নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রেজওয়ান

রোদ বৃষ্টি কাব্য

মানুষ তার স্বপ্নের চেয়েও বড়_ আমি বিশ্বাস করি।

রোদ বৃষ্টি কাব্য › বিস্তারিত পোস্টঃ

একজন নিত্যানন্দ বাবু এবং একটি ফাঁসির রায়

০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:০৪

ঠিস ঠিস, ঠিস ঠিস, ঠিস ঠিস.......প্রমীলা দেবীর ঘুমন্ত কানে একেবারে গরম সুঁই এর মত যেন আওয়াজটা ডুকে যাচ্ছে । ৭১ এ সংগ্রামের পর দেশে ফেরার পথে ভারতীয় বর্ডার থেকে গোটা পঞ্চাশ টাকা দিয়ে কেনা সিলিং ফ্যান আজ অবধি শোবার ঘরে গর্বের সাথে ঘ্যাড় ঘ্যাড় শব্দ করে চলছে । সেই ঘ্যাড় ঘ্যাড় সিলিং ফ্যানের শব্দকে ছাপিয়ে ঠিস ঠিস, ঠিস ঠিস টাইপ মেশিনের আওয়াজে এত রাতে কে কার জাত উদ্ধার করছে? প্রমীলা দেবী হাতড়াচ্ছেন চৌকিতে, কিন্তু তার স্বামী নিত্যানন্দ বাবু তার পাশে নেই। না এভাবে আর ঘুমানো যায়না। এই বয়সে সারা দিন ধোপীর কাজ করে রাতের বেলা একটু না ঘুমোতে পারলে প্রমীলা দেবী কাল সকালে আবার এলাকার সব মানুষের ময়লা কাপড় ধুবেন কিভাবে। আর নিত্যানন্দ'র তো কোন কাজই নেই। সারাদিন হাইকোর্টে ঘুরে ঘুরে চা বেচা, আর রাতে বাড়ি ফিরে বৌ প্রমীলা দেবীকে বলা, "জানোস নিতাইয়ের মা, আইজ্জাতো দেইল্যা রাজাকার রে দেইখা আইলাম হাইকোর্টে। এইবার দিবো ঝুলাইয়া, কই যাইবি চান্দু?" এসব কথা ভাবতে ভাবতে আর রাগে ফেটে পরে প্রমীলা দেবী চৌকি থেকে উঠলেন। শাড়ির আচলটা বুকে জড়িয়ে চুল গুলো খোপা বাঁধতে বাঁধতে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলেন, "অওও নিতাইয়ের বাপ রাইত দুফুরে কি শুরু করলা?" নিত্যানন্দ বাবু তার চোখ গুলো মোটা ফ্রেমের চশমায় আড়াল করতে চান। প্রমীলা দেবীর এতদিকে খেয়াল নেই, ঘুমে চোখ নিভে আসছে তার। কও কি কইবা, এহন উইঠ্যা আইসো ক্যা? আমি আইতাসি তুমি যাও। নিত্যানন্দ বাবুর শ্বাসনালী কেউ যেন চেপে ধরেছে তার কথা বলার ধরন শুনলেই বুঝা যায়। কিন্তু প্রমীলা দেবী ঘুমে কাতর হয়ে যাওয়ায় সেদিকে লক্ষ্য না করেই চলে যান শোবার ঘরে। ৬০ ওয়াটের ফিলিপস লাইটের নিচ থেকে প্রমীলা দেবীর ছায়া সরে যায়। ক্ষানিক বিরতি দিয়ে নিত্যানন্দ বাবু তার মান্ধাতা আমলের টাইপ মেশিনে আবার টাইপিং শুরু করেন ঠিস ঠিস.....ঠিস ঠিস......ঠিস ঠিস........

নিত্যানন্দ বাবু হাইকোর্টের বাইরে ফুটপাথে আগে টাইপ মেশিন নিয়ে বসতেন। বসতেন আজ থেকে বছর পনেরো আগে। তখন শহর তলীর মানুষ, গ্রাম গঞ্জের মানুষ, সব মানুষই টাইপ মেশিনের দ্বারস্থ হতো। কারো জমির দলিল, কারো সরকারী দরখাস্ত, কারো কাবিন নামা, কারো বা বিবাহ বিচ্ছেদ নামা। হঠাৎ একদিন শুনলেন টাইপমেশিনের যুগ শেষ, বাজারে এসেছে কম্পিউটার। দেখতে অনেকটা বাক্সের মত। অনেক টাকা দাম। নিত্যানন্দ বাবু বিশ্বাস করতেন নিজেকে, কম্ফুটার বম্ফুটার এইসব দিয়া লাভ নাই, টাইপ মেশিনই সেরা। নিত্যানন্দ বাবু বুঝে উঠতে পারেননি যে তিনি মূলত পৃথিবী থেকে অনেক অনেক দূর পিছিয়ে আছেন। ব্যাস, একটা সময় লোকে টাইপ মেশিন ছেড়ে কম্পিউটার কম্পোজের প্রতি ঝুঁকল। নিত্যানন্দ বাবু ছেড়ে দিলেন টাইপ রাইটিং এর কাজ, কিন্তু ছাড়লেন না হাইকোর্ট। হেটে হেটে চা বিক্রি করেন হাইকোর্ট চত্বরে আর মানুষ দেখেন, দেইল্যা রাজাকার, রসু খা, বাবর, আরো কত কত মানুষ।

কিন্তু এত রাতে নিত্যানন্দ বাবু কি টাইপ করছেন আর হঠাৎ করে কেনই বা টাইপ মেশিন নিয়ে বসলেন। এসবের কোন উত্তরই নিত্যানন্দ বাবুর কাছে নেই। তবে আজ জদি টাইপ মেশিনের আওয়াজে প্রমীলা দেবীর ঘুম না আসে তাহলে নিত্যানন্দ বাবুর কিছুই করার নেই। আজ যে করেই হোক নিত্যানন্দ বাবুকে টাইপ করতে হবে। ফাঁসির রায় টাইপ করতে হবে আজ রাতের মধ্যেই। আজকে নিত্যানন্দ বাবু হাইকোর্টে শুনে এসেছেন দু একদিনের মধ্যেই রায় ঘোষণা হবে রাজাকার মীর কাসেমের। নামটা নিত্যানন্দ বাবুর বেশ পরিচিত। ৭১ এ নিত্যানন্দ বাবুর আর প্রমীলা দেবীর নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে। যৌথ পরিবারে তাদের বসবাস ছিল চট্টগ্রামের হাজারী গলিতে। কিন্তু হঠাৎ ই একদিন রাজাকার মীর কাসেমের আল বদর বাহিনী হানা দেয় হাজারী গলিতে। পুড়িয়ে ছাড়কাড় করে মানুষের দোকান পাট, নির্দ্বিধায় মারে নিরীহ মানুষদের। সে বীভৎসতা নিত্যানন্দ ভূলতে পারেনা, মা বাবা, মাসতুতো ভাই বোন, পিশি-পেশো সবাই মরেছিল সেদিন। বেঁচে যায় নিত্যানন্দ, প্রমীলা দেবী আর তার ভাই বোন। নিত্যানন্দ কি করে ভুলবে কাসেম রাজাকারের চেহারা। দু একদিনের মধ্যেই রায় দিয়ে দিবে মীর কাসেমের। কিন্তু কোনখানের কোন বিচারক! হেয় আমার কষ্ট বুঝবো কোনথিকা? বাপ মরসে আমার, মায় মরসে আমার, ফাঁসির রায় তো দিমু আমি। হেইতে কি দিব?

নিত্যানন্দ বাবুর মোটা ফ্রেমের চশমা ঘোলাটে হয়ে যায় চোখের জল আর ঘামে। গেঞ্জির কোনা দিয়ে চশমার গ্লাসটা মুছে নিয়ে নিত্যানন্দ বাবু টাইপ করতে থাকেন ঠিস ঠিস....ঠিস ঠিস....ঠিস ঠিস......নিত্যানন্দ বাবু রাত জেগে মীর কাসেমের ফাঁসির রায় লিখতে থাকেন, এ রায় লিখার অধিকার কেবল নিত্যানন্দ বাবুরই আছে, আদালত পাড়ার কোন সাহেব বাবুর নেই। হাজারী গলির বেঁচে যাওয়া একমাত্র হিন্দু পরিবার নিত্যানন্দ বাবুই মীর কাসেমের ফাঁসির রায় লিখতে পারেন, পৃথিবীর আর কেউ নয়। আজ রাতেই তার রায় লিখা শেষ করতে হবে, কাল যদি বিচারক সাহেব রায় দিয়ে দেন তবে? আর সে রায়ে যদি ফাঁসি ছাড়া অন্য শাস্তির কথা থাকে তবে? নিত্যানন্দ বাবু মুখের ঘাম গুলো কাধে ঘষে নিয়ে ফাঁসির রায় টাইপ করতে থাকেন। টাইপ মেশিনের ঠিস ঠিস....ঠিস টিস.....ঠিস ঠিস.... আওয়াজ পৌছে যায় দূরের কবরস্থানে, শশান ঘাটে, পরিত্যক্ত বদ্ধভূমিতে।


রেজওয়ান
৩০/৮/২০১৬
রাতঃ ১২.১৫

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.