নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

রেজা ঘটক

ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।

রেজা ঘটক › বিস্তারিত পোস্টঃ

কেন লিখি? কী লিখি?

২৬ শে জানুয়ারি, ২০২০ সকাল ৯:১৯

আমাদের আত্মীয়স্বজন ও পরিবারের মুরব্বিদের কাছে ছোটবেলা থেকেই আমি একটি বিষয়ে খুব জানার চেষ্টা করতাম, সেটি হলো- আমাদের মধ্যে কে কতদূর পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে? সবার কাছেই এই প্রশ্নের জবাবটি পেতাম খুবই হতাশাজনক। আমার দাদু ভাই'রা দুই ভাই দুই বোন। তাঁদের কেউ খুব একটা লেখাপড়া করেননি। তাঁদের দুই বোনের লেখাপড়া কেবল কোরআন খতম পর্যন্ত। এর বাইরে বাংলা পড়তে পারতেন।

আর দুই ভাইয়ের মধ্যে আমার দাদু বড়। তিনি বাংলা পড়তে পারতেন। তাঁর প্রিয় বই ছিল হযরত আমীর হামজার পুঁথি। সময় পেলেই তিনি সুর করে হযরত আমীর হামজার পুঁথি পড়তেন। দাদু'র এক বন্ধু ছিলেন মাওলানা। তিনি প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন। তাঁর সঙ্গে মহানবী'র নানান কাহিনী এবং ইসলামের নানান ঘটনা নিয়ে তাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতেন। গল্প শেষ হতো দাদু'র সুর করে পুঁতি পড়া দিয়ে। কিন্তু দাদু'র ছোট ভাই মানে আমাদের ছোট দাদু লেখাপড়া একদমই জানতেন না।

দাদু'র বাবার অনেক সম্পত্তি ছিল। সম্পত্তি বলতে অনেক জমিজমা। এসব দেখাশোনা করার জন্য যতটুকু বিদ্যাবুদ্ধিকে তাঁরা প্রয়োজনীয় মনে করতেন, ততটুকুই তাঁরা নানাভাবে অর্জন করতেন। সেখানে লেখাপড়া করার কোনো যুক্তি তাঁরা খুঁজে পাননি। তাই কাউকে স্কুলকলেজে পড়ানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। ধানচালের হিসাবটা ঠিকমত করাটাই তাঁদের কাছে ছিল প্রয়োজনীয় শিক্ষা। এর বাইরে তাঁরা কখনোই চিন্তাও করেননি।

আমার দাদু ভাই'র ছিল দুই বউ। বড় বউয়ের ছিল তিন ছেলে পাঁচ মেয়ে। আর ছোট বউয়ের ছিল এক ছেলে তিন মেয়ে। সবমিলিয়ে দাদু'র মোট চার ছেলে আট মেয়ে। আমার বাবা ছিলেন সবার বড়। দাদু ভাই দ্বিতীয় বিয়ে করার সময় আমার দাদী তাঁর তিন ছেলে আর পাঁচ মেয়ে নিয়ে আলাদা সংসার শুরু করলেন। ফলে বড় ছেলে হিসেবে আমার বাবা'র খুব একটা লেখাপড়া হয়নি। কিন্তু পড়াশুনা'র প্রতি আমার বাবা'র খুব আলাদা একটা নজর ছিল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন- ছোট ভাইবোনদের লেখাপড়া শেখাবেন।

এই প্রথম আমাদের পরিবারে কেউ লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ দেখালেন। আমার মেজো কাকাকে তিনি লেখাপড়া শেখানোর উদ্যোগ নিলেন। কারণ মেজো কাকা'র নিজেরও লেখাপড়ার প্রতি খুব আগ্রহ ছিল। মেজো কাকা'র সমবয়সীরা যখন প্রাইমারি স্কুলের পর লেখাপড়া ছেড়ে দিলেন, তখন তিনি অনেকটা একা হয়ে গেলেন। কিন্তু আমার বাবা'র জেদ চেপেছিল অন্তত পরিবারের একজনকে তিনি এমএ পাশ দেখতে চান। তাই মেজো কাকাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গেলেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করলেন। তিনিই আমাদের পরিবারে প্রথম এমএ পাশ।

কিন্তু বাবা'র অন্য ভাইবোনদের লেখাপড়া আর ঠিকমত এগেলো না। কারণ তাঁরা নিজেরাই লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ ছিলেন না। স্কুল থেকে তাঁরা পালাতেন। যে কারণে আমাদের অন্য কাকাদের কেউ আর হাইস্কুল পর্যন্ত গেলেন না। প্রাইমারি থেকেই ঝড়ে গেলেন। ফুফুদের মধ্যে কেউ কেউ হাইস্কুলে গেলেও দাদু ভাই তাঁদের ধরে ধরে বিয়ে দিয়ে দিলেন। ফলে তাঁদের কারোর আর লেখাপড়া তেমন হলো না। অর্থ্যাৎ আমার বাবা'র একার আগ্রতে অন্যদের লেখাপড়া তেমন হলো না। কারণ তাঁরা নিজেরাও লেখাপড়া খুব একটা করতে চায়নি। এতো গেলে আমার বাবা'র দিকের পড়াশোনার হিসাব।

এবার আসি আমার মায়ের দিকের হিসাবে। আমার নানা ছিলেন তাঁর বাবা-মার একমাত্র পুত্র। আর নানা'র ছিল দুই বোন। নানা'র পড়াশোনা প্রাইমারি পর্যন্ত। তাঁর দুই বোনের পড়াশোনাও ওই কোরআন খতম পর্যন্ত। যদিও আমার মায়ের দাদু মানে আমার নানার বাবা ছিলেন মৌলভী এবং তিনি নিজেই একটা পাঠশালা পরিচালনা করতেন। কিন্তু তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের খুব একটা লেখাপড়া করাননি।

আমার নানার এক ছেলে এবং ছয় মেয়ে। আমার মামাও প্রাইমারির উপরে পড়াশোনা করেননি। খালাদের কেউ কেউ হাইস্কুল পর্যন্ত গেছেন। কিন্তু কলেজে পড়ার কারো অভিজ্ঞতা নেই। আমার মা প্রাইমারি স্কুল থেকেই বিদায় নিয়েছেন। মুসলমান পরিবারে একটা সাধারণ হিসাব ছিল এরকম- মেয়েরা কোরআন খতম দিতে পারলেই তাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো। আর ছেলেদের হিসাবনিকাশটা শিখতে পারলেই আর পড়াশোনার দরকার নাই। তারপরেই তাদের বাল্য বিয়ে দিয়ে পরিবার বানিয়ে দেওয়া হতো।

ফলে মুসলিম পরিবারে অংশ হিসেবে পড়াশোনার আগ্রহটা আমার বাবা'র বা মা'র কারো পরিবারেই খুব একটা ছিল না। সেখানে আমার বাবা নিজে লেখাপড়া কম জানলেও তাঁর মধ্যে পড়াশোনার একটা তীব্র বাসনা কাজ করেছিল। যে কারণেই তিনি তাঁর একটা ভাইকে এমএ পাশ করিয়েছিলেন। আমার বাবা'র ধারণা ছিল এরকম- ভাইকে এমএ পাশ করালে তিনি তাঁর নিজের ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করানোর পাশাপাশি ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাতেও আগ্রহ দেখাবেন। কিন্তু আমার বাবা'র সেই ইচ্ছে পূরণ হয়নি। ফলে দিনেদিনে পড়াশোনার ব্যাপারে বাবা আরো কঠোর হয়ে গেলেন।

এরপর আসলো আমাদের জেনারেশন। এবার আমার বাবা লেখাপড়ার ব্যাপারে আগের তুলনায় আরো কঠোর হলেন। আমরা নয় ভাই বোন। পাঁচ ভাই চার বোন। আমার বাবা'র কড়া হুকুম ছিল যে- স্কুলে যে যাবে না, তার ভাত বন্ধ। বাবা'র এই কড়া শাসনের কারণেই আমরা নয় ভাইবোন থেকে অন্তত চারজন এমএ পাশ করতে পেরেছি। একজন বিএ পাশ, দুই জন ম্যাট্রিক ফেল, আর দুই জন হাইস্কুল পর্যন্ত লেখাপড়া করা সম্ভব হয়েছে।

কিন্তু পারিবারিকভাবে আমাদের পড়াশোনায় যতোটা আগ্রহ ছিল, সেই তুলনায় আমার কাকাদের ছেলেমেয়েরা তেমন আগ্রহ দেখায়নি। যে কারণে তাঁদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা হাইস্কুলের উপরে খুব একটা যায়নি। ফুফুদের কথা আর নাইবা বলি। তাঁদের সবার ছেলেমেয়েদের কথা বা তাদের পড়াশোনার কথা এখন আর আমার খুব একটা মনেও নাই।

কিন্তু আমার যে কাকা এমএ পাশ করলেন, তিনি বড় চাকরি করলেন। নিজেও তাঁর বাবা'র মত দুই বিয়ে করলেন। দুই সংসারে দুই ছেলে চার মেয়ে। তাদের মধ্যে মাত্র দু'জন এমএ পাশ করলেন। বাকিদের কেউ বিএ পর্যন্ত কেউ এইচএসসি পর্যন্ত গিয়ে ঠেকলেন। প্রশ্ন হলো- এই যে আমার কাকা নিজে এমএ পাশ, আমার দুই চাচী'র এক চাচীও এমএ পাশ ছিলেন। কিন্তু তাঁদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা অতোটা হলো না কেন? ছয় জনেরই তো এমএ পাশ করা উচিত ছিল। অন্তত স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখলে তেমন সমীকরণ হওয়া উচিত ছিল।

সেটি হয়নি, কারণ কাকা দুই সংসারের প্রতি সমান মনযোগী ছিলেন না। আমার বাবা'র থেকেও কাকা এই জায়গাটিতে পিছিয়ে গেলেন একটি কারণে। কারণ শুধু লেখাপড়া নিজে শিখলেই হয় না। লেখাপড়ার সেই শক্তিটাকে তিনি কাজে লাগাতে চাননি। এমনকি আমরা যারা ভাইবোনরা পড়াশোনা শেষ করে চাকরির জন্য দেশের নানান প্রান্তে ছুটেছি, আমাদের চাকরি দেবার জন্য এই কাকা কোনো ধরনের আগ্রহ দেখাননি।

অথচ আমাদের গ্রাম থেকে কেউ ম্যাট্রিক পাশ করলেই কাকার কাছে যেতেন আমার বাবা'র একটা চিঠি নিয়ে। সে অনুযায়ী তারা চাকরি পেতেন। কেউ ডিগ্রি পাশ করে বাবা'র থেকে চিঠি নিয়ে গেলেই আমার কাকা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি দিয়েছেন। আমাদের গ্রামে, আমাদের থানায় এমনকি আমাদের জেলায় অন্তত এরকম চাকরি পেয়েছেন হাজারের উপরে মানুষ। কিন্তু আমাদের নয় ভাই বোনের চাকরির ব্যাপারে আমার বাবা কোনোদিন কাকাকে চিঠি লেখেননি। আমার কাকাও কোনোদিন নিজ থেকে কারো খোঁজ নেননি।

আমার বাবা আমাকে সবসময় একটা কথা বলতেন- নিজের যোগ্যতায় যদি চাও বিক্রি করি, আমি যেন তাই করি। কারো কাছে চাকরির জন্য যেন হাত না পাতি। এই 'কারো' দিয়ে তিনি তাঁর নিজের ভাইয়ের কথা ইঙ্গিত করতেন। যে কারণে আমরা ভাইবোনরা নিজেদের যোগ্যতায় যে যে কাজ করেছি, সবটুকু নিজেদের প্রচেষ্ঠায়। কারো দয়া বা অনুগ্রহে নয়।

আমাদের দেশের চাকরির বাজারের যে সিস্টেম গড়ে উঠেছে তা হল, যোগ্যতা যা থাকুক না কেন, যার টেলিফোনের জোড় বেশি, সে চাকরি পাবে। কিন্তু আমরা ভাইবোনেরা কোনদিন সেই সুযোগ থাকা স্বত্ত্বেও কোনো কাজে লাগানোর চেষ্টা করিনি। বাবা'র কড়া নির্দেশ ছিল- নিজের ছেলেমেয়েদের জন্য কারো কাছে তিনি জীবনেও কখনো কোনো অনুরোধ করবেন না। আমরা সেই আদর্শে বড় হয়েছি। যে কারণে সুযোগ থাকার পরেও আমরা সেই সুযোগ নেইনি।

আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক ছিলেন। কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট কখনোই তোলেননি। আমরাও বাবা'র মুক্তিযুদ্ধকে পুঁজি করে দেশের কোথাও কোনো সুযোগসুবিধা গ্রহণ করিনি। ভবিষ্যতেও কিছু গ্রহণ করার ইচ্ছা নাই। কারণ আমরা বাবা'র আদর্শকে কোনোভাবেই ছোট করব না।

আমার নিজের ক্যারিয়ার কেন হয়নি? আমার নিজের কারণেই হয়নি। কারণ আমি আমার বাবা'র মত আদর্শে একচুলও কখনোই নড়চড় করিনি। এইচএসসি পাশ করার পর আমি দুইবার সেনাবাহিনী'র বিএমএ লং কোর্স থেকে আইএসএসবি করেছি। আমার কাকা'র বন্ধুদের অনেকেই তখন মেজর জেনারেল বা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ছিলেন। সেনাবাহিনীতে আমার কমিশন পেতে নিজের যোগ্যতায় হয়নি। কিন্তু আমার কাকা'র একটি মাত্র টেলিফোন-ই যথেষ্ঠ ছিল আমার কমিশন পাবার জন্য। আমার বাবা বলেছিলেন- তোর হয়নি তাতে আমার কোনো আফসোস নাই। তোর অন্য কিছু নিশ্চয়ই হবে।

আমি ইকোনোমিক্সে মাস্টার্স পাশ করার পরপরই বাবা মারা গেলেন। আমাদের পরিবারটি তখন বটবৃক্ষ হারিয়ে হঠাৎ করেই গভীর সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছি। আমার একটা ভালো চাকরি তখণ পরিবারের জন্য খুব দরকার ছিল। আমার কাকা একবারের জন্যও কোনো আগ্রহ দেখাননি। আমার বড় ভাই তখন গো-ধরলেন যে- তোমাকে বিসিএস ক্যাডার হতে হবে। আর কিছু দরকার নাই। পরিবারের চাওয়া পাওয়ার প্রতি নজর দিতেই আমি অন্য কোনো চাকরিতে না ঢুকে তিনবার বিসিএস ভাইভা পর্যন্ত গেলাম। ১৭শ', ১৮তম এবং ২০তম বিসিএস-এ আমি ভাইভা পর্যন্ত গেছি।

তিনবার বিসিএস দিয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটি খুবই মর্মান্তিক। সেখানে আবিস্কার করলাম- বিএনপি বা আওয়ামীলীগ না করলে তার বিসিএস ক্যাডার হওয়া অতোটা সহজ বিষয় নয়। তারপর পারিবারিক পরিচয় দেবার মত কেউ নাই। যার বাবা সামান্য কৃষক তাঁর সন্তান কেন বাংলাদেশে বিসিএস ক্যাডার হবে? রাষ্ট্রই এই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছে। যারা কৃষকের সন্তান, তারা সামান্য চাকর-বাকরের চাকরি করবে। বড় জোড় ব্যাংকে বা কোনো কলেজে মাস্টারি করবে। তাদের তো আমলা বানানো যাবে না।

ফলে আমরা দলীয় লেজুরবৃত্তির ঘোড়াটপে আটকে গেলাম। আমি যখন বিসিএস ভাইভা ফেস করি, তখন আমার কাকা'র একটা টেলিফোনই যথেষ্ট ছিল আমার ক্যাডার হবার জন্য। কিন্তু আমার বাবা'র আদর্শের কথা স্মরণে রেখেই কাকাকে আমরা কেউ সেই অনুরোধ করিনি। কারণ দুই সরকারের আমলেই কাকা'র বন্ধুদের অনেকেই মন্ত্রী ছিলেন। আমরা সেই সুযোগ নেইনি। আমি নেবার তো প্রশ্নই ওঠে। ফলে আমার বিসিএস না হওয়ায় আমার পরিবারের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেছে।

আমি বিসিএস-এ না হওয়ায় আর চাকরির লাইনে হাঁটিনি। বড় ভাইয়ের উৎপাতে এবং নিজেকে অযোগ্য মনে করেই আমি আমার সকল সার্টিফিকেট পুড়িয়ে ফেলেছি। প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট যেহেতু কোনো কাজে লাগেনি, তাই সেই সার্টিফিকেট আমি আর জীবনে রাখতে চাইনি। এরপর থেকেই আমি নিজের রাস্তায় হাঁটা শুরু করেছি। এবং তখন থেকেই পরিবারের সাথে আমার সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে।

এরপর আমি পনের বছর আর্থসামাজিক বিভিন্ন বিষয়ের উপর গবেষণা করেছি। বাংলাদেশের মানুষের আচরণ, অভ্যাস, রুচি-পছন্দ, ক্ষমতা, টাকার বাহাদুরি, শিক্ষা, গবেষণা, সংস্কৃতি, ধর্ম, মুক্তিযুদ্ধের অপব্যবহার, সবকিছু আমি হাড়েহাড়ে চিনেছি। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পর থেকেই আমি নিজেকে নিজের ইচ্ছার উপরে ছেড়ে দিয়েছি। যখন যা ভালো লাগে তাই করি। নিজেকে সম্পূর্ণ একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবে আমি তৈরি করেছি।

সার্টিফিকেট পোড়ানোর পর থেকেই আমি এই শক্তি অর্জন করেছি। নিজেকে সমৃদ্ধ করাটাই আমার নেশা হয়ে গেছে। পড়াশোনার নেশাটা ছোটবেলা থেকেই ছিল। সার্টিফিকেট পোড়ানোর পর সেই নেশা আরো তীব্র হয়েছে। সারা বছর গবেষণার কাজ আমি ইচ্ছে করেই করতাম না। তখন বিভিন্ন বিষয়ের উপর পড়াশোনা করে সেই বিষয়ে বই লিখতে শুরু করি। অনার্স-মাস্টার্সের বিভিন্ন বিষয়ের উপর আমি প্রচুর নোটবই লিখেছি।

একটা সময় আমি বাংলা বাজার যেতাম আর বই নিয়ে আসতাম। প্রকাশকদের নতুন বইয়ের অর্ডার করে আসতাম। নতুন লেখার অর্ডারও নিয়ে আসতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি গাইড, ব্যাংকার্স রিক্রুটমেন্ট গাইড, সেনাবাহিনী'র বিএমএ লং কোর্সে ভর্তি গাইড, বিসিএসএস প্রিলিমিনারি গাইড, বিসিএস লিখিত বিভিন্ন বিষয়ের উপর গাইড, এমন অনেক গাইড বই লিখেছি। যখন লিখতে লিখতে বিরক্তি ধরে যেত তখনই কোনো একটা গবেষণা কাজে ঢুকে পড়তাম।

সেই ফাঁকে সৃজনশীল লেখার প্রতি মনযোগী হয়ে উঠলাম। আর গাইড বই লেখায় বিরতি দিয়ে দিলাম। এমনিতে স্কুলে আমরা দেয়াল পত্রিকা বের করতাম। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নানান সাময়িকী ও ম্যাগাজিনে আমার লেখা নিয়মিত প্রকাশ পাওয়া শুরু করলো। আমার এই লেখালেখি'র নেশাটা আমার বড় ভাই একদম নিতে পারেননি। যে কারণে আমারও জেদ চেপে গেল। আমি অন্যকিছু না হতে পারি, কিন্তু লেখক হব।

যে কারণে আমার সৃজনশীল লেখালেখি'র বয়সও ত্রিশ বছরের বেশি। যে কোনো বিষয়ের উপর আমি যখন খুশি তখন লিখতে পারি। আগে আমি ঢাকা শহরের প্রায় সবগুলো লাইব্রেরিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতাম। জাতীয় গ্রন্থাগার একসময় ২৪ ঘণ্টা চালু ছিল। ২০০৬ সালের ঘটনা। তখন আমি ফিল্মের লাইনে ঝুঁকলাম। সিনেমার শ্যুটিং শেষে ফিরে শুনি, যে মেসে আমরা তখন থাকতাম, তারা বাসাটি ছেড়ে দিয়েছে। পরদিন সকালেই সবাইকে নতুন বাসায় উঠতে হবে। আমি যেহেতু অনুপস্থিত ছিলাম, তাই আমার জন্য মেসের কেউ বাসা দেখেনি।

তখন আমি জাতীয় গ্রন্থাগারে একটানা ৫৭ রাত ছিলাম। যেহেতু আমার থাকার জায়গা ছিল না, তাই আমি পাবলিক লাইব্রেরিতে রাত কাটাতাম। সকালে একটা ঘটনা ঘটতো। ফজরের আজানের সময় কোনো এক হারামজাদা লাইব্রেরিতে বেল বাজাতেন। তার অর্থ হলো, এখন সবাইকে লাইব্রেরি ত্যাগ করতে হবে। আমি জগন্নাথ হলে গিয়ে স্নান করে ফ্রেস হয়ে কাঁঠালবাগানে আসতাম। লন্ড্রি থেকে পরিস্কার জামাকাপড় নিয়ে গায়ের জামাকাপড়গুলো লন্ড্রিতে দিয়ে আমি আবার কোনো লাইব্রেরিতে চলে যেতাম।

তখন মাথার মধ্যে সিনেমা পোকা ঢুকেছে। কোথাও বন্ধুদের শ্যুটিং হলে সেখানে শ্যুটিং দেখতে চলে যেতাম। লেখাপড়ার পাশাপাশি তখন আমি সিনেমাতে বেশি বেশি জড়িয়ে গেলাম। পাবলিক লাইব্রেরিতে তিনটা চেয়ার গায়েগায়ে মিশিয়ে বই দিয়ে বালিশ বানিয়ে টান হয়ে শেষরাতের দিকে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করতাম। বেল বাজলেই উঠে যেতে হতো। বলা যায় আমাদের মত যারা তখন পাবলিক লাইব্রেরিতে ভ্যাগাবন, তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হতো।

তাড়া খেয়ে আমাদের বাইরে চলে আসতে হতো। কিছুক্ষণ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হাঁটাহাঁটি করে শেষে জগন্নাথ হলে গিয়ে ফ্রেস হয়ে দিন শুরু হতো। তখন পাবলিক লাইব্রেরিতে ৮০ থেকে সর্বোচ্চ ৯৩ জন ছিল নিয়মিত সদস্য। যারা রোজ পাবলিক লাইব্রেরিতে পড়া এবং ঘুমানোর জন্য আসতো। ৫৭তম দিনে পাবলিক লাইব্রেরি'র এই ২৪ ঘণ্টা আইনটি শিথিল করা হলো। আগের নিয়মে সকাল নয়টা টু রাত আটটা হয়ে গেল।

কোনো উপায় না দেখে আমি একদিন পান্থপথে বন্ধু রাজীব নূরের গেলাম। রাজীবদা তখন পাঠসূত্র নামে একটা প্রকাশনী শুরু করেছেন। আমি গেলাম আসলে একটু ঘুমানোর সুযোগ বের করতে। রাজীবদা যোগসূত্র নামে একটা অ্যাড ফার্ম দিয়েছেন বন্ধুরা মিলে। পাশাপাশি সৃজনশীল প্রকাশনা হিসেবে পাঠসূত্র শুরু করলেন নিজের ইচ্ছাপূরণ করতে।

রাজীবদা আমাকে একটা শর্ত দিলেন যে, রাতে আমি তার অফিসে ঘুমানোর সুযোগ পাব, যদি আমি তার নির্দেশ শতভাগ পালন করি। একটাই শর্ত সকাল ৭টা বাজার আগেই অফিস থেকে নিস্তার হতে হবে। সেদিন রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত রাজীবদা আমি আড্ডা দিলাম। রাজীবদার নতুন নতুন পরিকল্পনা শুনলাম। গ্রিনরোডের জিঞ্জিরা হোটেল রাতের খাবার খেয়ে পাঠসূত্রে ঘুমানোর জন্য গেলাম।

গিয়ে দেখি সেখানে আরো দুই কবি রাতের বেলায় ফ্লোরে বিছানা করে ঘুমায়। একজন কবি অতনু তিয়াস অন্যজন কবি শতাব্দী কাদের। রাজীবদা বলে গেলেন যে আমি যেন সকাল সাতটার মধ্যে অফিস ত্যাগ করি। কিন্তু দীর্ঘদিন পর দুই কবি বন্ধুকে পাওয়ায় সেই রাতে আমাদের ঘুম যেতেই ভোর হলো। সকালে রাজীব নূর সাড়ে আটটায় এসে আমাদের ঘুম থেকে তুললেন। আমাকে একটা কড়া ধমক দিলেন। যে আপনি প্রথম রাতেই শর্ত ভঙ্গ করেছেন। অতএব আপনি আর অফিসে ঘুমাতে পারবেন না।

আমি সারাদিন এই ঢাকার শহরে কোথায় কোথায় টইটই করলাম। রাত বারোটার দিকে গিয়ে পান্থপথে পাঠসূত্রের অফিসের নিচে গিয়ে দেখি রাজীব নূর অতনুকে ধমক দিচ্ছেন। অতনু যদি আামাকে ঘুমাতে সুযোগ দেয়, তাহলে অতনুও ঘুমানোর সুযোগ পাবে না। রাজীবদা রাগ বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলেন না। রাত সাড়ে বারোটায় আমাকে বললেন, ঠিক আছে আজকের রাতটা ঘুমান। কাল থেকে কিন্তু আপনি এদিকে আসবেন না!

পরের রাতেও আমি কোথাও ঘুমানোর সুযোগ না পেয়ে রাত একটার দিকে নিচ থেকে অতনুকে ডেকে তুললাম। অতনু গেট খুলে আমাকে ভেতরে নিল। কিন্তু বললো যে, সকালে রাজীবদা আসার আগেই যেন আমি কেটে পড়ি। কিন্তু পরদিন সকালে রাজীবদার বদলে তনুজাদি'র কাছে ধমক খেলাম।

আমি তখন দিনের বেলায় বাসা খুঁজি আর বাসা না থাকায় রাতের বেলায় ঘুরেফিরে অতনু'র কাছে যাই রাজীবদাকে ফাঁকি দিয়ে। এভাবে তিনচার দিন পাঠসূত্র অফিসে ঘুমালাম। পরে যখন আমি কাঁঠালবাগানে একটা বাসা পেলাম, তখন আমার থাকার জায়গার সমাধান হলো। এখানে একটা কথা একটু বলি- এর আগে ২০০১ সালে আমরা বন্ধুরা যখন কাঁঠালবাগানে থাকি, তখন স্বয়ং রাজীব নূরও আমাদের সাথেই থাকতেন। রাজীবদা বিয়ে করেই ফেমিলি বাসায় উঠেছেন। তার আগপর্যন্ত আমরা এক বাসাতেই ছিলাম।

তখন ১৯ কাঁঠালবাগানে আমরা একসাথে থাকতাম- গল্পকার রাজীব নূর, গল্পকার খোকন কায়সার, গল্পকার রোকন রহমান, সুদত্ত চৌধুরী পবন, পুলক বিশ্বাস, রিয়াজ হক, দেবতোষ তালুকদার মণি, রেজাউল কবীর মাহমুদ নাছিম আর আমি। ঢাকায় আমাদের বন্ধুদের প্রায় সবারই তখন রোজ ১৯ কাঁঠালবাগানে দেখা হতো, আড্ডা হতো। সে গল্প অন্য কোনো সময়ে করা যাবে।

একদিন বন্ধু রাজীব নূর আমাকে ডেকে নিয়ে আরেক কবি বন্ধু শাহেদ কায়েসের পান্থপথের অফিস দেখাতে নিয়ে গেলেন। শাহেদের অফিস দেখার পর আমরা পাঠসূত্রে গেলাম। রাজীবদা প্রস্তাব দিলেন- রেজা আপনি পাঠসূত্রে জয়েন করেন। কোনো বেতন পাবেন না। আমরা বন্ধুরা মিলে প্রকাশনাটি দাঁড় করাব। আপনি যেহেতু লেখালেখি করতে চান। পাঠসূত্র থেকে আপনার বইও নিয়মিত প্রকাশ পাবে। তিনবেলা খাবার অফিসে খাবেন। আর আপনার বাসা ভাড়াটি আমি মাস শেষে দেবার চেষ্টা করব। প্রকাশনাটি দাঁড়ালে আপনার নিয়মিত বেতন ধরা হবে!

আমরা যোগসূত্র থেকে আয় করে পাঠসূত্র গড়ে তুলব। আমরা বাংলাদেশে একটি অন্যরকম আদর্শ প্রকাশনা গড়ে তুলব। আমি রাজীবদার কথায় রাজী হয়ে গেলাম। পাঠসূত্রে কাজ শুরু করলাম। প্রথম বছর আমরা বন্ধুদের কয়েকটি বই দিয়ে শুরু করলাম। আহমাদ মোস্তফা কামাল, আলফ্রেড খোকন, নজরুল কবীর, মুজিব মেহদী, আহমেদ স্বপন মাহমুদ, মানস চৌধুরী, দেবব্রত মুখোপাধ্যায়, মোস্তফা মামুন, জাকির তালুকদার অনেকের বই প্রকাশ পেল। পরের বছর আমার প্রথম গল্প সংকলন 'বুনো বলেশ্বরী' প্রকাশ পেল।

যেহেতু আমি নিজেই প্রকাশনার দেখাশোনা করি, তাই আমার বইটি প্রকাশ পেলো ২৮ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে আট টায়। বইমেলার শেষ দিন। আমার বন্ধুদের কেউ বইমেলার মাঠে আমার বইটির খবর জানতে পারেনি। তারা রাত এগারোটায় পান্থপথে চায়ের আড্ডায় আমার বই প্রকাশের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন। বন্ধু আবদুল্লাহ জুবেরী আমার বইয়ে আমার লেখক পরিচিতি লিখলো- জন্ম ২১ এপ্রিল ১৯৭০ (৮ বৈশাখ ১৩৭৭ বঙ্গাব্দ), শৈশব ও দূরন্ত কৈশোর কেটেছে গ্রামে, যৌবনের শুরু মফস্বল শহরে তারপর থেকে রাজধানী ঢাকায়। পেশায় বাউন্ডেলে!

২০০৮ সালে পাঠসূত্র প্রথম অমর একুশে গ্রন্থমেলায় স্টল পেল সিঙ্গেল ইউনিট। পরের বছর ২০০৯ সালে আমরা পেলাম দুই ইউনিট। ২০১০ সালে আমরা পেলাম তিন ইউনিট। পাঠসূত্রকে তখন বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিকরা একনামে চিনতে শুরু করলো। যোগসূত্র অ্যাড ফার্ম দিয়ে আমরা তখন টাকা রোজগার করি আর নিজেদের পছন্দ মত প্রকাশনা করি পাঠসূত্র ব্যানারে। ২০১০ সালের বইমেলা শেষে আমি বন্ধু টোকন ঠাকুরের সাথে একটা সিরিয়াল বানাতে শ্যুটিং করতে যাই ঝিনাইদহে।

ঢাকায় ফেরার পর রাজীবদার সাথে সম্পর্ক একটা টানাপোড়নে গিয়ে ঠেকলো। হয় আমাদের বন্ধুত্ব রক্ষা করতে হয় নতুবা পাঠসূত্র ছাড়তে হয়। আমি বন্ধুত্ব রক্ষা করার জন্যই খুশি মনে পাঠসূত্র ছেড়ে দিলাম। আমি চলে আসার পর তনুজাদি কয়েক বছর পাঠসূত্র চালানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু একসময় পাঠসূত্র বন্ধ হয়ে গেল। রাজীবদা যোগসূত্র বন্ধ করে দিয়ে আবার সংবাদপত্রে ফিরে গেলেন।

পাঠসূত্র থেকে বের হবার পর থেকেই প্রতি বছর আমার বই প্রকাশ পায়। এ পর্যন্ত মোট এগারোটি প্রকাশনা থেকে আমার ১৬টি বই প্রকাশ পেয়েছে। ২০১৭ সালে অমর একুশে বইমেলা শেষেই আমি 'হরিবোল' চলচ্চিত্রটি বানানোর কাজে হাত দিলাম। দীর্ঘ তিন বছর সীমাহীন পরিশ্রম করে 'হরিবোল' চলচ্চিত্রটির নির্মাণ কাজ শেষ করি ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে।

সেন্সর বোর্ডের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাগজপত্র তৈরি করতে লেগে গেল এক মাসেরও বেশি সময়। ১০ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে আমি সেন্সর বোর্ডে 'হরিবোল' চলচ্চিত্রটি জমা দেই। বিএফডিসি'র ছাড়পত্রের অযুহাত দেখিয়ে সেই রাষ্ট্রই এখনো আমার সিনেমা সেন্সর বোর্ডে আটকে রেখেছে।

জীবনে আমি কখনোই নিজের আদর্শ ছেড়ে কারো কাছে মাথানত করিনি। বাকি জীবনেও করার ইচ্ছে নাই। আদর্শ বিচ্যুত হয়ে দুই নাম্বারি করলে বহু আগেই টাকা-গাড়ি-বাড়ি সবকিছু বাংলাদেশেই বানাতে পারতাম। বাংলাদেশে পড়াশোনা মানে মাস্টার্স পাশ শেষে একটা চাকরি ধরার পর পড়াশোনার আনুষ্ঠানিক ইতি ঘটানো। আমি ঠিক তার উল্টো। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে, বিসিএস-এর পেছনে জীবনের মূল্যবান পাঁচটি বছর নষ্ট করে তারপর আরো বেশি পড়াশোনায় মনযোগী হয়েছি।

না পড়লে আমি ঘুমাতে পারি না। না লিখতে পারলে আমি অসুস্থ হয়ে যাই। লেখালেখি আর সিনেমাই এখন ধ্যানজ্ঞান। পারিবারিকভাবে যেহেতু আমাদের পড়াশোনাটা কঠোর অনুশীলনের মধ্যে হয়েছে। তাই সেই অভ্যাস আর ছাড়িনি। একাডেমিক পড়াশোনায় ফাঁকিবাজি করলেও সেই সময়ে আমি হয়তো বিশ্বের বড় বড় লেখকদের বই পড়ে কাটিয়েছি। লেখালেখিটা একদিনেই হুট করেই করতে আসিনি।

হাতের কব্জির জোর আছে বলেই লেখালেখিটা করি। লেখালেখি করতে এসে দেখেছি, অনেকেই সস্তা জনপ্রিয়তা পাবার জন্য হেন পুরস্কার নাই যার পেছনে না ছোটে। এই বদঅভ্যাসে আমার কোনো আগ্রহ নাই। ২০০৭ সাল পর্যন্ত দৈনিকের সাময়িকী পাতায় নিয়মিত লিখতাম। লেখালেখিতে জীবন কাটাবো বলেই দৈনিকের সাময়িকী সম্পাদকদের কাছে মাথা বিক্রি করিনি। কারো কাছ থেকে অন্যায় সুযোগসুবিধা নেবারও চেষ্টা করিনি।

অতএব সেন্সর বোর্ডের তথাকথিত বিএফডিসি'র ছাড়পত্রের নামে চাঁদাবাজির কাছে খুব সহজেই নত হওয়ার মত পাত্র আমি নই। আদর্শ ছেড়ে দিলে জীবনে বহু আগেই প্রতিষ্ঠা পেতে পারতাম। প্রতিষ্ঠার জন্য আমি এখনো খুব একটা চেষ্টা করি না। কিন্তু যতদিন বেঁচে আছি, নিজের যা ভালো লাগবে তাই করব। এই রাষ্ট্রের এপিঠ ওপিঠ সব আমার দেখা আছে।

এই রাষ্ট্রের মিডিয়ার তেলেসমাতিও আমার জানা আছে। সংগ্রাম করতে জানি, লড়াই বহাল থাকবে। কিন্তু কোনো অন্যায় সুযোগসুবিধা আমি গ্রহণ করে আমার সিনেমাকে কলুষিত করতে চাই না। 'হরিবোল' আমার ফার্স্ট চাইল্ড। তাকে আদর্শের সাথে লড়াই করেই ভূমিষ্ঠ করব। কারো কাছে আমি জীবনেও মাথা বিক্রি করি নাই। বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে নিজেকে আরো কঠোর করেছি। পদে পদে বাধা পেয়ে নিজেকে আরো নতুন করে গড়ে তুলেছি।

রেজা ঘটক ভাঙবে তবু মচকাবে না। শিড়দাঁড়া টান করেই আমার হাঁটার স্বভাব। মুখের উপর সত্য প্রকাশ করাটাই আমার স্বভাব। রাষ্ট্র হোক, মিডিয়া হোক, মন্ত্রী হোক, আমলা হোক, এমন কোনো বিষয় নাই যা নিয়ে আমি কখনোই সোচ্চার হইনি। সুবিধা নেবার জন্য কোনো বিষয়ে চুপ মেরে থাকার যে প্রাকটিস আমার প্রগতীশীল বন্ধুরাও সচরাচর করে, সেই কাজটি আমি পছন্দ করি না। নিজেও করি না। পেছনে কথা বলা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। যা বলি, সত্যটা মুখের উপর বলি।

আমি খুব স্বাধীন জীবনযাপন করি। কারো কাছে মাথা বিক্রি করে জীবনে একদিনও বাঁচতে চাই না। অতএব কোনো সুবিধা নেবার জন্য দয়া করে কেউ পরামর্শ দিতে আসবেন না। আমি নিজেই আপনাদের অনেকের চেয়ে অনেক বিষয়েই দক্ষ। আমি যা যা করতে চাই, সেসব কাজে আপনার দুর্বল পরামর্শের আমার একদম প্রয়োজন নাই। খনিশ্রমিকদের মত নিজে কঠোর পরিশ্রম করতে জানি। আমি যখন যা ভালো লাগবে তাই করব।

আপনি হয়তো বলবেন দিনশেষে আমি একজন ব্যর্থ মানুষ। কিন্তু আমি আমার কৃষক বাবার পুত্র। কৃষকের সন্তান হয়ে আমি খুব গর্ববোধ করি। অন্তত এই রাষ্ট্রে কেউ গালি দিয়েও বলতে পারবে না যে তুই অসৎ টাকায় চলিস! বুকটান করে হাঁটি এখনো। যে কয়দিন বাঁচব এভাবেই বাঁচব। আদর্শ থেকে আমাকে টলানো যাবে না। আমি পৃথিবীতে আমার কাজটুকুই করতে এসেছি। আপনাদের পেছনে বহু বহু হাজার হাজার ঘণ্টা ব্যয় করে দেখেছি, দিনশেষে আপনারা সবাই পলটিবাজ।

ফেব্রুয়ারি মাস অমর একুশে বইমেলায় হৈ চৈ আনন্দ করে কাটাবো। নো চিন্তা ডু স্ফূর্তি। মার্চ মাসে নতুন উদ্দামে কাজ শুরু করব। নতুন সিনেমার এখন স্ক্রিপ্ট লিখছি। সিনেমার জন্য প্রয়োজনীয় মানুষগুলোকে আমি যথাসময়ে ডাকব। আবার যুদ্ধ হবে। সিনেমা মানেই যুদ্ধ। আর একজন যোদ্ধার কাজে হল সবসময় যুদ্ধফিল্ডে থাকা। যুদ্ধে হেরে যাবার জন্য জন্ম হয় নাই। যুদ্ধ ছেড়ে দিয়ে ফিল্ড থেকে পলায়ন করারও কোনো ইচ্ছা নাই।

ফেব্রুয়ারি মাসে নতুন করে শপথ নিয়ে শক্তি সঞ্চার করে নতুন ভাবেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ব। কলমের শক্তি এই রাষ্ট্রের প্রচলিত আইন-অনিয়ম ব্যাভিচারের চেয়ে অনেক বেশি। অতএব মাথা নত নয় শিড়দাঁড়া উঁচু করেই হাঁটব। বন্ধুরা দেখা হবে যুদ্ধের ময়দানে। জীবন পুড়িয়ে যে যুদ্ধ করে যাচ্ছি, এই যুদ্ধ এক অনিশেষ যুদ্ধ। মাঝখান থেকে ওয়ারফিল্ড থেকে পেছনে যাবার কোনো সুযোগ নাই।

জীবন পুড়িয়ে আমি খড় বানাই। সেই খড়ের কালিতে আমি লিখি। প্রতিটা শব্দই এক একটা ব্রহ্মাস্ত্র। সেই ব্রহ্মাস্ত্র নিয়েই আমি পথ চলি। কারো দয়ায় নয়, একদম নিজের ইচ্ছামত স্বাধীনভাবে চলি। পিতৃমাতৃকুলের লেখাপড়ার প্রতি অনিহা থেকেই পড়াশোনার প্রতি আমি গভীর আগ্রহবোধ করি। স্ট্যাডি, স্ট্যাডি অ্যান্ড স্ট্যাডি এটা আমার জীবনীশক্তির একটা উপায়। পড়া, লেখা আর সিনেমা বানানো আপাতত এই নিয়েই আমি থাকতে চাই।

---------------------
রেজা ঘটক
২৬ জানুয়ারি ২০২০

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে জানুয়ারি, ২০২০ সকাল ৯:৩৪

রাজীব নুর বলেছেন: খুবই চমৎকার ভাবে আপনার জীবন চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।
আপনার বাবা চাকরী নিয়ে যা বলেছেন ভালোই বলেছেন।
আপনি একজন অভিজ্ঞ মানুষ। আপনি একজন কমরেড।

২| ২৬ শে জানুয়ারি, ২০২০ সকাল ১০:২৩

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: জীবন মানেই সংগ্রাম। আপনার সংগ্রামী জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আপনার সৃজনশীল জীবন সৃজনশীলতায় ভরে উঠুক। আপনার সেনাবাহিনীর কমিশন ও বিসিএস না পাওয়ার ব্যর্থতাই সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে সফলতা এনে দিচ্ছে। এগিয়ে যান।

একটা কথা, সেনাবাহিনীর কমিশন পাওয়ার জন্য কোনো টেলিফোনই কাজ করে না। ওখানে শুধু নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করা লাগে।

আপনার 'হরিবোল' সিনেমার মেকিং দেখে আমি খুব ইম্প্রেসড। চমৎকার কাজ হয়েছে।

৩| ২৬ শে জানুয়ারি, ২০২০ সকাল ১০:৪০

রানার ব্লগ বলেছেন: এগিয়ে যান !!! চলার পথে বাধা আসবেই, কিন্তু দিন শেষে আপনি বিজয়ী !!!

৪| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০২০ রাত ১১:৩৯

আলাপচারী প্রহর বলেছেন: আপনাকে ভালো লাগলো।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.