নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যা-ই লিখি, কাঠবিড়ালীর মত এখানে জমিয়ে রাখি। https://rimsabrina.blogspot.com/
আনত যীশুর শহরে ১
২
নানান ব্যস্ততায় সেলেকা মেয়েটাকে ভুলে গেলাম খুব সহজেই।
তারপর এক বিকেল। কাজের পাট চুকিয়ে বাড়ির পথ ধরেছি। বৃষ্টিভেজা দিন। কাদাপানিতে রাস্তা সয়লাব। গামবুট ঠুকে দ্রুত হাঁটছি। ছাতা নেই সাথে। ট্রেন স্টেশনটা আমাদের হাসপাতাল ক্যাম্পাসের সাথেই লাগোয়া। তবুও ভিজে ভূত হওয়া ঠেকানো যাবে না আজকে। কি জ্বালা।
হঠাৎ ছপ্ ছপ্ শব্দে পাশে তাকাতে হল। এই আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টির ভেতর খালি পায়ে আওয়াজ তুলে হাঁটছে কেউ। মহিলার বয়স পঁয়তাল্লিশের ধারে কাছে। নম্বর লেখা হাতের প্লাস্টিক আর্মব্যান্ডটা বলে দেয় সে এই রেখস্ট ডের ইজার হাসপাতালেরই রোগী হবে। আপাদমস্তক পলক বুলিয়ে আরো আঁতকে উঠতে হল। তার বাম চোখটা ফুলে ছোটখাট টেনিস বল। তীব্র আঘাতে গাঢ় বেগুনি রং নিয়েছে। পাতা বুজে গেছে। বেঢপভাবে ফুলে ওঠা চোখটা এই বুঝি কোটর ঠেলে বেরিয়ে ঠকাশ্ কারো মাথা ফাটিয়ে শোধ নেবে এক চোট।
মুহূর্তের জন্যে ভ্রান্তিতে পড়ে গেলাম। পাশ কাটিয়ে চলে যাবো নাকি থেমে গিয়ে জানতে চাইবো সাহায্য লাগবে কি না -এই দোলাচলে দুলছি যখন, তখন মহিলা নিজেই এসে পথ আগলে দাঁড়ালো। ঝুম বৃষ্টি তার চুল চুঁইয়ে আধবোজা চোখ গড়িয়ে নামছে। পড়নের জামাটাও ভিজে সপ্ সপে। কালো ফুটকি দেয়া হাসপাতাল গাউন হাঁটু আঁকড়ে আছে। যেন সাধ্য থাকলে এই পালিয়ে যাওয়া রোগীকে সে রুখে দিত।
‘ওডিয়নপ্লাতজ যাবো কিভাবে বলতে পারো?’। এই জার্মান দেশে অচেনা লোককে ‘আপনি’ বলাই ধর্ম। অবশ্য ধর্ম বজায় রাখার মত অবস্থা নেই তার। মাথার ভেতর হিসাব কষছি। ওডিয়নসপ্লাৎজ তো আমিও যাচ্ছি। সেখান থেকে ট্রেন বদল। কিন্তু পথের হদিস বলা কি ঠিক হবে? নাকি ভুলিয়ে ভালিয়ে আবার হাসপাতালে নিয়ে যাবো। মনের তরফ থেকে হ্যাঁ-না কোনো সদুত্তরই মিলছে না। যান্ত্রিক জীবনে বিবেকের দরজায় কড়া নাড়বার ফুরসৎ মেলে না। তাই খুব প্রয়োজনেও সে ঘুমিয়ে বেহুঁশ।
‘এই চোখ নিয়ে যাবেন কি করে? চলুন আপনাকে ইমার্জেন্সিতে পৌঁছে দিচ্ছি‘। দু’কদম দূরে লাল হরফে ‘নোটফাল যেন্ট্রুম’ মানে ‘জরুরী বিভাগ’ লেখা ব্যানারটা দেখিয়ে প্রস্তাব দিলাম।
প্রস্তাব টশকে উড়িয়ে মহিলা টলোমলো পায়ে তাল সামলাতে সামলাতে বললো, ‘আমার সাথে ওডিয়নসপ্লাৎজ যেতে পারবে? কিছু দেখতে পাচ্ছি না ভাল করে’।
-‘ট্রিটমেন্ট না করালে পরে কিন্তু আরো খারাপ হবে‘।
-‘ধুর্, বললাম তো নোটফাল থেকেই আসছি!’।
-‘ইনফেকশন হয়ে গেলে কিন্তু চিরকালের মত চোখ হারাবেন’।
-‘বলছি না, আমাকে যেতে হবে। এত কথা ভাল্লাগছে না, যত্তসব...’। গাউনের পকেট থেকে কাঁপা হাতে এক গোছ চাবি বের করে কথাগুলো বললো সে।
বুঝলাম বোঝাতে যাওয়া বাতুলতা। ঠিকানায় পৌঁছানো তার কাছে জরুরী বিভাগে ফিরে যাবার থেকেও জরুরী। বেশি কথা বলতে গেলে যদি হাতের চাবিটা বেগতিক ছুড়ে মারে। কথা আর না বাড়িয়ে, বৃষ্টি-কাদায় মাখামাখি হয়ে চললাম তার সাথে। উদ্দেশ্য, ঠিক ট্রেনে তুলে দেয়া। কিন্তু তুলে দেয়া পর্যন্তই। যাত্রা সঙ্গী হবার ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই।
কথাটা সত্য না। উপায় আছে। আসলে ইচ্ছে নেই। ফেরারী রোগীর সঙ্গী হয়ে নিজের অবস্থা সঙ্গীন হবার আশংকা আছে। রোগী ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি-টাইপ ঝামেলায় পড়তে পারি। কিংবা, সন্ধ্যার খবরের হেডলাইনও বনে যেতে পারি, ‘মিউনিখে জার্মান নারী সন্ত্রাসী হামলার শিকার। হামলাকারী প্রবাসী এবং মুসলিম। তাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে...ইত্যাদি ইত্যাদি’।
তার চেয়েও বড় কথা। সেলেকার বয়সী একটা ছেলে আছে। তাকে সময়মতো কিন্ডারগার্টেন থেকে তুলতে হবে। বেগুনি চোখ ভদ্রমহিলার সাথে জড়িয়ে ভেজালে পড়লে তাকে নিতে আসার কেউ থাকবে না।
ট্রেন এসে গেছে প্ল্যাটফর্ম কাঁপিয়ে। ঘটাং মোচড়ে হাতল ঘুরিয়ে লোকজন নামছে।
-‘উঠে পড়ুন। দুই সামনের স্টেশনের পরেরটাই ওডিয়নসপ্লাৎজ। আর সাবধানে যাবেন প্লিজ‘।
-তুমি আসবে না সাথে? আমি একলা যাবো?’।
এমন সরল আকুতির বিপরীতে ভাষা খুঁজে পেলাম না। ঢোঁক গিলে স্বার্থপরের মত নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম।
বেজায় ফোলা চোখটা নিয়ে খালি পায়ে ভেজা পোশাকে ট্রেন ধরলো অচেনা মানুষটা। তার চারপাশের লোকজনের চোখে তার অদ্ভূত উপস্থিতি এতটুকু ধরা পড়লো না। মুঠোফোনের থাবায় বন্দী তারা। সময় নেই ডান-বামের। দড়াম্ জোরে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আহত দৃষ্টিতে কাঁচের ওপাশ থেকে তাকিয়ে থাকলো ভদ্রমহিলা।
ট্রেন চলে গেলে শূন্যচোখে স্টেশনের ঘড়িটার দিকে চাইলাম। আর দু’মিনিট পরেই আবার ওডিয়নসপ্লাৎজের ট্রেন। নাহ্, মহিলাকে এড়ানোও গেছে। আবার ফিরতেও পারবো সময়মতো। তবু সব কিছু ছাপিয়ে খালি মনে হতে লাগলো, কি ঘটনা ঘটেছিল তার সাথে। কেনই বা অমন তাড়াহুড়ো করে হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়ে গেল সে? তাও আবার অমন ভীষন ফুলে ওঠা চোখ নিয়ে। চিকিৎসার পরোয়া না করেই।
কোনো জবাবই যে মেলার নয়। ফোঁশ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরের ট্রেনে চাপলাম। সামনে আর কোন বিচিত্র লোকের সাথে দেখা হবে কে জানে। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে হবে। একে একে ওরা সামনে এসে দাঁড়াবে। তারপর তাদের গল্পটা না বলেই চলে যাবে। আর মিছেমিছি ভাবিয়ে যাবে। (ক্রমশ)
২১ শে ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ২:৫০
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: জি, এমন সব সুখের দেশেও লোকে দুঃখ পায়-এটা বড় ভাবায়।
২| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২১ দুপুর ২:৪৮
মিরোরডডল বলেছেন:
জীবন থেকে নেয়া এরকম লেখাগুলো পড়তে ভালো লাগে রিমাপু ।
কিংবা, সন্ধ্যার খবরের হেডলাইনও বনে যেতে পারি, ‘মিউনিখে জার্মান নারী সন্ত্রাসী হামলার শিকার। হামলাকারী প্রবাসী এবং মুসলিম। তাকে গ্রেপ্তার ক্রে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে...ইত্যাদি ইত্যাদি’।
২১ শে ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ২:৫১
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: আপনাকে দুইবার করে ধন্যবাদ। এক মন্তব্যের জন্যে। দুই, আলগোছে বানান ভুল দেখিয়ে দেবার কারনে।
৩| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২১ বিকাল ৩:১৪
রাজীব নুর বলেছেন: খুব সুন্দর।
২১ শে ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ২:৫১
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: রাজীব ভাই, আপনি আমার লেখা পড়লে আনন্দ পাই।
৪| ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ১২:৪০
ইসিয়াক বলেছেন: বেশ! চলুক তবে জীবনের গল্প। পড়তে ভালো লাগছে।
শুভ কামনা রইলো।
২১ শে ডিসেম্বর, ২০২১ রাত ২:৫২
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: ইসিয়াক ভাই, আপনাকেও ধন্যবাদ। সাথে থাকবার জন্যে।
৫| ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ বিকাল ৩:৩৬
জাদিদ বলেছেন: 'তুমি যাবে না আমার সাথে' লাইনটার মাঝে অনেক কথা লুকিয়ে আছে!! পড়তে ভালো লাগছে।
০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ বিকাল ৩:৫২
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: জাদিদ ভাই তী তুফান মেলের গতিতে পড়েন দেখা যায়।
ভদ্রমহিলার সাথে যাই নি বলে অপরাধবোধ কাজ করেছে। কিন্তু উপায় ছিল না সে মুহূর্তে।
৬| ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ বিকাল ৪:৩৩
জাদিদ বলেছেন: হা হা হা। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে!!!
৭| ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ বিকাল ৫:৫৫
বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: মাঝে মাঝে জীবন চলার পথে এমন কত গল্প আসে যার শেষটা না জেনে আমরা,এড়িয়ে যাই, এগিয়ে যাই। তারপরেও মনের গহীনে একটা আকাঙ্ক্ষা কাজ করে যায় সেই ঘটনার শেষটা জানার জন্য।
২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ৩:১৬
রিম সাবরিনা জাহান সরকার বলেছেন: একদম সঠিক। এ কথাগুলোই খুঁজছিলাম। কিন্তু মাথায় আসে নি।
©somewhere in net ltd.
১| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২১ সকাল ১০:১৫
মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন:
বেদনাদায়ক ঘটনা।