নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...

রেজা ঘটক

ছোটগল্প লিখি। গান শুনি। মুভি দেখি। ঘুরে বেড়াই। আর সময় পেলে সিলেকটিভ বই পড়ি।

রেজা ঘটক › বিস্তারিত পোস্টঃ

মৃত্যু থেকে পালিয়ে আসা কবিতা!!

১২ ই মার্চ, ২০২০ ভোর ৪:৪৭

সমকালীন মঙ্গোলিয়ান কবিদের মধ্যে হাদা সেন্দো সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি। হাদা সেন্দো মঙ্গোলিয়াকে হৃদয়ে ধারণ করে প্রাণের শক্তি দিয়ে কবিতা লেখেন। সেই কবিতা বোঝার জন্য আমাদের মঙ্গোলিয়ান ভাষা জানার প্রয়োজন নাই। হাদা সেন্দোর কবিতা পড়তে পড়তে পাঠক নিজেই মঙ্গোলিয়া দেখতে পাবেন।

মঙ্গোলিয়ান আবেগী গীতিকবি হাদা সেন্দো'র একগুচ্ছ কবিতা অনুবাদ করেছেন তরুণ অনুবাদক ও লেখক অনন্ত উজ্জ্বল। বইয়ের নাম দিয়েছেন 'চাঁদের আলোয় যাযাবর গান'। বইটি প্রকাশ করেছে স্বদেশ শৈলী। বইটি পাওয়া যাবে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বাতিঘর-এ। বইটিতে মোট ৪৮টি কবিতা রয়েছে। কবিতাগুলোর নাম খুব সুন্দর। কবিতার নামগুলো পরপর পড়লে একটা মঙ্গোলিয়ান টেস্ট চলে আসবে।

দ্য গোবি, চিঠি, বাতাস, তৃণভূমির রাত, ধ্বংসস্তূপ, একটি দুঃখ, আমার বাড়ি নেই এটা সত্য না, আমার পথ, আমাদের সময়, পৃথিবী মা, বনের মধ্যে, ঘুমানোর জন্য বিছানা, আগুন, পৃথিবীর জন্য কবিতা, আমার পিতা ও লাল চাঁদ, শূন্যস্থান, হ্যাঙ্গাই, শিকড়, সম্ভবত আমার মৃত্যু আনন্দের হবে অন্যের মৃত্যুতে, মঙ্গোলিয়ান ঘর, ১৯৯১, ঘোড়া ও কবিতা, সাদা হরিণ ও নীল নেকড়ে, সূর্যমুখী ফুল আর আমি, রক্ত পড়েছে বরফের উপর, জোরো মরি, তুষার, পূর্ণিমা, পৃথিবীর কোনা, তীর্থযাত্রী, ছোট্ট হলুদ ফুল, জিয়া উপাসের উপর চাঁদের আলো, পৃথিবী ও আমি, নীরবতা, তামির নদী, উলানবাটোরের তুষার, ভালোবাসার গান, বিষন্ন গান, জীবনের উপহার, ১৯৬৭, নির্বাক রঙ, ঈগল, কারাকরুম, পৃথিবী ভগ্নহৃদয়, ঘুমহীন রাত, যাযাবর, তৃণভূমির শিকড় থেকে এবং যাযাবর মন।

কিছু কিছু কবিতার নিচে অনুবাদক অনন্ত উজ্জ্বল ছোট একটা নোট দিয়েছেন। কবিতায় কোনো দুরুহ বিষয় বা ভাব বুঝতে পাঠকের যাতে সুবিধা হয়, সেজন্য এই নোট। কোথাও কোথাও কোন প্রসঙ্গে বা কার প্রতি কবি হাদা সেন্দো এই কবিতা নিবেদন করেছেন, সেটি এই ছোট্ট নোটে পাঠক খুব সহজেই বুঝতে পারবেন। অনন্ত উজ্জ্বল সহজ-সরল ভাষায় হাদা সেন্দো'র কবিতার একটি ধারণা দেবার চেষ্টা করেছেন। যা যে কোনো পাঠকের ভালো লাগবে। ভাষা প্রয়োগে অনন্ত উজ্জ্বল সহজ-সরল রূপটি গ্রহণ করেছেন। যা মঙ্গোলিয়ান কবিতা বুঝতে পাঠকের জন্য কাজটি আরো সহজ হবে।

যদিও কবিতার মাতৃভাষার যে রূপ-রস-সৌন্দর্য, সেই টেস্ট অন্য ভাষায় রূপান্তর করাটা প্রায় অসম্ভব। কারণ কবিতা অন্য কোনো ভাষায় অনুবাদ করা যায় না। কবিতা হলো মাতৃভাষায় রচিত শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সুধা, যা অন্য বিদেশি ভাষায় অনুবাদ করার চেষ্টা বৃথা বরং এক ধরনের ধারণা দেওয়া যায় বটে। তবুও মঙ্গোলিয়ান কবি হাদা সেন্দো'র কবিতার যে সহজ-সরল রূপ তরুণ অনুবাদক অনন্ত উজ্জ্বল করেছেন, তা প্রশংসা করার যোগ্য।

কী নেই হাদা সেন্দো'র কবিতায়? মঙ্গোলিয়ান সমভূমি অথবা বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে দ্রুত গতিতে ধেয়ে আসা বাতাস, গোবি মরুভূমির রুক্ষতা, যাযাবরদের ঘরবাড়ি, জীবনযাপন, ঘোড়া বা ইয়াক। এই অঞ্চলের মানুষে মানুষে সম্পর্ক, রীতিনীতি, ব্যক্তিগত দুঃখ-বিরহ ও অনুভূতি প্রকাশের ভঙ্গি, স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য, মঙ্গোলিয়ার বিচিত্র ভূ-প্রকৃতি ও প্রাণি বৈচিত্র্য, ঘুঘরো পোকা থেকে কোকিল, নানান প্রজাতির প্রজাপতি থেকে মৌমাছি, ঈগল থেকে কাঠবিড়ালী, ভেড়া থেকে ঘোড়া, ইয়াক থেকে অন্যান্য গবাদি পশু, সাদা হরিণ থেকে নীল নেকড়ে, সবকিছু যেন একটি সমষ্টি বিন্দুতে এসে মিশেছে হাদা সেন্দো'র কবিতায়।

হাদা সেন্দো'র কবিতায় রয়েছে মঙ্গোলিয়ান প্রাকৃতিক ভূ-দৃশ্যের নান্দনিক সৌন্দর্য থেকে মানুষ ও আদি মঙ্গোলিয়ান সংস্কৃতির ঐতিহ্যের এব সুবিশাল সমাহার। হাদা সেন্দো'র ছোট ছোট কবিতাগুলো একদিকে যেমন মৌলিকতার দিক থেকে শ্রেষ্ঠ, অন্যদিকে তেমনি প্রাকৃতিক শক্তি ও সৌন্দর্যে অবারিত। বাতাস, নদী, হ্রদ, চাঁদ, তারা, আলো-অন্ধকার, ঋতু পরিবর্তন সবকিছুই যেন সেন্দো'র কবিতায় তারার মত জ্বলজ্বল করে ওঠে।

মঙ্গোলিয়ার ভূ-দৃশ্যের যে স্বভাবসুলভ রঙের পরিবর্তন, মেঘের পরে মেঘ, নানা বর্ণের মেঘ, অন্তহীন নীল আকাশ, শিশির থেকে তুষারপাত, তৃণভূমি, বনভূমি বা সমতল ভূমিতে সূর্যমুখী ফুলের যে বিশাল সমারোহ ও নান্দনিক সৌন্দর্য, বিস্তীর্ণ সবুজ তৃণভূমি থেকে স্তপ অঞ্চল বা গোবি মরুভূমি'র যে বৈচিত্র্য, সবকিছুই অত্যন্ত সাবলীল কাব্যের ভাষা হয়ে ধরা দেয় হাদা সেন্দো'র কবিতায়।

হাদা সেন্দো'র কবিতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি কবিতায় প্রচুর মিথ ব্যবহার করেন। সেই মিথের সাথে তিনি স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ভালোবাসায় রূপান্তরিত করেন কবিতায়। যেখানে তিনি মানবিক উষ্ণতা মিশ্রিত ভালোবাসা আর সরল প্রকাশভঙ্গিতে মঙ্গোলিয়ার উন্নত প্রতীকগুলোকে সামষ্টিক করে তোলেন। যেমন-

''তুমি যদি জানতে চাও আমি কোথা থেকে এসেছি
বলবো- আমি এসেছি আকাশ থেকে
নদী আর ঘন বন থেকে
আমি এসেছি বিস্তীর্ণ তৃণভূমি থেকে।''

রাশিয়ান লিরিক্যাল পোয়েট আলেকজন্দ্রভিচ ইয়েসচিনিন, মেক্সিকান কবি অক্টোভিও পাজ এবং সিরিয়ান কবি আদুনিস দ্বারা হাদা সেন্দো কবিতায় নানাভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। হাদা সেন্দো'র কবিতায় কিছু কিছু শব্দ এমন এক হৃদস্পন্দন তৈরি করে, যা অনেক পাঠকের জীবনে সম্ভবত পূর্বে কখনো তেমনটি ঘটেনি। একজন মানুষ তাঁর দেশকে যে কতটা ভালোবাসতে পারেন, দুঃখ-বিরহের সেই কাব্যিক অনুভূতিগুলো আপনি না পড়লে ঠিক বুঝতে পারবেন না।

হাদা সেন্দো'র কবিতা পাঠের সময় পাঠক একে একে আবিস্কার করবেন স্তেপের বিস্তীর্ণ তৃর্ণভূমি থেকে গোবি মরুভূমি'র বিশাল অঞ্চল, যাযাবর জীবনের নানান কিসিমের গল্প-কাহিনী, সেখানের রাতের আকাশে চাঁদের সঙ্গে খেলা করা অগণিত তারা, তারাভরা আকাশের নীচে চাঁদ-তারার আলতো আলোর মত ঝলমলে জীবন। তবুও হাদা সেন্দো'র কবিমনকে গভীরভাবে যা আঘাত করে তা হলো মঙ্গোলিয়ান সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মৃত্যু। তাঁর কবিতায় সেই আক্ষেপ একে একে ধরা পরে।

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কবি রিচার্ড বেরেন গ্রারটেন হাদা সেন্দো'র কবিতা সম্পর্কে লিখেছেন- ''আমি তাঁর কবিতা মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কবিতা। আমি তাঁর কবিতার শ্বাস-প্রশ্বাসের দর্শন আবিস্কার করতে পেরে খুবই আনন্দিত। বিষয় হিসেবে বাতাস (বায়ু, নিঃশ্বাস, আত্মা) খুবই গভীর একটা বিষয়। 'Come Back to Earth Ges The Wind' কবিতাটি মঙ্গোলিয়ান বিশাল অঞ্চল সম্পর্কে আমার ধারণা পরিস্কার করেছে। এই কবিতাগুলোকে আমি 'সর্বজনীন কবিতা' হিসেবে বিবেচনা করি। আমার বিশ্বাস হাদা সেন্দো একজন 'সার্বজনীন কবি'। কবিতাগুলো পড়ে আমি দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়েছি মঙ্গোলিয়ানদের হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির জন্য। তাঁর কবিতা আমাকে কিছু সিনেমার কথা মনে করিয়ে দেয়। যেমন 'The Cave of The Yellow Dog' এবং 'Story of the Weeping Came'। এই সিনেমা দুটিতে মঙ্গোলিয়ান যাযাবর জীবনের বিশাল সংস্কৃতির বর্ণাঢ্য চিত্র ও তথ্য রয়েছে।''

জার্মান লেখক রাইনার ওয়েডলার হাদা সেন্দো'র কবিতা নিয়ে বলেছেন- '' মঙ্গোলিয়া্ন কবি হাদা সেন্দো কবিতাসাহিত্যে অল্প পরিচিত ভূগোলকে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে উপস্থাপন করেছেন।'' এছাড়া জার্মান শিল্প-সমালোচক আনড্রেস ইউল্যান্ড বলেছেন- ''হাদা সেন্দো'র কবিতা তাঁর জীবন, প্রকৃতি, বিশাল মরু-পাহাড়ি অঞ্চল, সবুজ তৃণভূমি অঞ্চল ও মঙ্গোলিয়ার মনোরম বাতাসকে প্রতিনিধিত্ব করে। আমি সেই প্রকৃতি ও বাতাসের ছন্দ শোনার চেষ্টা করি হাদা সেন্দো'র কবিতায়। আমি প্রতিটি লাইনের কাব্যিক গুরুত্ব বিবেচনা করে পাঠ করি। কবিতার লাইনগুলো পাঠ করতে করতে আমার মনে হয় এই কবিতাগুলো 'কোনো মৃত্যু থেকে পালিয়ে আসা কবিতা' অথবা 'অনেক বেশি আনন্দিত হয়ে মৃত্যুর জন্য উন্মুখ কবিতা'। যেভাবেই বলি না কেন, এগুলোর সবই হাদা সেন্দো'র কবিতায় বারবার জন্মকেই ইঙ্গিত করে। সেন্দো'র কবিতা আমার হৃদয়কে স্পর্শ করে এবং জাগ্রত করে শক্তিশালী চিন্তা, গভীর আবেগ ও ভাবাবেগপূর্ণ চিত্রকল্প। আমি হাদা সেন্দোকে সংবেদনশীল এবং বাস্তববাদী কবি হিসেবে বিবেচনা করি।''

হাদা সেন্দো ১৯৬১ সালের ২৪ অক্টোবর মঙ্গোলিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। মঙ্গোলিয়ান ও চাইনিজ ভাষায় লেখাপড়া শুরু করলেও তিনি স্কুলের লেখাপড়ায় অনীহা দেখিয়ে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত স্তেপ তৃণভূমি অঞ্চলে যাযাবর জীবন কাটান। পরবর্তী সময়ে বাবার পরামর্শে তিনি আর্ট ইনস্টিটিউটে চাকরি নেন। তিনি মূলত মঙ্গোলিয়ান লোকগান ও ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করেন। পৃথিবীর প্রায় ৪০টি ভাষায় হাদা সেন্দো'র কবিতা অনূদিত হয়েছে।

-----------------
হাদা সেন্দো'র কবিতা 'চাঁদের আলোয় যাযাবর গান'।। ভাষান্তর: অনন্ত উজ্জ্বল।। প্রকাশক: স্বদেশ শৈলী।। প্রচ্ছদ: মামুন হোসাইন।। বাংলাদেশ পরিবেশক: বাতিঘর।। মূল্য: ২০০ টাকা। পৃষ্ঠা: ৬৪।। আইএসবিএন: ৯৭৮-৯৮৪-৩৪-৯০৭২-৮

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই মার্চ, ২০২০ সকাল ৮:২৩

নেওয়াজ আলি বলেছেন: অশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি।

২| ১২ ই মার্চ, ২০২০ সকাল ৯:০৮

রাজীব নুর বলেছেন: জানলাম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.