের নিকট চক্রব্যুহে প্রবেশের প্রণালী শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তেন। যে কারণে অভিমন্যু কেবল চক্রব্যুহে প্রবেশ করতে জানতেন কিন্তু বাহির হতে জানতেন না। আর জীবনের শেষদিনে সেই না জানাটাই অভিমন্যু'র জন্য কাল হলো।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিবসে কৌরব সেনাপতি দ্রোণাচার্য একটি চক্রব্যুহ রচনা করেন। এইসময়ে চক্রব্যুহ ভেদ করার জন্য পাণ্ডব শিবিরে অভিমন্যু ব্যতীত আর কেউ উপস্থিত ছিলেন না। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির তখন কৌরব চক্রব্যুহ ভেদ করার জন্য অর্জুনপুত্র অভিমন্যু'র উপর এই গুরুভার অর্পণ করেন।

কারণ যুদ্ধে চক্রব্যুহ ভেদের কৌশল মাত্র চার জন জানতেন। তাঁরা হলেন কৃষ্ণ, প্রদ্যুম্ন, অর্জুন আর অভিমন্যু। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ওই সময়ে দ্রোণাচার্যের অস্বাভাবিক বিক্রম আর চক্রব্যুহের দুর্ভেদ্যতা পাণ্ডব শিবিরে একরকম হতাশা জাগিয়ে তোলে। তখন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির অভিমন্যুকে বললেন- চক্রব্যুহ ভেদ করো। জবাবে অভিমুন্য বললেন, পিতার কাছে ব্যুহভেদ করার কৌশল জেনেছি কিন্তু বিপদকালে নিষ্ক্রমণের কৌশল তো জানা হয়নি। তখন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বললেন, তুমি চক্রব্যুহ ভেদ করো, আমরা তোমার পেছনে পেছনে প্রবেশ করবো। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের এই নির্দেশ যে ভুল ছিল তা আমরা যুদ্ধের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে বুঝতে পারি।

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের নির্দেশে অর্জুনপুত্র অভিমন্যু যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং কৌরবদের চক্রব্যুহ ভেদ করে কৌরব সেনাদের মধ্যে উপস্থিত হন। অভিমন্যু'র শরবর্ষণে তখন মদ্ররাজ শল্য ও দুঃশাসন মূর্ছিত হন। কর্ণের এক ভাই ও শল্যের ভ্রাতা যুদ্ধে নিহত হয় এবং শল্য রণভূমি থেকে পলায়ন করেন। যুদ্ধের এই পর্যায়ে যুধিষ্ঠির, ভীম, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডি, সাত্যকী, বিরাট ও দ্রুপদ তখন কৌরব ব্যুহে প্রবেশ করার চেষ্টা করলে ধৃতরাষ্ট্রের জামাতা সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ স্বয়ং শিবের আশির্বাদে তাঁদের পরাস্ত করেন ও চক্রব্যুহের প্রবেশ পথ রুদ্ধ করে দেন। কৌরবসৈন্য বেষ্টিত অভিমন্যু তখনো একাকী যুদ্ধ করতে থাকেন।

যুদ্ধে একপর্যায়ে কৌরব সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং যোদ্ধারা পালাতে থাকে। একপর্যায়ে শল্যপুত্র রুক্মরথ, দুর্যোধনের পুত্র লক্ষণ ও কোশলরাজ বৃহদবল অভিমন্যু'র বাণে নিহত হন। এই পর্যায়ে অভিমন্যুকে অপ্রতিরোধ্য দেখে দ্রোণের উপদেশে অভিমন্যুকে পিছন থেকে আক্রমণ করে রথচ্যুত ও ধনুর্হীন করেন কর্ণ। তখন দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন ও শকুনি নির্দয়ভাবে তাঁর ওপর শরাঘাত করতে থাকেন। এরকম উপর্যুপরি আক্রমণ প্রতিহত করতে করতে অভিমন্যু খড়গ, চক্র, গদা এমনকি রথের চাকা দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেও শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হন। এইসময় দুঃশাসনের পুত্র তাঁর মাথায় গদাঘাত করে। ফলে কৌরবসেনা নিপীড়িত বালক অভিমন্যুর প্রাণশূন্য দেহ তখন ভূপাতিত হয়। এভাবে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিবসে অর্জুনপুত্র অভিমন্যু বধ হন।

'রসপুরাণ' নাটকে 'অভিমন্যু বধ'কে একটি এপিসোড বানানো হয়েছে। মহাভারত ও রামায়ণের এরকম নির্বাচিত আটটি এপিসোড মিলে বানানো হয়েছে 'রসপুরাণ'। 'রসপুরাণ' নাটকটির নাট্যভাবনা, পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমেন্স বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আহমেদুল কবির।

রাক্ষসরাজ রাবণের জঙ্গল থেকে রামের স্ত্রী সীতাকে অপহরণ করার ঘটনা দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে অন্য একটি এপিসোড। মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন ভারতীয় নাট্য ও সঙ্গীত বিশারদ ভরত মুনি রচিত 'নাট্যশাস্ত্র' বর্ণিত ভাব ও রসনিষ্পত্তি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে অষ্টরসের আখ্যানে রচিত হয়েছে 'রসপুরাণ' নাটকটি।

'রসপুরাণ' নাটকটির মূল উপজীব্য হলো মানুষের সভ্যতার দ্বান্দ্বিক অগ্রগতির ইতিহাস, যুদ্ধ, হত্যা, ভয়, ক্রোধ শেষে যুথবদ্ধ জীবনে অফুরান ভালোবাসা ও সৌন্দর্যের প্রয়োজনীয়তা। ভরত মুনি'র নাট্যশাস্ত্রে শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস ও অদ্ভুত- এই আটটি রস একত্রে ‘নাট্যরস’ নামে পরিচিত। এই রসগুলোর প্রতিটি রসেরই স্থায়ী ভাব রয়েছে। যেমন- রতি ভাব থেকে শৃঙ্গার, হাস থেকে হাস্য, শোক থেকে করুণ, ক্রোধ থেকে রৌদ্র, উৎসাহ থেকে বীর, ভয় থেকে ভয়ানক, জুগুপ্সা থেকে বীভৎস এবং বিস্ময় থেকে অদ্ভুত রস তৈরি হয়।

'রসপুরাণ' নাটকটির জন্য প্রাচীন ভারতের দুটি মহাকাব্য 'মহাভারত' ও 'রামায়ণ' এবং অন্যান্য ধ্রুপদী নাটক থেকে আখ্যান-বস্তু চিন্থিত করা হয়েছে। এভাবে অষ্টরসের সম্মিলনে তৈরি করা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন আটটি এপিসোড। যেখানে প্রতিটি এপিসোড থেকে ভাবগত রসকে একটি অদৃশ্য সুতোয় মালা গাঁথা হয়েছে। আর দেখানো হয়েছে কীভাবে সংকটময় পরিস্থিতি থেকে সুন্দর ও নির্মল পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় মানুষের সভ্যতা।

দ্বান্দ্বিক সভ্যতার প্রধান যে লক্ষ্য সেই সুন্দর ও নির্মল জীবনের জন্য অষ্টরসের সমন্বয়ে নির্মিত 'রসপুরাণ' নাটকটি তাই সমকালীন বাংলাদেশের একটি অন্যতম ধ্রুপদী নাটকে রূপ নিয়েছে। নাটকটির চরিত্র নির্মাণ ও রূপায়নের ক্ষেত্রে সমকালীন দ্বান্দ্বিক সমাজের চিত্রই শেষপর্যন্ত দর্শকের কাছে সুস্পষ্ট হয়েছে।

নাটকটি শেষপর্যন্ত দর্শকের কাছে যেন এক প্রবাহমান মহাকালের দ্বান্দ্বিক ঘটনাপ্রবাহের অন্তরালে এক চিরসবুজ অফুরান জীবনের প্রতীক হয়ে ওঠে। যেখানে ভালোবাসা কখনো ফুরায় না। দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মৃত্যু-ক্ষৃধা, ভয়-আতংক, বীরত্ব-আনন্দ, ক্রোধ-শোক শেষে যেখানে মানুষ খুঁজে পায় কেবল অফুরান ভালোবাসা আর সুন্দর ও নির্মল এক জীবন। যে জীবনের লক্ষ্যেই পৃথিবীতে মহাকাল ধরেই এই দ্বান্দ্বিকতা।

মাত্র এক ঘন্টা ১৫ মিনিটের নাটক ‘রসপুরাণ’। অথচ দর্শক যেন এক মহাকাল ঘুরে আসেন। 'রসপুরাণ' নাটকটিতে অভিনয় করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সেমিস্টার ২০১৯ এর শিক্ষার্থীরা। নাটকটির সেট ও লাইট করেছেন ড. আহমেদুল কবির। কস্টিউম করেছেন ওয়াহীদা মল্লিক। কোরিওগ্রাফি ও আবহসংগীত করেছেন অমিত চৌধুরী।

'রসপুরাণ' নাটকটির প্রধান বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য হলো প্রতিটি এপিসোডের জন্য আলাদা আলাদা কম্পোজিশান। পারফর্মারদের সুন্দর স্টেপস এবং বডি ল্যাঙ্গুয়েজ নাটকটির মাত্রা অনেক উঁচুতে নিয়ে গেছে। মাত্র চার মাসের নিবিঢ় অনুশীলনের মাধ্যমে যে 'রসপুরাণ'-এর মত সুন্দর একটি ধ্রুপদী নাটক উপস্থাপন করা যায়, সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রমাণ করলেন।

নয়টি ছেলে ও পাঁচটি মেয়ে মোট চৌদ্দজন পারফর্মার। অথচ তাদের অভিনয় ও স্পোর্টিং কৌশল ছিল সত্যিই মুগ্ধ করার মত। দীর্ঘদিন পর মনে রাখার মত একটি মঞ্চনাটক দেখলাম। 'রসপুরাণ' নাটকটিতে অভিনয় করছেন মো. তানভীর আহম্মেদ, শাহবাজ ইশতিয়াক পূরণ, ওবায়দুর রহমান সোহান, মো. আবতাহী সাদমান ফাহিম, ফারজাদ ইফতেখার, সায়র নিয়োগী, দীপম সাহা, প্রণব রঞ্জন বালা, সুজানা জাহেদী, নিকিতা আযম, জান্নাতুল ফেরদৌস জিম, মোসা. নাসরিন সুলতানা, নাজমুল হোসেন, মো. রাফায়াতুল্লাহ, তনুশ্রী কারকুন, নীলিমা হোসেন ও হোসাইন জীবন।

২৫ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া 'রসপুরাণ' নাটকটি আগামী ৪ মে পর্যন্ত নাটমণ্ডল মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হবে। এক ঘন্টা পনেরো মিনিটের নাটক ‘রসপুরাণ’ মঞ্চস্থ হয় প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭ টায়। জয়তু 'রসপুরাণ'। জয়তু মঞ্চনাটক।

------------------------------
'রসপুরাণ' দেখার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা মে, ২০১৯ রাত ৯:১৮

মাহমুদুর রহমান বলেছেন: জানলাম।

২| ০৪ ঠা মে, ২০১৯ দুপুর ২:৪১

আলাপচারী প্রহর বলেছেন: Where is Natmondol?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.